বহুদিন থেকে দেশের প্রতিটি জনপদে ‘উন্নয়নের’ ফুলঝুরি ছড়ানো হচ্ছিল। সেই উন্নয়নের কথামালা এখন কোন অরণ্যে মুখ লুকিয়েছে কে জানে? কথিত উন্নয়নের কিছুটা যদি সত্য হয়েও থাকে, সেটা কোনোভাবেই টেকসই ছিল না। এখন সবাই তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। বরং উন্নয়নের প্রোপাগান্ডা চালিয়ে সবাইকে একটা ঘোরের মধ্যে ফেলে রাখারই কৌশল ছিল। এখন অনেকে মনে করছেন সেটা ছিল কেবলই মরীচিকা বা ভোরের শিশিরবিন্দুর মতো ক্ষণস্থায়ী, কিছু বেলা হলেই তা বাষ্পের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী মহোদয় সম্প্রতি যে মন্তব্য করেছেন, প্রকারান্তরে এই নিবন্ধের উপরের যে বক্তব্য তারই যেন একটা প্রতিধ্বনি তিনি করেছেন। পত্রিকায় সে মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। সেই মন্তব্য এখানে উদ্ধৃত করছি, ‘বর্তমানে দেশের অর্থনীতি চকচকে, কিন্তু তার গভীরতা খুব সামান্য, সামান্য ধুলো-বাতাসে এটা কেঁপে ওঠে।’ তিনি এ মন্তব্যও করেছেন, আমাদের আরো গভীরে যেতে হবে। প্রকৃত কথা হচ্ছে, উন্নয়ন বলতে তো অর্থনীতির সমৃদ্ধি ও শক্তিমত্তা বোঝায়। কিন্তু সেই শক্তিমত্তা এখন কোথায়। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে জনগণকে উপরে তুলে আছড়ে ভ‚মিতে ফেলে দেয়া হয়েছে। এতে মানুষ এখন হতবিহ্বল দিশেহারা।
বিদ্যুতের আলো নেই, আঁধারে ডুবতে চলেছে দেশ, অকারণে নাগরিকদের আয়কর দিতে হবে। একসময় আয় ছিল, আয়কর দেয়ার জন্য টিন নম্বর নিয়েছিল। এখন আয় বলতে কিছু নেই, সেই টিন নম্বরের সূত্র ধরে তাদের এখন বাধ্যতামূলকভাবে আয়কর দিতে হবে। গণমানুষের হাতের কাছে চিকিৎসা নেই, অথচ এ খাতে যে বার্ষিক বরাদ্দ, অদক্ষ-অথর্ব প্রশাসনের সক্ষমতার অভাবে সে অর্থ ব্যয় করতে না পারায়, সেটা আবার রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফিরে যাচ্ছে। হাজার হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেছে। লাখ লাখ ছাত্র-ছাত্রীর পড়াশোনা কি এখানেই শেষ হয়ে যাবে! আমরা কি তাহলে মূর্খের জাতিতে পরিণত হচ্ছি। যেখানেই হাত পাতা হচ্ছে, সেখান থেকেই শুনতে হচ্ছে, নেই কিছু। আসলে দেশে এখন কী আছে তা দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও দেখা যায় না।
হ্যাঁ, অবশ্যই দেশে অনেক কিছু আছে, সেটা দুর্নীতি, ভয়ঙ্কর সব রাজনৈতিক মাস্তানদের উৎপাত। অসংখ্য চাঁদাবাজ আছে, দেশের গরিব দুঃখী মানুষের জমানো ব্যাংকের টাকা পাচার হচ্ছে বেশুমার, আছে অসংখ্য ঋণখেলাপি। বন্ধ হয়ে থাকা শিল্প কারখানার সংখ্যা অগণন। অসংখ্য গায়েবি মামলার স্তূপ আছে। সাত হাজারের বেশি ডিজিটাল আইনে মামলা বিদ্যমান। আরো আছে প্রতিদিন সড়কে দুর্ঘটনার খবর, তাতে বহু হতাহতের সংখ্যা নিত্য স্ফীত হচ্ছে, প্রতি মুহূর্তে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির দুঃসংবাদ শোনা যায়। এমন খবরের দীর্ঘ ফিরিস্তি দেয়া যাবে।
তাহলে কি এই ভূখণ্ডের কোটি কোটি মানুষ এখন একটা নেতিবাচক রাষ্ট্রের নাগরিক। মানুষের সম্মুখে আশাবাদ জাগানোর সব উদ্যোগ নস্যাৎ করে দেয়া হয়েছে। পরিস্থিতি কিন্তু সে কথাই বলছে। এর পরও তার স্বরে বলা হচ্ছে, এই দেশকে একমাত্র আমরাই চালাতে সক্ষম, আমাদের দ্বিতীয় কোনো বিকল্প নেই। পরিবর্তনের সব পথ বন্ধ করার অপপ্রয়াস ক্রমাগতই চলছে।
শোনা যায়, রাজনীতিতে নাকি এখন বিকিকিনির হাট বসেছে। দুর্ভাগ্য, কেউ এখন আর আমজনতার বাটে যাচ্ছে না। রাজনীতির এই ভাগ বাটোয়ারা দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে! সব ঘটছে লক্ষ মানুষের সম্মুখে, কিন্তু কারো কিছুই বলার জো নেই। আসলে এখন আমরা কোন উদ্ভট উঠের পিঠে সোয়ার হয়েছি। সেই মরুর জাহাজ আমাদের কোন মরুদ্যানে না নিয়ে কোন মেরুতে নিয়ে ফেলে দেবে কে জানে? উর্বর ভূমি তাপে চাপে প্রাণ না ওষ্ঠাগত হয়। ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত মানুষকে এখন খাদ্য ও পানি পান করাবে। ক্ষুধায় ও পানিশূন্যতায় ভীষণ কাতর সাধারণ মানুষ। কিন্তু কেউ কি এসবে পরোয়া করছে।
যাদের দেশের দেখভাল করার কথা তাদের কাছে এখন আর কোনো দেশ নেই। এখন তারা শুধু নিজেকে নিয়েই পেরেশান। নিজের সুরক্ষার পরিকল্পনা নিয়েই সবাই ব্যস্ত। জনগণকে অ্যাবানডন করা হয়ে গেছে। কারণ এখন যে শৈলীর চর্চা, চিন্তা হচ্ছে, সেখানে জনগণের খুব একটা প্রয়োজন পড়বে না। ১৫ শতাংশ ভোটেই কেল্লা ফতেহ। এটা আর তুরস্ক নয় যে ৫০ শতাংশ ভোট না পেলে বিজয়ী হওয়া যাবে না।
উপরে বলা হয়েছে, দেশে যা আছে, আর যা কিছু নেই- সেই ফিরিস্তিটা হাতে নিলেই অনুমান করা সহজ হবে বিগত দেড় যুগে আমাদের কোথায় কতটুকু প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। আর সম্ভাবনার কোন সব দুয়ারে তালা লেগেছে। সেসব যোগ-বিয়োগ করলে সব স্পষ্ট হয়ে উঠবে বর্তমান প্রশাসনে দেড় দশকের একটা ‘প্রোগ্রেস রিপোর্ট’।
একজন সাধারণ মানুষ পর্যন্ত বুঝতে পারবে দুধের ননীর ভাগ কে কতটুকু পেয়েছেন। এদিকে আজকে জন্মানো প্রতিটি শিশুও মাথায় বিপুল ঋণের ভার বহন করছে।
সবচেয়ে অবাক হতে হয় এই প্রশাসনের উচ্চস্তরের কিছু ব্যক্তির দম্ভোক্তি শুনে। তাদের এমন আচরণ এ কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, রোম যখন জ্বলছিল সম্রাট নিরো তখন হৃদয়ানন্দে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। সম্রাট নিরোর না হয় সেটা ছিল তার নিজের রাজত্ব। সেজন্য কারো কাছে তাকে জবাবদিহি করার প্রয়োজন হতো না। কিন্তু আমাদের এই ভূখণ্ডের স্বত্বাধিকারী কিন্তু জনগণ। দুর্মুখরা বলে। সেটা হবে, মানলে তাল গাছ, না মানলে কিছুই না। অবশ্য এখানে সবাই গণতন্ত্রের একটা লেবাস পরেন। সেই লেবাস পাওয়ার খুব সহজ উপায় হচ্ছে ‘ভোটারবিহীন’ ও নৈশকালীন নির্বাচনের একটা ‘প্রসহন’-এর আয়োজন করা। তার জন্য অবশ্য প্রযোজক, পরিচালক, শিল্প নির্দেশকের প্রয়োজন হয়। ‘সুখের’ বিষয় দেশে তেমন ব্যবস্থা তথা ‘থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়’ গোছের একটা নির্বাচন কমিশনও মজুদ আছে। এমন নির্বাচন কমিশনের অপূর্ব সব ভ‚মিকা দেখা গেছে চলতি সংসদসহ আরো দুটো সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময়। সেই কমিশনের কর্তাদের দেখা গেছে বিভিন্ন সময়ে উপরে মানুষকে প্রভুজ্ঞানে ভক্তি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য কতটা গদ গদ থাকেন। এ সব বশংবদ কমিশন গঠনের একটা ‘ছাঁচ’ও আছে। সেই ছাঁচে ফেলে দিলে পছন্দমতো একটা কমিশন তৈরি হয়ে যায়। সে লক্ষ্যে বিধিবিধান রচনার সব পথ পদ্ধতি অতি চমৎকারভাবে মশ্ক করা হয়েছে। ফরমায়েশ মতো সব কিছু জাদুমন্ত্রের মতো হয়ে যায়। এমন কর্মকাণ্ডের সময় কর্মকর্তারা নিজের লাভটাই কেবল বিবেচনায় নিয়ে থাকেন। এমন তামাশা দীর্ঘদিন থেকে দেখতে হচ্ছে। এসব দৃশ্য দেখে অসহায়-হতাশ জনগণ।
বক্ষ্যমাণ এই নিবন্ধে এতক্ষণ যে কথাগুলো বলা হলো- এর সবই মানুষের অধিকার হারানোসংক্রান্ত বিষয়। সেই সব অধিকার কিন্তু বিধিবদ্ধ রয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আইন গ্রন্থে সেটা সুরক্ষিত। কিন্তু সেই সব অধিকার পাওয়া, ভোগ করা, প্রয়োগ করা যাচ্ছে কি না- এসব প্রশ্ন খুবই ‘রেলিমেন্ট’। তবে এখন সব অধিকারই শিকায় তুলে রাখা হয়েছে। গ্রাম দেশে বধূরা যেমন বিড়ালের ভয়ে খাবার দাবার সব শিকায় তুলে রাখেন। কিন্তু আমাদের বিধিবদ্ধ সব অধিকারগুলো কেন গণমানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে রাখা হচ্ছে! সে নিয়ে বর্তমানে একটা মস্তবড় প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে।
উপরে অনেক বিষয়ে আনীত মামলা দায়েরের কথা বলা হয়েছে। উল্লিখিত সব মামলা মানুষের অধিকার হরণের নিমিত্তেই করা হয়েছে। এমন ভূরি ভ‚রি মামলার কথা স্মরণ করা যায়। আবার এমন বহু উদাহরণও দেয়া যায় যে, বহু চিহ্নিত দোষীকে অনুরাগ অনুকম্পা দেখানো হচ্ছে। এমন অনুরাগ বিরাগের বশবর্তী হওয়া পরিষ্কারভাবে সংবিধান পরিপন্থী। আজকে প্রশাসন এতটাই একদেশদর্শী যে অতীত থেকে তার কোনো উদাহরণ পেশ করা সম্ভব নয়।
অতীতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় সরকার যখন ক্ষমতায় ছিল, সেটা ছিল তখন গণতন্ত্রের ধারক একটি সরকার। তারা সব কিছু হিসাব-নিকাশ করে এবং জবাবদিহিতার শৈলী অনুসরণ করে দেশ শাসন নয়, পরিচালনা করেছে। সেখানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ছিল বিধায় পান থেকে চুন খসলেই সেসব কথা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতো এবং জাতীয় সংসদে সেজন্য সরকারকে জবাবদিহি করতে হতো।
মানুষ এরশাদ সরকারকে নানা বিশেষণে ভ‚ষিত করে থাকে বটে- সে সরকারের আমলে আমাদের মতো বয়সের বহু সংবাদপত্রের কর্মীরা কাজ করেছেন। আমাদের সেসব দিনে উল্লিখিত দুই সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা হয়েছে। কিন্তু তাদের মধ্যে রুষ্টতা, ধৈর্যহীন বা প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে দেখিনি। আজকে তরুণ প্রজন্মের সাংবাদিকদের অভিজ্ঞতা একেবারেই বিপরীত। জ্যেষ্ঠদের কথা শুনে তারা বলেন, আর কি সেই দিন ফিরবে!
সেসব দিন ফিরবে কি না সেটা ভবিতব্য। তবে এ কথা মনে রাখতে হবে, ভবিষ্যতের গর্ভ থেকে সেসব দিন ফিরে না এলে বা ফেরাতে না পারলে গোটা দেশে নেমে আসবে দুর্ভেদ্য এক অন্ধকার। অমানিশার নিকশ কালো আঁধারের চেয়েও সে অন্ধকার হবে আরো বহু গুণ পুরু। তখন নিশাচর বাদুড়ই কেবল উড়তে পারবে আর কিছু নয়। ভোর হলেও আঁধার না কাটায় সব পাখীই কুলা থেকে বের হতে না পারায় ভয়ার্ত কণ্ঠে অদ্ভুত সুরে চিৎকার চেঁচামেচি করবে। অবাক হবার কিছুই থাকবে না। দেশ থেকে আঁধার দূরীভূত না হলে মানুষকেও সব অধিকার উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়ে তেমন আর্তচিৎকার ছাড়া ভিন্ন কিছুই করার থাকবে না। সবাইকে বুঝতে জানতে হবে কে তাদের সুহৃদ আর কে মেকি। কে ছদ্মবেশ ধারণ করে মানুষের কাছে এসে ঘুর ঘুর করছে। ঢাক ঢাক গুর গুর করতে থাকা মতলববাজদের নিয়ে খুব হুঁশিয়ার থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, আকাশের মতো মানুষও ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলায়! এটাই যখন সত্য, তখন আমরা সবাই বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করছি।
এমন অভিজ্ঞতা নিয়ে আসলে কোথাও কিছু বলা যাবে না, কেননা মন্দ কাজ কখনোই উদাহরণ হতে পারে না। তা নিয়ে অনুশোচনা অনুতাপ করা যায়, আর কিছু নয়। একই সাথে এ কথা মনে রাখতে হবে, মানুষই কেবল অসাধ্য সাধন করতে পারে। শেষ কথা ‘একবার না পারিলে দেখ শতবার’। ’৭১ সালে বাঙালি অসাধ্যই সাধন করেছে। সেই সব অগ্নিপুরুষদের অনেকেই আজ নেই, কিন্তু তাদের বীরত্বগাথা রয়ে গেছে। সেখান থেকে পাঠ নিলে দেশের শিরায় শিরায় জাগরণ আসবে। সবাই মিলে আজ আগুনের পরশমণি ছোঁয়াই প্রাণে।
ndigantababar@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা