১৭ মে ২০২৪, ০৩ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৮ জিলকদ ১৪৪৫
`


গণতন্ত্রের নামে সার্কাস ও নিষ্ঠুরতা

গণতন্ত্রের নামে সার্কাস ও নিষ্ঠুরতা - ছবি : সংগৃহীত

পৃথিবীতে চলছে গণতন্ত্রের লড়াই, গণতন্ত্র রক্ষার লড়াই, কোথাও চলছে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই। এ লড়াইয়ে পর্যুদস্ত হচ্ছে গণতন্ত্রের স্টেকহোল্ডাররা। শাসকভেদে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা ও প্রয়োগ ভিন্নতর হয়ে যাচ্ছে। মোটা দাগে মনে হচ্ছে, প্রতিপক্ষকে হত্যা করে হলেও নিজের মতবাদকে চালু রাখার নামই গণতন্ত্র। ‘কথা বলব আমরা আর মামারা, অন্য কেউ নয়’ কারো কারো মতে এটিই গণতন্ত্র। সবার মুখে আঠা লাগিয়ে দিয়ে রাজ্য শাসনই অনেকের মতে গণতন্ত্র। অনেকে বলছেন, উন্নয়ন আগে, গণতন্ত্র পরে। এটি (গণতন্ত্র) যেন অন্ধের হাতি দেখার মতো।

গণতন্ত্রের বিশ্লেষণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা করেছেন একরকম; শাসকরা নিজ স্বার্থে এর কার্যক্রম গ্রহণ করেছেন অন্যরকমভাবে। ‘গণতন্ত্র’ যদি বাকশক্তিসম্পন্ন একটি জীবপ্রাণী হতো তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে ঘোষণা দিয়ে চিরকুট লিখে স্বেচ্ছায় আত্মহত্যা করা ছাড়া ‘গণতন্ত্র’ নামক কল্পিত প্রাণীটির অন্য কোনো উপায় থাকত না। গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা ও গণতন্ত্র প্রয়োগের যে বিপরীত ধর্মী অ্যাকশন তা গণতন্ত্রের মুখে শুধু চুনকালি মেখে দেয় না; বরং গণতন্ত্রের সংজ্ঞা পরিবর্তনের তাগিদ দেয়। মঞ্চে বক্তার বক্তব্য ও বক্তার ব্যক্তিগত নষ্ট জীবন পর্যালোচনা করে শ্রোতার মনে যে বিষক্রিয়া শুরু হয় তাতে বক্তার প্রতি আর শ্রদ্ধাবোধ থাকে না। অনেক সময় নিজ শিষ্য গুরুকে হত্যা করার পেছনের এটিও একটি অন্যতম কারণ। অনুরূপ বর্তমানে চলতি গণতন্ত্র মুক্তি সনদ হিসেবে ব্যবহৃত হবে তা গণমানুষ আস্থায় আনতে পারছে না।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন বলেছেন, ‘Democracy is by the People, of the People and for the People’ অর্থাৎ গণতন্ত্র জনগণের দ্বারা জনগণ কর্তৃক ও জনগণের জন্য। লিংকনের মতাদর্শ মোতাবেক গণতন্ত্রের স্টেকহোল্ডার হলো জনগণ। জনগণই যদি গণতন্ত্রের ধারকবাহক হয়ে থাকে তবে সে জনগণের মতামতের মূল্যায়ন কোথায়? রাজনীতির অনুশীলন ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র হলো রাজনৈতিক দল, সেখানেও কি গণতন্ত্রের অভ্যন্তরীণ চর্চা আছে? হালে একটি প্রবাদ চালু হয়েছে- ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম, নতুবা সাইজ’। দলীয় কোনো নেতাকর্মীকে ‘সাইজ’ করা হয় শুধু দলে নেতার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে বাধাগ্রস্ত মনে হলে। দলের সভাতে প্রথমেই বলা হয়, কোনো নেগেটিভ কথা বলা যাবে না, অর্থাৎ হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তের কোনো সমালোচনা করা যাবে না। দলের সভায় অংশ নিলে দেখা যায়, নেতার প্রতি চামচামি ও তোষামোদের প্রতিযোগিতা কত প্রকার ও কী কী? ভোটাধিকার তথা গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশটি স্বাধীন হলো যার বয়স ইতোমধ্যে ৫১ বছর অতিক্রম করেছে। এ অর্ধশতাব্দীতে গণতন্ত্রের অনেক ভিন্ন ভিন্ন রূপ, কুৎসিত চেহারা দেশবাসী দেখেছে।

গণতন্ত্রের লেবাসে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর একদলীয় শাসনব্যবস্থা তথা সংবিধান সংশোধন করে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক পার্বটি (বাকশাল নামে বহুল প্রচারিত) গঠিত হয়েছিল। ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি সেনাসদস্য কর্তৃক ক্ষতবিক্ষত দুই রাষ্ট্রপতির নিথর দেহ (তন্মধ্যে একজন সপরিবারে), সম্পূর্ণ নিরাপদ জায়গায় কারাগার, সেখানেও জাতীয় নেতাদের হত্যা, দেখেছি রেলগেটের নিচ দিয়ে পালিয়ে নিজ দলের (ভূতপূর্ব) নেতাকর্মীদের আক্রমণ থেকে জীবন রক্ষা করেছেন এক রাষ্ট্রপতি, সামরিকজান্তা এক রাষ্ট্রপতিকে দেখেছি সিসি ক্যামেরাবন্দী অবস্থায় নির্জন দীর্ঘ কারাবাস, নিজ নেতাকে হত্যা করে অসামরিক ব্যক্তি সামরিক আইন জারি করে রাষ্ট্রপতি হওয়া মানুষটি জেল খেটেছেন, দুই নারী প্রধানমন্ত্রীর (জাতীয় সংসদের পাশাপাশি বিল্ডিংয়ে) কারাবন্দী জীবন দেখেছি, অসুস্থ, বয়স্ক সাবেক প্রধানমন্ত্রী জামিনবিহীন এখনো গৃহবন্দী কারাভোগের ঘটনাও দেখছি। মূল কথা, রাষ্ট্র শাসন করেছেন যেসব রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী সবারই একই হাল হয়েছে। অনুরূপ অবস্থায় পড়তে হয়নি শুধু তাদের যারা ছিলেন নখদন্তবিহীন নামসর্বস্ব রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী। সুখে শান্তিতে ক্ষমতা ছেড়েছেন সেসব প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি যারা ছিলেন ঢাল-তলোয়ার ছাড়া নিধিরাম সর্দার, যেমন- মোহাম্মদ উল্ল্যাহ, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, কাজী জাফর আহাম্মদ, অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন, আতাউর রহমান খান, মিজানুর রহমান চৌধুরী প্রমুখ।

আমরা আরো দেখেছি দায়িত্বরত অবস্থায় একজন প্রধান বিচারপতিকে অসুস্থ বানিয়ে বল প্রয়োগে দেশত্যাগ, দেখছি বিদেশে ধাওয়া খাওয়া ওয়ান-ইলেভেনের রূপকার সেনাপ্রধানকে। আরো দেখতে হয়েছে ত্রাণ দিতে গিয়ে সরকারি দলের পেটুয়াবাহিনীর আক্রমণে বিএনপি মহাসচিবের নাজুক অবস্থা, আদালতে জামিন নিতে যাওয়া সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের রক্তাক্ত দেহ, নিজ এলাকায় প্রতিপক্ষের হামলায় সিনিয়র নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের আহত হওয়ার দৃশ্য। তারপর রয়েছে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, জজ মিয়া নাটক, বড় বড় পুলিশ কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতার জন্য দীর্ঘ কারাবাস।

অতিসম্প্রতি দেখলাম পুলিশি বাধায় অফিসে ঢুকতে না পারা মহাসচিবের নয়াপল্টনে রাস্তায় বসে থাকার দৃশ্য, ডিএমপি কমিশনার থেকে শুনতে হলো ‘ক্রাইম সিন’ কাকে বলে? ডক্টরেট ডিগ্রিধারী উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তারা গায়েবি মামলা সৃজনে যে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন পৃথিবীর অন্য রাষ্ট্রে তা পাওয়া যাবে না। এ ধরনের অহরহ ঘটনা ঘটেছে এবং এখনো অব্যাহত আছে, ফলে গণতন্ত্রকে খোঁজার জন্য আমাদের আরো কিছু দেখার কি প্রয়োজন রয়েছে? জাতীয় সঙ্কট উত্তরণে জাতীয় ঐকমত্য প্রয়োজন, যা বর্ণিত কারণে সুদূরপরাহত। এজন্য আরো কয়েক জেনারেশন অপেক্ষা করতে হবে।

পূর্ণিমার রাতে চাঁদকে অনেক সুন্দর দেখায়, এর স্নিগ্ধ মনমোহিনী আলো উপভোগের তৃপ্তি অনেক, কিন্তু আমস্ট্রং যখন পৃথিবীর প্রথম মানুষ হিসেবে অবতরণ করলেন তখন দেখলেন চাঁদ পাথরের মস্তবড় একটি গ্রহ ছাড়া অন্য কিছু নয়। দূর থেকে অনেক বিষয় সুন্দর মনে হলেও এর কুৎসিত চেহারা যখন প্রকাশ পায় তখন আতঙ্কিত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। রাজনীতিকদের মন ভুলানো বক্তৃতা বা ক্ষমতাসীনদের মিথ্যা কথার অনুশীলন ও মিথ্যা প্রতিযোগিতা দেখলে জোসনা রাতের স্নিগ্ধতা আর পাওয়া যায় না, যা পাওয়া যায় তা অত্যন্ত কুৎসিত, নোঙরা। তবে কি রাজনীতি ছেড়ে দিতে হবে? না; বরং রাজনৈতিক অনুশীলনকে আদর্শিক পর্যায়ে আনতে হবে। দুর্বৃত্তদের কবল থেকে রাজনীতিকে মুক্ত করতে পারলেই প্রতিষ্ঠিত হবে আদর্শিক রাজনীতি। রাজনীতি তথা রাজনৈতিক দলে আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হলে মানিলন্ডারিং বন্ধ করার জন্য আইন প্রণয়ন করতে হবে না, থাকবে না তখন বিদেশে বেগমপাড়া বা সাহেবপাড়া গড়ে তোলার প্রতিযোগিতা। তারা নিজ দলের কর্মী ও যেসব কর্মী-নেতার জন্য জীবন দিতে পারে তাদেরও শোষণ করতে মোটেও ভুল করে না। কুৎসিত সে চেহারা মনে হলে বিতৃষ্ণা হওয়া শরীরে ও মনে ঘামঝরা আতঙ্কের সৃষ্টি হয়।

মালয়েশিয়ায় আনোয়ার ইব্রাহিমকে সমকামিতার অভিযোগে জেল খাটতে হয়েছে, যিনি নিজ গুরু মাহাথিরকে পরাজিত করে বর্তমানে রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশে প্লেট চুরির দায়ে রাজনীতিকরা জেল খেটেছেন, ময়লার ট্রাক পোড়ানো মামলায় পার্টি মহাসচিবকে জেল খাটতে হয়েছে। এ ব্যর্থতা শুধু রাজনীতির নয়, বরং এ জন্য বিচার বিভাগের দ্বীনহীনতার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে দেশটি স্বাধীন হয়ে সবচেয়ে বড় সম্পদ হিসেবে যা পেল তা হলো মহামূল্যবান একটি ‘সংবিধান’। দেশের মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার রক্ষাকবচ হলো কালির কলমে লেখা একটি বই, যার নাম সংবিধান। এ সংবিধানের অভিভাবক হলো সুপ্রিম কোর্ট। বাংলাদেশের একজন প্রধান বিচারপতিকে যখন ঘাড় ধরে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয় তখন বিচার বিভাগের অভিভাবকত্বের দায়িত্ববোধ আর কোথায় থাকে? পরে দুর্নীতির অভিযোগ এনে তাকে অবসরে যেতে বাধ্য করা হয়। তাকে নিয়োগ দেয়ার আগে কি নিয়োগদাতা রাষ্ট্রপতি বিচারপতি এস কে সিনহার দুর্নীতির খোঁজখবর না নিয়েই শুধু আনুগত্য বিবেচনা করেই রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি বানিয়েছেন?

উচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগের পদ্ধতিও এখন পর্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ। সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগ দান করিবেন।’ এ তো হলো সংবিধানের লিপিবদ্ধ কথা। বাস্তবে কি তাই? সরকারপ্রধানের ইচ্ছার বিপরীতে রাষ্ট্রপতি কি তার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন? সরকারপ্রধান যা করেন তা অবশ্যই রাজনৈতিক আনুগত্যের বিবেচনা করে থাকেন, ফলে বিচারপতি নিয়োগের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ থেকেই যায়। একটি প্রতিষ্ঠিত প্রবাদ রয়েছে যে, একটি স্বচ্ছ নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ ব্যতীত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না, অন্য দিকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হলে একটি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ বিচারিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। একটি অন্যটির সম্পূরক বিধায় রাজনীতিকদের সৃষ্টি করা সঙ্কটের জন্য কোনোটিই পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারেনি, ফলে লুণ্ঠিত হচ্ছে স্বাধীনতার মূল চেতনা, বঞ্চিত হচ্ছে দেশের আপামর জনগণ। তবে যারা সরকারের ছত্রছায়ায় সুখে শান্তিতে রয়েছে তাদের কথা ভিন্ন।

প্রতিপক্ষকে অধিকারবঞ্চিত করে ক্ষমতায় টিকে থাকার প্র্যাকটিসকেই ‘গণতন্ত্র’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে এ দেশে। গণতন্ত্রকে হত্যার জন্য সুবিধামতো আইন প্রণয়ন, আনুগত্যের ভিত্তিতে বিচার বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে নিয়োগ, পদোন্নতি ও লোভনীয় পোস্টিংকে ক্ষমতাসীনরা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।

চলছে, এখন গণতন্ত্রের নামে সার্কাস ও নিষ্ঠুরতা। গণতন্ত্রের ব্যাখ্যায় আব্রাহাম লিংকনের মতবাদ এখন অচল। বর্তমান প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা হওয়া উচিত জোর যার মুল্লুক তার। ‘জনগণই ক্ষমতার উৎস’ এ কথাটিও এখন সর্বৈব মিথ্যা ও বানোয়াট। মূলত আমলাতন্ত্র ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই এখন ক্ষমতার উৎস। ক্ষমতার আরো উৎস হলো পুলিশের গায়েবি মামলা, লাঠিচার্জ। এর সাথে যুক্ত বিচার বিভাগের ব্যর্থতা ও পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ।

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement