২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

কেন ইসরাইল রাষ্ট্রের বিরোধিতা

-

কেন আমরা ইসরাইলের বিরোধিতা করি এবং করে যাবো? আমাদের প্রায় নব্বই ভাগ জনগোষ্ঠী মুসলমান আর ফিলিস্তিনিরাও মুসলমান। তাই আমাদের ধর্মীয় দায়িত্ব হলো ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়ানো আর তাদেরই ঘাড়ের ওপর বসে তাদেরকে বঞ্চিত করে কেবল ইহুদিদের জন্য বানানো জুলুমবাজ ইসরাইল রাষ্ট্রের বিরোধিতা করা- এই হলো আমাদের মানুষের ধর্মতাত্ত্বিক বোধ। ফিলিস্তিনিদের লড়াই সংগ্রাম সমর্থন করে যাওয়া আমাদের কাজ। এটা ধর্মতত্ত্বীয় দিক থেকে খুবই শক্ত এক পদক্ষেপ ও শক্ত আর্গুমেন্টও এবং সবার ওপরে এটা ফিলিস্তিনিদের পক্ষে এক ব্যাপক জনসমর্থন জোগানোর দিক থেকে খুবই কার্যকর উপায়!

কিন্তু তবু অন্যান্য দিকেরও তৎপরতা এবং পালটা শক্ত বয়ান ও পয়েন্ট আমাদের দরকার আছে। কারণ এটা কলোনি যুগ পেরিয়ে অধিকারভিত্তিক আধুনিক রাষ্ট্রের যুগ এবং গ্লোবাল রাজনৈতিক ব্যবস্থা বলতে যা আমরা সামনে দেখি তা এক অধিকারভিত্তিক আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাই। এর কেন্দ্রে আছে কলোনিমুক্ত রাষ্ট্রগুলোর এক প্রভাবশালী অ্যাসোসিয়েশন, নাম তার ‘জাতিসঙ্ঘ’। জাতিসঙ্ঘের অনেক দুর্বলতা, অক্ষমতা ও অকর্মণ্যতা এবং সর্বোপরি, ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে পড়ার সমস্যা সবই আছে, কথা সত্য। কিন্তু এসব সত্ত্বেও জাতিসঙ্ঘই কমান্ড করে বলে দিতে পারে, কলোনি দখল করে শাসন করা অবৈধ। সাদ্দাম-পরবর্তী ইরাককে বুশের দখল করে নেয়া তাই জাতিসঙ্ঘের চোখে ‘অবৈধ দখল’ ছিল এবং কফি আনান তা ঘোষণা করে বলে দিয়েছিলেন।

১৯৪৭ সালে কাশ্মিরের রাজাও কাশ্মির ভারতের সঙ্গে যুক্ত ও বিলীন হতে চায় বলে কাগজে সই করেছিলেন। কিন্তু জাতিসঙ্ঘ তা মানে নাই, অবৈধ মনে করেছিল। কারণ সে মনে করে, কাশ্মিরের পক্ষে এই সিদ্ধান্ত নেয়ার একমাত্র বৈধ অধিকারী কাশ্মির-ভূখণ্ডের বাসিন্দা জনগণ, ফলে গণভোট করে তাদের রায় জেনে নিতে হবে। অতএব, আধুনিক রাষ্ট্র ও এর কাঠামোগুলোর গুরুত্বও বুঝতে হবে।

হয়তো আপনার মাথায় রাষ্ট্র বিষয়ে অনেক ভারী তত্ত্বকথা আছে বলে আপনি মনে করেন। কিন্তু দয়া করা উপস্থিত আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাটার কোনো অর্জন নেই, কিছু হয় নাই, কিচ্ছু না, বলে এর বিরুদ্ধে কামান দাগার কাজ হাতে নেবেন না। এটা অপ্রয়োজনীয়। আপনি নতুন যা করতে চান, যে নতুন ক্ষমতা কায়েম করতে চান তা করুন- সেজন্য এখন তা নিয়ে প্রচার, বুঝানো, হেদায়েত সব করতে থাকুন আর সে কাজে জাতিসঙ্ঘসহ এই আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাটা আপনার পক্ষে যতটা সম্ভব ব্যবহার করেই তা করতে থাকুন। পরে নিজে ক্ষমতাবান হয়ে গেলে পুরান সবকিছু বদলে ফেলতে এরা কেউ বাধা হবে না। সোজা কথা বর্তমানের অর্জনকে ফেলে দিয়ে পায়ে মাড়িয়ে এগিয়ে যেতে চাইবে না। বরং বলুন, এটা যথেষ্ট অর্জন হয়নি। কিন্তু দয়া করে এটা বলবেন না যে, এটা কোনোই অর্জন নয়।

এখন আসুন আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা মোতাবেকই ইসরাইল রাষ্ট্র কেন ভেঙে দেয়া উচিত- সেসব বুঝে নেয়ার চেষ্টা করি। মনে রাখতে হবে, ইসরাইল টিকে আছে (যেভাবেই হোক) মূলত নিজের পক্ষে এক গ্লোবাল সমর্থন জোগাড় করতে পারার কারণে। কাজেই আমাদেরও ওই গ্লোবাল সমর্থন ভাঙতে হবে, আর পালটা সমর্থন লাগবে। কখন ও কিভাবে? আমেরিকার নেতৃত্বের এই গ্লোবাল সমর্থকদের দুর্বলতার জায়গায় আঘাত করতে হবে যখন এরা নিজেই দুর্বল থাকবে। আর ঠিক তার দুর্বলতার জায়গাটা হলো- আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার চোখেই ইসরাইল অন্যায্য রাষ্ট্র। এই কথা সর্বত্র তুলে ধরতে হবে এবং এমন এক সময়ে যখন আমেরিকা নিজেই তার গ্লোবাল নেতৃত্ব ধরে রাখার ক্ষেত্রে হিমশিম বেকায়দায়। ফলে গ্লোবাল নতুন মেরুকরণ দুনিয়াজুড়ে আসন্ন হয়ে উঠছে যখন তখনই সে কাজের সবচেয়ে ভালো সময়।

আধুনিক রাষ্ট্রের কী কী বৈশিষ্ট্য ইসরাইল লঙ্ঘন করে
বৈশিষ্ট্য-এক, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রকে রিপাবলিক হতেই হয়। রিপাবলিক মানে যেখানে ক্ষমতার উৎস জনগণ। অর্থাৎ এর পাল্টা বা রাজা-সম্রাটের দেশ মানে কোনো রাজতান্ত্রিক শাসন নয়। জাতিসঙ্ঘ রাজতান্ত্রিক দেশকে কি সদস্য পদ দেয় না? দেয়, অবশ্যই দেয়। কিন্তু যখনই কোনো রাজার দেশের রাজক্ষমতা কখনো ওর নিজ জনগণের চোখে টালমাটাল চ্যালেঞ্জ হয়ে যায় তখনই কেবল জাতিসঙ্ঘ ওকে টেকনিক্যাল সহায়তা করে নতুন রিপাবলিক রাষ্ট্র হয়ে উঠতে সাহায্য করতে চায়। আর যত দিন বাদশাহর দেশ থাকে তত দিন আবার তাকে বদলাবার কাজ জাতিসঙ্ঘের নয়। তাই রিপাবলিক রাষ্ট্র না হয়েও কোনো রাজশাসন জাতিসঙ্ঘের সদস্যপদ পেতে পারে। তবে রাজশাসনকেও রিপাবলিক সদস্য রাষ্ট্রের জন্য জাতিসঙ্ঘের সব আইন, নিয়ম ও কনভেনশন এবং মানবাধিকারসহ যা কিছু আছে সেগুলো মেনে চলতে প্রতিশ্রুতি দিতে হয়। এই কারণেই দুবাইয়ের প্রিন্সেস লতিফাকে নিয়ে জাতিসঙ্ঘ সমালোচনা করছে ও উদ্বেগ জানাতে পারছে।

অন্য দিকে আবার ঠিক বাদশাহদের মতোই কমিউনিস্টরাও মনে করেন, অভ্যন্তরীণভাবে নিজ দেশে ‘হিউম্যান রাইট’ বজায় রাখা তাদের রাজনীতি নয়, অ্যাজেন্ডা বা পালনীয় নয়। তবে এমন রাষ্ট্রগুলোর কৌশল হয় (এটা অবশ্য স্বৈরাচারীদেরও কৌশল) সে কথা পাবলিকলি স্বীকার করে না-বলা। আর অমন পরিস্থিতিগুলোতে সরাসরি জাতিসঙ্ঘের ‘হিউম্যান রাইট’ মানি না তা অবশ্যই তারা কোথাও বলেন না। বরং এড়িয়ে পাশ কাটিয়ে চলা হয়, যতদূর পারেন।

ইউরোপের ইহুদিরা কেন জায়নিস্ট রাষ্ট্র চেয়েছিল?
কেন মূলত জার্মান ইহুদিরা বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের বিদ্বেষ ও নৃশংসতার পর এর বিরুদ্ধে একটা জায়নিস্ট রাষ্ট্র গড়াকে তাদের রক্ষাকবজ বলে সাব্যস্ত করেছিল? মানুষের মনস্তাত্ত্বিক ব্যবহার বড় অদ্ভুত। বর্ণবাদিতার চরম অত্যাচার যে সয়েছে তাকে-ই আবার আমরা পাল্টা প্রতিহিংসায় সেই একই বর্ণবাদী হয়ে উঠতে দেখি! এখানে তাদের কাম্য ‘জায়নিস্ট রাষ্ট্র’ মানে কী তা গুরুত্ব দিয়ে বুঝতে হবে। এর মানে হলো, এটা ‘কেবল ইহুদিদের’ রক্ষার জন্যই একটা রাষ্ট্র হতে হবে। ফলে স্বভাবতই কেবল ইহুদিদেরই সব ধরনের বাড়তি বা বিশেষ সুবিধা দেয়ার রাষ্ট্র এটাকে হতেই হবে। এর পক্ষে সাফাই হলো, যেহেতু ইহুদিরা এতবড় এক ভিক্টিম তাই এখন তাদেরকেই বিশেষ সুবিধা দিতেই হবে। আর এখান থেকেই এক মিথ্যা দাবি তারা করে যে, এই জায়নিস্ট রাষ্ট্র এসব সুবিধাদির না হয়ে থাকলে ইহুদিরা দুনিয়াতে আর কোথাও সুরক্ষিত হবে না, শান্তি পাবে না।

প্রথমত, এটা একটা মানসিক ট্রমা বা আঘাতপ্রাপ্ত মানুষের বক্তব্য। যখন অসুস্থ মানুষটা এই স্টেজে থাকে তখনকার বক্তব্য। এটা এক ধরনের ট্রমা যা মানুষকে সবসময় নিরাপত্তার অভাববোধে পাগল করে তোলে। আর প্রথমে যা ছিল তাদের নিরাপত্তার অভাববোধে জন্ম নেয়া ট্রমা, পরে থিতু হলে সম্ভবত এটাই রূপান্তরিত হয়ে যায় প্রতিহিংসা-স্পৃহায়। এমন হিটলারি নৃশংসতায় সব মানুষের মনেই কমবেশি প্রতিহিংসা-স্পৃহা জেগে ওঠা অস্বাভাবিক নয় যদিনা কেউ সাইকোলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট বা এক্সসারসাইজের ভেতর দিয়ে না গিয়ে থাকে; বা আগাম ব্যবস্থা না নেয় এই বলে ও মেনে যে, সে কোনো প্রতিহিংসা করতে পারে না, কারণ এটা তাকেও অসুস্থ বানিয়েও ছাড়ে।

জায়নিস্ট এক রাষ্ট্রের কল্পনা তাই আসলে অনিরাপত্তা-বোধজনিত ট্রমা থেকে। কারণ কোনো আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার কল্পনা মানেই এর প্রধান কাজ হলো, সব নাগরিককে নিরাপত্তা দেয়া। কাজেই আলাদা করে জায়নিস্টদের দেয়া বিশেষ সুবিধার রাষ্ট্রের স্বপ্ন-কামনা, এটা একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু জায়নিজম বলতে চাচ্ছে সে এতে সন্তুষ্ট নয়; কারণ সে ট্রমাগ্রস্ত; তাই কেবল এই ট্রমাগ্রস্ত ইহুদিদের জন্য আলাদা করে নিরাপত্তাবোধ দেয়ার রাষ্ট্র, এক জায়নিস্ট রাষ্ট্রই, একমাত্র এতেই তাদের আস্থা। তাই এটাই গড়তে হবে।

তাহলে তাদেরকে বিশেষ সুবিধার একটা রাষ্ট্র গড়তে দিলে অসুবিধা কী? অসুবিধা এক. তাদের ট্রমাগ্রস্ততা কাটানোর জন্য সর্বোত্তম উপায় কি একটা সাইকোলজিক্যাল ট্রিটমেন্টের দুনিয়াসেরা এক হাসপাতাল নাকি, একটা ইহুদিবাদী কথিত বিশেষ সুবিধার রাষ্ট্র? আশা করি পাঠকেরা বুঝেছেন, এখানে ট্রমাগ্রস্ততার চিকিৎসা একটা ভালো হাসপাতাল। কোনো জায়নিস্ট রাষ্ট্র নয়।

অসুবিধা দুই. জায়নিস্টদেরকে দেয়া বিশেষ সুবিধার রাষ্ট্রনির্মাণের কল্পনা আসলে নিজেই আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার চিন্তাটার বিরুদ্ধে। এটা মৌলিকভাবে বিরোধী। কারণ আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মৌলিক অবস্থান হলো, রাজনৈতিক সাম্য। রাজনৈতিক অধিকারে সাম্য, বৈষম্যহীন সাম্য। এখানে কাউকে বিশেষসুবিধা দেয়ার কথাটা আনা মাত্রই তা আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মৌলিকভাবে বিরোধী। আপনি নিজের নিশ্চিত নিরাপত্তা অবশ্যই পেতে পারেন, যদি আপনার রাষ্ট্র ব্যতিক্রমহীনভাবে সবারই নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। কিন্তু আপনি চাচ্ছেন, না, আমাকে বিশেষ নিরাপত্তা দিতে হবে কারণ আমি ভিক্টিম। এই হলো জায়নবাদিতার শুরু। এর ভিক্টিমহুড তৎপরতা মানে আমি এখন ভিক্টিম বলে ভিক্টিমের প্রতি সমাজের যে সহানুভূতি তৈরি হয় সেইটা বেচে ভিক্টিম এখন খেতে চায়! এটাকেই বলে ‘ভিক্টিমহুড’। অর্থাৎ, বাড়তি সুবিধা নেবো। অন্যকে মারব-ধরব যা খুশি করব...।

ইহুদিদের জন্য বিশেষ সুবিধার ইহুদিবাদী রাষ্ট্র, অথবা হিন্দুত্বের জন্য বিশেষ সুবিধার হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র অথবা এ রকম যেকোনো ধর্মের তা হতে পারে। ধর্ম ছাড়াও তা হতে পারে। যেমন- বাঙালি জাতিবাদীদের জন্য বিশেষ সুবিধার বাঙালিবাদী রাষ্ট্র হয়তো দাবি করবে যে সে নিজের জন্য নিরঙ্কুশ, কম করে দুই যুগ বা বিয়াল্লিশ সাল পর্যন্ত ধরে ক্ষমতায় থাকতে চায়।

অসুবিধা তিন. জায়নবাদী চিন্তার আরেক বৈশিষ্ট্য হলো, সে সর্বজনীনতাকে ভয় পায়, কারণ ভিক্টিমহুডের অজুহাতে ‘বিশেষ’ সুবিধা চায়। কাজেই আপাতত যে ইসরাইলের রাষ্ট্রসীমার ভেতরেই যে আরব মুসলমান, তার জমিসম্পত্তি দখল করে সরকারি পয়সায় সেখানে হাইরাইজ বানিয়ে এরপর তা নিজেরা ভাগ করে খেতে চায়। কাজেই সর্বজনীন আইন থাকলে তো ওই আরব মুসলমান জমি হারাবে না। কাজেই ‘বাড়তি সুবিধা’ মানেই হলো, অন্যেরটা কেড়েও নেয়া এবং এক বিচারহীনতায় দিন যাপন। এ ছাড়া আরো আছে, একইভাবে ইসরাইলের রাষ্ট্রসীমার বাইরেও যেসব ফিলিস্তিনি ভূমি আছে সেগুলোও একইভাবে দখল করা এবং তা একেবারে গায়ের জোরে।

আর এটাকেই বলে ‘কলোনি দখল’। সোজা ভাষায় ইসরাইল একালে কলোনি দখল আবার শুরু করে দিয়েছে। কেন এভাবে বললাম? বেশির ভাগ মানুষ জাতিসঙ্ঘের জন্মভিত্তি ও এর ইতিহাস একেবারেই জানে না। ন্যূনতমটাও জানে না। এর জন্য প্রধানত দায়ী তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল যিনি আমাদের ‘কলোনি মালিক’ ছিলেন। তিনি চান নাই তাই নাকে খত দেবার দুর্বলতার কথা জনে জনে জানুক। আর দ্বিতীয়ত দায়ী নেহরুর মতো রাজনীতিবিদ যারা নিজেরাই এসব ইতিহাস জানেন না, যার অজস্র প্রমাণ দেয়া যায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে (১৯৩৯-৪৫) আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেলট ১৯৪১ সালের আগস্ট পর্যন্ত কোনো পক্ষকেই সমর্থন না করে যুদ্ধের বাইরে যুক্তরাষ্ট্র রেখেছিলেন। কারণ তিনি চেয়েছিলেন সারা দুনিয়াকে কলোনি করে রাখা ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো এই যুদ্ধ শেষে কলোনি দখল যুগের অবসান ঘটাবেন এই প্রতিশ্রুতি দিলেই তিনি তাদের পক্ষে হিটলারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামবেন।

এই শর্তে প্রথম যিনি এগিয়ে আসেন তিনি হলেন তখনকার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল; কারণ নইলে হিটলারের কাছে হেরে পাল্টা দখল হয়ে যেত তার দেশ-ভূমি। তাই ১৪ আগস্ট ১৯৪১ সালে চার্চিল ও রুজভেল্ট এক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন আট দফার; যার প্রথম দফাটাই হলো তারা দুই রাষ্ট্র প্রতিজ্ঞা করছে যে তারা নিজ নিজ মূল ভূখণ্ডের বাইরে কোনো ভূমি দখলে আর যাবে না। এটাই পরে হয়ে যায় কলোনিয়াল-দখল অবৈধ এ কথার ভিত্তি। কারণ এই চুক্তিটাই পরে আরো দুই রাষ্ট্র স্টালিনের সোভিয়েত আর চিয়াং কাইশেকের চীন- এভাবে চার রাষ্ট্র মিলে আবার একসাথে স্বাক্ষরিত হয় ১ জানুয়ারি ১৯৪২ সালে। এটাকেই বলা হয় জাতিসঙ্ঘের ‘জন্ম ঘোষণা’। একই দিনে আরো প্রায় ২৬টা দেশও এতে স্বাক্ষর করেছিল। আর ওই দিনই আমেরিকা হিটলারের জোটের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিল এবং তার জোটসঙ্গী জাপানে আক্রমণ চালিয়েছিল। সেই থেকে এজন্য কলোনি দখল নিষিদ্ধ আর এটাই জাতিসঙ্ঘের প্রতীক। কাজেই জাতিসঙ্ঘের সদস্য থাকতে চাইলে ইসরাইল জায়নিস্ট হতে পারবে না। কারণ জায়নিস্ট ইসরাইল কলোনি দখল করেছে। এ ছাড়া অন্যের ভূমি দখলের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই ইসরাইলের বিরুদ্ধেই নিরাপত্তা পরিষদে পাস হওয়া রেজুলেশন আছে।

অসুবিধা চার. লক্ষ করলে দেখা যাবে যারাই জায়নিস্ট বা হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র কায়েম করেছে বা করতে চায় তারা নেশন-স্টেট বা জাতিরাষ্ট্র ধারণার অনুসারী। জাতিরাষ্ট্র হলো প্রথম যুগের আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা বা এ বিষয়ের চিন্তা। যেমন- আগের রাজতন্ত্র ভেঙে রিপাবলিক গড়তে চাওয়া ইউরোপীয় চিন্তা বাস্তবায়নের শুরু বলা যায় ১৬৪৯ সালের ইংলিশ (ক্রমওয়েলের) রেভিলিউশনকে। এই ধারাই নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে থিতু হওয়ার পরে তা চলেছিল ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত। সে সময়ের ইউরোপীয় বিপ্লবে স্থাপিত নতুন রাষ্ট্রগুলোই রিপাবলিক বা আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার শুরু বলা যায়। অর্থাৎ রাজা নয়, জনপ্রতিনিধিরাই ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন এমন রিপাবলিক সেগুলো।

তবু এরা সবগুলোই ছিল ‘জাতিরাষ্ট্র’ (নেশন-স্টেট) ধরনের রিপাবলিক। মানে আমরা প্রত্যেকে নাগরিক কি না, রাষ্ট্রে আমাদের রাজনৈতিক সাম্য থাকবে কি না, বৈষম্যহীন অধিকার থাকবে কি না- এসব সেখানে উহ্য থাকে। এর বদলে আমরা একটা ‘জাতি’ এই উদগ্র ধারণার প্রাবল্য যেখানে প্রচণ্ড। এই ধারণারই সবচেয়ে বিকশিত ফসল হলো হিটলারের নাৎসিবাদ।

আর আধুনিক রাষ্ট্রের জাতিরাষ্ট্ররূপে এই আদি ধারায় তিনশ’ বছর পরে হিটলারের উত্থান দেখে এর দায়দায়িত্ব ত্যাগ করে বাকিরা আমূলে বদলে যায়। সারা ইউরোপ ১৯৫৩ সালে ৪৭ রাষ্ট্রের এক সম্মেলনের মাধ্যমে সবার নিজ রাষ্ট্রভিত্তি বদল করে অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্র করে নেয়া হয়। সেই থেকে ইউরোপে ‘জাতিরাষ্ট্র’ ধারণাটা ম্লান হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের এ দিকে নেহরুর ভারতসহ বাংলাদেশে এখনো জাতিরাষ্ট্র। এই ধারাতেই জায়নবাদী ইসরাইলও এক জাতিরাষ্ট্র। মূল কারণ উগ্র জাতিবাদী চিন্তা ভালো খোলে ‘জাতিরাষ্ট্র’ এর মধ্যে। অথচ আমাদের সবার জন্যই এটা ত্যাগ করার সময় পেরিয়ে গেছে পঞ্চাশের দশকেই।

সবশেষে তামাশার দিকটা হলো, যে ইউরোপীয় ইহুদিরা হিটলারি নাৎসিবাদের শিকার হয়েছিল তারাই এর পরে ফিলিস্তিনিদের ওপর সওয়ার হয়ে শুধু নয়, সেই হিটলারকেই কপি করে জায়নবাদিতা চর্চায় ইসরাইল রাষ্ট্র গড়ে তুলেছে।

আমরা আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিচারেও ইসরাইলের বিরোধিতা করে যাবো কারণ, এই জায়নবাদী রাষ্ট্র আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ন্যূনতম শর্তও পূরণ করেনি। এই রাষ্ট্র নাগরিক বৈষম্যপূর্ণ, রাজনৈতিক অসাম্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা, পক্ষপাতমূলক বিচারব্যবস্থার, সর্বোপরি কলোনি দখল করা ফিরিয়ে আনতে চাওয়া রাষ্ট্র। কাজেই এখানে এসে জায়নিজম বিরোধিতা স্রেফ কোনো মুসলিম ইস্যু আর নয়। এটা যারা দুনিয়ায় রাজনৈতিক সাম্যের প্রতিষ্ঠা দেখতে চান তাদের সবার ইস্যু!

জায়নিজমের বৈষম্যের প্রতিকার হওয়ার আগে পর্যন্ত ইসরাইল রাষ্ট্রের বিরোধিতা তাই আমরা করি এবং করে যাবো!

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com


আরো সংবাদ



premium cement