১৬ মে ২০২৪, ০২ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৭ জিলকদ ১৪৪৫
`


প্রধান বিচারপতি সমীপে

- ছবি : সংগৃহীত

ব্রিটিশ থেকে পাকিস্তান (১৯৪৭), পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ (১৯৭১) স্বাধীন হয়। প্রথম স্বাধীনতার মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশের শৃঙ্খল থেকে ভারতবাসীকে মুক্ত করা। দ্বিতীয় স্বাধীনতার মূল উদ্দেশ্য ছিল- সম্পদের সুষম বণ্টন ও জনগণের কাক্সিক্ষত অধিকার অর্জন। তবে বিদেশে শাসকশ্রেণীর সাহেবপাড়া, বেগমপাড়ায় বিলাসবহুল প্রাসাদের নেশায় জনগণের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টনে রাষ্ট্রীয় প্রত্যয় দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে মনে হয়।

স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে- ‘আমরা আরো অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এক শোষণমুক্ত সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করা হইবে।’

সংবিধানের এ অঙ্গীকারও দুর্বল করে দিয়েছেন ক্ষমতাসীনরা, বিশেষ করে ক্ষমতার দাপটে বারবার পিষ্ট হয়েছে সংবিধান। দেশ চলছে ব্রিটিশের আদলে, যেখানে আমলাতন্ত্র চলে আদর্শে নয়; আদেশে। সেখানে বিবেক, বিচারবুদ্ধি, মানবতা, মৌলিক মানবিক অধিকার অথবা সংবিধান বা স্বাধীনতার চেতনার মূল্যবোধ কার্যকর কতটুকু কার্যকর থাকবে তা সহজে অনুমেয়। গাড়ি-বাড়িসহ আমলা লালন-পালনে জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ ব্যয় হয়। কিন্তু জনগণকে ন্যূনতম সম্মান দেয়া বা তাদের প্রতি ন্যূনতম মানবিক আচরণ দেখানোর মানসিকতার আদলে আমাদের আমলাতন্ত্র গড়ে ওঠেনি। ফলে আমলারা ব্রিটিশ শাসনে জনগণকে যেভাবে নিগৃহীত করেছেন, বর্তমানেও চলছে সেই একই চিত্র। অথচ সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘প্রজাতন্ত্র (অর্থাৎ বাংলাদেশ) হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে।’

সংবিধানের ৭(ক) অনুচ্ছেদ মোতাবেক জনগণ রাষ্ট্রের মালিক হওয়া সত্ত্বেও তারা আজ ক্ষমতার কষাঘাতে জর্জরিত।

গত ২০ ডিসেম্বর গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলাধীন বোয়ালি ইউনিয়নে হাতে হাতকড়া, পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি লাগানো অবস্থায় মায়ের জানাজা আদায় করতে দেখা যায় মধ্যবয়সী এক ব্যক্তিকে যার নাম আলী আজম। যিনি কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকায় ২৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগ অফিসে হামলার অভিযোগে বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে ২ ডিসেম্বর গ্রেফতার হয়েছেন। ১৯০৮ সালের ৮ জুন ব্রিটিশ সরকার ‘বিস্ফোরকদ্রব্য আইন-১৯০৮’ পাস ও কার্যকর করে। ব্রিটিশের করা সেই ১১৪ বছরের পুরোনো আইন ব্যবহার করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে সরকার কারাবন্দী রাখছে এবং মামলাগুলো গায়েবি জানার পরও আদালত জামিন দিচ্ছেন না, অধিকন্তু অনেক সময় রিমান্ডের পর রিমান্ড দেয়া হচ্ছে। সংবিধানের ১১৬(ক) মোতাবেক- বিচার বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তি এবং ম্যাজিস্ট্রেটরা বিচারকাজ পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকার সাংবিধানিক নিশ্চয়তা থাকার পরও গায়েবি মামলার নার্সিং ও বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী নির্যাতনে সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য কোনোভাবে কমছে না, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নয়; মানসিক দুর্বলতা এর একটি কারণ হতে পারে।

‘রাখিবো নিরাপদ, দেখাবো আলোর পথ’ কারা কর্তৃপক্ষের একটি নামসর্বস্ব স্লোগান যার অন্তরালে রয়েছে কর্তৃপক্ষের নিজস্ব ব্যবসায়। ব্রিটিশের আইনে কারা কর্তৃপক্ষ অনেক ক্ষমতার মালিক। সিট কেনাবেচা, খাদ্য সরবরাহ, টেলিফোনিক সুবিধা, ডাণ্ডাবেড়ি লাগানো-খোলানো, অফিস কল সাক্ষাৎকার, জানালায় দাঁড়িয়ে সাক্ষাৎকার প্রভৃতি সব কিছুতে রয়েছে কারা কর্তৃপক্ষের লাভজনক ব্যবসায়, অধিকন্তু পিসি অ্যাকাউন্ট ব্যবসায় তো রয়েছে। ১৮৬৪ সালের আগে পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারতে কোনো জেলকোড ছিল না। ব্রিটিশ কর্তৃক সময়ে সময়ে ইস্যুকৃত সার্কুলার, আদেশ দিয়ে কারাগার পরিচালিত হতো এবং নিষ্ঠুর নির্যাতন চলত। সে নিষ্ঠুরতা থেকে সুভাষ বসু থেকে শুরু করে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কেউ-ই রক্ষা পাননি।

১৮৬৪ সালে তৎকালীন ইন্সপেক্টর জেনারেল অব প্রিজন অব বেঙ্গল Dr. F J Mouat তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের ইস্যুকৃত আদেশ ও সার্কুলার একত্রিত করে একটি জেলকোড প্রণয়নের উদ্যোগ নেন। অতঃপর ১৮৬৭ সালে Mr. Hodge Ges Dr. F J Mouat-এর উদ্যোগে জেলকোড নামান্তরে একটি নন-অফিসিয়াল জেল ভ্যালুয়েম তৈরি হয়। যা পরবর্তী বিভিন্ন বেঙ্গল কারা মহাপরিদর্শক W.J. Heeley (1876), Dr. Lethbridge (1862), W. Leonard (1996) পরবর্তী প্রেসিডেন্সি জেলসুপার Mazor J. Mulvany I.M.S-এর উদ্যোগে একটি জেলকোড প্রণীত হলেও The Prisoner Act, 1871, The Presoner Act, 1894, The Prisoner Act, 1894 প্রণয়নসহ সময়ে সময়ে কারাকমিশন গঠনের মাধ্যমে কারাবন্দীদের মানবাধিকার রক্ষার বিষয়টি জেলকোডের অন্তর্ভুক্ত করা হলেও কারাকর্তৃপক্ষের সামন্ত প্রভুর মতো ক্ষমতা প্রয়োগে তারা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছেন না। কারণ বিরোধীদের নির্যাতনে ক্ষমতাসীনরা পুলিশ ও আমলাদের যেভাবে ব্যবহার করছেন, কারাকর্তৃপক্ষের বেলায়ও তা অপরিবর্তিত রয়েছে। ফলে কারাকর্তৃপক্ষ এক ঢিলে দুই পাখি মারছে, একদিকে রয়েছে সরকারকে খুশি করার ফর্মুলা, অন্যদিকে রয়েছে সরকারকে সন্তুষ্ট রেখে কারাগারকে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে চালিয়ে যাওয়ার নিশ্চয়তা। কারাকর্তৃপক্ষ বন্দীদের সাথে ‘দাসের’ মতো আচরণ করে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কারাগারের আধুনিক নামকরণ হচ্ছে কারেকশন সেন্টার (শুদ্ধিকরণ কেন্দ্র)। অথচ এটিই এখন সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও অ্যাজেন্সির মতোই দুর্নীতির শিল্প হিসেবে পরিণত হয়েছে।

জনৈক এক কথাসাহিত্যিক বলেছেন- ‘কিছু মানুষ রয়েছে যারা এক জনকে দিয়ে আরেকজনকে অত্যাচার নির্যাতন করাকে তামাশার মতো উপভোগ করে’। এ ধরনের উপভোগ পাষণ্ড ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য হতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রযন্ত্র এ ধরনের উপভোগের হাতিয়ার বা অংশীদার হতে পারে না। রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রযন্ত্রের ভূমিকা যখন অহেতুক নাগরিকদের ওপর নির্যাতনকারী হিসেবে ব্যবহৃত হয় তখন এটি কল্যাণমূলক অথবা গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। বাংলাদেশে আইনের প্রয়োগ হয় দুই ভাগে। সরকারি দলের জন্য সাধারণত আইনের কোনো প্রয়োগ হয় না, হাতেনাতে ধরা পড়লে মুখরক্ষার জন্য যদিও বিচারের জন্য আদালতে সোপর্দ করা হয় তখন তার কারাভোগ হয় প্রথম শ্রেণীর হাসপাতালে। অন্য দিকে, বিরোধী দলের অবস্থা কী হচ্ছে তা তো দেখা যাচ্ছে।

গায়েবি মামলা এখন ওপেন সিক্রেট বিষয়। একটি সরকার কী পরিমাণ মিথ্যাচারের আশ্রয় নিতে পারে তার প্রমাণ গায়েবি মামলা। গায়েবি মামলার রচিয়তা ও পৃষ্ঠপোষকদের একদিন না একদিন জবাবদিহির আওতায় আসতে হবে। গায়েবি মামলার রচয়িতাদের চিহ্নিত করতে একদিন অবশ্যই কমিশন গঠনের দাবি ওঠবে। কারণ মৃত ব্যক্তি, বিদেশে অবস্থানকারী, পঙ্গু, ভিক্ষুক কেউ-ই গায়েবি মামলা থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না, যারা সরকারি দলের রোষানলে রয়েছেন। রাজনীতি করেন না, অথচ সরকারি দলের সংসদ সদস্যের বিরাগভাজন হয়েছেন এমন ব্যক্তিরাও গায়েবি মামলা থেকে রেহাই পাননি।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামিকে হাতকড়া, ডাণ্ডাবেড়ি ছাড়াই জেলখানার বাইরে নেয়া হয়েছে, কিন্তু ডাণ্ডাবেড়ি ও হাতকড়া পরিয়ে একজন স্থানীয় বিরোধী দলের নেতাকে মায়ের জানাজা পড়াতে বাধ্য করা হয়েছে, একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে বিষয়টি কি গুরুত্বহীন থেকে যাবে? নাগরিক অধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি কিভাবে মূল্যায়িত হবে? সংবিধানে উল্লেখিত- ‘সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হওয়া’র বাণী আজ কোথায় গেল? দ্য ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশন অ্যাক্ট-২০০৯ অনুযায়ী গঠিত কমিশনই এ মর্মে কি ভূমিকা রাখবে? সরকারের কাছে বিবেক বন্ধক দেয়া কথিত বুদ্ধিজীবীদের এ মর্মে কোনো রাঁ নেই কোন বিবেচনায়।

জাতিসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশনে ১০ ডিসেম্বর ১৯৮৪ কনভেনশন এগেইন্সট টর্চার অ্যান্ড আদার ক্রুয়েল, ইনহিউম্যান অর ডিগ্রেডিং ট্রিটমেন্ট অর পানিশম্যান্ট শিরোনামে একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুমোদিত হয় যা ১৯৮৭ সালের ২৬ জুন থেকে কার্যকর। ওই আইন মেনে চলতে জাতিসঙ্ঘের অন্তর্ভুক্ত একটি সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে স্বাক্ষর করেছে। ডাণ্ডাবেড়ি ও হাতকড়া পরা অবস্থায় কারাবন্দীকে (যিনি এখনো সাজাপ্রাপ্ত নন, বিচারাধীন মাত্র) মায়ের জানাজা পড়তে বাধ্য করে কারাকর্তৃপক্ষ শুধু সংবিধান ও মানবতা লঙ্ঘন করেনি, সরকারের মনোরঞ্জনে ১৯৮৪ সালের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে।

দেশের প্রধান বিচারপতি একজন কারাবন্দী তথা বিচারাধীন একজন নাগরিকের ন্যূনতম মর্যাদা রক্ষায় কোনো ভূমিকা রাখবেন কি?

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement