২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

‘অবরোধ’ ছাড়া কোথাও আলাপ নেই

‘অবরোধ’ ছাড়া কোথাও আলাপ নেই - নয়া দিগন্ত

চার দিকে এখন অবরোধ ছাড়া যেন কোনো আলোচনার বিষয় নেই। গত ১০ ডিসেম্বর বাইডেন প্রশাসন এক স্যাংশন বা অবরোধের তালিকা প্রকাশ করেছিল। ওই তালিকাটা প্রকাশ করার পরে সবচেয়ে বড় চাপটা তৈরি হয়ে আছে বাংলাদেশে। তালিকায় ভুক্ত অন্য দেশগুলো হলো- উগান্ডা, উত্তর কোরিয়া, চীন, বেলারুশ, শ্রীলঙ্কা ও মেক্সিকো। কিন্তু বাংলাদেশসহ এই সাত দেশের যেসব সরকারি কর্মকর্তার ওপর অবরোধ আরোপ হয়েছে তারা মোট ১২ জন। অথচ এই ১২ জনের মধ্যে একা বাংলাদেশেরই সাতজন। সম্ভবত তাই বড় চাপ অথবা ‘বড় থাবা’তে আমেরিকা ধরেছিল বাংলাদেশকে তা অনুমান করা যায়। বাংলাদেশের সর্বত্র চা দোকান থেকে আলিশান ড্রয়িংরুম বা ক্ষমতার করিডোরগুলোতে প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়েছে অবরোধ।

কিন্তু এই অবস্থার কারণেই আবার বাংলাদেশের বাইরে অবরোধের প্রতিক্রিয়া কী হচ্ছে, কিভাবে পড়ছে সেদিকটা নজর শূন্য হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। অথচ সেটাও বাংলাদেশের দিক থেকে দুনিয়ার পরিবর্তন বুঝার জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ নয় মোটেও। তবে প্রথমেই বলে নেই, এখানে ‘বাংলাদেশের বাইরে’ বলতে শুধু অবরোধ তালিকায় থাকা উগান্ডা, উত্তর কোরিয়া, চীনসহ ছয় দেশের কথা বুঝাচ্ছি না। এর বাইরেরও দেশ যারা আছে, যাদের নাম তালিকায় থাকার কথা কিন্তু শেষবেলায় এসে আমেরিকা যার নাম তালিকায় রাখেনি। যেমন, এমন অন্যতম দেশ হলো, ভারত।

এই ২০০১ সাল শুরু হয়েছিল ভারত আমেরিকার তখন থেকে ঘোরতর স্ট্র্যাটেজিক বন্ধু এটা ধরে নিয়ে। আসলে ইসলামোফোবিয়ার নামে অগ্রহণযোগ্য এথনিক ঘৃণা ছড়ানো- আবার এটাই ভারত আমেরিকার কমন অনৈতিক স্বার্থ। এমন দগদগে স্বার্থই তাদের আগের শতকের সব পুরনো বিবাদ ভুলে কাছাকাছি ও নতুন বন্ধু হতে উৎসাহিত করেছিল।

অন্যভাবে বললে আমেরিকার ‘ওয়ার অন টেরর’ পলিসিতে বড় সমর্থক হিসেবে এশিয়ায় ভারতকে পেতে ভারত-আমেরিকা কমন ইসলামোফোবিয়ার ভিত্তিতে পরস্পর নতুন বন্ধু হয়েছিল। আর এটা এমনই পরস্পরের পিঠ চুলকে দেয়া বন্ধুত্ব যে, মনে করা হতো তাদের পরস্পরের এই ‘পার্টনারস ইন ক্রাইম’-এর বন্ধুত্ব- এটা সহসাই নষ্ট হচ্ছে না; হবে না বা ভাঙবে না।

কিন্তু এমন সব অনুমানকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে বাইডেনের তালিকা প্রকাশ। ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অবরোধ আরোপ’- এই ভিত্তিতে সেই তালিকা; তবে বেছে বেছে ‘কিছু দেশের’ ওপর বাইডেন প্রশাসনের অবরোধের পদক্ষেপ নিতে তাদের নাম তালিকায় রেখেছেন। বেছে বেছে কিছু দেশ বললাম এজন্য যে, বাইডেন নিজের ঘোষিত নীতি ভারতের বেলায় প্রয়োগ করার মুরোদ দেখাতে পারেননি।

ঘটনার শুরু গত ২০২০ সালে বাইডেন যখন প্রেসিডেন্ট প্রার্থিতা নিশ্চিত করেন। তবে এরও আগেই কিছু আমেরিকান কংগ্রেস সদস্য কাশ্মিরে ভারতের মুসলমানদের ওপর নির্যাতন, নিপীড়ন আর সর্বোপরি কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা ক্ষুণœ করে জবরদস্তিতে সারা কাশ্মিরই ভারতের অংশ বলে (২০১৯ আগস্টে) মোদি সরকারের সংসদে ঘোষণা- এরপর থেকে কাশ্মিরের বাসিন্দাদের ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘন চরমে উঠেছিল বলে এসব ঘটনাকে আমলে নিয়ে এর বিরুদ্ধে মার্কিন কংগ্রেসে প্রস্তাব এনেছেন। আর প্রার্থী বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হলে এই প্রস্তাবের পক্ষে পদক্ষেপ নেবেন বলেছিলেন। আর এমন ঘোষণা মোদি সরকার ভালোভাবে নেয়নি, বিপদ দেখেছিল। এই ঘোষণা থেকেই মোদির পিছটান ও আমেরিকান সম্পর্ক ছেড়ে পালানোর উপায় বের করা শুরু হয়েছিল। তাই বাইডেন বিজয়ী হওয়ার পর থেকে মোদি সরকারের অঘোষিত টেনশন শুরু হয়ে যায়।

সেই টেনশন আরো বাস্তব হয়ে উঠতে বাইডেন প্রশাসন শপথ নেয়ার পরেও ১০ মাস সময় লেগে যায়। এবার ১০ ডিসেম্বরে বাইডেন অবরোধের তালিকা প্রকাশ করেছেন। এদিকে ইতোমধ্যে মোদি সরকারের মুসলমানদের ওপর একের পর এক নির্যাতন, নিপীড়ন পাপ আর কেবল কাশ্মিরেই আটকে থাকেনি। ভারতজুড়ে সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল। কোন কোন দেশের নাগরিককে তার দেশের সরকার নিজ নিজ ধর্মপালনে বাধা দিচ্ছে বা ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে তা নোট নেয়ার জন্য আমেরিকায় এক রাষ্ট্রীয় স্বাধীন কমিশন আছে যার কাজ হলো সেসব সরকারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য যে প্রশাসনই আমেরিকায় ক্ষমতায় থাকে তার কাছে বার্ষিক সুপারিশ রিপোর্ট পাঠিয়ে দেয়া। এবারের ২০২১ সালের এমন রিপোর্টে ভারতকে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী ক্যাটাগরির দেশ হিসেবে ভারতের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেয়ার সুপারিশ গিয়েছিল।

তাই মোদি সরকারের আশঙ্কা ছিল বাইডেন ট্রাম্প প্রশাসনের মতো তার ফেভারেবল সরকার নয়। এ ছাড়া চলতি ডিসেম্বরের ৯-১০ তারিখ বাইডেন ‘ডেমোক্র্যাসি সামিট’ আহবান করেছিল আর এখান থেকে যে এই অবরোধের তালিকা প্রকাশ করা হবে তা আমেরিকা থেকে আগেই ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। ফলে সেসব কথা ভারত জেনে যায় গত অক্টোবর মাস থেকে, বিশেষ করে নভেম্বরের শুরুতে প্রকাশ্যে দাওয়াতপত্র বিতরণ শুরু হওয়া থেকে।

আর এখান থেকেই মোদি সরকার আমেরিকার ওপর পাল্টা চাপ সৃষ্টির কৌশল ও পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছিল। ভারত প্রকাশ্যেই রাশিয়ার সাথে তার ঘনিষ্ঠতা প্রকাশ করতে শুরু করে। অনেকে ধারণা করত চীন ও রাশিয়া যেহেতু আমেরিকার বিরুদ্ধে তারা এক-জোট; এই অবস্থা গত ১০ বছরের বেশি ধরে বহাল রেখেছে কাজেই চীন-ভারত প্রকাশ্য বড় শত্রুতায় আছে বলে একে পাশ কাটিয়ে ভারত-রাশিয়া ঘনিষ্ঠতা কার্যকর হবে না।

আসলে ২০০১ সালে ওয়্যার অন টেরর নীতির কারণে ভারত ও আমেরিকার মধ্যে যে ঘনিষ্ঠতা শুরু হয়েছিল তাতে বলা যায় আমেরিকা ওই প্রথম রাশিয়া থেকে ভারতকে আলাদা করে ও অনেক দূরে নিয়ে চলে যায়; যার মূল কারণ হলো, বুশের আমেরিকা ভারতকে পরমাণু-অস্ত্রবিষয়ক টেকনোলজি ও কাঁচামাল-উপাদান সরবরাহের যেসব আইনি বা কনভেনশনের বাধা (এনপিটি) ছিল তা উপেক্ষা করে সহায়তার হাত বাড়িয়েছিল। স্বভাবতই এর লোভেই ভারত তার এতদিনের কেবল রাশিয়ান অস্ত্রে সজ্জিতকারী এত পুরনো বন্ধু রাশিয়াকে উপেক্ষা করে আমেরিকার স্ট্র্যাটেজিক বন্ধু হওয়ার জন্য ছুটে গিয়েছিল।

ভারতের সরকারি কালচারে কোনটাকে তারা সুখ বা অর্জন বলে বুঝে এর কিছু বিশেষ ভঙ্গিমা আছে। যেমন আমেরিকা ভারতকে গুরুত্ব দিয়ে গত প্রায় ২০ বছর চলেছে কাজেই ভারত পরাশক্তি হয়ে গেছে। এটা সরকার নিজে পাবলিকলি প্রচার করে না। কিন্তু সরকারের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের সাথে কাজ করে এমন সাংবাদিকদেরকে তা বিশ্বাস করিয়েই ছেড়েছিল। এ ছাড়াও আমেরিকা যেসব ঢংয়ে ভারতকে গুরুত্ব দেয়া প্রকাশ করেছিল সেটা নিশ্চয় ভারতের জন্য খুবই সম্মানের- এই অনুমানটাই সরকারি কালচারে বর্তমান।

যেমন প্রায়ই আমরা একটা কথা শুনব যে ‘২+২ ডায়ালগ’। এটা তাদের বিচারে খুব উচ্চমার্গের ব্যাপার। অথচ ব্যবাপারটা আর কিছুই না, আমেরিকার অস্ত্র গছানোর কায়দা একটা। সেখানে ‘২+২’ মানে দুদেশেরই পররাষ্ট্র আর প্রতিরক্ষামন্ত্রী এখানে চারমন্ত্রীর একসাথে বসে অস্ত্র কেনাবেচার লক্ষ্যে মিটিং করা। এটা এতদিন আমেরিকান স্টাইল ছিল, ভারতকে জাতে তোলার। তাই এবার পুতিনের সফরে ভারতও রাশিয়ার সাথে এক ‘২+২ ডায়ালগ’ করেছে। এর এক পরোক্ষে ‘প্রদর্শনী অর্থ’ আছে যে, আমরা আমেরিকা ছাড়াই রাশিয়ার সাথেও এমন গুরুত্বের ডায়ালগ করেছি।

এ ছাড়া আরেকটা মিডিয়া কাভারেজ আমরা দেখতে পাই ওই একই দ্য-প্রিন্ট ওয়েবপত্রিকায় যেটা লিখবেন জ্যোতি মালহোত্রা। লেখা পড়ে পেইড লেখা মনে হবে। ‘যেমন তেমন’ লেখাটার শিরোনাম ‘পুতিনস ভিজিট ইজ অ্যা ডিফাইনিং মোমেন্ট ফর ইন্ডিয়া-রাশিয়া টাই-ম। এটাই চীনকে বলা এক মেসেজ’। মানে নয়নীমা বসুর লেখাটা যদি বিদেশ মন্ত্রণালয় তাকে প্রভাবিত করে লেখানো বলি তাহলে মালহোত্রার লেখাটা হলো অর্ডার দিয়ে লেখানো! কিন্তু কেন এটা ‘ডিফাইনিং মোমেন্ট’ বলা হচ্ছে এর ব্যাখ্যা নেই। আর এমন তো নয় যে, রাশিয়া ভারতের সাথে কোনো ডিফাইনিং মোমেন্ট তৈরিতে যেতে চাইছিল না; তা তো নয়। বরং ভারতই আমেরিকার সাথে তাকাতে রঙিন চশমা দিয়ে দুনিয়া দেখার সুযোগ নিচ্ছিল আর এটাই ভারতকেই আটকে রেখেছিল রাশিয়ার কাছে ছুটে যাওয়া থেকে। তাহলে ডিফাইনিং মোমেন্টের নাগাল ভারত এতদিন পায়নি নিজের বোকামিতেই...।

তবে এতে যেটা হয়েছে তা হলো, ভারত আমেরিকা থেকে আরো অনেক দূরে চলে গেছে যেখান থেকে ফিরে আবার আমেরিকার কাছে যাওয়াটা অনেক কঠিন হয়ে গেল।

কিন্তু মোদি আমেরিকার সাথে সম্পর্ক ছেড়ে রাশিয়ার সাথে পুরান সম্পর্কটা ফিরে জাগাতে এত সিরিয়াস কেন? প্রথমত মোদি করতে গেছেন সরকারের স্বার্থে নয়। বাইডেনের মানবাধিকার লঙ্ঘন বা মুসলমান দমনের অভিযোগ মোদিকে ২০২৪ সালের নির্বাচনে বেকায়দা অবস্থায় ফেলতে; এই হলো মোদির অনুমান। মোদির পাবলিক রেটিং এখন খুবই খারাপ। আর সেটাকে চাঙ্গা করতে মোদি এখন আরো বেপরোয়াভাবে মুসলমান নির্যাতন শুরু করেছেন। ‘পাবলিক প্লেসে নামাজ পড়া যাবে না। ভোটের আগে ত্রিপুরায় মসজিদে হামলা বা কমিউনিটিতে হামলা করলে অন্য বিরোধীরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে আগিয়ে আসবে না। এই ভয়ে যে এতে সেই বিরোধী দল হিন্দু-ভোট হারাবে।’ আবার চার দিন আগে উত্তরাখণ্ডের হরিদ্বারে কথিত কিছু সাধু দিয়ে প্রকাশ্যে জনসভায় ঘোষণায় আহ্বান জানালেন মুসলমানদের হত্যা করার জন্য। অথচ কেউ মামলা করেনি, এই অজুহাতে পুলিশ চুপ করে বসে আছে। তাই কলকাতার মমতার দল তৃণমূলের এক উপস্থিত সদস্য বাদি হয়েছে। অর্থাৎ এগুলো হলো, আগামী মাসে উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে আবার জিতে আসার একমাত্র উপায়। তাই এই অবস্থায় মুসলমানের ওপর নির্যাতন বা হত্যার অভিযোগ আবার আমেরিকান মানবাধিকার লঙ্ঘনে বড় হয়ে উঠুক এটা মোদি নিতে পারবেন না। তাই আমেরিকার কাছ থেকেই ভারতের এই পলায়ন। তাতে ভারত রাষ্ট্রের স্বার্থ যাই হোক সেটা সেকেন্ডারি, পরে দেখা যাবে। মোদির মূল স্বার্থ এখন নির্বাচনে বিজয়।

তাই এই ডিসেম্বর মাসেই বাইডেনের ওপর পাল্টা চাপ তৈরি করতে ভারত এবার মরিয়া অবস্থায় রাশিয়ার পুতিনের ভারত সফর আয়োজন করে। পুতিনের ভারত সফর ছিল ৬ ডিসেম্বর এবং তা কেবল পাঁচ ঘণ্টার জন্য। কিন্তু আয়োজন, আলোচনার বিষয়বস্তু প্রসঙ্গে ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের প্রপাগান্ডা ছিল শিখরে।

ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয় তাদের দেশীয় মিডিয়ায় কিভাবে হাজির থাকতে চায়, এর কিছু তরিকা দেখতে পাওয়া যায়। দা-প্রিন্টের নয়নীমা বসু বলতে চান যে, ভারত আর শুধু রাশিয়ান অস্ত্রের ক্রেতা নয়। ভারত এখন অস্ত্রবিষয়ে জয়েন্টভেঞ্চারে উৎপাদক। এমনকি অস্ত্রবিষয়ক গবেষণাতেও অংশীদার হতে যাচ্ছে।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com


আরো সংবাদ



premium cement