১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

লেনদেনের ‘বস্তুই’ নাই

লেনদেনের ‘বস্তুই’ নাই - ফাইল ছবি

গত ১০ ডিসেম্বর বাইডেনের আমেরিকার ট্রেজারি বিভাগ বাংলাদেশের বিশেষ প্যারামিলিটারি বাহিনী ‘র‌্যাবে’র চলতি এবং সাবেক সাত অফিসার ও খোদ প্রতিষ্ঠানটির ওপর অবরোধ বা স্যাংশন আরোপের ঘোষণা দিয়েছে। এতে সাবেক র‌্যাব প্রধান ও বর্তমান আইজি পুলিশ বেনজীর আহমেদও আছেন। এ দিকে সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদেরও আমেরিকান ভিসা বাতিল করে তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে বলে দেশের মিডিয়ায় রিপোর্ট এসেছে।

আমেরিকার এই অবরোধ আরোপের রাজনৈতিক-সামাজিক প্রভাব এখন কোথায় কতটুকু পড়বে অথবা এর প্রতিক্রিয়া কী কী, কতদূর হতে পারে অথবা সরকার টিকে থাকতে কোনো সমস্যায় পড়বে কি না- এসব নিয়ে জল্পনা-কল্পনা এখনকার প্রধান আলোচনার বিষয়। তবে এটা বলাইবাহুল্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার যেকোনো বাহিনীর সদস্যরা তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার বিষয়ে এখন অন্তত পুরো পরিস্থিতি ও এর অভিমুখ ঠাহর করার আগ পর্যন্ত সতর্ক হয়ে থাকতে চাইবেন।

সবচেয়ে বড় কথা, গত ১৩ বছরে নানা অনিয়ম রেজিমে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় সেই ব্যবহারিক রেওয়াজ আবার একটু থমকে দাঁড়াতে চাইবে। ‘আবার’ বললাম এ জন্য, যেমন গত ২০১৯ সালে ক্রসফায়ারে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ছিল চার শতাধিক। কিন্তু পরের বছর তা কমে এর মাত্র ১০ ভাগে নেমে এসেছিল। কারণ, কক্সবাজারে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ড। অনেকের অনুমিত ব্যাখ্যা যে, বাহিনীতে দলাদলি বা সহমত ভেঙে যাওয়ায় রেকর্ড উল্টো হয়েছে। কাজেই অবরোধের ঘটনাতেও এই শক থেকে এবার ডাটা কী আসে তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবে মনোবলের ওপর প্রভাব পড়া যে খুবই সম্ভব তা সম্ভবত সরকার আমল করছে। যেমন ১০ তারিখের পর থেকে এখন পর্যন্ত সরকারের প্রধান প্রতিক্রিয়া হলো একেবারে ‘ডিনাইয়াল’ বা পুরোপুরি অস্বীকার করা। সম্ভত তাদের অনুমান, গুরুত্বপূর্ণ আমলা ও দলীয় নেতাকর্মীদের মনোবল ধরে রাখতে এটাই পথ।

এই অবরোধের সিদ্ধান্ত প্রেসিডেন্ট বাইডেনের এক নির্বাহী আদেশে (ইও নং ১৩৮১৮) হয়েছে এবং বাইডেন প্রশাসনের স্টেট ডিপার্টমেন্ট বা পররাষ্ট্র বিভাগসহ আরো অনেক বিভাগের মিলিত তৎপরতার সার ফলাফলে এই অবরোধ আরোপ ঘটেছে। কিন্তু সবশেষে এর পাবলিক ঘোষণাটা দেয়া হয় ট্রেজারি বিভাগ থেকে। কেন?

কারণ বিষয়টা মূলত ফাইন্যান্সিয়াল এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত বিষয়ক। আরেকটু খুলে বললে দুনিয়ায় যত বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেন হয় তার ৮৫ ভাগ বা তারও বেশি হয় আমেরিকান ডলারে; যার সোজা মানে সব লেনদেনের একটা না একটা পর্যায়ে তা হতে হয় ডলারে আর এর পরেই তা কনভার্ট হয়ে নিজ নিজ দেশীয় মুদ্রায়। আর ডলারে হওয়া মানে, কোনো না কোনো স্থানীয় (যেমন ঢাকার) ব্যাংকের এক আমেরিকান ব্যাংকে (ডলারে) যে অ্যাকাউন্ট থাকে এর মাধ্যমে তা হয়েছে। তাই ডলারে লেনদেন মানেই আমেরিকান ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেমের অংশ হওয়া ও তা ব্যবহার করা। মানে ধরা যাক, বাংলাদেশে স্থানীয় ‘ন্যাশনাল ব্যাংকে’ আমার অ্যাকাউন্ট আছে। এই ব্যাংকের আবার কোনো আমেরিকান ব্যাংকে ডলার-অ্যাকাউন্ট আছে। এতে এখন মূলত আমার হয়ে সেই ডলার-অ্যাকাউন্ট কোনো লেনদেন সম্পন্ন করে দিয়ে থাকে। আমার হয়ে আমার দেশী মুদ্রার ব্যাংক অনেক লেনদেন করে দেয় বলে আমরা ডলারে লেনদেন ব্যাপারটা টের পাই না। কিন্তু যখন আমার নামে ‘অবরোধ আরোপ’ করা হবে এর অর্থ, আমার জন্য এই ‘আমেরিকান ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেমকে’ ব্যবহার ও প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয় তখন থেকে।

তাহলে কোনো আমেরিকান ব্যাংক যদি আমাকে নিষিদ্ধ বা অবরোধ করার তথ্য জেনে অথবা না জেনে আমার লেনদেনটাও সম্পন্ন করে দেয় তাহলে কী হবে? বলাই বাহুল্য, এতে এই ট্রেজারি বিভাগ সেই আমেরিকান ব্যাংককে কড়া ফাইন করবে। যেমন- ইরানের ওপর আরোপিত অবরোধে হংকং ব্যাংকের আমেরিকান শাখা এই নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করে এক লেনদেন ঘটিয়ে দিয়েছিল বলে ওই ব্যাংককে ট্রেজারি বিভাগ থেকে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার ফাইন করা হয়েছিল।

আরেকটা কথা, কেন আমেরিকার হাতেই এমন অবরোধ আরোপের ক্ষমতা দেখা যায়? দুনিয়ার অন্য কোনো দেশ বা সে দেশের মুদ্রা এমন অবরোধ আরোপ কি করতে পারে না? অবশ্যই করতে পারে। যেমন- চীনও পাল্টা কিছু কিছু আমেরিকান প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির ওপর অবরোধ আরোপ করে দেখা যায়। কিন্তু দুইটার ফারাক হলো যেহেতু চীনা মুদ্রা ইউয়ানে দুনিয়ায় লেনদেন ডলারের তুলনায় অনেক কম তা বলে চীনা-অবরোধের প্রভাবও অনেক কম। এ ছাড়াও যাদের লেনদেন চীনের সাথেই কেবল সেখানে এর কিছু প্রভাব পড়বে।

আমেরিকা কী কারণ দেখিয়ে এই অবরোধ আরোপ করেছে? তারা দেখিয়েছে যে, বাংলাদেশের র‌্যাব ও এই প্রতিষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট ওসব ব্যক্তি বাংলাদেশে গুরুতরভাবে ‘আইনের শাসন’ ও ‘মানবাধিকার আইন’ ভঙ্গ করেছেন। এখন আমেরিকান প্রশাসনও যদি এমন কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘন করে থাকে তাহলে কি আমরা অথবা অন্য কোনো দেশ একই ধরনের মানে আমেরিকার ওপর অবরোধ আরোপের পদক্ষেপ নিতে পারব? আর পারলে তা করি না কেন?

প্রথমে বলে রাখি, এটা তো এখন আশা করি সবার কাছে পরিষ্কার যে, এই অবরোধের শাস্তি দেয়ার সাথে জাতিসঙ্ঘ বা কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা নেই। কেবল আমেরিকান প্রশাসনই এটা করেছে। তাই বলা যায়, আইনত বাংলাদেশ বা আমেরিকাবিরোধী অন্য কোনো দেশও এমনইভাবে কোনো আমেরিকান ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে চাইলে এমন পদক্ষেপ নিতে পারবে। কিন্তু সবার আগে ব্যাপারটায় আমেরিকা আমাদের সাথে খুব তুলনীয়ই নয়, সেদিকটায় নজর দিতে হবে। কারণ আমেরিকার বিচারব্যবস্থা এখনো তাদের সমাজে যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা রাখে, এ ছাড়া নিজেকেই নিজে সংশোধন করে নেয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন; যদিও এর সবই ভালো এমন আদর্শব্যবস্থা নিশ্চয় এটা নয়। তবে আমাদের দেশে এ ধরনের অভিযোগগুলোর গত ১৩ বছরে কোনো সুরাহা বা প্রতিকার নেই। ফলে এ জায়গায় আমরা আমেরিকার সাথে তুলনীয় নই।

দ্বিতীয় প্রসঙ্গটা আরো গুরুত্বপূর্ণ। এখনো পর্যন্ত ডলারের দেশ আমেরিকা বাদে অন্য কোনো দেশে অবরোধের কোনো শক্ত প্রভাব নেই, এর মূল কারণ কী? মানে অন্য কোনো দেশের অবরোধের তেমন মূল্য নেই। কারণ কিছুটা উপরে বলেছি। বাকিটা হলো, অবরোধ মানে, আসলে প্রতিষ্ঠিত কোনো দেশের ইকোনমিক ও ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেম থেকে কাউকে বের করে দেয়া। অনেকটা একঘরে করে দেয়ার মতো যদিও সেটা আমেরিকান ডলারের অবরোধ হলে তবেই সেই চাপ কার্যকর। কারণ দুনিয়ার ৮৫ ভাগেরও বেশি লেনদেন হয় এই ডলারে। আবার সবকিছুই এত বেশি পরিমাণে ডলার-মুদ্রায় কেন? এমন হওয়ার কারণ, গ্লোবাল বাণিজ্য ও লেনদেন ব্যবস্থাটার নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান আইএমএফ হলেও এটা জন্ম (১৯৪৪) থেকেই একমাত্র আমেরিকান ডলারকে ভিত্তি করে শুরু বা কার্যকর হয়েছিল। ফলে তাতে ডলার আন্তর্জাতিক লেনদেনের একমাত্র মুদ্রা হয়ে যায়। কিন্তু তা হলেও তখনো মূলত ডলার আসলে একটা দেশের, আমেরিকার স্থানীয় মুদ্রা। অর্থাৎ আমেরিকার নিজের মুদ্রার ব্যাপারে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা আমরা অন্য দেশের কেউ বাধা দিতে পারি না।

তাহলে আমরা ডলারকে আন্তর্জাতিক লেনদেনের একমাত্র মুদ্রা হিসেবেও নিয়েছিলাম কেন?
কারণ সে সময় এক আমেরিকান ডলার ছাড়া আর কোনো দেশের মুদ্রা- তার অ্যাকাউন্টে সারপ্লাস বা উদ্বৃত্ত ছিল না। এর মানে আবার কী? মানে হলো, দুনিয়ার যত লোককে ডলারে পেমেন্ট দিতে হবে বা আমেরিকার কাছে পাওনা, এর চেয়ে আমেরিকা যাদের কাছে পাবে মানে তারা ডলারে আমেরিকাকে পেমেন্ট দেবে, এর পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। এই পরিস্থিতিটাকে বলা হয় (ডলার) সারপ্লাসে আছে। আবার একটা টেকনিক্যাল পয়েন্ট হলো গ্লোবাল বাণিজ্য লেনদেন ব্যবস্থা কোনো মুদ্রায় চালু করতে গেলে ওর জন্য গ্লোবাল বাণিজ্যের সেই মুদ্রাকে সারপ্লাস মুদ্রা হতে হয়। ১৯৪৪-৪৫ সালে একমাত্র মার্কিন ডলার ছিল সারপ্লাস। এ ছাড়া বাকি ইউরোপের সব মুদ্রা ছিল মুদ্রাস্ফীতির মুদ্রা। মানে, ভল্টে রাখা সোনার চেয়ে নোট ছাপানো মুদ্রা মান-পরিমাণে বেশি। তাই সেকালে ডলার হয়ে যায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একমাত্র মুদ্রা।

তারা ভারতের মানবাধিকার লঙ্ঘনের খবর তালিকাতে রেখেও ভারতের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের কোনো ঘোষণার মুরোদ দেখাতে পারেননি। উল্টো ভারতকে ‘গণতন্ত্রী রাষ্ট্র’ বলে দাওয়াত দিয়েছেন আর মোদি সেখানে বক্তৃতা দিয়েছেন। বাংলাদেশ নিয়ে আলজাজিরার রিপোর্টে অনেকে ব্লিঙ্কেনের ‘এই চাপাবাজি’র ফাঁদে পড়েছেন। দেখা গেছে, তারা ব্লিঙ্কেনের কথা বিশ্বাস করে নিয়েছেন; আগে যাচাই করেননি

কাজেই একা আমেরিকা সেকালে পাওয়া সুবিধার জন্য একালেও যে অবরোধ আরোপের সুবিধা নিচ্ছে তা সেকালের সবল অর্থনীতির কারণে। এই বাড়তি সুবিধা যা পেয়েছিল সেটা ওর পড়ে পাওয়া সুবিধা, যা কেবল উঠিয়ে নেয়া সুবিধা।

এ জন্য বেনজীর বা ওই সাতজন শুধু আমেরিকাতেই নয় বিদেশে যেকোনো সম্পত্তি কিনতে চাইলে বাধা পাবেন। আগে থেকে কোনো সম্পত্তি থেকে থাকলে টেজারি বিভাগ তা এখন বাজেয়াপ্ত করে নেবে। এ ছাড়া সবচেয়ে বড় কথা, এই সাতজনের সংখ্যাটা যেকোনো সময় আমেরিকা আরো বাড়াতে পারে। এ নিয়ে আমাদের সরকারি আমলা বা দলীয় নেতারা সবসময় একটা ভয়ের মধ্যে কাটাবেন, কী জানি কী হয়! এটা সরকারি কার্যক্রমকে শিথিল করেও দিতে পারে। দায়িত্ব নিয়ে কাজ করার লোক পাওয়ার অভাব দেখা দিতে পারে। তাই সরকার মনোবল বাড়ানোর দিকে নজর বাড়িয়েছে।

কোনো এক প্রফেসরের পরামর্শ হলো, আমেরিকা যেহেতু লবিতে পরিচালিত এক দেশ; ফলে বাংলাদেশ সরকারের উচিত নিজের পক্ষে লবি ফার্ম নিয়োগ করা। পরে আমরা এর পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেনকে দেখতে পাই। ‘মানবজমিন’ লিখেছে- তিনি বলছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র সরকারে অনেক জ্ঞানী-গুণী লোক আছেন তাদের সাথে আমাদের আলোচনা চলছে, সেটি অব্যাহত থাকবে।’ অর্থাৎ সরকার যে আমেরিকান কোনো লবি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দিয়ে সে ভিত্তিতে তৎপর হয়েছে সেটাই তিনি এভাবে আমাদের জানালেন। এর ১২ ঘণ্টার মধ্যে আমরা জানলাম আমেরিকান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন ফোন করেছেন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে। কিন্তু কী কথা হয়েছে সুনির্দিষ্ট তবে কেউ তেমন ব্যাখ্যা করতে পারলেন না; যদিও একটা শীতল প্রভাব অনেকের মধ্যে দেখা গেল যেন বা সরকারের ভাগ্য কী হয় সে উৎকণ্ঠা যেন এখন থেকে কেটে যাচ্ছে যাবে। কিন্তু একই সাথে সবার এটাও অনুমান এটা এত সহজে যায় না। তাহলে?

এবার এ নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। বাস্তব বড় কঠিন। বাস্তবতাকে ঢেকে রেখে লাভ নেই বরং দুদণ্ড আবেগকে বাইরে রেখে বাস্তব চিন্তা করলেই যা জানা যায়। সেই কঠিন বাস্তবতাটা হলো, আমেরিকার এই অবরোধ আরোপের পরে, ‘না সরকারের খুব কিছু আমেরিকাকে অফার করার আছে, না আমেরিকার খুব কিছু পাওয়ার সুযোগ আছে।’ এমন কাঠামোর মধ্যে আছি আমরা দুইপক্ষ। অনেকে খুঁজে পেয়েছে কিংবা মহাসত্য কোনো কিছু দেখিয়ে দিতে পেরেছে মনে করে বলার চেষ্টা করছেন যে, ‘বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অধীনে একাধিক বৈঠক হয়ে থাকে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ফোরাম হচ্ছে পররাষ্ট্র সচিবপর্যায়ে পার্টনারশিপ ডায়ালগ। এ ছাড়াও বিভিন্ন বৈঠকে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা হয়ে থাকে। তারা যেসব বিষয়ে জানতে চায় সেটির উত্তর দেয়া হয়’ ইত্যাদি। কূটনীতি মানে আসলে কথা সরিয়ে কথার প্যাঁচাল, এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

এখানে মোমেনের আসল স্বার্থের কথাটা ছিল, ‘নিষেধাজ্ঞা শিথিলে বাইডেন প্রশাসনের সাথে আলোচনা চায় ঢাকা’। এটা আসলে মুখ্য গিভ অ্যান্ড টেক। আমরা সরাসরি সে জায়গায় যাবো; এতে সময় ও জায়গা বাঁচবে।

কথা হলো, বাংলাদেশ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার দেখতে চায়। কিন্তু বাইডেন কী পেলে তা প্রত্যাহার করবেন? টু দ্য পয়েন্ট বললে এক কথায়, শেখ হাসিনা চীন থেকে সরে এলে। এখন এটা কী সরকারের পক্ষ থেকে করা সম্ভব? একেবারে অসম্ভব। তাহলে সরকার এর বদলে কী কামনা করছে? সে চাইছে বৈষয়িক অন্য একটা কিছু ‘কোনো প্রজেক্ট’ নিয়ে যেন মিটিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু সে কথায় আবার সারবস্তুটা হলো, সরকারের দেয়ার মতো এমন কিছু নেই যা পেলে বাইডেন খুশি হবেন; সব মিটিয়ে নেবেন।

তবে সেই কথা বলার বাহানাতে সরকারের একটা লাভ হয়েছে যে, বাইডেন সরকারের সাথে তারা ‘গুড টার্মে’ আছে, এটা বাংলাদেশের পাবলিককে দেখানো গেছে।

আর বলা হচ্ছে, মানবাধিকার নিয়ে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা হয়েছে। কিন্তু একমত হওয়ার সুযোগ কী আছে? অবশ্যই না। কারণ মূল সমস্যা তো মানবাধিকার মানা না মানাতে নয়। মানবাধিকারের প্রশ্ন তো লংটার্মের পালনীয় শর্ত দিয়ে সবসময় মিটিয়ে নেয়া হয়েছে। গত ২০১৩ সাল থেকে ইউপিআরের নামে জাতিসঙ্ঘও কি এভাবেই সময় বাড়িয়ে চলছে না? যেখানে বাংলাদেশের বয়ান হলো, ‘বাংলাদেশের গুম-নিয়ে কোনো আইন বা করণীয় নেই। তাই বাংলাদেশে কোনো গুম নাই।’

আবার প্রকৃত সমস্যা অনেক গভীরে। আমেরিকা আসলে যা চাচ্ছে বাংলাদেশ তা দিলে তা ধরার পাত্রই আমেরিকার কাছে নেই। যেমন- আস্থা পাওয়া যায় বাংলাদেশের টিকার এমন সুরাহা প্রশ্নে চীনা-বিকল্প কী আমেরিকার মুরোদে আছে? যেখানে সেই সমাধান করে দিয়েছে আমেরিকার কাছে এমন কোনো দেশের নাম নেই। বরং উল্টো, সে তো জি৭-এর সদস্য হিসাবে তাদের জাতিসঙ্ঘের ‘হু’কে দেয়া কমিটমেন্টের সব টিকাই দেয়নি। অথচ বাংলাদেশের সমাজে দোকান হাটবাজার যে খোলা আছে কারখানা চলছে তা তো এই চীনা টিকার প্রাপ্যতার জোরেই। ফলে এখনো বাংলাদেশে আবার টিকা নেই মানেই হবে, লকআউট। টিকা নেই মানে, অর্থনীতি নেই।

যদিও টিকা মানে করোনা থেকে মুক্তি এমন অবস্থায় দুনিয়া পৌঁছায়নি, তবু যতটুকু যা ব্যবসা-বাণিজ্য খোলা, তা চলতে পারছে টিকা দেয়ার জন্যই। আমেরিকার এ নিয়ে চীনের বিকল্প কী দেয়ার আছে আমাদের? বিশেষ করে নয়া ওমিক্রনের মুখে? ও দিকে ম্যান্ডেটবিহীন নিশিথ ভোটের সরকার, এটা এখন বিলিয়ন ডলারের অবকাঠামো প্রকল্প ছাড়া চলতে পারবে না। কর্মীদেরকে ‘প্রকল্প’ না দিতে পারলে তারা থাকবে কেন? আমেরিকা কি চীনের মতো এই অবকাঠামো ফান্ড জোগাতে সক্ষম? তাহলে কিসের ভরসায় এ দেশ চীনকে ফেলে ছেড়ে আসবে? কাজেই কোনো ডিলের জায়গা নেই; বলপ্রয়োগে সরানো ছাড়া সরকারের সরে যাওয়ার জায়গা নেই!

আবার চীন ছেড়ে আসবে কোথায়? কোয়াডে? ‘অসামরিক’ কোয়াড কি সক্রিয়? ভারত কি এখন আমেরিকান ক্যাম্পে আছে- তা না ভারত নিশ্চিত বলতে পারবে, না আমেরিকা! এই নড়বড়ে কোয়াডের কোথায় ঢুকবে হাসিনার বাংলাদেশ?

মূল ইস্যু তো একখানেই- মানবাধিকারে! ভারতের মানবাধিকার প্রশ্নে আমেরিকার যেসব অবরোধ আরোপ করার কথা তা বাইডেনের উচ্চারণের আগেই তো ভারত ভেগে গেছে! এতে এখন বিশৃঙ্খল ভারত-আমেরিকা সম্পর্ক বাইডেন সোজা করবেন কী করে? ইমিডিয়েট কোনো পরিকল্পনা নেই বাইডেনের হাতে।

কূটনীতিতে একটা বড় অংশ থাকে বাকচাতুরি, এজন্য কূটনীতির ভাষাই আলাদা; যদিও সবটাই চাতুরি অবশ্যই নয়। কিন্তু ব্লিঙ্কেন ভেবেছেন এটা শতভাগ চাপাবাজির খেলা। ডেমোক্র্যাসি সামিটসহ গত ৯ তারিখ থেকে বাইডেন কোথাও বলেননি যে, এখন থেকে মানবাধিকার তার সরকার-প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ কথা বলতে চাইলে যেভাবে গুরুত্ব দিয়ে তা প্রকাশ করতে হয় তা করেছেন? কেউ জানে না!

অথচ বাইডেনের পররষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন এখন এশিয়ায় আসিয়ান দেশ সফরে, ইন্দোনেশিয়ার পরে মালয়েশিয়ায় সফর শেষ প্রায়। তিনি প্রতিদিন চাপা মারছেন, মানবাধিকার নাকি তাদের সরকার-প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ! ভয়েস অব আমেরিকার এই রিপোর্টে বলা হয়েছে তারা বিদেশনীতিতে মানবাধিকারকে ঢুকিয়ে (ইনফিউজ) নিচ্ছে। কিন্তু এটা ব্লিঙ্কেনের নিজের ভাষ্য নয়, রিপোর্টার যা বুঝেছে সেই ভাষ্য। আরেক জায়গায় বলেছে, আমরা মানবাধিকারকে বিদেশনীতির কেন্দ্রে নিচ্ছি। এই বাক্য ব্লিঙ্কেনের নয়, নিজের বক্তব্য বলছেন রিপোর্টার। কিন্তু এই প্যারাগ্রাফেরই শেষ শব্দগুলো হলো ‘নো ম্যাটার হয়ার দে অকার’। মানে হলো তাতে মানবাধিকার লঙ্ঘন ‘যেখানেই হোক না কেন’।

এসব শুনে-পড়ে মনে হতে পারে যে, বাইডেন-ব্লিঙ্কেন খুবই সিরিয়াস এবং একটা নীতিগত অবস্থান নিয়ে তারা মানবাধিকার বাস্তবায়নে এগিয়ে আসছেন। ফলে এবার আর তারা দেশ বা ‘কৌশলগত বন্ধু’ দেখবেন না। দেখবেন মানবাধিকারের নীতি কে মানেননি; আর তার ওপর তারা কঠোর হবেন।

তাই কী?
না, এটাই সর্ব্বৃহৎ চাপাবাজি। কারণ তারা ভারতের মানবাধিকার লঙ্ঘনের খবর তালিকাতে রেখেও ভারতের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের কোনো ঘোষণার মুরোদ দেখাতে পারেননি। উল্টো ভারতকে ‘গণতন্ত্রী রাষ্ট্র’ বলে দাওয়াত দিয়েছেন আর মোদি সেখানে বক্তৃতা দিয়েছেন। বাংলাদেশ নিয়ে আলজাজিরার রিপোর্টে অনেকে ব্লিঙ্কেনের ‘এই চাপাবাজি’র ফাঁদে পড়েছেন। দেখা গেছে, তারা ব্লিঙ্কেনের কথা বিশ্বাস করে নিয়েছেন; আগে যাচাই করেননি।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com


আরো সংবাদ



premium cement