১৯ মে ২০২৪, ০৫ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলকদ ১৪৪৫
`


মুসলিমদের বিচারে যদুনাথ সরকারের বিকার

ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার (১৮৭০-১৯৫৮)। - ছবি : সংগৃহীত

উপমহাদেশের ইতিহাস প্রাচীন। বহু জাতি ও জনগোষ্ঠীর প্রাণের বিনিয়োগে এই ইতিহাসের চলমানতা নিশ্চিত হয়। এখানকার জনজীবনের যে চিত্র ও চরিত্র, এর মধ্যে বহু সহস্রাব্দের রক্ত, স্বভাব ও মেজাজ আপন হস্তাক্ষর খোদাই করে রেখেছে। যুগ-যুগান্তরের এই বিরতিহীন প্রবাহ অতিক্রান্ত কালখণ্ডের পলিমাটি সাথে নিয়েই সামনের দিকে অগ্রসর হয়েছে। উপমহাদেশীয় জীবন পরিক্রমায় ভূমিপুত্র ও বহিরাগতের যৌথতা যে মোহনা তৈরি করেছে, তার মধ্যেই হয়েছে বহুমাত্রিক ঐতিহ্য ও মনোস্বভাবের চাষাবাদ। এখানে গড়ে ওঠা সিন্ধু সভ্যতা সমৃদ্ধ অতীতের এমন স্বাক্ষর, স্যার জন মার্শালের মতে, যার গৌরবময় সময় খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৫০ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৫০ অব্দ। আইভার রিজসার বিচারে এর উদ্ভব ঘটে খ্রিষ্টপূর্ব ৩৬০০ অব্দে। স্যার মার্টিমার হুইলার এর সূচনা নির্দেশ করেন খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০০ অব্দে। সমৃদ্ধ এই সভ্যতা ছিল দ্রাবিড়ভাষী মানুষের সৃষ্টিকর্ম। যদিও সুমেরিয়, পছনি, অসুর, ব্রাত্য, বাহীক, দাস, নাগ, ব্রাহুই জাতির আত্মনিয়োগের স্বাক্ষর রয়েছে সিন্ধু সভ্যতায়। বস্তুত বহু জাতির মিলিত সাধনার ফসল ছিল সিন্ধু সভ্যতা।

অন্যান্য কারণ সক্রিয় থাকলেও প্রধানত বহিরাগত আর্যদের আক্রমণ সিন্ধু সভ্যতাকে ধ্বংস করেছে। আর্যদের উপাসনা, বাহন, জীবনব্যবস্থা, মৃতদের সাথে আচরণ ইত্যাদি ছিল সিন্ধু সভ্যতার বিপরীত। তারা লিঙ্গপূজাকে ঘৃণা করত, সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরা পূজা করত লিঙ্গের। আর্যরা ছিল যাযাবর, তাদের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় পশু ছিল ঘোড়া, কিন্তু সিন্ধু সভ্যতায় কোনো ঘোড়ার কঙ্কাল পাওয়া যায়নি, তাদের সবচেয়ে দরকারি পশু ষাঁড়। সিন্ধুর অধিবাসীরা গড়েছে শহর, কিন্তু যাযাবর আর্যদের শহর গড়ার ঐতিহ্য নয়, কেবল ধ্বংসের ইতিহাস। মৃতদেহ তারা আগুনে পোড়াত, কিন্তু সিন্ধু সভ্যতায় পাওয়া গেছে বহু কবরস্থান। লাশ দাফনের ঐতিহ্য এখানে। সিন্ধু সভ্যতার মানুষ লেখাপড়া জানত। কিন্তু আর্যরা তা জানত না। তারা যখন এখানে এলো, প্রথম দিকে জানত না কৃষিকাজও। স্থানীয়রা বহু শতাব্দী ধরে প্রধানত কৃষির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করত। আক্রমণকারী আর্যরা যখন উপমহাদেশে আসে, মূলত বর্বরতা তাদের সঙ্গী। বৈদিক সাহিত্য জন্ম দিতে তারা সক্ষম হয় এখানে আসার পরে। এখানকার সভ্যতার প্রভাবকে অধিগ্রহণের পরে।

আর্যরা প্রাচীন সভ্যতাকে সংহার করলেও এর থেকে আহরণ করেছে প্রাণরস, শিক্ষা। এর মহার্ঘ্য দান গ্রহণ করে নিজেদের সমৃদ্ধি নিশ্চিত করেছে। কিন্তু স্থানীয় জনসঙ্ঘের সভ্যতা-সংস্কৃতির মহিমা স্বীকার করেনি। নিজেদের বিশ্বাস, সংস্কৃতি, ভাষা ও দৃষ্টিভঙ্গি সবার ওপর চাপিয়ে দেয়ার বিরতিহীন চেষ্টায় নিমগ্ন থেকেছে আর্য মানস। এখানকার জনজীবনের প্রাণ ও ব্যক্তিত্ব তারা লাঞ্ছিত করেছে প্রতিনিয়ত। সহস্রাব্দের আধিপত্য প্রয়াসের ধারায় উপমহাদেশে আর্যপ্রতিপত্তি একটা বাস্তবতা হয়ে উঠল। যা উপমহাদেশীয় জনজীবনের দেহে ও চিত্তের আর্যদের প্রভাব সুনিশ্চয় করে তুলল। সে নিজেকে প্রকৃত ভারতীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতা হিসেবে দাবি করতে লাগল।

কিন্তু সেই প্রভাব কোনোভাবেই একমাত্র ভারতীয়ত্ব নয়, একমাত্র স্থানীয়তা নয়। প্রকৃত ভারতীয়ত্ব, প্রকৃত স্থানীয়তা আর্যদের আগমনেরও হাজার বছর আগে থেকে এখানে চর্চিত, বিকশিত ও উদযাপিত হয়ে এসেছে। যা প্রধানত দ্রাবিড় ঐতিহ্যজাত হলেও এতে ভেড্ডিড, নেগ্রিটো, অস্ট্রিক, মোঙ্গলীয়, এসিরিয়, সুমেরিয়, নর্ডিক ইত্যাদি নরগোষ্ঠীর সমবেত অংশীদারত্ব রয়েছে।

মুসলিম বিজয়ের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশের ইতিহাসে আসে নতুন যুগ। এই যুগে দু-একটি আরব ব্যতিক্রম ছাড়া বিজয়ী শাসকরা উপমহাদেশের সীমান্তলগ্ন পারস্য ও আফগান থেকে আসেন, কিন্তু এখানকার মুসলিম জনগোষ্ঠী প্রধানত এখানকার বাসিন্দা, যারা নবীযুগ থেকে ইসলামের সাথে ব্যবসায়ী, প্রচারক ও সাধকদের মাধ্যমে পরিচিত হচ্ছিল। ১১৯২ খ্রিষ্টাব্দে ভারতবর্ষে স্থায়ীভাবে মুসলিম শাসনের সূচনা হলেও আনুমানিক ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দের আগেই মাদ্রাজের তালিমনাড়ু প্রদেশের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল মালাবারের হিন্দু রাজা চেরুমান পেরমলের ইসলাম গ্রহণের ঐতিহাসিক বিবরণ রয়েছে। তারপর অব্যাহতভাবে এখানকার অধিবাসীরা ইসলামে দীক্ষিত হয়েছেন এবং উল্লেখযোগ্য হারে জনপদসমূহে ইসলাম লাভ করেছে স্থায়ী অধিষ্ঠান। ইসলাম কোনো শাসকদের মাধ্যমে এখানে প্রচারিত বা নির্দেশিত হয়নি।

ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার (১৮৭০-১৯৫৮) মুসলিম যুগের প্রকৃতি নির্দেশ করেছেন বিক্ষোভের সুরে। ইসলাম ইন ইন্ডিয়া গ্রন্থে তিনি মুসলমানদের দেখিয়েছেন বিদেশী ও বিধর্মী জাতি হিসেবে। ফল অব দ্য মুঘল এম্পায়ার, শিবাজি অ্যান্ড হিজ টাইমস, হিস্টোরি অব আওরঙ্গজেব ইত্যাদি গ্রন্থে একই দৃষ্টিভঙ্গির প্রচার করেছেন তিনি। হিন্দু সমাজ তার কাছে ‘একটা সার্বজনীন মিলনের ও একত্রীকরণের প্রকাণ্ড যন্ত্র’। বিদেশ থেকে আগত প্রথা ও পূজাকে সে নিজস্ব করে নেয়। খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০ অব্দে গ্রিক বীর হেলিওডোরস ভারতে আসেন রাজা আন্টালকিদসের দূত হয়ে। কিন্তু রাস্তায় তিনি মালবের বেসনগর শহরে অনায়াসে হিন্দু হয়েছিলেন। এমন ঘটনা আরো আছে। যদুনাথের ভাষায়-
‘মুসলমানদের পূর্বে অনেক বিদেশী বিধর্মী জাতি আসিয়া ভারতে বসতি করে- যেমন গ্রিক, সিথীয় (শক), পার্থীয়, মোঙ্গোলীয়। কিন্তু তাহাদের বংশ দুই তিন পুরুষ পরেই হিন্দুসমাজে সম্পূর্ণভাবে মিশিয়া যায়, হিন্দু নাম, হিন্দু ভাষা, বেশভূষা, ধর্ম ও চিন্তা অবলম্বন করে।’

‘কিন্তু মুসলমান বিজয়ের পর এইরূপ মিলন ও একত্রীকরণ বন্ধ হইল। হিন্দুধর্ম ইসলামকে নিজস্ব করিয়া, মুসলমান জাতিগুলিকে হজম করিয়া ভারতবর্ষের অঙ্গীভূত করিতে পারিল না।’ ‘মুসলমানেরা কোনোমতে ইসলামের মূলমন্ত্র ছাড়িয়া হিন্দুধর্মের সহিত আপস করিলেন না।’

চেষ্টা অবশ্য হিন্দুরা করেছেন। তারা আল্লোপনিষৎ লিখেছেন, বাদশা আকবরকে অবতার বলে পূজা করেছেন, প্রয়োজনে আরবের দেবদূতকে রামানুজ-শঙ্কর প্রভৃতির ভাই বলে কবুল করতে রাজি ছিলেন। কিন্তু সব নষ্টের গোড়া ‘ইসলামের একেশ্বরবাদ’। আল্লাহর সাথে আর কাউকে শরিক করলে ‘তিনি রাগ করেন ভীষণ’।
এর ফলে কী ঘটল? যদুনাথের ভাষায়- ‘অতএব, হিন্দু ও মুসলমান (পরে হিন্দু ও খ্রিষ্টান) একই দেশে শত শত বর্ষ বাস করিয়াও সমাজে জীবনে এক হইতে পারে নাই।’ যদুনাথ এর পরে করেছেন গুরুতর অভিযোগ। সেটি হলো- ‘ভারতীয় মুসলমানদের হৃদয়ের দ্বার ভারতের দিকে বন্ধ, ভারতের বাহিরের দিকে খোলা।’ এর প্রমাণও হাজির করেছেন তিনি। ‘এখনো তারা নামাজে মক্কার কাবার দিকে মুখ ফেরান’, তাদের ‘চিন্তার, আইন-কানুনের, শাসন-পদ্ধতির, প্রিয় সাহিত্যের আদর্শ ভারতের বাহির হইতে আসে’, ‘স্থানীয়দের ধর্মের ভাষা, শকাব্দ, সাহিত্য, শিক্ষক, সাধুপুরুষ এবং তীর্থ সমস্ত জগৎ ব্যাপিয়া এক, এসব ভারতের বাহিরের বস্তু।’
যদুনাথের কাছে ভারতীয় হবার মানে কি তবে হিন্দু হওয়া, হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করা কিংবা তার বিশ্বাস ও সংস্কৃতির আদলে নিজেদের পুনর্গঠন করা? ‘হিন্দু নাম, হিন্দু ভাষা, হিন্দু বেশভূষা, ধর্ম ও চিন্তা’ অবলম্বনের মধ্য দিয়ে ‘ভারতবর্ষের অঙ্গীভূত’ হতে পারে যে কেউ! হিন্দুসমাজও এ জন্য আপস করবে। কিন্তু মুসলমানরা কোনো মতে সেই আপস করলেন না। যদুনাথের এই বয়ান আর্যদের ধর্ম, সংস্কৃতিকে ভারতীয় হওয়ার মানদণ্ড স্থির করেছে। অথচ এটি কেবল অ্যারিয়ান সুপ্রিমেসির দাবি। যার সাথে জড়িয়ে আছে ভীষণরকম বর্ণবাদী ও একচ্ছত্রতাবাদী মানসিকতা। বস্তুত আর্যরা বহিরাগত এবং বিশ্বাসে ও জীবনে তাদের অনুগামী হওয়ার সাথে হিন্দু হওয়ার সম্পর্ক আছে বটে, ভারতীয় হওয়ার নয়। হিন্দু না হয়েও ভারতীয় হওয়ার ঐতিহ্য হিন্দু ধর্মের চেয়েও প্রাচীন।

যদুনাথের বিশ্লেষণ হিন্দুত্বে বিলীন না হওয়ার জন্য মুসলিমদের প্রতি ক্ষোভে ও বিবমিষায় ফেনায়িত। তার হিন্দু জাতীয়তাবাদ মুসলিমদের ধর্মাচারের বিলুপ্তি কি কামনা করছে? মুসলিমরা ধর্মের আদেশে কিবলার দিকে নামাজ আদায় করেন, এটিও তার বিচারে ভারতীয় হতে না পারার লক্ষণ। যে অবধি তারা নিজেদের ধর্মের নির্দেশিত বিধানসমূহ ত্যাগ না করছে, যদুনাথের জাতীয়তাবাদ তাদেরকে বিদেশী হিসেবে দেখছে। ব্রিটিশদের কাছে নাইটহুড উপাধিপ্রাপ্ত এই ইতিহাসবিদ আবার ব্রিটিশদের বহুত্ব, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য স্বীকারের বৈশিষ্ট্য ও পশ্চিমা রেনেসাঁর ভাবাদর্শের বিপুল প্রশংসা করেছেন। কিন্তু এখানে তিনি চাইছেন মুসলিমরা ভারতীয় হতে চাইলে বিশ্বাস ও সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য পরিহার করুক।

এ জন্য ভারতের মুসলিমদের হৃদয় ভারতের দিকে বন্ধ, বাইরের দিকে খোলা তত্ত্ব তিনি সামনে আনেন। তার এই প্রকল্প দাঁড়িয়েছে কতগুলো ভুল অনুমানের ওপর। প্রথমত, নামাজে মক্কার দিকে মুখ ফেরানোকে ধরা হয়েছে ভারতের প্রতি উপেক্ষা। কিন্তু মুসলমানরা মক্কার দিকে মুখ ফেরান ধর্মের আদেশে। আরবের প্রতি ভক্তির কারণে নয়। এমনকি মক্কার ভ‚মির প্রতিও সম্মান প্রদর্শনের জন্য নয়। কেউ যদি মনে করেন মক্কার বা কিবলার ইবাদত করছেন, তাহলে তিনি শিরকে লিপ্ত হবেন।

ভারত-ভূমির প্রতি মমতা ও আকর্ষণের জন্য মুসলিমদের সামনে রয়েছে ধর্মীয় অনুপ্রেরণা। এর রয়েছে নানা দিক। ১. প্রত্যেকের মাতৃভূমির প্রতি মমত্ব ও দায়িত্বশীলতার শিক্ষা মহানবী সা:-এর জীবনাদর্শ থেকে সুস্পষ্ট। ২. ভারতীয় উপমহাদেশে হজরত আদম আ:-এর আগমনের বিবরণ রয়েছে। মুসলমানদের কাছে এটা প্রথম নবী ও প্রথম মানুষের ভূমি। যার মাধ্যমে ইসলামের সূচনা। ইসলামের পূর্ণত্ব অর্জিত হয় হজরত মুহাম্মদ সা:-এর মাধ্যমে। ৩. সাহাবাযুগ থেকে উপমহাদেশীয় ভূমিতে ইসলামের মহান মনীষীদের এত বিপুল সমাবেশ ঘটেছে, যার ফলে এর প্রতি আবেগ ও অনুরাগ মুসলিম মনের স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তি। ৪. বিভিন্ন হাদিসে উপমহাদেশীয় প্রসঙ্গের উল্লেখ হয়েছে গুরুত্ব, মহিমা ও বহুবিধ তাৎপর্যের সাথে। ৫. উপমহাদেশীয় ভূ-ভাগের প্রতি মুসলিম মনের আকর্ষণ ইসলামের নিজস্ব ঐতিহ্য থেকেই জন্ম নিয়েছে। এর ফলে ইসলামের বিচারে উপমহাদেশের গুরুত্ব বয়ান করে তৈরি হয়েছে বহু সাহিত্য। যা প্রাচীনকাল থেকে প্রমাণ করছে ভারতীয় মুসলিমদের মন ভারতের জন্য সর্বদাই উন্মুক্ত।

যদুনাথের আরেকটি ভুল অনুমান হলো মুসলমানদের ‘চিন্তার, আইন-কানুনের, শাসন-পদ্ধতির, প্রিয় সাহিত্যের আদর্শ ভারতের বাহির হইতে আসে’। গুরুতর সাধারণীকরণ। মুসলিম বিশ্বাসের সাথে অপরিচয় কিংবা উদ্দেশ্যমূলক প্রোপাগান্ডার প্রয়োজনে এমন বক্তব্য জন্ম নিতে পারে। ইসলামের জীবনাদর্শের মূল সূত্র হলো ওহি। সেই ওহি নিজেকে কোনো বিশেষ দেশ বা জাতির নিজস্ব জিনিস বলে কখনো দাবি করেনি। বরং কুরআন হচ্ছে সমগ্র মানবজাতির জন্য আগত হেদায়েত। এটি যতটা আরবদের, ততটাই পার্সিয়ানদের, ততটাই নিগ্রোদের কিংবা ভারতীয়দের। হাদিসের ব্যাপারটিও তাই। ফলে যদুনাথ সরকারের ভাষ্য মূলত ইসলামী জীবনের এসব উৎস যা নয়, তাকে তা হিসেবে দাবি করছে। মুসলিমদের চিন্তা, আইন, শাসনপদ্ধতির আরো নানা উৎস রয়েছে। যেমন ইজমা বা সর্বজনীন বিশেষজ্ঞ ঐকমত্য। তা ভারতীয় বা মধ্য এশীয় বা আফ্রিকান বিশেষজ্ঞ আলেমদের গুরুত্বকে অন্য কারো তুলনায় লঘু করে না। কিয়াস বা যুক্তিপ্রক্রিয়ার ব্যাপারটিও এমনই। উরফ বা সামাজিক প্রথা হচ্ছে আরেকটি ভিত্তি। ভারতীয় মুসলিমরা স্থানীয় উরফ বা রীতি ও প্রথাকে গ্রহণ করেছেন ইসলামেরই শিক্ষার ফলে। উরফের মাধ্যমে ইসলাম উপমহাদেশীয় যা কিছু তার বিশ্বাস ও বিধানকে বিব্রত করে না, সে সবকে জায়গা দিয়েছে। আরেকটি ভিত্তি হলো অবস্থা ও পরিস্থিতির বিবেচনা, যাকে বলে ইস্তেসহাবুল হাল। এর পাশাপাশি সূ²যুক্তি বা ইস্তেহসান, ক্ষতিকর বিষয় থেকে প্রতিরক্ষাবিধি বা সদ্দুযজারায়ে ইত্যাদি ভিত্তি থেকে ইসলামী চিন্তা, আইন, শাসনপদ্ধতি জন্ম লাভ করে। যার মধ্যে স্থান-কাল-পাত্রের বাস্তবতা ও বৈচিত্র্যকে সচেতনভাবে বিবেচনা করে বিধি প্রণয়ন করা হয়। এর ফলে উপমহাদেশীয় মুসলিমরা স্থানীয়তাকে সবসময় গুরুত্ব দিয়েছেন, এর জন্য খোলা রেখেছেন নিজেদের মন ও জীবনের দরোজা।

যদুনাথের দুঃখজনক এক বিকার হলো, তিনি দাবি করেছেন মুসলিমদের প্রিয় সাহিত্য ভারতের বাইরে থেকে আসে। তার মতো বিদগ্ধ পণ্ডিত অবশ্যই জানতেন যে, ভারতের সাথে রাজনৈতিক মুলাকাতের প্রথম প্রহরেই মুসলিমরা ভারতচর্চাকে নিজেদের প্রিয় বিষয় বানিয়ে নেন। বস্তুত ভারতবিজ্ঞানের পদ্ধতিগত স্রষ্টা মুসলমানরাই। আল বেরুনীর মতো মহাজ্ঞানী প্রথমবার ভারতীয় বিশ্বাস, জীবন, সমাজ, সংস্কৃতি, ভূমি, নৃতত্ত্ব, আবহাওয়া, প্রাণ-প্রকৃতি ও জ্ঞানের ওপর বৈজ্ঞানিক আলোকপাত করেন। তার কিতাবুল হিন্দ হচ্ছে ভারতচর্চার পথিকৃৎ। ভারতকে প্রথম দিন থেকে মুসলমানরা জ্ঞান ও ভালোবাসার চোখ দিয়ে দেখেছেন। ভারতীয় সাহিত্য তরজমা করেছেন আরবি ও ফার্সিতে। তখনকার বিশ্বরাজধানী বাগদাদে আদৃত হয়েছে সংস্কৃত গ্রন্থাবলি। অনূদিত ও চর্চিত হয়েছে প্রাচীন ভারত। এমনকি হিন্দুদের গ্রন্থাবলি প্রথমবার অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বপরিসরে উপস্থাপন করেন মুসলমানরা। সংস্কৃত ছাড়া অন্য ভাষায় এসব গ্রন্থের অনুবাদ হিন্দুরা খারাপ চোখে দেখতেন। মুসলিমরাই এই অচলায়তন ভাঙেন। এমনকি বাংলা ভাষায় রামায়ণ-মহাভারত অনূদিত হয় মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায়। ভারতীয় গল্প কালিলা ও দিমনা মুসলিমদের কাছে এত জনপ্রিয়, যার ফলে একে অবলম্বন করে রচিত হয় বহু গ্রন্থ। এখানকার উপাখ্যানগুলোকেও অসামান্য গুরুত্ব দিয়েছে মুসলিম সাহিত্য। মুসলমানরা ভারতকে দিয়েছেন ইতিহাসচর্চা। উপমহাদেশে তারা এখানকার ইতিহাস নির্মাণ করেছেন, বিকাশ দিয়েছেন; ইরান, তুরান বা আরবের ইতিহাস নয়।

যদুনাথের আরেক অনুমান হলো ‘স্থানীয়দের ধর্মের ভাষা, শকাব্দ, সাহিত্য, শিক্ষক, সাধুপুরুষ এবং তীর্থ সমস্ত জগৎ ব্যাপিয়া এক, এসব ভারতের বাহিরের বস্তু।’

ভাষার প্রশ্নে ইসলামে কোনো শুচিবায় নেই। ইসলাম প্রতিটি ভাষাকেই মহিমান্বিত করে। যেখানে বৈদিকরা অন্যান্য ভাষাকে ইতর প্রতিপন্ন করত, সেখানে ইসলাম জগতের প্রতিটি ভাষাকেই আল্লাহর নিদর্শন বলে ঘোষণা করেছে। ফলে ভারতীয় ভাষাসমূহের বিকাশে মুসলিম সভ্যতার ভূমিকা হয়েছে অবিস্মরণীয়। যদুনাথ সরকার স্বীকার করেছেন এখানে উর্দু ভাষা মুসলিমদের হাতেই জন্ম নিয়েছে এবং ‘মুসলমান যুগের দেওয়া শান্তি ও ঐশ্বর্য্যরে ফলে হিন্দি বাঙ্গলা মারাঠি প্রভৃতি নব্য ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি আরম্ভ হইল।’ মুসলিমদের শকাব্দ বাইরের এবং সমান মাত্রায় ভেতরের। মুসলিমরা হিজরির চর্চা করতেন চান্দ্রবর্ষ হিসেবে। ঠিক তেমনিভাবে তারা এখানে জন্ম দিয়েছেন সৌরবর্ষ। আমাদের বঙ্গাব্দও মুসলিম আমলের অনুদান। মুসলিমদের সাহিত্যকে ভারতের বাইরের বস্তু বলাটা একদেশদর্শী। মধ্যযুগে হিন্দি, উর্দু, মারাঠি, বাংলা, পশতু, সিন্ধি ইত্যাদি ভাষার সাহিত্যিক বিকাশে মুসলিমদের ভূমিকা জনকের, জননীর। শুধু বিদেশী উপাদান দিয়ে এটি কিভাবে সম্ভব? মুসলমানরা বরং এসব ভাষায় এনেছেন আন্তর্জাতিকতা। স্থানীয় উপাদানকে যেমন কাজে লাগিয়েছেন, তেমনি তখনকার বিশ্বের অগ্রসর জ্ঞান, চিন্তা ও শিল্পকে আহরণ করে এনেছেন উপমহাদেশের বাইরের নানা অঞ্চল থেকে। মুসলিমরা ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্যসমূহে তৈরি করেন পৃথিবীর অগ্রসর বাস্তবতা ও চলমানতার নতুন তরঙ্গ।

মুসলিমদের শিক্ষক ও সাধুপুরুষ ভারতের বাইরের জিনিস নয় সাধারণভাবে। সেই প্রথম নবী হজরত আদম আ: থেকে ভারতে মুসলিমদের শিক্ষক ও সাধকদের ঐতিহ্যের সূত্রপাত। মহানবী সা:-এর জীবদ্দশায় সাহাবিদের উপমহাদেশে আগমন প্রমাণিত। তাঁরা এখানে বসবাস করেছেন, সমাহিত হয়েছেন। এর পরে সাহাবি, তাবেয়ি, তাবে তাবেয়ি থেকে নিয়ে মহান শিক্ষক ও সাধকদের যে বিশাল ও বিস্তৃত সমাগম এই ভারতে ঘটেছে, তার নজির অন্যত্র বিরল। বিশেষত সুফিদের কথা বলাই যায়। তাদের বিবরণীর জন্য বিশ্বকোষ রচনা করতে হবে। মুসলিমদের পবিত্র ভূমি সারা পৃথিবী। প্রতিটি মসজিদই মহিমার অর্থে তীর্থকেন্দ্র। আবার যেকোনো জায়গাই কোনো স্থাপনা ছাড়াও মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। ইসলামে বিশেষায়িত মসজিদ তিনটি ; কাবা, মসজিদে নববী ও বায়তুল মুকাদ্দাস। আর অন্য সব মসজিদ সমান। সে ক্ষেত্রে প্রাচীন ঐতিহ্যধারী মসজিদের বিচারে উপমহাদেশের বিশেষত্ব আলাদা। কারণ এখানে রয়েছে নবীযুগে প্রতিষ্ঠিত মসজিদ। লোকায়ত মুসলিম মন যে জায়গাগুলোকে নিজেদের তীর্থস্থান হিসেবে বিবেচনা করে, এর মধ্যে উপমহাদেশীয় শহর, জনপদ ও স্মৃতিকেন্দ্রের সংখ্যা এত বেশি, সম্ভবত পৃথিবীর অন্য কোথাও কোনো মুসলিম জনগোষ্ঠী নিজেদের তরফে এত তীর্থস্থানের জন্ম দেয়নি।

যদুনাথ সরকার উপমহাদেশীয় মুসলিমদের বিচারে ও বয়ানে যে বিকারের চর্চা করেছেন, তার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অভিঘাত ঘটছে ভয়ানকভাবে!

লেখক : কবি, গবেষক
71.alhafij@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement