০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`


মাওলানা মুহিউদ্দিন খান : জাতিসত্তা নির্মাণের অন্যতম কাণ্ডারি

মাওলানা মুহিউদ্দিন খান - ছবি : সংগৃহীত

জাতির অভিভাবক, জাতিসত্তা নির্মাণের অন্যতম কাণ্ডারি, বাংলাদেশে সীরাত সাহিত্যের পথিকৃৎ ও ইসলামী রেনেসাঁর পুরোধা ব্যক্তিত্ব মাওলানা মুহিউদ্দিন খান (১৯৩৫-২০১৬) পৃথিবীকে বিদায় দিয়ে চলে গেছেন সাত বছর হয়ে গেল। নিভে গেছে আরেকটি আলোর প্রদীপ, থেমে গেছে জীবনের স্পন্দন। তিনি ছিলেন বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের অধিকারী। এ মনীষীর জীবনসাধনার বহুমাত্রিকতা জাতির জন্য মডেল ও পাথেয়। ইসলামের সোনালি আদর্শে সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তোলার আন্দোলনে তিনি ছিলেন উৎসর্গিতপ্রাণ ও সাহসী কর্মী। ইসলাম, কুরআন ও নবীজীবন সা: ও ধর্মীয় শিক্ষার ওপর যখনই আঘাত এসেছে তখনই তিনি প্রতিবাদ-প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন লড়াকু সৈনিকের মতো। বাতিলের বিরুদ্ধে হকের ময়দানে তার ভূমিকা ছিল আপসহীন। ৮১ বছর বয়সে মৃত্যুকে পরিণত বলতে হবে কিন্তু এ মৃত্যুর ক্ষত শুকাতে সময় লাগবে। এমন এক সময়ে তিনি চলে গেলেন যখন তার প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি। একে একে ভেঙে যাচ্ছে আলোর মিনার। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে জাতি অনেক রাহবারকে হারিয়েছে।

আজ থেকে ৬৫ বছর আগে ময়মনসিংহের গফরগাঁও থেকে তিনি ঢাকা আলিয়ায় হাদিস ও ফিকহশাস্ত্রে উচ্চতর শিক্ষা (কামিল) অর্জনের জন্য এসেছিলেন। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে তিনি ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। সাহিত্য রচনা করেছেন, জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, দিকনির্দেশনা দিয়েছেন ও আশার বাণী শুনিয়েছেন। অবশেষে ঢাকাকে বিদায় জানিয়ে ২৬ জুন গ্রামের ছেলে গ্রামে ফিরে গেলেন চিরদিনের জন্য। গফরগাঁও উপজেলার আনসার নগরে পারিবারিক কবরস্থানে তার শেষশয্যা রচিত হলো। গত বছরের শেষের দিকে গফরগাঁও-এর পাঁচবিবিতে গিয়ে তার কবর জিয়ারত করে এসেছি। সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত সাদামাটা কবর। সালফে সালেহিনদের নমুনা। প্রার্থনা করি আল্লাহ তায়ালা যেন তাকে জান্নাতুল ফিরদাউসের উচ্চতর মাকাম নসিব করেন।

মাওলানা মুহিউদ্দিন খান ছিলেন আমাদের পিতৃতুল্য ও শ্রদ্ধাভাজন অভিভাবক। তিনি যখন ১৯৫৫-৫৬ সালে ঢাকা আলিয়ায় কামিল করছেন তখন আমার জন্ম। আমৃত্যু তার সাথে আমার গভীর, আন্তরিক ও গুরু-শিষ্য সম্পর্কে ছেদ পড়েনি। তিনি আমাকে স্নেহ করতেন, মুহাব্বত করতেন। ঢাকার বিভিন্ন জাতীয় প্রোগ্রামে আমাকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করতেন কিন্তু অনেক দূরে চট্টগ্রাম শহরে একটি কলেজে শিক্ষকতার কাজে যুক্ত থাকায় সব প্রোগ্রামে শরিক হতে ঢাকা যেতে পারিনি। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে বেশ কয়বছর আগে তাঁরই নেতৃত্বে আমি আলিম-ওলামার একটি ডেলিগশনের সদস্য হিসেবে সচিবালয়ে শিক্ষামন্ত্রীর সাথে জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে আলোচনায় অংশ নেয়ার সুযোগ লাভ করি। তার সম্পাদনায় প্রকাশিত সিরাত স্মারকে আমার বেশ কয়টি লেখাও প্রকাশিত হয়েছে। তার আগ্রহ ছিল আমার লেখা যেন স্মারকে থাকে।

২০১২ সালে এক বিকেলে তাঁর সাথে মদিনা ভবনে সাক্ষাৎ করি। আমি তাকে বলি খতিবে আযম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ (রহ.)-এর জীবন ও কর্মসাধনার ওপর একটি প্রামাণিক স্মারক প্রকাশের কাজ হাতে নিয়েছি; আপনার লেখা চাই। ইতোপূর্বে লেখা চেয়ে আমি চিঠি লিখেছিলাম কিন্তু অত্যধিক ব্যস্ততার কারণে তিনি কলম ধরতে পারেননি। পুরনো পল্টনের মদিনা ভবনে এলে তাকে সাক্ষাৎপ্রার্থীরা ঘিরে ধরেন নানা কাজে। আমি আবদার করে বললাম আগামীকাল বিকেলে আসব এক ঘণ্টার জন্য কক্ষ বন্ধ করে রাখব, আপনি বলবেন আমি লিখব। বাইরে দারোয়ান দাঁড়িয়ে থাকবে। প্রোগ্রাম অনুযায়ী আমি যথাসময়ে অফিসে পৌঁছে দরজা বন্ধ করে দিই। তিনি বলছেন আমি লিখছি। এক সময় লেখা যখন শেষ হয়ে গেল আমি তাকে বললাম লেখাটি সম্পাদনা করে আপনাকে কখন দেখাব? তিনি যে উত্তর দিলেন তা অবাক করার মতো। ‘দেখাতে হবে না। আপনার লেখাই আমার লেখা। আপনার লেখার প্রতি আমার আস্থা আছে। জাতীয় দৈনিকে বিশেষত দৈনিক ইনকিলাব ও আমার দেশে আপনার যেসব লেখা প্রকাশিত হয় আমি অত্যন্ত আগ্রহভরে পড়ি। আমার পরে তো আপনারাই।’ মাওলানা মুহিউদ্দিন খান সাহেবের সে দিনের উক্তি চিরকাল আমার মনে থাকবে। খতিবে আযম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ (রহ.)-এর স্মৃতি উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি তার লেখায় যে মন্তব্য করেন তা পাঠকদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করছি, যা এখনো প্রাসঙ্গিক :

‘আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে আল্লামা শিবলী নুমানী বিরচিত আল-ফারুক যখন আমি উর্দু হতে বাংলায় তরজমা করে ছাপার অক্ষরে বের করি, তা দেখে তিনি (খতিবে আযম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ রহ:) অত্যন্ত খুশি হন। আমাকে খবর দিয়ে এনে মিষ্টিমুখ করান। আসার সময় আমার পকেটে ২০ টাকা গুঁজে দিয়ে বলেন, অতিরিক্ত টাকা থাকলে এক হাজার দিতাম। দুআ করি, কাজ করে যাও। তখনকার সময় আলিম-ওলামার মধ্যে উর্দু চর্চার প্রচলন ছিল বেশি। করাচি ও লাহোর হতে যেসব উর্দু পত্রিকা আসতো আমরা তাই আগ্রহভরে পড়তাম। বাংলা ভাষায় উন্নত মাসিক পত্রিকা ছিল একেবারে হাতেগোনা। আমি যখন মাসিক মদিনা বের করি। তিনি আমার এ চ্যালেঞ্জিং উদ্যোগ দেখে আমার জন্য বিশেষভাবে দু‘আ করেন, আজো আমি তার দুআর বরকত অনুভব করি।

এমন একসময় ছিল যখন মাওলানা আকরাম খাঁ (রহ:), মাওলানা নুর আহমদ আযমী (রহ:), মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ:), মুফতি দীন মুহাম্মদ (রহ:), আল্লামা রাগিব হাসান (রহ:), মুফতি আমিমুল ইহসান (রহ:), মাওলানা আবদুল্লাহ আল-কাফী আল-কুরায়শী (রহ:), মাওলানা আতাহার আলী (রহ:), মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ (রহ:), খতিব মাওলানা ওবায়দুল হক (রহ:)-এর মতো প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্বের স্নেহ ছায়ায় আমরা ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেছি। আজ এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তাদের তুল্য কোনো মানুষ চোখে পড়ে না; একটু পরামর্শ নেবো, একটু আশ্রয় নেবো, দিকনির্দেশনা খুঁজব, সে মানুষ নেই। বর্তমানে আত্মার খোরাকের দারুণ অনটন। এমন আলিমের অভাব রয়েছে যার সাথে আলোচনা করে যেকোনো জিজ্ঞাসার শান্তিপূর্ণ ও যুক্তিনির্ভর জবাব পাওয়া যায়। পরিশেষে বলতে চাই আমরা আসলে সৌভাগ্যবান ছিলাম কিন্তু সৌভাগ্যকে মূল্য দেবার বোধশক্তি আমাদের হয়নি। বর্তমানে ইসলামী আন্দোলনের সতীর্থদের মধ্যে পারস্পরিক মুহাব্বত ও সহমর্মিতার অভাব আমাদের পীড়িত করে।’

মাওলানা মুহিউদ্দিন খান রহ:-এর মৃত্যুর পর একই কথা আমাদের বেলায়ও খাটে। তার মতো বটবৃক্ষসম ব্যক্তিত্ব আর চোখে পড়ে না, যার ছায়ায় একটু আশ্রয় নেবো। মাওলানা মুহিউদ্দিন খান রহ: বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে স্থায়ী কাজ করে গেছেন। শতাধিক গ্রন্থ তিনি উর্দু থেকে বাংলায় ভাষান্তরিত করেন। এর মধ্যে তাফসির সিরাতে রাসূল ও ইতিহাসনির্ভর গ্রন্থ সবচেয়ে বেশি। আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ শফী (রহ:) বিরচিত আট খণ্ডের কালজয়ী তাফসিরগ্রন্থ মা‘আরিফুল কুরআন তিনি উর্দু থেকে বাংলায় ভাষান্তর করেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে এটি প্রকাশিত হয়। ১৪১৩ হিজরিতে মদিনাস্থ বাদশাহ ফাহদ কুরআন মুদ্রণ প্রকল্পের উদ্যোগে মা‘আরিফুল কুরআন সংক্ষিপ্তাকারে ১ খণ্ডে বাংলায় ছেপে সারা দুনিয়ায় বাংলাভাষীর মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। ইমাম গাযালী রহ:-এর ইহয়াইয়াউ উলুমিদ্দীন ও মাওলানা আবুল কালাম আযাদের ইনসানিয়ত মওত কে দরওয়াযে পর (জীবন সায়াহ্নে মানবতার রূপ) গ্রন্থের সার্থক অনুবাদক মাওলানা মুহিউদ্দিন খান রহ:। তার প্রতিষ্ঠিত মদিনা পাবলিকেশন্স ১৯৫৭ সাল হতে এ পর্যন্ত কুরআন-হাদিস, সীরাতে রাসূল, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অভিধান বিষয়ক ৬০০ মানসম্মত গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। এসব গ্রন্থ বাংলাদেশে এবং বিদেশের বাজারে ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। মাসিক মদিনা মাওলানা মুহিউদ্দিন খান রহ:-এর জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। একসময় এর সার্কুলেশন এক লাখে পৌঁছে। এ পত্রিকাটির জন্য তিনি অনেক মেহনত করেন। এমনকি মাথায় নিউজপ্রিন্ট বহন করে প্রেসে নিজে পৌঁছে দিতেন। এক কথায় তিনি বিজ্ঞ অনুবাদক, প্রাজ্ঞ সিরাত গবেষক, সার্থক লেখক, দূরদর্শী ইসলামী চিন্তাবিদ, তুখোড় বক্তা ও দক্ষ সংগঠক।

আরেকটি আশ্চর্য বিষয় হলো তিনি কওমি মাদরাসায় না পড়েও দেওবন্দি চিন্তাধারার অনুসারী ছিলেন। সারাটি জীবন দেওবন্দী চিন্তা-চেতনা লালন করেন। দেওবন্দি ওলামা মাশায়েখদের লিখিত গ্রন্থ বাংলায় তরজমা করেন। দেওবন্দি ধারার সংগঠন জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের সাবেক মুহতামিম আল্লামা কারী তাইয়েব (রহ.) মাসলাকে ওলামায়ে দেওবন্দ গ্রন্থে লিখেন, ‘দরসে নিযামি পড়া ও পড়ানোর নাম দেওবন্দিয়ত নয়, এটি একটি বোধ ও চিন্তাধারার নাম যা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকিদার ওপর প্রতিষ্ঠিত।’ মাওলানা মুহিউদ্দিন খান রহ: তার উজ্জ্বল নিদর্শন। গোটা জীবন কওমি মাদরাসায় পড়েও দেওবন্দি হতে পারেননি এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়।

মাওলানা মুহিউদ্দিন খান রহ:-এর বিদায় আমাদের জন্য বিরাট আঘাত ও প্রচণ্ড শূন্যতা। তার অভাব পূরণ হতে বহুদিন সময় লাগবে। তিনি বেঁচে থাকবেন তার কালজয়ী সাহিত্যকর্মের মধ্যে। বাংলা সাহিত্য অঙ্গন তিনি সমৃদ্ধ করে গেছেন। তিনি যোগ্য সন্তান রেখে গেছেন তার মিশন চালু রাখার জন্য। মাসিক মদিনা ও মদিনা পাবলিকেশন্স আগামী দিনগুলোতে তার স্মৃতি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেবে।

লেখক : অধ্যাপক ও গবেষক
drkhalid09@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement