১৭ মে ২০২৪, ০৩ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৮ জিলকদ ১৪৪৫
`


স্মৃতির পটে খন্দকার মাহবুব হোসেন

খন্দকার মাহবুব হোসেনের ছবি। - ছবি : সংগৃহীত

বিভিন্ন সামাজিক ও খেটেখাওয়া শ্রমজীবী মানুষের সংগঠন করে আসছি কলেজ জীবন থেকেই। তন্মধ্যে নারায়ণগঞ্জ অন্ধ কল্যাণ সমিতি ছিল আমার অন্যতম প্রিয় সংগঠন। বধির প্রতিবন্ধী ও অন্ধ প্রতিবন্ধীদের কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য ইতোপূর্বে নারায়ণগঞ্জে কোনো প্লাটফর্ম ছিল না। ১৯৮০-৮১ সালে বধির ও অন্ধদের জন্য আলাদা দু’টি সংগঠন করার জন্য বধির ও অন্ধদের সংগঠিত করা শুরু করি। নারায়ণগঞ্জের উভয় প্রতিবন্ধী গ্রুপ বিষয়টিকে লুফে নিলো এবং নারায়ণগঞ্জ বধির সংঘ ও নারায়ণগঞ্জ অন্ধ কল্যাণ সমিতি নামে পৃথক দু’টি সংগঠন জন্ম লাভের পাশাপাশি তাদের কল্যাণ ও অধিকার আদায়ের বিষয়ে সংগঠন দু’টি বেশ তৎপরতা শুরু করেছিল।

নারায়ণগঞ্জ অন্ধ কল্যাণ সমিতি করার পর বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধ কল্যাণ সমিতির জাতীয় কার্যকরী পরিষদের অনুমোদন লাভের জন্য সমিতির কেন্দ্রীয় অফিসে যোগাযোগ শুরু করলে খন্দকার মাহবুব হোসেনের সাথে পরিচয় ও পরবর্তীতে ঘনিষ্ঠতা লাভ করি। স্বাধীনতার পর বকশীবাজারে তিনি জাতীয় অন্ধ কল্যাণ সমিতির (বিএনএসবি নামে পরিচিত) প্রতিষ্ঠা করেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। মৃত্যু পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহত আইভী রহমান। ১৯৮৭ সালে নারায়ণগঞ্জের গরিব মানুষের চোখের ছানি কাটানোর জন্য স্থানীয় বেগম রোকেয়া খন্দকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাত দিনব্যাপী চক্ষুশিবির চালু করি। তারা দু’জনেই আমার বাড়িসহ বেগম রোকেয়া খন্দকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থাপিত চক্ষুশিবির পরিদর্শন করে চক্ষুশিবিরের খরচাদি নির্বাহ করার জন্য তৎসময়ে ২০ হাজার টাকা অনুদান দেন।

১৯৯০ সালে খন্দকার স্যার আমাকে জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মনোনীত করেন এবং দীর্ঘদিন ওই পদে অধিষ্ঠিত ছিলাম। বিএনএসবির অনুমোদিত বিভিন্ন জেলায় অবস্থিত চক্ষু হাসপাতাল পরিদর্শনে তিনি আমাকে পাঠিয়েছেন। সরকার থেকে জমি লিজ পাওয়ার পর সমিতির প্রধান কার্যালয়েই (মিরপুর ১ নম্বর) স্থাপন করেছেন অত্যাধুনিক চক্ষু হাসপাতাল, যাকে পরবর্তী সময়ে কৃতজ্ঞাস্বরূপ আমাদের সবার উদ্যোগে ‘খন্দকার মাহবুব হোসেন চক্ষু হাসপাতাল’ নামকরণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে তিনি আমাকে ভাইস চেয়ারম্যান মনোনীত করেন এবং বিগত কয়েক টার্ম ধরে এ পদে অধিষ্ঠিত থেকে খন্দকার স্যারের বদান্যতায় জাতীয়ভাবে দেশব্যাপী অন্ধ সমাজের সেবা করার সুযোগ পাচ্ছি। এ জন্য তিনি কৃতজ্ঞতাবোধে আবদ্ধ করেছেন।

নারায়ণগঞ্জ অন্ধ কল্যাণ সমিতির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে খন্দকার স্যার প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করেছেন, বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠানে সস্ত্রীক আমার নারায়ণগঞ্জের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে আমার মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন এবং সপরিবারে আমি খন্দকার স্যার ও তার পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞ। খন্দকার স্যারের স্ত্রী অধ্যাপিকা ফরহাত হোসেন বিএনএসবির অন্যতম ভাইস চেয়ারম্যান হওয়ায় তাকে অনেক কাছ থেকে দেখা ও জানার সুযোগ হয়েছে। তিনি অধ্যাপক ছাড়াও একজন গবেষক ও আইনজীবী। রবীন্দ্র সঙ্গীতে পারদর্শী বহুবিধ প্রতিভার অধিকারী। তার গবেষণালব্ধ ÔInternational Human Rights: Perspective of Bangladesh থিসিসটি বিচারক, আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীদের সহায়ক হিসেবে কাজ করবে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, অধ্যাপিকা মহোদয়ের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে খন্দকার স্যারের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলো আরো দৃঢ়তা লাভ করবে।

খন্দকার স্যার ও আমি একই দলের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম। তিনি প্রথমে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও পরবর্তীতে নির্বাচিত হয়েছেন জাতীয় নির্বাহী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান। দলের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করলেও সর্বশেষ আমি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও জেলা বিএনপির সভাপতির দায়িত্বে ছিলাম। বিএনপি চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কারাবন্দী হলে তার মুক্তির জন্য ‘গণতন্ত্র ও বেগম খালেদা জিয়া মুক্তি আইনজীবী আন্দোলন’ নামে সংগঠনটির মাধ্যমে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি, খন্দকার স্যার ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। ওই সময় বিভিন্ন মানববন্ধন, অবস্থান ধর্মঘট, র‌্যালি, সেমিনার ও বিক্ষোভ মিছিল করে দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করেছেন। ওই সংগঠনটির আমি আহ্বায়ক ও অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম তালুকদার রাজা সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করেন।

ওই আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন অ্যাডভোকেট আবেদ রেজা, এ বি এম ওলিউর রহমান, শাকাওতুল হক, শাহ মো: ফিরুজ, গোলাম মোস্তফা, ড. রফিকুল ইসলাম মেহেদী, শাহ মোহাম্মদ বাদল, আনিছুর রহমান খানা, আনিছ, ব্যারিস্টার নাসিম খান, শহিদুল ইসলাম চাপাই, কামাল আহাম্মদ, মনির হোসেন, ড. শাফিউর রহমান শাফি, গোলাম মোস্তফা, ইকবাল হোসেন, আবুল খয়ের খান, নাসির উদ্দিন খান সম্র্রাট, আ: মতিন মণ্ডল, সাবিনা ইয়াসমিন লিপি, আয়েশা আক্তার, আঞ্জুমান আরা ইয়াসমিন, এম খালেদ, ওলিউর রহমান শুভ, মোক্তার হোসেন, নাহিদ সুলতানা প্রমুখ আইনজীবী নেতা। সুপ্রিম কোর্ট শাখার আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের যথাক্রমে দায়িত্ব পালন করেন সিনিয়র অ্যাডভোকেট গিয়াসউদ্দিন আহাম্মদ ও আইউব আলী আশ্রাফী, ঢাকা বার শাখার আহ্বায়কের দায়িত্বে ছিলেন অ্যাডভোকেট ইসমাইল হোসেন।

খন্দকার স্যারের পৃষ্ঠপোষকতায় ওই আন্দোলনের প্রতিনিধি হিসেবে দেশব্যাপী বিভিন্ন আইনজীবী সমিতিতে স্থানীয় আইনজীবীদের নিয়ে আমরা সমাবেশ করি। শেষে জাতীয় প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি আইনজীবীদের প্রথম ও একমাত্র জাতীয় সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন তিনি। আমার সভাপতিত্বে ওই আইনজীবী সমাবেশে বক্তব্য রেখেছেন ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার মাহাবুব উদ্দিন খোকন, মাসুদ তালুকদার, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, ব্যারিস্টার কায়সার কামালসহ বরেণ্য আইনজীবী ও জেলা আইনজীবী সমিতির প্রতিনিধিরা। পরবর্তী সময়ে খন্দকার স্যার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের আহ্বায়ক মনোনীত হয়েছিলেন। কিন্তু দু’-একজন ছাড়া দেশনেত্রী খালেদা জিয়া মুক্তি আন্দোলনে যারা সক্রিয় ছিলেন, তারা পরে আর জায়গা পাননি। খন্দকার স্যারের সহযোগিতায় দেশনেত্রী খালেদা জিয়া মুক্তি আইনজীবী আন্দোলনের আমরা ১০০টি কর্মসূচি পালন করি।

আইনজীবী বিশেষ করে ফৌজদারি আইনজ্ঞ হিসেবে তার মেধা ও প্রজ্ঞা ছিল অতুলনীয়। ফৌজদারি কার্যবিধি ও দণ্ডবিধির ওপর বিভিন্ন রেফারেন্স সম্বলিত দু’টি বই প্রকাশ করেন যা আইন পেশায় সহায়ক পুস্তিকা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। একজন সফল আইনজীবী, একজন সফল রাজনীতিবিদ ও পরীক্ষিত সমাজসেবক, পৃথিবীর সবচেয়ে অবহেলিত মানুষ- যারা অন্ধ হওয়ায় পৃথিবীর সৌন্দর্য ভোগ করতে পারে না, তাদের সেবা ও দৃষ্টিদানের জন্য আজীবন আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। তিনি আমাদের বলতেন, ‘চোখ বন্ধ করে দেখো পৃথিবীতে তুমি কত বড় অসহায়। তাই আজীবন দুঃখী এ মানুষের পাশে দৃঢ়তার সাথে দাঁড়াবে।’ তার জীবদ্দশায় গত ১৭ ডিসেম্বর বিএনএসবির জাতীয় কার্যকরী পরিষদের সর্বশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়। গুরুতর অসুস্থতার কারণে খন্দকার স্যার সভায় উপস্থিত হতে পারেননি, কিন্তু ইন্টারনেট মোবাইলের মাধ্যমে উপস্থিত প্রত্যেক সদস্যের সাথে কথা বলে দিকনির্দেশনা দেন। আমার সাথেও কথা বলেন, যা শেষ স্মৃতি হয়ে থাকবে। সরকারি-বেসরকারি, স্বেচ্ছাসেবী, ধর্মীয় অনেক প্রতিষ্ঠানে আমি নিজেও সভাপতিত্ব করেছি এবং দেশ-বিদেশে অনেক জাতীয় মান্যবর ব্যক্তির সভাপতিত্বে সভায় অংশগ্রহণ করেছি। সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার দীর্ঘ সময় পরে হওয়ার পর সভায় গৃহীত রেজ্যুলেশন সভাপতির স্বাক্ষরের পর প্রকাশিত হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে খন্দকার স্যারের অবস্থান ছিল অনন্য ও ব্যতিক্রম। সভার সিদ্ধান্তগুলো তিনি নিজেই তৎক্ষণাৎ ডিকটেশন দিতেন, রেজ্যুলেশন সাথে সাথে টাইপ হতো এবং স্বাক্ষর করতেন। তার এ ব্যতিক্রম কর্মটি একজন কর্মপ্রিয় নেতাকর্মীর জন্য অবশ্যই অনুকরণীয় ও শিক্ষণীয়।

খন্দকার স্যারের খিলগাঁও (মাটির মসজিদ), বসুন্ধরা, এমনকি নন্দীপাড়ার বাগানবাড়িতে আতিথেয়তা গ্রহণ করেছি। সর্বশেষ বসুন্ধরার বাড়িতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের জন্য নেতৃস্থানীয় আইনজীবীদের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয় যাতে আমিও উপস্থিত থেকে আপ্যায়িত হয়েছি। পরবর্তীতে জানতে পারি, তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। করোনা সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকার জন্য তিনি ঘর থেকে বের হননি। কিন্তু প্রয়োজনে তিনি সে বাধা অতিক্রম করে তিন ঘণ্টাব্যাপী আইনজীবীদের মিটিং করেছেন।

বরগুনার গ্রামাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী খন্দকার পরিবারে জন্মগ্রহণ করে নিয়মনিষ্ঠা ও অক্লান্ত পরিশ্রমে দেশব্যাপী আইনজীবীদের তিনি ছিলেন অভিভাবক, ছিলেন দৃষ্টিহীন প্রতিবন্ধীদের অকৃত্রিম বন্ধু। রাজনৈতিক অঙ্গনে ছিলেন একজন চিন্তাশীল ব্যক্তিত্ব। মানুষের কল্যাণের জন্য তিনি ছিলেন একজন পরীক্ষিত সমাজকর্মী। সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রে পাকিস্তানি দোসরদের বিচারের জন্য তিনি নিযুক্ত হয়েছিলেন স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির বারবার নির্বাচিত সভাপতি, বার কাউন্সিলের দুবার নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান। এ ছাড়াও বৃহত্তর বরিশাল বিভাগ সমিতির সভাপতি। মানুষের সাথে পথ চলাই ছিল তার বৈশিষ্ট্য।

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail : taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement