০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`


বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল একই পক্ষে থাকবে চীন-ভারত!

বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল একই পক্ষে থাকবে চীন-ভারত! - ছবি : নয়া দিগন্ত

ইন্দো-প্যাসিফিকে চীন যুক্তরাষ্ট্রের দ্ব›দ্ব পুরনো। এই অঞ্চলে আমেরিকার সব তৎপরতার কেন্দ্রে রয়েছে চীনকে ঠেকানো । কিন্তু এখানে কী ভারত ও চীন একই অবস্থানে থাকতে পারে, যেখানে ওয়াশিংটন বেইজিংয়ের বিপরীতে দিল্লিকে মিত্র হিসাবে পেতে চাইছে? আর এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলোতে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্বে ভারতের নীতিই বা কী হতে পারে। এই নীতি বাংলাদেশকে কিভাবে কতটা প্রভাবিত করতে পারে? এসব ভূ-রাজনৈতিক প্রশ্ন এখন আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশে শাসনের ধারাবাহিকতা বা পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও।

ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে বাংলাদেশ ঠিক কী অবস্থান নিয়েছে তা এখনো স্পষ্ট নয়। কখনও মনে হয় দেশটি এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বানে সাড়া দিয়েছে। আবার কখনও মনে হয়, ঢাকা নিরপেক্ষতার অজুহাত দেখিয়ে চীনের সাথেই ঘনিষ্ঠতা বজায় রাখছে। ঢাকার এই দোদুল্যমানতা আমেরিকান ফরেন পলিসি সাময়িকীর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও ফুটে উঠেছে। তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পশ্চিমের ইন্দো-প্যাসিফিক নীতিতে যুক্ত হচ্ছে। আর এ ক্ষেত্রে প্রভাবিত করছে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের কৌশলগত মিত্র ভারত। ভারতকে এ ক্ষেত্রে প্রভাবিত করায় ভ‚মিকা রাখছে জাপান। দুটি দেশ চীনবিরোধী জোট হিসাবে পরিচিত কোয়াডের অভিন্ন অংশীদার। তবে চূড়ান্তভাবে যুক্তরাষ্ট্র এখনো আস্থাশীল নয় ঢাকা কোন দিকে ঝুঁকবে, যেখানে চীন বাংলাদেশকে তার বলয়ে রাখার ক্ষেত্রে মরিয়া। এই প্রচেষ্টা তার নিরাপত্তার গভীর উদ্বেগ থেকে উৎসারিত বলে তাতে বেইজিং কতটা আপস করবে- যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। মাইকেল কুগেলম্যানের ফরেন পলিসির নিবন্ধেও তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

রহস্যে ঘেরা চীন ভারত সম্পর্ক ও ঢাকায় স্বার্থ
চীন ভারত সম্পর্ক এখনো নানা রহস্যে ঘেরা। মাঝে মধ্যে চাঙ্গা হয়ে ওঠা বহু দশকের গভীর সীমান্ত বিরোধে দু’দেশের কৌশলগত সহযোগিতার বিষয় কল্পনা করা কঠিন। কিন্তু এই দুই দেশই ব্রিকস, নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও হংকং সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার মতো জোটে শীর্ষ সহযোগী দুই প্রতিবেশী দেশ। আবার এই দুটি দেশ সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক ও বিনিয়োগ অংশীদারও। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো মোদির কৌশলগত ও ব্যক্তিগত সহযোগী হিসেবে পরিচিত আদানির বিশাল সম্পদরাজির বিনিয়োগের বড় অংশই এসেছে চীন থেকে। আর আদানির অর্থানুকূল্যে মোদি বিজেপির নির্বাচনী বৈতরণী পার হচ্ছেন বার বার। এই গোপন সম্পর্ক চীন ভারতের উত্তেজনাকে কখনোই বিস্ফোরণ পর্যায়ে যেতে দেয় না, যদিও পশ্চিমা দেশগুলো সঙ্ঘাত উসকে দিতে চেয়েছে।

অন্য দিকে মিয়ানমারের মতো একাধিক ক্ষেত্রে দুটি দেশ অভিন্ন পক্ষে থেকে ভূমিকা পালন করেছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ছিল বিপরীত অবস্থান। বাংলাদেশে কী হতে পারে বেইজিং নয়াদিল্লির ভূমিকা? এখানে কি একই সমান্তরালে কৌশলগত স্বার্থ মিলিত হয়ে শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতা প্রলম্বিত করতে সহায়তা করবে নাকি জাপানি প্রধানমন্ত্রী কিসিদার সাম্প্রতিক নয়াদিল্লি সফরে ভারতকে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের সহযোগী হিসেবে পাওয়ার বিষয়টি সামনে দেখা যাবে?

আসলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে স্বার্থের মিলনই সহযোগিতাকে একই সমান্তরালে প্রবাহিত করে। কোনো সম্পর্কই নিরঙ্কুশভাবে একমুখী হয় না। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে সত্য। এই সম্পর্কে নেতিবাচক উপাদান হিসেবে যুক্ত রয়েছে রাশিয়া। এই দেশটি স্নায়ুযুদ্ধের পুরো সময়জুড়েই ছিল ভারতের কৌশলগত ছায়ার মতো। এখনো ভারতের প্রতিরক্ষা শিল্পে রয়েছে রাশিয়ার প্রযুক্তি ও সহযোগিতার ছায়া। ইউক্রেন যুদ্ধের পর এই ছায়া নানা সমীকরণে আরো জটিলভাবে বিস্তৃত হয়েছে। অন্য দিকে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রতিবেশী সম্পর্কের একমাত্র উপাদান চীন-বৈরিতা নয়। এখানে প্রতিটি প্রতিবেশী দেশের সাথে ভারতের সম্পর্কের নিজস্ব সমীকরণ রয়েছে। সেই সমীকরণ কতটা কিভাবে বাংলাদেশ সম্পর্ককে প্রভাবিত করবে সেটিই বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে এ সময়ে।

ইন্দো-প্যাসিফিক প্রশ্ন
ইন্দো-প্যাসিফিক একটি বিশাল ভৌগোলিক অঞ্চল যা ভারত মহাসাগর এবং পশ্চিম ও মধ্য প্রশান্ত মহাসাগরকে ঘিরে রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ওশেনিয়ার অনেকগুলো সমুদ্র। ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শব্দটি কেবলই ২০১০ এর দশকের শেষের দিকে ভূ-রাজনীতির অভিধানে উপস্থিত হতে শুরু করে। পরলোকগত জাপানি প্রধানমন্ত্রী আবে শিনজো প্রথম ২০০৭ সালের মাঝামাঝি ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরের মিলনের কথা উল্লেখ করেছিলেন এবং ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’-এর আনুষ্ঠানিক ব্যবহার প্রথম ২০১৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষা শ্বেতপত্রে প্রকাশিত হয়। তার পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আসিয়ান সবাই ইন্দো-প্যাসিফিকের জন্য তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি এবং কৌশল প্রকাশ করেছে।

এশিয়ার ‘ইন্দো-প্রশান্তকরণ’ দুটি উপায়ে প্রকাশ পায়- প্রথমত, এই স্বীকৃতি যে ভারতকে আর এশিয়ান কৌশলগত ব্যবস্থা থেকে বাদ দেয়া যাবে না; দ্বিতীয়ত, আঞ্চলিক শৃঙ্খলা তৈরির জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী দৃষ্টিভঙ্গির উত্থান। ইন্ডিয়া ফ্যাক্টর হলো সবচেয়ে স্বজ্ঞাত, যা ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’-এ ‘ইন্দো’-এর প্রতিনিধিত্ব করে, কিন্তু এর অর্থ হলো আরো সক্রিয় ভারত, সেই সাথে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরকে এক কৌশলগত ব্যবস্থায় একীভূত করা।

ভারত একটি ক্রমবর্ধমান শক্তি, যা অভ্যন্তরীণভাবে ক্রমবর্ধমান ছাড়াও একটি সক্রিয় বৈদেশিক নীতি সংস্কৃতিও এর রয়েছে। ভারতের ‘অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি’, ‘লুক ইস্ট পলিসি’র উত্তরসূরি, যেটি ইন্দো-প্যাসিফিকের দেশগুলোর সাথে বিস্তৃত অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য নয়াদিল্লির একটি প্রচেষ্টা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ভারত-জাপান কৌশলগত অংশীদারিত্বের সাথে উভয় দেশের নিয়মিত নৌ মহড়া, রাজনৈতিক আদান-প্রদান এবং সামরিক-সামরিক যোগাযোগ জড়িত। এ সমীকরণে টোকিও এই অঞ্চলের নিরাপত্তা স্থাপত্যের একটি অপরিহার্য অংশীদার হয়ে উঠেছে।

মার্কিন-চীন সম্পর্কের বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, এটা যৌক্তিক বলে মনে হবে যে, যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ধারণ করার জন্য ভারতের অন্তর্ভুক্তিকে স্বাগত জানাবে, যা চতুর্পাক্ষিক নিরাপত্তা সংলাপের (কোয়াড) মতো ক্ষুদ্রতর ব্যবস্থায় প্রকাশিত হয়েছে। তবে সবাই বিষয়টিকে এভাবে দেখে না। অনেকের মতে, চীনকে বাদ দেয়ার পরিবর্তে, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল স্বীকার করে যে চীন, ভারতের মতো, এই অঞ্চলে একটি প্রধান ভ‚মিকা পালন করবে। অধ্যাপক রাজেশ রাজাগোপালান যুক্তি দেন যে ভারত একটি ভারসাম্যপূর্ণ ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল অনুসরণ করে, যা বেইজিংকে ভারসাম্য ও আশ্বস্ত করার একটি প্রচেষ্টা। চীনকে ধারণ করার লেন্সের মাধ্যমে ইন্দো-প্যাসিফিককে দেখার পরিবর্তে, ২০১৮ সালের শাংরি-লা সংলাপে মোদি তার বক্তৃতায় দাবি করেছেন যে, ভারত ইন্দো-প্যাসিফিককে কারো বিরুদ্ধে নির্দেশিত হিসাবে দেখতে চায় না এবং এটি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আধিপত্য বিস্তারের জায়গা হওয়া উচিত নয়।

ভারতের সক্রিয় অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরের সম্মিলনকে প্রতিফলিত করে। মালাক্কা প্রণালী দিয়ে যে বৈশ্বিক বাণিজ্য চলে তাও বিশাল ভারত মহাসাগরের মধ্য দিয়ে যায়। চীনা এবং জাপানি দৃষ্টিকোণ থেকে, জ্বালানি আমদানির জন্য যোগাযোগের সমুদ্র লাইনের (এসএলওসি) উপর তাদের অত্যধিক নির্ভরতার অর্থ হলো যে তাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা তাদের বাণিজ্য এবং নৌ প্রবেশাধিকারের পাশাপাশি ভারত মহাসাগরের ওপরও নির্ভর করে। ভারত মহাসাগরে চীনের আগ্রহ তার স্ট্রিং অফ পার্লস কৌশল দ্বারা প্রদর্শিত হয়।

প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি-এফওআইপি ও বিআরআই
যেভাবে এশিয়ার ‘ইন্দো-প্রশান্তকরণ’ উদ্ভাসিত হয় তা আঞ্চলিক ব্যবস্থা বিনির্মাণের প্রতিদ্বন্দ্বী দৃষ্টিভঙ্গির উত্থানে দেখা যায়। ইন্দো-প্যাসিফিক কনস্ট্রাক্ট আঞ্চলিক ব্যবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত প্রাসঙ্গিকতার ভিত্তি তৈরি করে। স্নায়ুযুদ্ধ এবং একমেরুর সময় যা এশিয়ার নিরাপত্তা স্থাপত্যকে আচ্ছন্ন করেছে তা আজও বিদ্যমান। তবে, মার্কিন-চীন কৌশলগত প্রতিযোগিতায় যে চ্যালেঞ্জগুলো আবির্ভূত হয়েছে তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তার স্বার্থকে বৈধতা দেয়ার জন্য আরো কিছু প্রস্তাব করতে হবে। এটি ফ্রি অ্যান্ড ওপেন ইন্দো-প্যাসিফিক (এফওআইপি) আকারে এসেছে, যা জাপানের ২০১৬ এফওআইপি ধারণা থেকে উদ্ভূত একটি কৌশল। এফওআইপি হলো একটি স্থিতাবস্থা-ভিত্তিক কৌশল যা আইনের শাসন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সমুদ্রপথে সংযোগ এবং শান্তি ও স্থিতিশীলতার উন্নয়ন করে। তবে, অনেক আঞ্চলিক অভিনেতা এফওআইপি-এর নিজস্ব ব্যাখ্যা প্রকাশ করেছে।

এর বিপরীতে, মার্কিন এফওআইপি-এ নিরাপত্তা জোট এবং অংশীদারিত্বের উপর বেশি জোর দেয়া হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো তার ঐতিহ্যবাহী মিত্রদের দেয়া একটি বৃহত্তর কৌশলগত ভার, সেই সাথে ভারত এবং আসিয়ান-এর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলা। অধিকন্তু, ২০২২ ইউএস রিপোর্ট স্পষ্টভাবে চীনকে তার জবরদস্তিমূলক আচরণ বন্ধের জন্য আহ্বান জানানোর বিষয় রয়েছে এবং দেশটি আধিপত্যবাদী উচ্চাকাক্সক্ষার অধিকারী বলে অভিযোগ করেছে। ইউএস ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল চীনের সাথে আরো অগ্রসর কৌশলগত প্রতিযোগিতার মঞ্চ তৈরি করে।

চীন ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ শব্দটি ব্যবহার করা থেকে বিরত রয়েছে কারণ তারা বিশ্বাস করে যে এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তার উত্থান রোধ করার একটি চক্রান্ত। এটি এমন ধারণা তৈরি করতে পারে যে চীনের একটি ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল নেই, যদিও বিআরআই হলো চীনের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল। চীনের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত বৈশ্বিক অবকাঠামো উন্নয়ন কৌশল দেশটির পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। যদিও অর্থনৈতিক প্রকৃতির এই প্রকল্পটির ভ‚-রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে। প্রফেসর লি মিংজিয়াং বলেছেন যে, বিআরআই তার বিদেশী বিনিয়োগ রক্ষার জন্য চীনের নিরাপত্তা নীতির পরিবর্তন করবে। ওয়েই লিং যুক্তি দেন যে, বিআরআই অ-হস্তক্ষেপের মতো চীনা নিয়ম ও মূল্যবোধকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তার মতে, বিআরআই হলো বস্তুগত এবং আদর্শগতভাবে চীনা শক্তি প্রক্ষেপণের একটি মাধ্যম।

বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন যে বিআরআই হলো ‘চীনা বৈশিষ্ট্যসহ ইন্দো-প্যাসিফিক’ কৌশল। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে অর্থনীতি এবং নিরাপত্তা জড়িত যার তাৎপর্যপূর্ণ ক‚টনৈতিক এবং আদর্শিক প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এর ব্যাপক প্রকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে, বিআরআইকে আঞ্চলিক ব্যবস্থা তৈরির জন্য একটি দৃষ্টিভঙ্গি হিসাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। এফওআইপি-এর সাথে একত্রে, এই আঞ্চলিক ব্যবস্থাগুলো ঐতিহ্যগত নিরাপত্তার বাইরে এবং সামাজিক অগ্রগতির সমৃদ্ধি ও মূল্যবোধের দিকে যায়। ইন্দো-প্যাসিফিক নির্মাণ এই দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, এই অর্থে যে এটি দুটি মহাসাগরের ভাগ্যকে আন্তঃসংযোগ করে এবং দেশগুলোর অর্থনৈতিক-নিরাপত্তা-ক‚টনৈতিক সংযোগ বোঝার জন্য কাঠামো প্রদান করে।

ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে বাংলাদেশের অবস্থান
এই দুই প্রতিপক্ষ ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে বাংলাদেশের অবস্থান কী। বাংলাদেশ আগেই চীনের বিআরআইতে যুক্ত হয়েছে, ভারত যেটি করেনি। এখন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা বাংলাদেশকে তাদের ইন্দো-প্যাসিফিকে যোগ দিতে বলছে। ঢাকা এ বিষয়ে পরিষ্কার কিছু বলেনি। তবে চীনা রাষ্ট্রদূত সম্প্রতি এই আহ্বানে সাড়া না দেবার জন্য ঢাকাকে অভিনন্দিত করেছেন। একই রকম অভিনন্দন এর আগে মস্কোও করেছে। আমেরিকান দক্ষিণ এশীয় বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলম্যান লিখেছেন, এই দেশগুলো কেন বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে অংশ হতে বলছে তা বোঝা বেশ সহজ। বাংলাদেশ ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে অবস্থিত, ভারতের সীমান্তবর্তী হওয়া ছাড়াও এই দেশটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রবেশদ্বার হিসেবেই কাজ করে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঢাকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। আবার অনেক ইউরোপীয় দেশের সঙ্গেও বাংলাদেশের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ। এই দুই বাস্তবতার কারণে বাংলাদেশ সবার কাছেই ভালো অংশীদার।

অন্য দিকে চীন অবকাঠামোগত ঋণের মাধ্যমে বাংলাদেশে তার নিজস্ব প্রভাব বাড়িয়েছে। তবে চীনের এই ঋণকে মার্কিন কর্মকর্তারা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় ঢাকার জন্য খারাপ চুক্তি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া ভারত মহাসাগর অঞ্চলের পশ্চিমাঞ্চলে জিবুতিতে অবস্থিত চীনের সামরিক ঘাঁটিসহ দেশটির বর্ধিত নৌ উপস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন চীনের প্রতিদ্ব›দ্বীরা। মূলত এসবই বাংলাদেশের সামুদ্রিক এলাকার কাছাকাছি অবস্থিত। এ ছাড়া চীন বাংলাদেশের অস্ত্রের বড় সরবরাহকারীও। তাই যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক ভিশনে বাংলাদেশের যোগদান হবে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের কৌশলগত বিজয়।

আরো একটি কৌতূহলী প্রশ্ন হলো- বাংলাদেশ কেন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল এবং চীনকে মোকাবেলার বিষয়ে পশ্চিমাদের লক্ষ্যের সঙ্গে যুক্ত হতে চাইবে। যুক্তরাষ্ট্রের এ কৌশলে অংশগ্রহণ বাংলাদেশকে ওয়াশিংটনের প্রধান বাণিজ্য ও বিনিয়োগ অংশীদার হওয়ার কাছাকাছি নিয়ে যাবে। বাংলাদেশ ও ভারতের বর্তমান সরকার বেশ ঘনিষ্ঠ এবং নয়াদিল্লি সম্ভবত ঢাকাকে এই কৌশলটি গ্রহণ করতে উৎসাহিত করেছে। তবে বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলকে গ্রহণ করলেও একই সঙ্গে চীনকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। ঢাকার নিজস্ব ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক খসড়ায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা এড়াতে চায় এবং ঢাকার কোনো নিরাপত্তা লক্ষ্য নেই। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নিজস্ব ইন্দো-প্যাসিফিক খসড়াকে ‘নীতি’ বা ‘কৌশল’ না বলে এটিকে একটি আউটলুক বা ‘দৃষ্টিভঙ্গি’ বলার একটি নমনীয় অর্থ রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ এমন ইঙ্গিত এখনো দেয়নি যে দেশটি চীনের প্রতিদ্ব›দ্বী চার দেশীয় জোট কোয়াডে যোগ দেবে। তবে এর পরও চীন উদ্বিগ্ন বলে মনে হচ্ছে। গত সপ্তাহে, বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে ঢাকাকে মার্কিন শিবিরে টেনে নেয়ার চেষ্টার অভিযোগ তোলেন।

তাই চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার জন্য বাংলাদেশ অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল থেকে সরে আসতে পারে। এ ছাড়া ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠু না হলে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক খারাপ হতে পারে। ২০২১ সালের শেষের দিকে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‌্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।

কুগেলম্যান বলেছেন, বাংলাদেশে সন্ত্রাস দমনের প্রচেষ্টার সফলতা দেখতে যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ় আগ্রহ রয়েছে। তবে একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র শক্তিশালী এই বার্তাও পাঠাতে চায় যে বাংলাদেশে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের বিষয়ে ওয়াশিংটন বেশ উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশে জঙ্গি হুমকির অজুহাতে সরকারবিরোধী দলকে নতুন করে দমনপীড়ন চালাতে পারে। এটি ওয়াশিংটন মেনে নিতে তৈরি নয়।

প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান ও রিপোর্টার শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার বিষয়ে যে প্রতিক্রিয়া যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো থেকে এসেছে তাতে স্পষ্ট হয় যে কুগেলম্যান ঢাকার চীনমুখী হবার ব্যাপারে যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে তা বাস্তবে ঘটলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা বসে থাকবে না। নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞার চাপও আসতে পারে। ঢাকার জন্য স্থিতি বজায় রাখতে হলে দু’পক্ষের চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। বঙ্গোপসাগর এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত চাহিদা পূরণ এবং মুক্ত অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আহ্বানে সাড়া না এলে যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগতভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলার পদক্ষেপ নিতে পারে। এই পদক্ষেপ এমন হতে পারে যাতে একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং মিয়ানমার প্রশ্নে চীনের অনুগামী হয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ অসম্ভব হয়ে দাঁড়াতে পারে। প্রথম আলো ইস্যুতে এর একটি নমুনা দেখা গেছে বলে মনে হয়েছে।

ঢাকায় প্রভাব বিস্তারের এই সঙ্ঘাতে মুখ্য খেলোয়াড় এখন বেইজিং ও ওয়াশিংটন। কিশিদার বক্তব্যে এই প্রতিযোগিতায় দিল্লি বেইজিংয়ের বিপরীত দিকে থাকবে বলে ধারণা প্রকাশ করা হলেও মোদির সাথে শি’র গোপন কোনো বোঝাপড়ায় অন্য কিছুও ঘটাতে পারে। আর একই পক্ষে দিল্লি-বেইজিং থাকলে ওয়াশিংটনের জন্য এখানে কৌশলগত বিজয়ের মূল্য অনেক বড় হতে পারে।
mrkmmb@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
নারী কর্মীকে শ্লীলতাহানির অভিযোগ : যা বললেন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল মিয়ানমারের পুরুষদের বিদেশে কাজের আবেদন নিষিদ্ধ করল জান্তা সরকার তানজিদ-সাইফুদ্দীনকে নিয়ে মাঠে নেমেছে বাংলাদেশ অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগে ৭ জন আটক ইসরাইলবিরোধী পোস্টের দায়ে নাগরিকদের আটক করছে সৌদি পোরশায় পুলিশ সুপারের বাড়িতে চুরি প্রকৃতিকে প্রতিনিয়ত ধ্বংস করছে সরকারি দলের লুটেরা-ভূমিদস্যুরা : রিজভী টিএইচই এশিয়া ইউনিভার্সিটি র‌্যাঙ্কিংয়ে দেশে ২য় বাকৃবি সৌদি-ইসরাইল সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের দ্বারপ্রান্তে : যুক্তরাষ্ট্র হাটহাজারী উপজেলায় শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছেন আবুল বাশার ‘এতে মজা আছে নাকি, সবাই একদল আমরা’

সকল