১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

হিন্দুত্ব ফেল, কোভিডে চিকিৎসাস্বল্পতা ও পেটের টানে

হিন্দুত্ব ফেল, কোভিডে চিকিৎসাস্বল্পতা ও পেটের টানে - ফাইল ছবি

রাজনীতিবিদ অপেক্ষাকৃত তরুণ কেউ হলে একটা বাড়তি সুবিধা কখনো পেতে বা নিতে দেখা যায়। সেই হলো অ্যাপ্রোচ, মানে কোনো মনোভাব থেকে বসে একটি সমস্যাকে সে দেখবে? আগের রাজনীতিক নেতারা যেভাবে দেখে এসেছেন সেভাবেই? নাকি নয়া উদ্যোগে? কোনো নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা বিকল্প পথ খুঁজে দেখে তাতে সমাধান বা অবস্থা বদলের চেষ্টা করবেন? দেখা যায়, রাজনৈতিক নেতা বা প্রধানমন্ত্রী নতুন বা অপেক্ষাকৃত কম বয়সী হলে তিনি অনেক ভিন্ন দিক থেকে সমাধান খুঁজতে চাইছেন, যা আগে ভাবা হয়নি। সমস্যা বা বিরোধগুলোকে বিপক্ষ অংশের সাথে মানে তাদের চোখেও দেখে এক নয়া অ্যাপ্রোচে নতুন পথে সমাধান বা বিপক্ষকে মানানোর বা পরস্পরের সমস্যাটা ঠিক কোথায় তা ঠিকঠাক বুঝে এগোনোর পথ এ ক্ষেত্রে খুঁজে থাকেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তেমনই একজন!

ইমরান যখন ২০১৮ সালের আগস্টে প্রধানমন্ত্রীর শপথ নেন, তখন ভারতে বিজেপির মোদির প্রথম টার্মে ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে চার বছর পার করে ফেলেছেন। কারণ মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ২০১৪ সালের মে মাস থেকে। মানে পরের বছর ২০১৯ সালের মে মাসে মোদি আবার নির্বাচনে দাঁড়াবেন। মোদি দ্বিতীয়বার দাঁড়িয়েছিলেন এবং তিনিই ‘বিজয়ী’ বলে নির্বাচন কমিশন ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু ইমরান খান পাকিস্তানের আগের যেকোনো প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে নয়া অ্যাপ্রোচ, নয়া উদ্যোগ নেয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন অপেক্ষাকৃত কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই। সার কথায়, নয়া উদ্যোগের প্রধানমন্ত্রী ইমরানের থেকে মোদির ভারত নয়া উদ্যোগ বা অ্যাপ্রোচের সুবিধা পেতে বা নিতে চান বা নিয়েছেন; এমন তো আমরা দেখিনি। কেন?

প্রথমত, এটি ঠিক মোদির বিরুদ্ধে যতটা অভিযোগ, এর চেয়ে বরং বলতে হবে মোদির পক্ষে এমন কোনো আশা দেখানো বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার নয়া উদ্যোগ এগোনো বা ইমরানকে উৎসাহ দেয়া ইত্যাদি আসলে মোদির পক্ষে সম্ভবই ছিল না। সেই প্রসঙ্গেই এখানে বলব।

তবে এর আগে সাধারণভাবে ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান এই তিন দেশের দুর্ভাগ্য যেখানে আটকে গেছে ও শুরু হয়েছিল তা নিয়ে দু’টি সাদা কথা বলে নেবো।

ভারত-পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয়। বিরোধের ইস্যু এমন যে, এর অন্তত কিছু গূঢ়-ইস্যু নিয়েই অনন্তকাল বিবাদ চালিয়ে দেয়া সম্ভব। মানে কোনো সমাধানের দেখা পেতে এখানে কতগুলো প্রজন্ম লাগবে এর হদিস কেউ জানে না। কাশ্মির ছাড়াও জন্ম থেকেই বিরোধের সূত্রপাত এমন ইস্যু অনেক আছে।

কিন্তু এসব বিরোধের আসল উৎস কী তা স্বল্প কথায় বললে- এর প্রধান উৎস হলো ব্রিটিশরা কলোনি-ইন্ডিয়া ত্যাগ করে চলে গেলে কলোনিমুক্ত ভারত কেমন রাষ্ট্র হবে এ নিয়ে অপরিপক্ব জবাব দেয়ার চেষ্টা এবং রাষ্ট্র নিয়ে খাটো চিন্তা-ধারণা হাজির করা থেকেই আজকের ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান- এ তিন দেশ সেই থেকে সাফার করে আসছে, ধুঁকে মরছে।

কোনো একদল নিজ ধর্মীয় বা যেকোনো আইডেনটিটির জাতি-রাষ্ট্র করবে বলে, বুঝে বা না বুঝে গোঁ ধরলে এর পরিণতিতে তা বাকি সব পক্ষই আরেকটা করে ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম বা ভাষা অথবা অন্য যেকোনো ভিন্নতার আইডেনটিটির ভিত্তিতে জাতি-রাষ্ট্র গড়তে চাইবেই। সব বিবাদের শুরু এখান থেকে, নানান দিকে তা যাবেই। এটি অনিবার্য। এই সরল সত্য ও বাস্তবতা বোঝার যোগ্যতা কারো ছিল না; বরং সবাইকে একটা আইডেনটিটির জাতি-রাষ্ট্রে আনতেই হবে আর সেটি হতে হবে হিন্দু-জাতিরাষ্ট্রই; এভাবে তা বাকি সবার ওপরে চাপিয়ে দিয়ে হলেও যেন ‘এটিই হতে হবে’। কংগ্রেসের এই জবরদস্তি, এ থেকেই সব বিরোধের আরো ডালপালায় বিস্তার এখনো চলছে। এর শুরু বা আদিপাপের রচয়িতা-কর্তা মুসলিম লিগ বা জিন্নাহ নয়। এরা নিরুপায় অনুসারী মাত্র। সেই মূল রচয়িতা-কর্তা হলেন ১৮১৫ সাল থেকে শুরু করা রাজা রামমোহন রায় ও তার ব্রাহ্মসমাজ। তিনই বোকা নাকি ইসলামবিদ্বেষী? যাই হোক, কমিউনিস্টদের চোখে রামমোহন নাকি ‘বেঙ্গল রেনেসাঁর আদিগুরু’! এখন তা হলে কমিউনিস্টরা ব্যাখ্যা করে দিন যে, কমিউনিস্টদের চোখে ধর্মচর্চা তো এখনো খুবই খারাপ কাজ। এই বহু কথিত রেনেসাঁর আদিগুরু রামমোহন, তিনি কী করে নতুন একটা ধর্ম- ব্রাহ্মধর্ম চালু করেন? এ কোনো বিপ্লবীপনা? আর এটা নিয়েই বা সব রেনেসাঁবাদী কমিউনিস্টরা বেমালুম চুপচাপ নির্বিকার কেন? কিভাবে? এর সাফাই কী এবং কৈ?

আমাদের অনেকের মনে হতে পারে, ভারত-পাকিস্তানের ক্যাঁচাল থেকে বাংলাদেশ এখন স্বাধীন হয়ে অনেক দূরে গিয়ে বেঁচেছে। কিন্তু না। এমন মনে হলেও এটি তা নয়। কারণ অখণ্ড ভারতে আমাদের মূল বিবাদ ছিল, ভাষা বা ধর্মীয় আইডেনটিটির জাতিরাষ্ট্র খাড়া করে সমাধা পাওয়ার খায়েশ থেকে শুরু হওয়া লড়াই। তাতে বাংলাদেশে আমরা এখন ভৌগোলিকভাবে ভারত-পাকিস্তানের কেউ না বলে তাদের ক্যাঁচালের কেউ না- এই আত্মপ্রসাদ পেতে চাইলেও যা আমরা সাথে নিয়েই হাঁটছি তা হলো, বাংলাদেশ এখনো একটা ভাষা বা ধর্মীয় আইডেনটিটির জাতি-রাষ্ট্রই। সেই আদিপাপ আমরা ত্যাগ করতে পারিনি। বাংলা ভাষাভিত্তিক আইডেনটিটির জাতি-রাষ্ট্র কেন ধর্মীয় আইডেনটিটির জাতি-রাষ্ট্র থেকে কোনো অর্থেই আলাদা কিছুই না? মূল কারণ যেকোনো আইডেনটিটির জাতি-রাষ্ট্র মাত্রই একটা অস্থিতি ও বিবাদের উৎস হয়ে থাকবে বলে এ থেকে বের না হতে পারার বিবাদ থাকবে। এ কারণে হিন্দু-মুসলমান নিয়ে বিবাদে আমরা এখনো সবাই প্রায়ই আক্রান্ত হই, আর এতে সামাজিক-অর্থনৈতিক সব অর্জন ম্লান হয়ে যায়।

আমাদের প্রসঙ্গ মোদি-ইমরানের মধ্যে সীমিত করব। ভারত-পাকিস্তানের অবস্থা এখন এমন যে, সবাই ন্যূনতম এক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চায় হয়তো; সব পক্ষেরই কাম্য এটি কিন্তু একই সাথে এর সমস্যা অন্যখানে। কারণ এক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এমনকি বিজেপি-আরএসএসের মোদিরও হয়তো অকাম্য নয়। পেয়ে গেলে তা মোদির জন্য খারাপ কিছু হতো না। কিন্তু সমস্যা হলো প্রায়োরিটির, অর্থাৎ মোদিও পাকিস্তানের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চান না অথবা কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী ইমরান ক্ষমতায় এসেছেন তার সাথে নতুন উদ্যোগ নেবেন, তা করতেও মোদির কোনো আপত্তি আছে- ব্যাপারটা তা নয়, তা একেবারেই নয়। সমস্যা হলো প্রায়োরিটির।

মোদির প্রায়োরিটি হলো, ভারতের নির্বাচনে ‘হিন্দু-ভোটের মেরুকরণ’ হতে হবে, পরিস্থিতিকে এমন হতে বাধ্য করতে হবে, যাতে সব হিন্দু-ভোট তাদের বাক্সমুখী হয়, এমন এক উত্তেজনা সৃষ্টি করা। কারণ ইমরান ক্ষমতায় আসার পরের বছর ২০১৯ সালের মে মাসে মোদিকে আবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার নির্বাচনে জিততে হবে। তাই পাকিস্তানের সাথে মিথ্যা করে হলেও সীমান্ত-উত্তেজনা সৃষ্টি করা, সেভাবে ভারতের সেনা ও সিভিল প্রশাসনকে সাজানো আর ঠিক নির্বাচনের আগে এ বিবাদকে চরমে তোলা- এটিই হয়ে পড়েছিল মোদির প্রায়োরিটি। পাকিস্তানের ইমরানের সাথে সম্পর্কের চেয়ে বরং ভোটের বাক্সে হিন্দু মেরুকরণের ভোট, এটাই মোদির সবার উপরের প্রায়োরিটি হয়ে পড়েছিল। তাই ছদ্মযুদ্ধ লাগানো, পাকিস্তানে মিথ্যা বোমা ফেলে আসার ছলনা তৈরি, ইত্যাদিই খুবই টপ প্রয়োরিটি ছিল মোদির কাছে। আর ৩৬ ইঞ্চি ছাতি দিয়ে মোদিই একমাত্র ভারত রক্ষাকারী নায়ক- এই ইমেজ ছিল ভোটে মোদির ‘তুরুপের তাস’!

অন্য ভাষায় বললে, মোদির হিন্দুত্ব মানে হিন্দু জাত-ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব- এমন দাবি করে যে রাজনীতি মোদি খাড়া করতে চান, অর্থাৎ কেউ হিন্দু হলেও বাস্তবত বরং সে হিন্দু-শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার নাও হতে পারে, এমন হিন্দুত্বের রাজনীতির বাহক তিনি নাও হতে চাইতে পারেন- মোদি এটি হতে দিতেই চান না। পরিষ্কার ভিন্নতাটা অস্পষ্ট করে, মানে দিতে চান উল্টা। বলতে চান, কেউ হিন্দু মানেই সে মোদির হিন্দুত্ব রাজনীতির বাহক- এই একমাত্র অর্থ এবং ব্যাখ্যা ও বয়ানে তা আটকে রাখতে চান। এটিই বিজেপি-আরএসএসের রাজনীতি ও হিন্দু-শ্রেষ্ঠত্ববাদ। এটিই হিটলারের জার্মান আর্য-নীল চোখের শ্রেষ্ঠত্ববাদ অথবা ট্রাম্পের সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদ- এদের সবারই আরেক ভাই হিসেবে মোদির হিন্দুত্বের উত্থান ঘটেছে।

মনে রাখতে হবে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের ইতিহাসে ইমরান খানই একমাত্র প্রধানমন্ত্রী- যিনি পাকিস্তানের তরুণ; নতুন করে যারা পাকিস্তানকে নিয়ে চিন্তা করতে চান এরই প্রতীক হলেন ইমরান। যিনি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন, পাকিস্তানি নাগরিক সে যে ধর্মেরই হোক- তার সব নাগরিকের মতোই সমান অধিকার আছে। ব্লাসফেমি আইন- যেটা এত দিন মূলত জমিজমার দখলের সঙ্কীর্র্ণ স্বার্থ উদ্ধারের কাজে করা মামলা হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে, এমন আসামিদের মামলার বিচারে সুপ্রিম আদালত যাকে খালাস দিয়েছে, নির্বাহী সরকারপ্রধান হিসেবে ইমরান নিশ্চিত করেছেন তার মুক্তি; ইচ্ছামতো দেশ-বিদেশ যাওয়া বা চলাচলের। ইমরান এটি তার প্রধানমন্ত্রিত্বের জন্য কর্তব্যজ্ঞান করেছেন।

অথচ চরম সঙ্কীর্ণ ও হিন্দুত্বের ভোট জোগাড়ে ব্যস্ত বিজেপির মোদি এমন ইমরানের কাছ থেকে ভারতের জন্য কোনো সুবিধাই নিতে পারেননি। কারণ মোদির লক্ষ্য অন্য কিছু। তাই ভারত-পাকিস্তানের বিবাদের ইস্যুগুলোর কোনো একটার বেলায় কিছু হাল করা, উদ্যোগী হতে পারেননি মোদি। ভৌগোলিকভাবে পাকিস্তানে পড়েছে যে কার্তারপুর-এর শিখ গুরুদুয়ারা, তা ভারতের পাঞ্জাবের শিখরা এখন যেকোনো ভ্রমণকারীর মতো ২০ ডলার ফি দিয়ে ভ্রমণ করে আসতে পারেন। মানে গুরুদুয়ারা তীর্থ করে আসতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী ইমরানের কারণে এটি সহজেই বাস্তব হয়ে গেছে।

করোনাভাইরাসের কাছে মোদিও খাটো
কিন্তু পরাক্রমশালী করোনাভাইরাস মোদির মতো যারা হিন্দু-শ্রেষ্ঠত্ববাদী তাদেরকেও সোজা করতে পারে। অনেক কিছুই করতে বাধ্য করতে পারে, তাই মনে হচ্ছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয় মুখে স্বীকার না করেও মিডিয়া রিপোর্ট হাজির হতে দিচ্ছে যে ভারত-পাকিস্তান আলোচনা হচ্ছে কখনো গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই আর ‘র’-এর মধ্যে। অথবা প্রশাসনিক কর্তা পর্যায়ে এবং মিডিয়া থেকে দূরে থেকে। এমন আলাপ আগের কংগ্রেস বা বিজেপি আমলেও হয়েছে, আর সেসব হয়েছে মূলত ব্যাংককে। এবারো তা ব্যাংককে বা দুবাইয়ে হচ্ছে বলে মিডিয়া রিপোর্ট দিচ্ছে।

কিন্তু কেন তারা এত লুকোচুপি করে আবার দেখাও করছে? এবং তা নিজ নিজ দেশের বাইরে করছে?

একমাত্র কারণ মোদির ‘ভোটবাক্স’ প্রায়োরিটি, যা আগে বলেছি। ভারতের কল্পিত বিরাট শত্রু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মোদি একাই লড়ে ভারতের হিন্দুস্বার্থ রক্ষা করে চলেছেন, এই ইমেজ মোদির ভোটবাক্সের জন্য খুবই দরকারি। কিন্তু এর অবস্থা এখন খুবই সঙ্গীন। যেমন কাশ্মিরে লাদাখ সীমান্তে যখন চীনের সাথে ভারতের সামরিক টেনশন চলছিল তখন মোদি-সেনাদের টেনশন বাড়ছিল যে, কখনো যেন ভারতকে চীনের পাশাপাশি পাকিস্তান- এই দুই দেশের সাথে তাদের নিজ নিজ সীমান্ত দু’টি যুদ্ধক্ষেত্রে লড়তে না হয় এটি নিশ্চিত করা। তাই সে সময় চীনের পাশাপাশি পাকিস্তানের সাথেও কথা বলে ভারত ধারণা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় যে, ভারত পাকিস্তানের সাথেও সঙ্ঘাত চায় না। এটি অবশ্যই দুই দেশের জন্যই লাভজনক ছিল। কারণ যুদ্ধের ফ্রন্ট খুললে তা পাকিস্তানের অর্থনীতির জন্য কোনো ইতিবাচক ঘটনা ভাবার কারণ নেই। আর এ বাস্তবতার সুবিধাটাই ভারত উঠিয়ে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু পাবলিকলি দেখা করলে মোদির ভোটবাক্সে টান পড়বে। আর সে কারণে এত লুকোচুরি।

এখানে কোভিডের আরেক সুবিধা বা অসুবিধার কথাও বলা দরকার। গত দেড় দুই বছরে মিডিয়া প্রশ্নে মোদির সরকার বিরাট সুবিধা ভোগ করে চলেছে। ভারতের লিডিং প্রায় সব মিডিয়া এখন মোদির অনুগত, পায়ের কাছে ঘুরঘুর করার অবস্থা! কেন? কারণ প্রতিটি মিডিয়া কোভিডের ঠেলায় বিক্রি ও বিজ্ঞাপন কমে এক অর্থনৈতিক টানাটানিতে ডুবে গেছে। ফলে কর্মীদের ৪০ শতাংশ বেতন দেয়ার প্রতিশ্রুতিও রক্ষা করতে মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থাটাই বোঝা যাবে এটি দেখলে যে, ধনী-গরিব প্রতিটি মিডিয়াই এখন পাবলিক ডোনেশনের চাঁদা চেয়ে নোটিশ টাঙ্গিয়ে রেখেছে। কাজেই সবাই এখন একমাত্র ও সহজ উপায় হিসেবে দেখছে বিজেপির রাজনীতির পক্ষে সাফাই দেয়ার কাজকে। এমন মিডিয়া হয়ে যাওয়ার বিনিময়, সরকারি দল বা সরকারি ফান্ড হাতিয়ে নেয়া- এভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টাই এখন সব মিডিয়ার প্রধান ট্রেন্ড বা ধারা। মিডিয়াগুলো আরেক নয়া কৌশল ধরেছে। তারা বলতে চাচ্ছে, তারা আরএসএস-বিজেপির হিন্দুত্ববাদের প্রমোটর নয়। কিন্তু তারাই আবার দাবি করছে, তারা আসলে সেটা করেনি। তারা বরং হিন্দু-জাতি-রাষ্ট্রের সরকার, সরকার যেই হোক তাকে সমর্থন দেয়া দ্য হিন্দুর সুহাসিনী হায়দারের কর্তব্য, অথবা দ্য প্রিন্টের শেখর গুপ্তের কর্তব্য- এরা এই আড়াল টেনে কাজ করে যাচ্ছে।

কিন্তু সম্প্রতি আরো উইকেটের পতন ঘটেছে। এটি শ্রুতি কপিলা নামে একজনের দ্য প্রিন্ট পত্রিকায় এক মন্তব্য-রিপোর্ট। তিনি বলছেন, টুইটারে ‘রিজাইন মোদি’ এই হ্যাশট্যাগ পপুলার ভিত্তি পেয়ে উঠছে। তিনি দাবি করেছেন, এটি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, কোভিড মহামারী এবার এই প্রথম ‘রাজনৈতিক’ হয়ে উঠছে। মানে, রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে উঠছে।

গত বছরের এ নিয়ে বিপর্যয়ের সময়ও চির-স্ট্রং মোদি মহামারী ছাপিয়ে ওঠা সত্ত্বেও নিজ পপুলারিটি নিয়ে সেসবের ঊর্ধ্বে ছিলেন। বহু সার্ভেতেই দেখা গেছে, তিনি উপরে আছেন। মিস কপিলা এর কারণ ব্যাখ্যা করে বলতে চান, গত বছরের কোভিড পরিস্থিতি কোনোভাবেই কম চ্যালেঞ্জিং ছিল না। কিন্তু জনগণ এর পরও সম্মিলিতভাবে মোদির ওপর (তার হিন্দুত্বের ওপর) আস্থা রেখেছিলেন যে, তাদের ঐক্যবদ্ধতার কারণে মোদি সবাইকে রক্ষা করে নেবেন।

মিস কপিলা লিখছেন, ‘ভারতে এখন প্রতিদিন নতুন আক্রান্ত রোগী তিন লাখ; এমন সংখ্যা এটিই সম্ভবত প্রধানমন্ত্রীকে কম করে মাফ করা শুরু করেছে। টুইটারে প্রকাশিত ট্রেন্ড, ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া হতাশা, এগুলোই সম্ভবত মোদির হিন্দুত্বের সমর্থন হারানোর প্রথম ইঙ্গিত! এখন ক্রমেই ভয়ের ওপর প্রাধান্য দিতে দেখা যাচ্ছে ‘বিক্ষুব্ধ’ হয়ে ওঠাকে। সম্ভবত এ দিকটা খেয়াল করেই, মোদি সম্প্রতি পাবলিককে ডিসিপ্লিন থাকার জন্য আকুল আবেদন করেছেন।’

তা হলে এবারে মোদির হিন্দুত্ব- এটি আর কোনো মহামারীর বিপর্যয় ঠেকাতে পারছে না? কোভিডের মহামারীতে চিকিৎসার অভাব আর পেটের টানের বিরুদ্ধে এবার ‘হিন্দুত্ব’ আর সব ঢেকে ফেলতে পারছে না! হিন্দুত্বের জোশ আর কি কাজ করছে না? মোদি এবার সব আগলে রাখতে কি ফেল করবেন! মোদি আস্থাহীন নেতা হবেন কি?

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com


আরো সংবাদ



premium cement