২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

রাশিয়ার ত্রয়কা ভারতের বুকে শেল মেরেছে

-

বাঁশের চেয়ে কঞ্চি কখনো কখনো বেশি শক্তি দেখাতে চায়। আটলান্টিক কাউন্সিল থিংকট্যাংকের ফেলোরা মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের চেয়েও বুদ্ধিমান দেখাতে চাচ্ছেন নিজেদের। আফগানিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে হিমশিম খেয়ে, কী বলবেন এখন, কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন তা হাতড়ে অসহায় অবস্থায় মুখ বন্ধ হয়ে আসার দশায় তারা। উপায়ান্তর না পেয়ে তারা এখন আমেরিকাকে সাধুপুরুষ আর মহাভদ্রলোক সাজিয়ে এরপর চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান, ইরান এমনকি ভারতকেও অভিযুক্ত করে নিজ মান বাঁচানোর চেষ্টা শুরু করেছেন। বলার চেষ্টা করছেন এসব দেশের স্বার্থের কারণেই তালেবানেরা আফগানিস্তানে ক্ষমতায় ফিরে আসার অবস্থা তৈরি হয়েছে।

২০ বছর ধরে আফগানিস্তানে আমেরিকা তালেবানবিরোধী পুতুল সরকার বসিয়ে যা খুশি তাই করার সুযোগ নিয়ে চলেছিল। অথচ এই কনসালট্যান্ট ফেলোরাই প্রশ্ন তুলে বলছেন, ‘কেন আফগানিস্তানে এমন রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারেনি, যেখানে তালেবানের বিকল্প শক্তি তৈরি হয়, কেন তালেবানের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকল? এখন এই প্রশ্ন তাদেরকেই আমরা জিজ্ঞাসা করব। তাদেরকে এর জবাব দিতে হবে। তাই তারা বুদ্ধিমানের মতো আগে নিজেই প্রশ্ন তুলে জবাব এড়িয়ে যাচ্ছেন, কোনো উত্তর দিচ্ছেন না। এরাই আবার পাকিস্তানকে দায়ী করছেন যে পাকিস্তান হলো তালেবানের ‘আশ্রয়দাতা’। যেন সে জন্য আজকের আফগানিস্তানে তালেবানরা ফিরে আসার সুযোগ পাচ্ছে। অথচ ঘটনা হলো আফগানিস্তান বা তালেবানরা কেউই পাকিস্তানের শত্রু বা বিরোধী ছিল না। আমেরিকানরাই জবরদস্তিতে পাকিস্তানকে বাধ্য করেছে, আমেরিকান আফগান-শত্রুতাকে যেন পাকিস্তানও নিজের শত্রু মনে করে। আর যাতে আমেরিকা পাকিস্তানে সামরিক ঘাঁটি বানিয়ে সেখান থেকে উড়ে গিয়ে আফগানিস্তানে বোমা ফেলে আসতে পারে। অথচ সেই আমেরিকাই উল্টো পাকিস্তানকে ‘জঙ্গি আশ্রয়দাতা’ দেশ বলে প্রপাগান্ডা করে গেছে; অর্থাৎ কার্যত এভাবে পাকিস্তান তো আমেরিকান হুকুমে চলে যাওয়া এক দেশ হয়েই ছিল। তা হলে এই পাকিস্তান আবার আমেরিকানদের শত্রু তালেবানদের নিজ দেশেই আমেরিকানদের পাশাপাশি আশ্রয় দেয় কেমন করে!

আবার একালে আফগানিস্তান সব খোয়ানো আমেরিকার সেই আফগানিস্তানকে ফেলে পালানোর ইচ্ছা বহুদিনের, সেই ওবামা আমল থেকে। এ কারণে তারাই সে সময় চীনকেও আফগানিস্তানে সংশ্লিষ্ট হতে বলেছেন, গ্লোবাল নেতার কিছু কিছু দায়-দায়িত্ব চীনও নিক এই উদ্দেশ্যে, চীন তালেবানদের সাথে কথা বলুক মূলত এ লক্ষ্যে। এক থার্ড পার্টি দেশ কাতারে- তালেবানরা যেন অবাধে যেতে-আসতে ও যে কারো সাথে মিটিং করতে পারে; এ ব্যবস্থা ওবামা আমলেই ২০১৫ সাল থেকে চালু করা হয়েছিল। অরিজিনালি ‘সাংহাই করপোরেশন অর্গানাইজেশন’ বা এসসিও জোট গঠন করার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল এটিই। যে কারণে সেন্ট্রাল এশিয়ান দেশ আর চীন ও রাশিয়াকে নিয়েই গঠন করা হয়েছিল এসসিও। অথচ আজ আমেরিকান ফেলোরা প্রপাগান্ডা শুরু করেছেন যেন চীন-রাশিয়া নিজ স্বার্থেই তালেবানদের ফেরত আনছে।

আবার ওবামার পরে ট্রাম্প আরো জব্বর উদ্যোগী যেন পারলে এখনই আফগানিস্তানকে ফেলে নিজ সেনাদের নিয়ে পালিয়ে যান। তিনিই তো সেনা প্রত্যাহারের আলোচনা আফগান পুতুল সরকারের সাথে করেননি; বরং সরাসরি কেবল তালেবানদের সাথেই কথা বলেছিলেন, ‘ডিল’ করেছিলেন। সেনা প্রত্যাহারের শেষ দিন কী হবে, তাও পর্যন্ত ঠিক করেছিলেন; যা বাইডেন ক্ষমতায় এসে পুনঃঅনুমোদন দিয়ে সেটি ‘তারও চুক্তি’ বলে স্বীকৃতি দেন। অথচ ট্রাম্প তালেবানদের সাথে কিসের বিনিময়ে কী ডিল করে গেছেন, সেটি প্রকাশ্য নয়। তালেবানরা নিজ উদ্যোগে ক্ষমতা দখল করুক আর এতে ট্রাম্পই অনুমোদন দেয়ার বিনিময়ে- এ শর্তেই আমেরিকান সেনা প্রত্যাহার বাধাহীন করে দিয়ে যাননি, তা আমরা কি নিশ্চিত? সে জন্যই কি থিংকট্যাংক ফেলোরা আমেরিকা বাদে বাকি সবাইকে আগাম দায়ী করা শুরু করেছেন যেন তাদের জন্যই তালেবানরা ক্ষমতায় ফিরে এসে যেতে পারে বলেন, প্রপাগান্ডা শুরু করেছেন। মানে তারা কলসালট্যান্ট এই পরিচয় ধুলায় লুটিয়ে একেকজন ‘প্রপাগান্ডিস্ট’ পরিচয় নিতে চাইছেন! অথচ কী চুক্তি হয়েছে অন্তত ইনফরমালি কিছু তাদের অজানা থাকার কথা নয়!

রাশিয়ার পুতিনের ত্রয়কা
অরিজিনালি ত্রয়কা (troika) শব্দের আক্ষরিক অর্থ সেকালের রাশিয়ার তিন ঘোড়ায় টানা গাড়ি; অর্থাৎ তিন শক্তির সমন্বয়ে কোনো অ্যাকশন। এখানে এই তিন শক্তি বলতে এরা হলো- রাশিয়া, আমেরিকা ও চীন। হ্যাঁ, অবশ্যই পরস্পর রাজনৈতিক প্রতিদ্ব›দ্বী হলেও এরা আফগান-তালেবান ইস্যুতে একসাথে কাজ করতে নেমেছে। আর এ কাজে মানে আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের পর যেন আফগানিস্তানে কোনো বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা বা সশস্ত্র তৎপরতার ঢল নেমে না আসে, অতীতে যেমন আফগানিস্তানে অনেকবারই ঘটেছে। কিন্তু সেটিই বা ত্রয়কা চাচ্ছে কেন?

খুবই সংক্ষেপে বললে, সেনা প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিবদমান পক্ষ ও স্বার্থগুলো একত্রিত হয়ে একটি রাজনৈতিক নেগোশিয়েশনে ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি থিতু সমাজ, একটি ফাংশনাল সরকার আর ন্যূনতম আইনশৃঙ্খলা স্থাপন করতে যেন সক্ষম হয়, সে কাজে সহায়তা করা এই ত্রয়কার উদ্দেশ্য।

গত ২০১৮ সালের শেষে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন তালেবানদের সাথে কথা বলার, যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সেনা প্রত্যাহার। কারণ তার সরকারের অর্থ আফগানিস্তানে ঢালার অপচয় চলছিল, কোনো সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য হাসিল ছাড়াই। তাই পরের বছর তিনি এক আফগান অরিজিন আমেরিকান ডিপ্লোম্যাট- জালমে খলিলজাদেকে তার সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন, যাতে তিনি তালেবানদের প্রধান আলোচক বা নেগোশিয়েটর মোল্লা আবদুল গনি বারাদরের সাথে আমেরিকান সেনা প্রত্যাহার নিয়ে কথা শুরু করতে পারেন। আর মূলত প্রথম থেকেই তালেবানদের শর্তানুসারে আফগান পুতুল সরকারের কোনো প্রতিনিধি কোনো সভাতেই না রাখার নিয়ম চলে আসছে। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে একটি চুক্তিতে তারা পৌঁছাতে সমর্থ হয়েছিল আমেরিকার নির্বাচনের বছর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির ২৯ তারিখে; যদিও এর বাস্তবায়নের মূল উদ্যোগের মাঠের কাজ গড়িয়ে যায় পরের বছরে। অর্থাৎ তত দিনে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ২০২১ সালের জানুয়ারিতে শপথ নিয়ে নিয়েছেন।

কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরের পরে অনেক স্থানে বড় ঘটনা হয়ে দাঁড়ায় তালেবানদের সশস্ত্র তৎপরতা। এ ঘটনায় তাই উদ্বিগ্ন হয়ে উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে এসেছিল পুতিনের রাশিয়া। কেন?

২০০৮ সালে জি-৮ গ্রুপ থেকে রাশিয়াকে বের করে দেয়ার পর রাশিয়া-আমেরিকার সম্পর্ক একেবারেই নিচে নেমে গিয়েছিল। তা কখনোই ভালো হয়নি। কিন্তু আফগানিস্তানের যেকোনো ঘটনা-দুর্ঘটনায় আজো রুশ স্বার্থের জন্য অনেক কিছু যায়-আসে, তাই গুরুত্বপূর্ণ। তার মূল কারণ, সেন্ট্রাল এশিয়ান দেশগুলোর স্থিতিশীলতা রক্ষা করাই রাশিয়ার স্বার্থ। এসব দেশ অতীতে জার সাম্রাজ্যের অধীনে দখলে গিয়ে প্রথম রাশিয়ান শাসিত হতে শুরু করেছিল। কিন্তু সেই থেকে কমিউনিস্ট আমল পেরিয়ে এখন পর্যন্ত আশপাশে ইসলামী সমাজ-রাজনীতির প্রভাবে যেন সেন্ট্রাল এশিয়ায় সাজানো রুশ ভারসাম্য নষ্ট না হয়ে যায়, এ দিকে পরের রাশিয়ার সব শাসকের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল।

যেমন ১৯৭৯ সালের এপ্রিলে ইরান বিপ্লবের পরে এর প্রভাবে না সেন্ট্রাল এশিয়ান দেশগুলোতে অভ্যন্তরীণ আন্দোলন-বিপ্লবের ছাপ পড়ে যায় বা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে; এই ভয়ে ভীত হয়েই ছয় মাসের মধ্যে ব্রেজনেভের সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরেই আগাম আফগানিস্তান দখল করেছিল। কারণ কার্যত আফগানিস্তান হলো ইরান থেকে সেন্ট্রাল এশিয়াকে বেশির ভাগ জায়গায় আলাদা করার দেয়াল। তাই সেই ইরান বিপ্লবের পর শুরু হয়ে আফগানিস্তান আজো এক হট স্পট ও আন্তর্জাতিক ইস্যু।

এ কারণে রাশিয়া-আমেরিকা সম্পর্ক যতই নিচে থাকুক না কেন, পুতিনের রাশিয়া আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা দেখতে পাওয়ার উদ্দেশ্যে রাশিয়াকে অনেক কিছু করতেই হয়। তাই উদ্যোগ নিয়ে আমেরিকা ও চীনকে সাথে নিয়ে ত্রয়কা গড়ে নিয়েছেন পুতিন। সেই পুরনো উদ্দেশ্য, আফগানিস্তানের অস্থিরতার আঁচ যেন মধ্য এশিয়ার দেশে না পড়ে। এ দিকে চীন এখন আমেরিকার বদলে গ্লোবাল নেতা হওয়ার দাবিদার। ফলে তারও দায়-স্বার্থ আছে। এ ছাড়া আফগানিস্তান, ইরান ও সেন্ট্রাল এশিয়ার সাথে চীনের খোদ সীমান্তই আছে।

তা হলে এই ত্রয়কায় চীন ও রাশিয়া এই দুই রাষ্ট্রের সাথে আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা শত্রুতা থাকলেও মিলের ভিত্তিটা ঠিক কী? কেন?

এই ভিত্তিটা হলো, এক গ্লোবাল পলিটিক্যাল অর্ডার, যার কেন্দ্রে আছে জাতিসঙ্ঘ। ১৯৪৫ সালের পরে যে গ্লোবাল একটা রাজনৈতিক ব্যবস্থা জাতিসঙ্ঘকে ঘিরে তৈরি করা হয়েছিল, সেটিই এর ভিত্তি। কেন?
এই জাতিসঙ্ঘকেন্দ্রিক গ্লোবাল রাজনৈতিক ব্যবস্থাটা সম্পর্কে যেটা গত ৭৫ বছর ধরে ফাংশনাল হয়ে আছে, এটি নিয়ে অজস্র অভিযোগ এবং এর নানান খুঁত ও ঘাটতি নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। তা সত্ত্বেও এটিই দুনিয়াতে একমাত্র গ্লোবাল পলিটিক্যাল অর্ডার কায়েম করা এক সিস্টেম। আর এটি না থাকার মানে ১৯৪৫ সালের আগে ফিরে যাওয়া, যখন যুদ্ধ করারও কোনো নিয়মনীতি নেই; চাইলে যেকোনো জনগোষ্ঠীকে ‘নির্মূল’ করে দেয়াও ছিল; রেসিজম বৈধ ছিল মানে কোনো বাধা ছিল না- যা খুশি, জোর যার রাজ্য তার এবং সর্বোপরি কাউকে দখল নেয়া বা কলোনি করে রাখাও ন্যায্য ছিল। কাজেই এটিই সবেধন নীলমনি, এক গ্লোবাল পলিটিক্যাল সিস্টেম। আর এটি দাঁড়িয়ে আছে যেকোনো ভ‚খণ্ডের নাগরিক বাসিন্দারা হলো আসল ক্ষমতার উৎস; যেকোনো ভ‚খণ্ড কার দ্বারা শাসিত হবে, তা নির্ধারণের একমাত্র হকদার ভ‚খণ্ডে বসবাসকারী জনগণ- এ ভিত্তিতে। তাই এটি মূলত অন্য কারো দেশ দখল বা কলোনি করে নেয়ার বিরুদ্ধে এক রক্ষাকবজ। আর সেখান থেকেই, এটি পরোক্ষে রাজা-বাদশাহদের শাসন ক্ষমতাকেও বৈধতা দেয় না। তবে একটি ছাড় আছে যে, আগে থেকে চলে আসা কোনো রাজতন্ত্র বা বাদশাহতন্ত্রকে জাতিসঙ্ঘ অবৈধ বলতে চায় না, যতক্ষণ না ওর অভ্যন্তরীণ জনগণ সংগঠিত হয়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে তা চায় বা দাবি করে।

ঠিক এ কারণে ত্রয়কার কাজের ভিত্তি জাতিসঙ্ঘ। আর ২০১৯ সালের মার্চ থেকে এই ত্রয়কা নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন মিটিং করে আসছে, সেখানে জাতিসঙ্ঘের প্রতিনিধিকেই সংশ্লিষ্ট করেছে। আর তাই সেখানে ৩০ নভেম্বর ২০২০ এক রেজ্যুলেশন হলো, তারা জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের ২০২০ সালের এক সিদ্ধান্ত সমর্থন করছে। আর যেখানে বলা হয়েছে, তারা ‘তালেবানদের ইসলামিক আমিরাতকে পুনঃস্থাপন সমর্থন করছে না।’ বরং আহ্বান রাখছে যেন আফগানিস্তানের বিবদমান সব পক্ষকে সাথে নিয়ে সবাই সংশ্লিষ্ট হয়ে একটি রাজনৈতিক মীমাংসায় পৌঁছায় এবং বিবাদের একটি শান্তিপূর্ণ সুরাহা যেন হয়।

এসব প্রস্তাবকে কিভাবে দেখব ও বুঝব?
প্রথমত শুরুতে যেমন বলেছি আমেরিকান থিংকট্যাংক ফেলো যারা সব দোষ তালেবানের বলে তালেবানবিরোধী প্রপাগান্ডায় নেমে গেছেন, অথচ এরা জানেন একটি ত্রয়কা-উদ্যোগ কাজ করছে; যেখানে রাশিয়া, আমেরিকা ও চীন এই তিন শক্তিই সক্রিয় এবং তারা তালেবানদের কোনো আগাম শত্রুজ্ঞান করে ক্যাম্পেইন করতে বসেনি। কেবল ডায়লগে সবাইকে নিয়ে বসে একটি পলিটিক্যাল সেটেলমেন্ট করে নিতে বলছে, সাহায্য করতে চাইছে। অথচ এই থিংকট্যাংক ফেলোরা তালেবানবিরোধী প্রপাগান্ডায় আগাম নেমে গেছেন, যা আসলে ভারতের অবস্থান! এমনকি এটি আমেরিকার অবস্থানও নয়।

তবে এই গ্লোবাল পলিটিক্যাল ব্যবস্থা আপনি পছন্দ করেন না, তা হতেই পারে। জাতিসঙ্ঘ একটি গ্লোবাল পলিটিক্যাল ব্যবস্থা দাঁড় করানোর শেষ কথা নয়। বরং কেবল শুরু যাকে অনেক পথ হাঁটতে হবে, বদলাতে হবে, অন্য অনেক অপরকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, ডায়লগ করতে হবে। যেমন ধরা যাক, আপনি এক ইসলামিস্ট অথবা কোনো কমিউনিস্ট, যিনি গ্লোবাল পলিটিক্যাল ব্যবস্থাটাকে পছন্দ করেন না বা এটি তার ফেভারে বলে দেখেন না।

এ ব্যাপারটা অনেকটা আগে থেকে গড়ে থাকা একটি শহরের মতো, যেখানে ওই শহরের ভেতরে বাসিন্দাদের বসবাস ও থাকা বা চলাচলের জন্য প্রচলিত নিয়মকানুন আইন কনভেনশন আছে। আপনি এখন বাইরে থেকে এসে ওই শহরেই বাস করতে চাইছেন। কিন্তু আপনার দাবি ওই সব নিয়ম আইনের কিছুই আপনি মানেন না; কারণ এগুলো তৈরির সময় আপনার মতামত নেয়াই হয়নি- এমন কথা বলে যদি ওই শহরে ঢুকতে যান এতে ফলাফল হতে পারে এই যে, ওরা উল্টো আপনাকেই আউটকাস্ট, কী বাইরের লোক বা গোঁয়াড়, আনকুথ কিংবা জঙ্গি বলে বের করে দিতে পারে। আইনের শাসন না মানা লোক বলে ট্যাগ দিয়ে আপনাকে একা করে দিতে পারে; আর এমন ইমেজের কারণে হয়তো আপনি আর কোনো সহানুভ‚তি বা আপনার কী হয়েছে, তা শুনানোর মতো কাউকেই পেলেন না- এমনভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে রাখার দশায় পড়ে যেতে পারেন।

তা হলে একে মোকাবেলার উপায় কী? এ কারণে ওই শহরে ঢুকতে গেলে আপনাকে পরিকল্পনা-কৌশল নিয়ে এগোতে হবে। তাই সম্ভবত এর চেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে প্রথমত আপনি তাদের নিয়ম মানেন বলে প্রবেশাধিকার তো নেবেন আগে। এরপর ওদের নিয়ম মেনেও চলেন। আর এবার কেউ আপনার পাল্টা নিয়মটা যা আপনি চালু করতে চান, সেটি কেন বেশি ভালো এই প্রচার চালান আশপাশে। ওই শহরের বিভিন্ন রাজনৈতিক সঙ্কটে নিজের ভালো চিন্তাগুলো তুলে ধরার চেষ্টাও করতে পারেন। এরপর সময়ে আপনার দলে ভারী বুঝলে তখন নিয়ম বদলানোর চেষ্টা বা উদ্যোগ নেন।

অর্থাৎ এর মূল কথাটা হলো- খেলার পুরনো নিয়ম বদলাতে চাইলে দূরে গ্যালারিতে বসে থেকে তা বদলাতে পারা যাবে না। উল্টো আপনাকেই এরা উপড়ে ফেলে দিতে পারে। এর চেয়ে বরং খেলায় অংশ নিয়ে খেলতে খেলতেই এমন পুরনো নিয়ম বদলাতে চেষ্টা করতে পারেন। এর সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এই পথ না ধরলে কী হবে?

সেটি একটি উদাহরণে বলা যাক। গত ৩০ জুলাই আমাদের স্থানীয় এক দৈনিকের খবরের শিরোনাম “ফজলের ‘কৌতুক’ চিরতরে স্তব্ধ করল তালেবান”। তিনি আফগান পুতুল সরকারের এক পুলিশ অফিসার ফজল মোহাম্মদ। তিনি অনলাইনে হাস্যরসাত্মক নানান ভিডিও পোস্ট করার জন্য আফগানদের কাছে তার পুলিশ পরিচয়ের চেয়ে ‘কৌতুক অভিনেতা’ বলে বেশি পরিচিত। কিন্তু তালেবানরা নাকি প্রায় দুই সপ্তাহ আগে বাড়ি ফেরার পর তাকে তুলে নিয়ে যায়। পরে তাকে হত্যা করে। এ ক্ষেত্রে হত্যার কথা শুরুতে অস্বীকার করলেও গত সপ্তাহে এ-সংক্রান্ত একাধিক ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। তার পরই তাকে হত্যার কথা স্বীকার করে তালেবান। এ হলো খবরটি। তবে আফগানিস্তানে অনেক সময় এসব হত্যা প্রকাশ্যেও ঘটে থাকে।

এখানে তালেবানদের জন্য সবচেয়ে খারাপ খবরটা হলো, তার ইমেজ ধ্বংস করা। তবে সে আইনের শাসন মানে না আর জঙ্গি ট্যাগ লাগানো ইমেজ সৃষ্টির প্রচেষ্টা অবশ্যই। তাই তালেবানদের এমন তৎপরতা আত্মঘাতী।

কোনো যুদ্ধের মাঠে আপনি বা আপনার শত্রু খুন হয়ে যাওয়ার একটি আলাদা অর্থ হয়। আর তুলনামূলক শান্ত এক জনসমাজে আপনি ঘর থেকে কোনো জেনুইন অপরাধীকেও যদি উঠিয়ে এনে জনসমক্ষে মেরে ফেলেন এর ফল হবে উল্টো। নিরস্ত্র নিরীহ মানুষ, ওই সময়ে অসহায় যে মানুষটি খুন হচ্ছে, ওর মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করে ফেলে তার প্রতি সহানুভ‚তিশীল হয়ে উঠতে পারে। আর এটিই আপনার জন্য বিরাট নেতি-ইমেজ তৈরির উপাদান হয়ে উঠবে। তা হলে করণীয়?

এটি যুদ্ধের মাঠের খুনোখুনি যদি বোঝাতে চান, তবে আগে যুদ্ধ ঘোষণা করে নিতে হয়। নইলে বিপরীত পথ হলো কাউকে হত্যা করার আগে তার বিচার হতে হবে। এখন বিচার মানে কিন্তু অনেক কিছু; যার শুরু সেই কনস্টিটিউশন থেকে। এরপর আইন, বিচারব্যবস্থা সেটআপ ইত্যাদি অনেক কিছু। মানে আসলে সবার আগে ক্ষমতা দখল করে নিতে হবে। এরপর আবার অপরাধীর আত্মপক্ষ সমর্থনের পর্যাপ্ত সুযোগ থাকতে হবে এবং স্থায়ী ও আইনের ওপর প্রতিষ্ঠিত আদালত থাকতে হবে। আর গ্রেফতারকারীই পরে বিচারকই আবার শাস্তি বাস্তবায়নকারী, তিনি এমন হতে পারবে না। মানে পুলিশিং আর বিচারক একই লোক হতে পারবে না। নইলে তো যে কেউ যে কাউকে অপরাধী বলে মেরে ফেলার অরাজকতা শুরু হয়ে যাবে। আর এখানেই দেশে-বিদেশে আপনার ইমেজ আপনার রাজনৈতিক চিন্তা কেমন, আপনি দায়িত্বশীল ক্ষমতাবান মানুষ কি না- এসব বহু প্রশ্ন ভর করবে। বলাবাহুল্য, আপনি জঙ্গি, আপনি অমানবিক গুণের বা আপনি নৃশংস, কাজেই আপনার ধর্মটাই খারাপ- এই ইমেজ দাঁড় করানোর জন্য একদল লোক অবশ্যই হাজির থাকবে। অর্থাৎ আপনি নিজেই ২০০১ সালের মতো নিজেকে উপড়ে ছুড়ে ফেলে দেয়ার পক্ষে কাজ করতে পারেন না।

সারকথায় একালের দুনিয়াতে গ্লোবাল রাজনৈতিক ব্যবস্থা বলে একটা কিছু আছে, একে অবজ্ঞা করবেন না। একে মানুন আর না-ই মানুন, একে আগে বুঝুন। এরপর এগোনোর পদক্ষেপ কৌশল। নইলে বেঘোরে মার খেয়ে হারিয়ে যাবেন।

আফগানিস্তান নিয়ে এত হইচইয়ের কারণ কী?
কথা শুরু করেছিলাম ত্রয়কার গঠন দিয়ে। পরে এই ত্রয়কা নিজেকে প্রথমে বর্ধিত করে, পাকিস্তানকে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। আর তাতেই ঘটে প্রথম বিস্ফোরণ। কেন?

প্রথমত, পাকিস্তান হলো ল্যান্ডলকড আফগানিস্তান ভূখণ্ডের এক প্রবেশদ্বার। আমেরিকা এ জন্য আফগানিস্তানে হামলা চালাতে পাকিস্তানকে হাত করে, বাধ্য করে, ঘাঁটি বানিয়েই নিয়েছিল আগে। অতএব, আফগানিস্তানে ব্যবহারিক যেকোনো পদক্ষেপের আগে ত্রয়কার পাকিস্তানকে সাথে নিয়ে নেয়া জরুরি ছিল। কাজেই রাশিয়া নিজে উদ্যোগ নিয়ে পাকিস্তানের সাথে কথা বলে সসম্মানে তাকে ত্রয়কার বাড়তি সদস্যের ভূমিকা নিতে হয়েছিল।

কিন্তু রাশিয়া আমেরিকা বা চীনের ত্রয়কার এসব ব্যবহারিক সমস্যার দিকটি ভারতের বোঝার বা আমল করার মতো অবস্থায় নেই। এমনকি মনে মনে মানলেও তা স্বীকার করা অসম্ভব। কারণ? ও পাকিস্তান- এটি তো একটি জঙ্গি রাষ্ট্র, ‘তালেবানদের মদদ দেয়া রাষ্ট্র’ ইত্যাদি গত ২০ বছর প্রপাগান্ডা করে এসেছে ভারত। এখন প্রশ্ন হলো, পাকিস্তান যদি জঙ্গি রাষ্ট্রই হয়, তা হলে তো সে রাশিয়া, আমেরিকা বা চীনের পাশাপাশি একই মর্যাদার আসনে বসতে পারে না। আর বাস্তবে যদি বসতে দেখা যায় তার মানে পাকিস্তান জঙ্গি রাষ্ট্রই নয়, দায়িত্ববান রাষ্ট্র। তা যদি রাশিয়া পাকিস্তানের পাশাপাশি ভারতকেও ত্রয়কায় সাথে নিত, তাতে ভারতের মুখরক্ষা হতো।

বরং পাকিস্তানকে ত্রয়কার ভেতরে নিয়ে ত্রয়কাকে পরে ত্রয়কা-প্লাস নাম দেয়া হয়, ফলে তাতে ভারতের জ্বলুনি আরো বাড়ে। কিন্তু এ ঘটনা ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির আর বাইরে খুবই কম প্রচারিত ঘটনা বলে এত দিন ভারত এই লজ্জা লুকিয়ে রাখতে পেরেছিল? এখন গ্লোবাল মিডিয়ায় আগাম ঘোষণা দিয়ে বলা হয়, ১১ আগস্ট হবে পরের মিটিং। আর সাধারণত এসব মিটিং হয়েছে রাশিয়ায় না হলে কাতারে। কারণ কাতার ২০১৫ সাল থেকে আফগান-তালেবান ইস্যুতে নিরপেক্ষ হোস্ট। তাই সে প্রতিনিধি; সাথে ওই মিটিংয়ে থাকে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে ইরান ও তুরস্ককেও নেয়া হয়েছে। এতে এখন ভারতের মিডিয়াও আর দেশপ্রেমের জোশে মোদি-জয়শঙ্করকে জবাব দাবি করে পারছে না। আর এসব কথা ভারত প্রভাবিত মিডিয়ায় বড় করে আসায় বাংলাদেশেও ভারতের এই বেইজ্জতির খবর ছড়িয়ে পড়েছে।

রাশিয়া ভারতকে এমন বিমুখ ও বেইজ্জতিতে ফেলল কেন?
রাশিয়ার সমস্যা অন্য। রাশিয়া মনে করে আগস্টে সেনা প্রত্যাহারের পরে বর্তমান আফগান পুতুল সরকারের আর ক্ষমতায় থাকা ঠিক নয়। বরং অন্তর্র্বর্তীকালীন ও প্রতিনিধিত্বমূলক এক সরকারের থাকা উচিত, যার কাজ হবে সবাইকে নিয়ে রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছানো। আর বিপরীতে ভারতের অবস্থান হলো, বর্তমান পুতুল সরকারে হাত দেয়া যাবে না।’ আরো আগিয়ে ভারত বলছে, গায়ের জোরে পুতুল সরকার বদলালে ভারত মানবে না। যেন ভারত না মানলে বিরাট কিছু যায়-আসে!

কথা হলো, প্রথমত ক্ষমতা তো মুরোদেই মানে গায়ের জোরেই বদলাতে হয়, বদলায়। যদিও এটিই শেষ নয়। এরপর সব পক্ষকে নিয়ে প্রপার সুযোগ দিয়ে রাষ্ট্র বা কনস্টিটিউশন গড়তে তো অসুবিধা নেই।
আর তালেবানদের ক্ষমতা দখল না করতে কেউ স্পষ্ট করে তো কিছু বলেনি। ত্রয়কাও না। এমনকি ব্রিটেন আগাম জানিয়েই দিয়েছে, সে স্বীকৃতি দিতে রেডি। তবে তালেবানরা ক্ষমতা নিজের হাতে নেয়ার পর এবার ত্রয়কার কথা শুনে চলা সব পক্ষীয় সরকার ইত্যাদির অনুগত হলে অসুবিধা কী?

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক


আরো সংবাদ



premium cement