২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

“কৌশলগত ‘গণতন্ত্র’ সম্মেলন”

বাইডেনের ‘গণতন্ত্র’ সম্মেলন আসলে হয়ে গেছে কৌশলগত ‘গণতন্ত্র’ সম্মেলন - ছবি : সংগৃহীত

বাইডেন এটিকে নাম দিয়েছেন ‘ডেমোক্র্যাসি সামিট’। যেটা আসলে স্ট্রাটেজিক ‘ডেমোক্র্যাসি সামিট’ বা একে বাংলায় বললে “কৌশলগত ‘গণতন্ত্র’ সম্মেলন”।

আমাদের দেশে ‘কৌশল করা’ শব্দের একটি অর্থ হলো ছলনা করা। ফলে কৌশল মানে হলো, যা বলবে তা করবে না বা করবে আরেকটি- এটিই কৌশল। ঠিক এ অর্থেই বাইডেনের আমেরিকা এক ‘ডেমোক্র্যাসি সামিট’ ডেকেছেন গত ৯-১০ ডিসেম্বর ২০২২। এর অর্থ হলো আমেরিকা যাকে যাকে ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ মনে করে তারাই এই সম্মেলনে দাওয়াত পেয়েছিলেন যার সোজা মানে এই মনে করাটা আগে আমেরিকা ‘মনে করত’ হলেও হবে না, এখনকার বাইডেন সরকারের নিজ লাভালাভের মানদণ্ড দিয়ে যদি বলেন তা হলেই কেবল সেটি ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ বলে মানা হবে। তার মানে, এটিই বাইডেন কথিত গণতন্ত্রের মানদণ্ড।

এক কথায় বললে, বাইডেনের ‘ডেমোক্র্যাসি সামিট’ এতই দেউলিয়া যে, এর ‘ডেমোক্র্যাসি’ ধারণার কোনো সংজ্ঞাই এখানে নেই। সংজ্ঞায় যাওয়ার মুরোদ নেই। তাই দেয়া হয়নি বা কাজ করে না। কোনো ক্রাইটেরিয়াই নেই। কী কী থাকলে ‘ডেমোক্র্যাসি’ মানা হবে তাও জানা যায় না। তারা বলতে পারেন না। কেবল এটি বাইডেন প্রশাসনের স্বার্থের খেয়াল যে, তারা কাকে কাকে ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ মনে করবে।

তা হলে কারা ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ তা বলতে না পারলে ডাকবে কী করে? খুব সহজ সেই একই পন্থা। যেমন কোনো ঘটনাকে তারা ‘টেররিজম’ বলবেন বা বলেন? এরও কোনো সংজ্ঞা বা মানদণ্ড এখনো নেই। কখনো দেয়া হয়নি। এভাবেই চলছে। আর আছে এর বদলে তাদের একটি তালিকা। ওই তালিকায় যেসব রাষ্ট্রের নাম আছে সেটিই টেরর বা জঙ্গি রাষ্ট্র। এই হলো অসততার স্টাইল। বুশের আমল থেকে এ ব্যবস্থা চালু আছে আমেরিকায় এবং তা এখনো বহাল করে রাখা আছে। এমনকি জাতিসঙ্ঘেরও টেরর রাষ্ট্রের কোনো সংজ্ঞা বা ক্রাইটেরিয়া নেই। একই পদ্ধতি। এগুলোকেই বলা যায় ‘মাতবর’ রাষ্ট্রগুলোর বৈষয়িক মানে বিষয়-আশয়ের স্বার্থের ভিত্তিতে ওই তালিকায় নাম ঢুকানো বা বের করা।

কাজেই এটি পরিষ্কার, বাইডেন প্রশাসনের চেয়ে বড় মানবাধিকারের দোকানদার ও স্বার্থবাজ আর কেউ নেই। আমাদের দুর্ভাগ্য হলো, ক্ষমতাবান প্রধান রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন ছাড়া হিউম্যান রাইট লঙ্ঘনের ইস্যুতে কোনো পদক্ষেপ আসার কোনো সুযোগই নেই। একমাত্র এখন যতটুকু যা সম্ভব তা হলো, বিশ্বজুড়ে ব্যাপক জনমতের চাপ কিন্তু প্রতিটি রাষ্ট্রের বেলায় এমন গ্লোবাল জনমত তৈরি প্রায় অসম্ভব। তবু আমাদের লড়তে হবে, এ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

গত লেখায় আমেরিকান ফরেন পলিসি পত্রিকায় মাইকেন কুগেলম্যানের নিয়মিত ‘সাউথ এশিয়া ব্রিফিং’-এর কথা বলেছিলাম। এটি সাপ্তাহিক ব্রিফিং বা কলামের মতো। চলতি সপ্তাহে সেই কুগেলম্যানও বাইডেনের ‘ডেমোক্র্যাসি সামিটকে’ ইস্যুতে কিছুটা সমালোচক হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করেছেন। তিনি আগেই স্বীকার করে নিচ্ছেন যে, ‘ডেমোক্র্যাসি সামিটে’ দাওয়াতি কারা হবেন এ নিয়ে কোনো সংজ্ঞা বা মানদণ্ড এখানে নেই। তিনি লিখছেন তালিকায় নাম থাকা না থাকা নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে আর এতে এই অনুমান তৈরি হয়েছে যে, বাইডেন প্রশাসন ‘অযোগ্য দাওয়াত-দাতা’। কুগেলম্যানের ভাষায় ‘আনফিট হোস্ট’ এবং তিনি বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ার নিমন্ত্রিত দেশের তালিকা দেখে বোঝা গেছে, এই সামিটে দাওয়াত পাওয়ার যোগ্যতা বা একমাত্র মানদণ্ড ডেমোক্র্যাটিক পারফরম্যান্স ছিল না; এটি প্রমাণিত। মানে, অন্য অনেক কিছু ছিল। কুগেলম্যান এমনকি ব্রিটিশ ফ্রিডম হাউজের র‌্যাংকিংয়ের সাথে তুলনা নিয়ে এসে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, বাইডেন কোনো মানদণ্ডই মানেননি, এখানে অনুসরণ করেননি।

এবার তিনি সরাসরি লিখেছেন, আসলে এশিয়ার যেসব দেশের নাম তালিকায় রাখলে ‘আমেরিকার রাষ্ট্রস্বার্থ হাসিল হয়’ (বেস্ট সার্ভ ইটস কারেন্ট ইন্টারেস্ট) সেসব দেশের নামই ওখানে রাখা হয়েছে; অর্থাৎ বাইডেনের তালিকার গরমিলের বোঝা এতই ভারী যে, তিনি সোজা এর দায়দায়িত্ব নেননি। উল্টো সমালোচকদের দলে ভিড়ে গেছেন।

এখন আরেকজনের নাম করব তিনিও মাইকেল কুগেলম্যানের মতোই থিংকট্যাংক ফেলো- আলী রিয়াজ; তিনি কিন্তু একেবারে ‘ধরাশায়ী’ হয়ে গেছেন। সম্ভবত তিনি ভেবেছেন থিংকট্যাংকের সিনিয়র বা জুনিয়র ফেলো হওয়ার কাজটা হলো- উপস্থিত আমেরিকান প্রশাসনের পক্ষে সাফাই দেয়া। এটিই এশিয়ান অরিজিনের সমস্যা কি না, জানি না। আলী রিয়াজ ‘ডেমোক্র্যাসি সামিট’ ইস্যুতে কুগেলম্যানের উল্টো অবস্থানে গিয়ে বাংলাদেশের মানবজমিন পত্রিকায় বিরাট এক সাক্ষাৎকারে বাইডেনের পক্ষে ব্যাপকভাবে সাফাই জোগানোর চেষ্টা করেছেন।

বলাবাহুল্য, সাফাইটি দাঁড়ায়নি। কত উজানে বাওয়া যায় তারও তো কিছু সীমা থাকে! কারণ বাইডেনের রাষ্ট্রস্বার্থের খেয়ালে যে তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে তার পক্ষে সাফাই তিনি কোথা থেকে আনবেন?

এমনকি বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা কী? গত ২০০৭ সালে এই একই কথিত ‘গণতন্ত্র’ মানবাধিকার আর দুর্নীতিবিরোধী কথা বলে ‘তাদের’ আগমন ঘটেছিল। কিন্তু বাংলাদেশকে ভারতের হাতে তুলে দেয়া ছিল এর পরিণতি! এটি কে অস্বীকার করতে পারবে? তা হলে আলী রিয়াজ আজ কোথা থেকে কী আনবেন? কী সাফাই দেবেন?

তাই বাইডেনের ‘গণতন্ত্র’ সম্মেলন আসলে হয়ে গেছে কৌশলগত ‘গণতন্ত্র’ সম্মেলন; অর্থাৎ কৌশলগত; মানে যা বলে তা করে না; করে আরেকটি। ছলনা করে। নানান নখরাও করে। কেন? ইংরেজি স্ট্রাটেজিক শব্দটার বাংলা করা হয় কৌশলগত বা কৌশলী। তাই আলী রিয়াজের মানবজমিনে দেয়া বক্তব্যে তিনি উপায়ন্ত না পেয়ে এই স্ট্রাটেজিক শব্দটা এনেছেন। তিনি সংজ্ঞাহীনতা বা ক্রাইটেরিয়া না থাকার সব অভিযোগ স্বীকার করে নিয়েই যেন বলেছেন, ‘পাকিস্তান ও ভারতকে আমন্ত্রণ জানানোর কতগুলো কৌশলগত কারণ রয়েছে। শুধু যে গণতান্ত্রিক বিবেচনাই প্রাধান্য পেয়েছে, তা নয়। এর কারণ যুক্তরাষ্ট্রকে এ অঞ্চলে ও অন্যান্য অঞ্চলে তার কৌশলগত যে নীতি আছে, সে দিকে গুরুত্ব দিতে হয়েছে। এ কথা এখন আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ভারতকে এখন আর আমরা কোনো অবস্থাতেই ‘গণতান্ত্রিক দেশ’ বলতে পারব না।’

অর্থাৎ এখানে তিনি পুরো সারেন্ডার করেছেন; অর্থাৎ তার গণতন্ত্র এখন আর বিশেষণ ছাড়া শুধু গণতন্ত্র নয়। এর বিশেষণ এখন ‘কৌশলগত’ এই শব্দটা। তবুও সাফাই দেয়ার চেষ্টা বন্ধ করেননি। তাই এবার কৌশলগত শব্দের আমদানি। অথচ কে না জানে যা কৌশলগত তা আর কোনো ক্রাইটেরিয়া বা মাপকাঠি নয়। এটি একান্তই বাইডেনের আমেরিকার লাভালাভের স্বার্থ!

ইমরানের রসিক জবাব
তবে আমেরিকান দাওয়াত মানে গণতন্ত্রের সার্টিফিকেট বেচা বিক্রির এক চরম তামাশা ঘটিয়ে দিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। তিনি এই দাওয়াতে যেতে অপারগতা (decline) জানিয়েছেন। সাথে বলেছেন, তারা চীন-আমেরিকা এমন দলাদলি বা ব্লক ভাগাভাগিতে পড়তে চান না!

যা হোক, মনে হচ্ছে আলী রিয়াজ কুগেলম্যানের কাছে জেনে নিতে পারতেন যে, থিংকট্যাংক ফেলোর চাকরি নেয়া মানেই আমেরিকান প্রশাসনের সিদ্ধান্তের দায় নিয়ে ‘পক্ষে’ লিখতেই হবে তা নয়। দায় না নিয়েও এবং সাথে সমালোচনা করে বা নিদেনপক্ষে অন্যরা কী সমালোচনা করেছে তার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেও সেসব উল্লেখ করে কথা বলা সম্ভব।

তবে সমস্যা হয়তো অন্যখানে এবং তা আরো জটিল হয়েছে; কারণ আলী রিয়াজ অহেতুক কমিউনিস্ট ও নন-কমিউনিস্ট ভাষ্যের বিতর্কে ঢুকে গেছেন। একালে কোনো রাষ্ট্র আর কমিউনিস্ট কি না, এটি কোনো ইস্যুই নয়। স্বৈরাচার বা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র হতে গেলে তাকে কমিউনিস্ট হতে হবে, তা তো নয়। মোদির হিন্দুত্ববাদ নিশ্চয়ই কমিউনিজম নয় বা এই দোষে দুষ্ট নয়। আবার আজ পুতিনের রাশিয়া নিজেও দাবি করে না যে, সে কমিউনিস্ট রাষ্ট্র। এ ছাড়া একালে ব্যতিক্রম বাদে প্রায় সব রাষ্ট্রই আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের সক্রিয় সদস্য হয়ে গেছে; কারণ এই সক্রিয় সদস্যপদ না থাকলে রাষ্ট্রের বৈদেশিক বাণিজ্য সুবিধা থাকে না। আর না থাকলে মানুষকে কাজ দেয়া খাবারসহ দেয়া এসব রাষ্ট্র চালানোই মুশকিল, একালে প্রায় অসম্ভব। এই মাপকাঠিতে চীন-রাশিয়া সবাই আর কমিউনিস্ট কি না সে প্রশ্ন তোলা যায়। আর চীনের ক্ষেত্রে এমন প্রশ্ন তো আরো অচল। কারণ আমেরিকা ক্রমেই আরো দুর্বল হলো ও সক্ষমতা হারিয়ে ফেললে তাকে সরিয়ে চীন গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম বা অর্থনীতির নেতার আসনে বসতে যাচ্ছে। কাজেই সে কমিউনিস্ট কি না, এটি নিয়ে কী করবেন? অবশ্য অভ্যন্তরীণভাবে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি পুরনো বক্তব্যের সাফাইয়ের ওপরই চলে এবং কমিউনিজম-২ বলে কিছু করার ভাবনা আছে, এ কথা ভাবছে।

কাজেই ‘সারা বিশ্বের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে দুটো আদর্শিক অবস্থান তৈরি হয়েছে যার একটির প্রতিনিধিত্ব করে যুক্তরাষ্ট্র। অপরটির প্রতিনিধিত্ব করে চীন ও (বলা যায়) রাশিয়া’- এগুলো একেবারেই ভুয়া কথাবার্তা এবং অচল মুখস্থ কথাবার্তা। একালে এটি কোনো বুদ্ধিমানের পর্যবেক্ষণ বা মিনিংফুল অবজারভেশন হয়নি। ‘ডেমোক্র্যাসি সামিট’কে কমিউনিজমের বুদ্ধি বা ক্রাইটেরিয়া দিয়ে সাফাই ব্যাখ্যা দেয়া আসলেই বেশ অভিনব। তা হলে চীন যখন গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের নেতা হবে, তখন কথিত ‘আদর্শিক অবস্থান’ জিনিসটা কোথায় থাকবে?

আসলে আমাদের ভেবে কথা বলতে হবে। পুরনো কমিউনিজম কী শিখিয়েছে তাই শেষ কথা বা সবচেয়ে জ্ঞানের কথা মেনে নেয়াটাই তো ভিত্তিহীন এবং তা অবাস্তব, ননপ্র্যাকটিক্যাল।

কথা আরো আছে। এই যে গণতন্ত্র শব্দটা আমেরিকা চালু করল মডার্ন রাষ্ট্র সম্পর্কে এটি তো মূল শব্দ বা ধারণা নয়। মূল ধারণামূলক শব্দটি হলো ‘রিপাবলিক’ বা মডার্ন রিপাবলিক। অথচ এটিকেই কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে গিয়ে শব্দটি বদলে আনা হলো ‘গণতন্ত্র’। পেছনের মূল কারণ সোভিয়েত ইউনিয়ন বা চীন- এ দুই রাষ্ট্রই তাদের বিপ্লবের পরে রাষ্ট্রের নামের মধ্যে এই ‘রিপাবলিক’ শব্দটা রেখেছিল। ইউএসএসআর (USSR) এই নামের মধ্যে ‘আর’ মানে রিপাবলিক। ওদিকে চীনের আনুষ্ঠানিক নাম পিআরসি (পিপলস রিপাবলিক অব চায়না) অর্থাৎ এখানেও ‘রিপাবলিক’ শব্দ বর্তমান। তাই কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলো রিপাবলিক নয়, তা বলা সম্ভব ছিল না যদিও কাঠামো সমস্যা আছে। তাই আবার সেই আমেরিকান কৌশল বা স্ট্রাটেজি!

রিপাবলিক শব্দটি ফেলে দিয়ে প্রমিনেন্ট করা হলো নতুন শব্দ ‘গণতন্ত্র’। আর তাতে সবচেয়ে জোর দেয়া হলো, যা কমিউনিস্ট দেশে নেই বা দুর্বল অপুষ্ট; এর একটি যেমন ভোট বা নির্বাচন যার মূল এবং মৌলিক ধারণাটা হলো জনপ্রতিনিধিত্ব। অথচ আমেরিকান কথিত গণতন্ত্রের ধারণায় জনপ্রতিনিধিত্ব ধারণাটার গুরুত্ব নেই। যেমন বাক-ব্যক্তির স্বাধীনতা; অর্থাৎ যেসব শব্দ উচ্চারণ করলে কমিউনিস্টরা বিব্রত হবে। এতে গ্লোবাল আইডিয়ার লড়াইয়ে আমেরিকা মাইলেজ পেয়েছে, সন্দেহ নেই বিশেষ করে কোল্ড ওয়্যারের আমলে। কিন্তু সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে রাষ্ট্রবিষয়ক ধারণাগুলো বোঝাবুঝিতে, রাজনীতির বোঝাবুঝির ক্ষেত্রে। রাজনীতি বা রাষ্ট্র মানে তা নেমে এসেছে ভোটাভুটিতে। এ ছাড়া সবচেয়ে ক্ষতি করেছে রাষ্ট্রবিষয়ক ধারণার বিকাশ ঘটতে না দিয়েও এই ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় ছেদ ঘটানো হয়ে গেছে।

যেমন কেন রিপাবলিক ধারণাটা? এটি যে মনার্কি বা রাজতন্ত্রের বিপরীতে রাজতন্ত্রের পেট চিরে একটি নতুন ধারণা বা সমাধান তা ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে- আমেরিকার এই গণতন্ত্র শব্দটি এনে। যেমন আরো দিক হলো, ব্যক্তি মানুষের উন্মেষ, এর ইতি ও নেতি দিক, পারসোনাল লিবার্টি, রাইট টু লাইভ, বেঁচে থাকার বা জীবনের অধিকার এমনকি খোদ রাজনীতি বা রাজনৈতিকতা শব্দটার অর্থ কী? এসব কিছুকে আড়ালে ফেলা শুধু নয়, কবরে মাটিচাপা দেয়া হয়ে গেছে। আর সব কিছুকে নামিয়ে আনা হয়েছে ‘গণতন্ত্র’ আর ভোটাভুটিতে। কোল্ড ওয়্যারের যুগের এই আমেরিকা-সোভিয়েত এই ব্লক রাজনীতির ধারণার আড়ালে। অথচ আজো এসব বাজে তর্ক- আমেরিকা-সোভিয়েত ঠাণ্ডা যুদ্ধে কার পক্ষে মাইলেজ আসবে- সেসব নিজ অযোগ্যতাতেই আপনাআপনিই ক্ষয়ে লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। কারণ প্রশ্নটা আমেরিকা না সোভিয়েত- কে ভালো এর তর্ক একেবারেই নয়। কারণ আমাদের জানতে ও চিনতে হতো ও হবে রাষ্ট্রকে। নিজের রাষ্ট্র ও সমাজকে গড়তে।

যারা কমিউনিস্ট থেকে এখন থিংকট্যাংক ফেলো হয়েছেন তাদের জন্য সম্ভবত এটি কষ্টসাধ্য যে, একটি মনার্কির বিপরীতে রিপাবলিক তুলনা করে না বুঝলে জানা যাবে না যে, রাজতন্ত্রে ব্যক্তি-মানুষ বলে কিছু নেই। ধারণাটিই নেই, আসেনি। আমেরিকা কী করে ‘লিবার্টির’ আমেরিকা হয়ে উঠেছে সেই ইতিহাসে আগ্রহ নেই। আগ্রহ হলো, আমেরিকা কী করে ‘গণতন্ত্র’ নামে একটি ধাপ্পাবাজির প্রচারক হয়েছে অথবা এটি দিয়ে সোভিয়েতকে হারিয়েছে, সেখানে।

ইতিহাসে এক ট্রাইবাল সমাজ পেরিয়ে অনেক পরে মানুষের উন্মেষ হয়েছে তাও আবার রাজতন্ত্রের যুগের শেষপ্রান্তে এসে। তাও তাতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যক্তির উন্মেষের খবর হয়নি, জানা হয়নি অনেক সমাজে। যেমন আমেরিকা তালেবানদের পশ্চাৎপদ বলে কিংবা ইসলাম পশ্চাৎপদ বলে প্রপাগান্ডা করতে ভালোবাসে। আর এসব বলাবলিকে কাজে লাগাতে চায় এভাবে যে, ওরা পশ্চাৎপদ; কাজেই তার এখন আমেরিকান আধিপত্য মেনে নিতে হবে, কায়েমের কাজে লাগতে হবে। অথচ নিজেরা যে কথিত ‘গণতন্ত্রের’ প্রচারে লেগে আছে যেটি স্রেফ ভোটাভুটি আর আমেরিকার তাতে স্বীকৃতি। অথচ এসবের বিপরীতে আমাদের দরকার নিজ রাজনীতি ও রাষ্ট্রধারণার বিকাশ, নিজ রাষ্ট্র গড়ে তোলা।

একালের আমেরিকা আরো ভয়ঙ্কর। সে জুয়াচোর। একটি উদাহরণ দেবো, বাকিটা সবাই বুঝবে। ইটিআইএম- ইস্টার্ন টার্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্ট (ETIM)। নাম শুনে অনেকের বুঝতে কষ্ট হতে পারে, তাই চিনিয়ে দেই। এরাই হলো চীনা উইঘুরের সশস্ত্র সংগঠন। এই সশস্ত্রতার এখনকার বসবাস ও তৎপরতা আফগানিস্তানে আশ্রয় নিয়ে।

বুশের আমল থেকেই এরা টেরর বা সন্ত্রাসের দল হিসেবে আমেরিকান ও ইউএনের লিস্টে তালিকাভুক্ত। কিন্তু তা এখন ‘ছিল’ বলতে হচ্ছে; কারণ ডোনাল্ড ট্রাম্প তো খুবই বুদ্ধিমান ও ধূর্ত করিৎকর্মা। তিনিই এই দলকে নিজ সন্ত্রাসবাদের তালিকা থেকে মুক্ত করে দিয়েছেন। এর উদ্দেশ্য কী? খুবই ‘মহৎ’! আর ইটিআইএম এখন কী নিয়ে ব্যস্ত ও কোথায়?

পাকিস্তানে চীনা অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পের শেষ নেই। তেমনই এক প্রকল্পের এলাকায় ভেতরের সেটিও কয়েক মাইল বলে তাদের অভ্যন্তরীণ নিজস্ব বাস সার্ভিস চালু আছে, যা দিয়ে ইঞ্জিনিয়ার থেকে শ্রমিক বা যেকোনো কর্মী চলাচল করে থাকে। সেই বাসে বোমা বেঁধে রেখে তা দিয়ে হামলা করে। তেমনই এক বাস পাশের নদীর তীরে বা খাদে পড়ে যায়। এতে ১৩ জন চীনা ইঞ্জিনিয়ার মারা যান। আর এ হামলার নায়ক ইটিআইএম।

ট্রাম্পের তালিকামুক্তি কেন তা আমরা নিশ্চয় বুঝলাম। কিন্তু খেয়াল করতে হবে; তা হলে এটি কি চীনের সাথে আমেরিকার স্বার্থবিরোধ লড়বার ‘গণতান্ত্রিক’ পদ্ধতি! না, এটি ভাবার কারণ নেই, বাইডেন এসব থেকে দূরে। ট্রাম্প এ তালিকামুক্তি দিয়েছিলেন ক্ষমতা ছাড়ার অল্প আগ দিয়ে। মানে হলো, এর পুরো ‘লাভালাভ’ ও পারফরম্যান্স সব বাইডেনের।

এর পরে তালেবানরা গত আগস্টে ক্ষমতা দখলের আগে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে তাদের নেতারা এক সাক্ষাৎ করেছিল। ওই মিটিং শেষে তালেবানরা প্রকাশ্যেই মিডিয়াকে জানিয়েছিল, এমন সশস্ত্র গ্রুপগুলো যারা আফগানিস্তানে আশ্রয় নিয়ে অন্য দেশে তৎপরতা চালাচ্ছে তাদের আর আশ্রয় দেবে না।’ আমরা অনেকেই জানি এখনকার আফগানিস্তানে আইএস (কে) বা খোরাসান গ্রুপ যারা তালেবানদের চেয়েও আরো রেডিক্যাল ও আলাদা, তাদের কামনা তালেবানরা যেন বিফল ও পরাজিত হয়, তারা অপেক্ষা করছে। এ দিকে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে ওই সাক্ষাতের পরে ইটিআইএম এর পর থেকে অবাধে আফগানিস্তানে চলাচল সীমিত করে ফেলে এবং ওই আইএস (কে) এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রটেকশনে তৎপর হয়।

চীন-আমেরিকার স্বার্থবিরোধ থাকতেই পারে। কিন্তু সেই বিরোধে আপার-হ্যান্ড পেতে ইসলামী সশস্ত্র গ্রুপকে লেলিয়ে দিতে হবে, ব্যবহার করা হবে? এটি কোন গণতন্ত্র?

তা হলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল, বাইডেনের ‘গণতন্ত্র’ এই বুলির মূল কথা কী?

যেটা আমেরিকার রাষ্ট্রস্বার্থ সেটাই গণতন্ত্র!

তা হলে বাইডেনের এই ‘ডেমোক্র্যাসি সামিট’ কী বস্তু? আলী রিয়াজ আমাদের গণতন্ত্রের ‘দুটো আদর্শিক অবস্থান তৈরি’ শিখিয়েছেন। আমরা নিশ্চয় এখন এর মর্মবস্তু বুঝতে পেরেছি। আমেরিকান রাষ্ট্রস্বার্থটাই হলো আমেরিকান ‘গণতন্ত্রের আদর্শ’।

তা হলে বাংলাদেশের সরকার নিপীড়ক, গুম-খুন থেকে নিশীথ ভোট ইত্যাদি অভিযোগের এখানে শেষ নেই। আমরা সবাই এসব নিয়েই আছি, নিরন্তর ভুগছি।

এখন এতে আমেরিকা যদি আগ্রহ নেয় তার মানে যেটা ‘আমেরিকার রাষ্ট্রস্বার্থ সেটাই গণতন্ত্র!’ এই সূত্র অনুসারে এগিয়ে আসে তা হলে আমাদের এখন খোঁজ নিতেই হয় যে এখানে আমেরিকার রাষ্ট্রস্বার্থটা মানে গণতন্ত্রটা ঠিক কী?

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
গাজার ২টি হাসপাতালে গণকবরের সন্ধান, তদন্তের আহ্বান জাতিসঙ্ঘের তীব্র তাপদাহে পানি, খাবার স্যালাইন ও শরবত বিতরণ বিএনপির ৬ জেলায় বয়ে যাচ্ছে তীব্র তাপপ্রবাহ, সিলেট বিভাগে বৃষ্টির সম্ভাবনা মাতামুহুরিতে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ ২ আপিল বিভাগে ৩ বিচারপতি নিয়োগ ফেনীতে ইসতিসকার নামাজে মুসল্লির ঢল গাজা যুদ্ধের মধ্যেই ১০০ শতাংশ ছাড়িয়েছে ইসরাইলের সামরিক ব্যয় মন্ত্রী-এমপি’র স্বজনরা প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করলে ব্যবস্থা : কাদের গ্যাটকো মামলা : খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে শুনানি ২৫ জুন বুড়িচংয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১ গলাচিপায় স্ত্রীর স্বীকৃতির দাবিতে ৩টি সংগঠনের নেতৃত্বে মানববন্ধন

সকল