০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`


শস্য বহুমুখীকরণ

শস্য বহুমুখীকরণ - ছবি : সংগৃহীত

শস্য বহুমুখীকরণের সাথে খাদ্য বহুমুখীকরণ ও খাদ্যনিরাপত্তা নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। প্রথমোক্তটির সাফল্য শেষোক্ত দু’টির সাফল্যের জন্য সহায়ক। বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ। জনসংখ্যার তুলনায় আমাদের দেশের আয়তন ক্ষুদ্র হওয়ায় এবং এর পাশাপাশি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার প্রকট হওয়ায় প্রতি বছর বাড়তি জনসংখ্যার মাথা গোঁজার ঠাঁই গৃহ নির্মাণে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চাষযোগ্য জমি চাষের আওতাবহির্ভূত হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া শহরাঞ্চলের বিস্তৃতি, চাষযোগ্য জমিতে আবাসন প্রকল্প ও কলকারখানা স্থাপন এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো সংশ্লেষে স্থাপনার ব্যাপকতার কারণে চাষের জমির পরিধি দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। এ বাস্তবতায় শস্য বহুমুখীকরণ আমাদের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

স্বাধীনতার অব্যবহিত-উত্তর আমাদের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। সে সময় যে পরিমাণ ভূমিতে আমাদের প্রধান খাদ্য ধান এক কোটি টন উৎপাদন হতো বর্তমানে ধান উৎপাদনে ব্যবহৃত ভূমির পরিমাণ হ্রাস পেলেও উৎপাদনের পরিমাণ সাড়ে তিন কোটি টন অতিক্রম করেছে। এটি সম্ভব হয়েছে উন্নত বীজ, সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, যান্ত্রিক চাষ, এক ফসলি ভূমিকে দু’ বা তিন ফসলি ভূমিতে রূপান্তর, উন্নত জাতের বীজ উদ্ভাবন, বপন অথবা রোপণ হতে পরিপক্ব হওয়ার সময়ের হ্রাসে সাফল্য, ক্ষেত্র মতো পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণ প্রভৃতি সমন্বিতভাবে কার্যকর করার উদ্যোগ গ্রহণের ফলে।

কৃষিকাজের মাধ্যমে উৎপাদিত খাদ্য এবং খাদ্যবহির্ভূত পণ্য শস্যের অন্তর্ভুক্ত। পাট, ফল, ফুল, মাছ, ফলদ ও বনজ বৃক্ষ প্রভৃতি কৃষিপণ্য হিসেবে শস্য। এমনকি রান্নার উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত পেঁয়াজ, রসুন, আদা, মরিচ, হলুদ, জিরা, ধনে, এলাচ, গোলমরিচ, দারুচিনি প্রভৃতিও শস্য।
শস্য বহুমুখীকরণের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আমাদের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সব কৃষিপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এবং বাড়তি উৎপাদিত পণ্য রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন।

আমরা ধান, সবজি ও আলু উৎপাদনে দুর্যোগের সম্মুখীন না হলে চাহিদা মিটিয়ে রফতানির জন্য কিছু অবশিষ্ট পাচ্ছি। এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় ধরনের সাফল্য। এ সাফল্যের ধারাবাহিকতায় আমরা যদি উচ্চমূল্যের কৃষিপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারি তা একদিকে আমদানি-নির্ভরতার হ্রাস ঘটাবে অপরদিকে কৃষকের জীবনে সমৃদ্ধি আনবে। আমাদের অর্থনীতি এখনো অনেকটা কৃষিনির্ভর। আমাদের উল্লেখযোগ্য শিল্পায়ন হওয়া সত্ত্বেও গড় জাতীয় উৎপাদনে কৃষির অবদান বর্তমানে প্রায় ১৮ শতাংশ। কৃষকের উন্নয়ন মানে তার ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ কৃষক হওয়ায় এ ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি অর্থনীতিতে যে গতির সঞ্চার করবে তা সার্বিকভাবে অর্থনীতিকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করবে।

বর্তমানে দেশের অনেক স্থানে কৃষকরা ধানের সাথে মাছ চাষ করে সফলতা পেয়েছেন। এ সফলতা কৃষকের জন্য আমিষের চাহিদা পূরণ ছাড়াও বাড়তি অর্থের জোগান দিচ্ছে। তবে চাষের এ পদ্ধতিটি নিচু জমির মধ্যে সীমিত রয়েছে। অনেক স্থানে ধানের সাথে খেশারি, কলাই ও মুগ ডালের চাষ হচ্ছে। আবার অনেক স্থানে ধানের এক বা দু’টি ফসল করার পর সবজি মসলা, আলু প্রভৃতির আবাদ হচ্ছে।

একই কৃষিপণ্য সব সময় উচ্চমূল্যের কৃষিপণ্য হিসেবে বিবেচিত হয় না। এটি মূলত নির্ভর করে একটি পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহের ওপর। আমাদের কৃষকদের উৎপাদন ও চাহিদা এ দু’টি বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা না থাকার কারণে সাধারণত দেখা যায়, কোনো বছর একটি কৃষিপণ্যের উচ্চ মূল্য পাওয়া গেলে পরবর্তী বছর কৃষকরা পণ্যটি অধিক হারে উৎপাদন করে। কিন্তু অধিক উৎপাদনের কারণে সরবরাহ বৃদ্ধির ফলে যে পণ্যের মূল্য নিম্নমুখী হয় সে বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে প্রায়ই তাদের লাভের পরিবর্তে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।

এমন অনেক উচ্চমূল্যের কৃষিপণ্য রয়েছে যেগুলোর চাহিদার কিয়দংশ আমাদের দেশে উৎপাদন হয় যেমন- এলাচ, দারুচিনি, জিরা, গোলমরিচ প্রভৃতি। এ সব কৃষিপণ্য ফসলের মাঠের পরিবর্তে বাড়ির আঙিনায় চাষ অধিক লাভজনক ও সুবিধাজনক। আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক এখনো এ সব কৃষিপণ্যের চাষ ও উৎপাদন পদ্ধতি বিষয়ে অবহিত নয়। এ সব পণ্য চাষ বিষয়ে কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে উপকরণ সরবরাহ করে সফলতা প্রত্যাশা করা যায়। তা ছাড়া এ সব পণ্য বাড়ির আঙিনায় চাষ করে শতভাগ চাহিদা পূরণ সম্ভব বিধায় আবাদযোগ্য জমি অন্যান্য প্রয়োজনীয় কৃষিপণ্য উৎপাদনে ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হয়।

আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে যে সব ফল উৎপন্ন হয় তার মধ্যে আম, লিচু, বেল, কমলা, তরমুজ, পেয়ারা প্রভৃতি উচ্চমূল্যের ফল হিসেবে বিবেচিত। এ সব ফল বছরে একবার উৎপন্ন হয়। উচ্চতর প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এ সব ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি করা গেলে কৃষক লাভবান হওয়ার পাশাপাশি ভোক্তারা সাশ্রয়ীমূল্যে ক্রয়ের সুযোগ পাবে।

আনারস, কাঁঠাল, পেঁপে, কলা, লটকন, বিভিন্ন ধরনের লেবু, কুল, জাম প্রভৃতি আমাদের দেশের প্রচুর উৎপাদন হয়। এর মধ্যে কলা ও পেপে সারা বছর উৎপাদন হয় এবং অন্যগুলো মৌসুমি ফল। এ সকল ফলের চাহিদা ও যোগানের সমন্বয় থাকায় সকল শ্রেণিপেশার মানুষ কমবেশি স্বাদ আাদনের সুযোগ পায়।
প্রাকৃতিকভাবে পৃথিবীর এক অঞ্চলে যে ফল উৎপাদন হয় অতীতে অন্য অঞ্চলে সে ফলের উৎপাদন হতো না। কিন্তু বর্তমানে মাটির গুণাগুণ পরিবর্তনের মাধ্যমে এক অঞ্চলের ফল অপর অঞ্চলে উৎপাদন সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- স্ট্রবেরি, আঙ্গুর, মাল্টা, আপেল, কফি প্রভৃতি। স্ট্রবেরি ফলটি আমাদের দেশে উৎপাদন পূর্ববর্তী সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে ছিল। বর্তমানে এর ব্যাপক উৎপাদনের কারণে মূল্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে এবং বলা যায় সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার নাগালে। দেশের কতিপয় অঞ্চলে আঙ্গুর চাষে সফলতা পাওয়া গেছে তবে তা এখনো চাহিদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। মাল্টা, আপেল, কফি এ তিনটি পণ্য রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের পাহাড়ি অঞ্চলে উৎপন্ন হয়। এ তিনটি পণ্যের উৎপাদন সম্ভাবনা ব্যাপক হলেও তা অদ্যাবধি কাজে লাগানো যায়নি। তা ছাড়া সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের পাহাড়ি অঞ্চল এবং ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, শেরপুর, ঢাকা ও গাজীপুরের গড় অঞ্চলে এ তিনটি পণ্য উৎপাদনের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।

নদীবিধৌত চরাঞ্চলের ভূমি এবং নদী তীরবর্তী ভূমি বালি দিয়ে আচ্ছাদিত থাকায় এ সব ভূমি পতিত হিসেবে গণ্য হতো। অধুনা এ সব ভূমিতে ব্যাপক আকারে ভুট্টার চাষ হচ্ছে। ভুট্টা দিয়ে প্রস্তুত খাদ্য হাঁস-মুরগির খামারের প্রধান খাদ্য হওয়ায় ভুট্টার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। নিকট অতীতেও আমদানির মাধ্যমে ভুট্টার চাহিদা মেটানো হতো। বিগত দু’-এক বছরে উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন চাহিদা মেটানোর পরও একটি অংশ রফতানির জন্য উদ্বৃত্ত থাকছে।
এক বিঘা জমিতে ফুল চাষ করে যে লাভ পাওয়া যায় তা অন্য যেকোনো খাদ্যজাতীয় কৃষিপণ্য থেকে অধিক হওয়ায় চাষিদের একটি অংশ আবাদি জমিতে ফুলের চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। ফুলের চাহিদার তুলনায় উৎপাদন এখনো সন্তোষজনক না হওয়ায় পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আমদানির মাধ্যমে অভাব মোচন করা হচ্ছে। পাহাড় ও গড় অঞ্চলে এবং পাহাড়ের পাদদেশে ফুল চাষ বিস্তৃত করে অভাব পূরণ ছাড়াও রফতানির অবকাশ রয়েছে।

এমন কিছু উচ্চমূল্যের বনজবৃক্ষ রয়েছে যা অল্প পরিসরে ঊর্ধ্বপানে দ্রুত বেড়ে উঠে যেমন- সেগুন ও মেহগনি। যেকোনো কৃষক বাড়ির আঙ্গিনায় এ ধরনের পাঁচ-ছয়টি বৃক্ষ লাগিয়ে ত্রিশ-চল্লিশ বছর লালন করতে পারলে তার পেছন ফিরে তাকানোর অবকাশ কম।

মশুর ও মুগডাল এবং যেকোনো ধরনের তেলবীজ উচ্চমূল্যের কৃষিপণ্য। আমাদের ডাল ও ভোজ্যতেলের বিপুল ঘাটতি রয়েছে। আমন ধান কাটার পর একই জমিতে ডাল ও তেলবীজের আবাদ করে কৃষকরা লাভবান হওয়ায় পাশাপাশি ঘাটতি পূরণে এগিয়ে আসতে পারে।
ইদানীং ধানের কুঁড়ার তেল জনসাধারণের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এ তেলটির মূল্য সয়াবিন বা পাম অয়েলের চেয়ে অধিক হলেও এর শোষণক্ষমতা কম হওয়ায় ব্যবহার সাশ্রয়ী। চিকিৎসকদের মতে, অন্য যেকোনো ভোজ্যতেলের চেয়ে এটি অধিক স্বাস্থ্য-উপযোগী। ধানের কুড়া তেল উৎপাদনে ব্যবহারে কৃষকের জন্য দু’টি বাড়তি পয়সা উপার্জনের পথ করে দিয়েছে।

আমাদের পাহাড় অঞ্চলের বিশাল ভূমি বৃক্ষশূন্য ও অনাবৃত। তা ছাড়া আবাদযোগ্য অনেক ভূমি এখেনা অনাবাদি রয়েছে। সড়ক, রেলপথ, বেড়িবাঁধের দু’পাশ ও বিশাল সীমান্ত এলাকায় বৃক্ষরোপণের সুযোগ রয়েছে। এ সব ভূমিতে চাহিদা ও উপযোগিতার কথা বিবেচনায় রেখে বৃক্ষরোপণ ও ক্ষেত্রমতো চাষের উদ্যোগ নেয়া হলে শস্য বহুমুখীকরণের পথ অনেকটা প্রশস্ত হবে।

এ কথাটি সত্য, আমাদের জনসংখ্যার তুলনায় ভূ-ভাগ সীমিত হওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদনযোগ্য সব কৃষিপণ্য উৎপাদন করা যাচ্ছে না। ভূমিস্বল্পতার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আমাদেরকে অল্প সময়ের মধ্যে একই ভূমি থেকে সর্বোচ্চ উপযোগিতা লাভের প্রয়াস নিতে হবে। এ লক্ষ্য অর্জনে সরকারের পাশাপাশি যার যার অবস্থান থেকে দেশের সব শ্রেণিপেশার মানুষের একনিষ্ঠ হয়ে সহযোগিতার হস্ত প্রসারিত করতে হবে। আর এর মধ্যেই নিহিত আছে শস্য বহুমুখীকরণের সাফল্যের সুপ্ত বীজ।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com

 

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement
আনোয়ারায় ২ সন্তানের জননীর রহস্যজনক মৃত্যু, স্বামী আটক লজ্জা এড়ালো জিম্বাবুয়ে গাজীপুরে ট্রেন দুর্ঘটনা : সাময়িক বরখাস্ত ৩, ঘটনা তদন্তে ৩ কমিটি আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বেনাপোল ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি মালিক সমিতির নির্বাচন ঘিওরে নির্বাচনে অংশ নেয়ায় বিএনপির ২ নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ জিম্বাবুয়েকে লজ্জার রেকর্ডের দিকে ঠেলে দিচ্ছে টাইগাররা জনগণের কাছে হেরে যাওয়ার আগে ক্ষমতা ছেড়ে দিন : ফারুক আলমডাঙ্গায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড নয়টি বাড়ি পুড়ে ছাই গৌরনদীতে আ’লীগের ২ পক্ষের সংঘর্ষ, ইউপি চেয়ারম্যানসহ রক্তাক্ত জখম ৫ টাঙ্গাইলে তৃষ্ণার্ত মানুষের পাশে সোনালি সূর্য শুরুতেই উইকেটের দেখা পেল বাংলাদেশ

সকল