২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

নেপাল থেকে শিক্ষা

সীমান্ত কুমার গোয়েল, খাগড়া প্রসাদ অলি ও পুষ্প দাহাল প্রচন্ড - ছবি : সংগৃহীত

বিশ্বের চলতি প্রধান ঘটনা হলো, গত ৩ নভেম্বরের আমেরিকার জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল যেখানে ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনকে জিতানোর পক্ষে আগাচ্ছিল। কিন্তু বিজয়ী হতে প্রয়োজনীয় ২৭০ ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের শেষ ৬টি পূরণ হওয়ার আগেই মনে হচ্ছে তা থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ওদিকে অন্তত একটা রাজ্যে (জর্জিয়া) ভোট পুনঃগণনা শুরু হয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বীদের ফলাফলের পার্থক্য ১% এর নিচে হলে সেখানে পুনঃগণনা শুরু হয়ে যায়, কেউ অনুরোধ না করলে। এতে এতক্ষণে যদিও ফলাফলের সামগ্রিক ঝোঁকটা বাইডেনকে বিজয়ী করার দিকে ছিল, কিন্তু যতক্ষণ তা নিশ্চিত নয় ততক্ষণ এ নিয়ে এর চেয়ে বেশি কথা এখনই না বলা ভালো। ওদিকে ফলাফল পুরা প্রকাশিত হওয়ার আগেই ক্ষমতাসীন ট্রাম্প নিজের বিজয় ঘোষণা করে বক্তৃতা প্রচার করে দিয়েছেন। আর সাথে তিনি এমন একটি ধারণা প্রচার করেছেন যে, তিনি বা তার দল এখন সুপ্রিম কোর্টে অসংখ্য (ভিত্তিহীন হলেও) অভিযোগ নিয়ে একবার হাজির হতে পারলেই আদালত ট্রাম্পের বিজয়ের পক্ষে রায় দিয়ে দেবেন। কিন্তু কেন এমন হবে? এর জবাবটাই তিনি প্রচার করছেন আরেক কানকথা ছড়িয়ে যে, এখনকার সুপ্রিম কোর্টের ৯ জন বিচারকের মধ্যে ৬ জনের নিয়োগ হয়েছে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টের হাতে; মানে তারা কনজারভেটিভ চিন্তার। অতএব এ কারণে ট্রাম্পই নিজের জিতার পক্ষে আদালতের রায় পাবেন। কিন্তু আমেরিকার সাধারণ সমাজ ও বিচার সমাজ কি এতই বোকা, অবিবেচক? কাজেই এই অনুমান ভিত্তিহীন। তবে কিছুটা সত্যতা থাকতে পারে। বিচারকদের কেউ রক্ষণশীল চিন্তার হতেই পারেন; তাই বলে কোনো যুক্তি-প্রমাণ বা শক্ত কারণ ছাড়াই কি তারা রায় দিতে পারেন? এছাড়া আরেকটা কথা মনে রাখতে হবে, প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী ধরনের নির্বাহী ক্ষমতাধারী যা করতে পারেন একজন বিচারক তা পারেন না। সেটা হলো, কোনো নির্বাহী কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সে সিদ্ধান্তের পক্ষে কারণ তিনি প্রকাশ্যে নাও বলতে পারেন; ‘রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা’ ইত্যাদির কথা তুলে। কিন্তু একজন বিচারক রায় লেখার সময় কারণ উল্লেখ করে সেটা যে ন্যায়সঙ্গত এর সপক্ষে সাফাই দিয়ে রায় লিখতে হয়।

আর ঠিক সে কারণে এখন আমেরিকান বিশ্লেষকরাই মিডিয়াতে মন্তব্য করছেন, বিচারককে কেবল প্রমাণ হাতে পাওয়ার পরেই আর ন্যায়সঙ্গত কারণ দেখিয়ে রায় লিখতে হবে। আর এর চেয়েও বড় কথা, বাস্তবে যেসব নির্বাচনী অসঙ্গতির অভিযোগ তুলে মামলা করা হয় বা এবার হয়েছে সেখানে কথা একটাই বলা হচ্ছে, অভিযোগ আছে কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রমাণসহ অভিযোগ তোলা হয়নি। ফলে বিচারক তা আমলে না নেয়ার সম্ভাবনাই প্রবল হচ্ছে। তাই এক কথায় বললে, ট্রাম্প ও তার রিপাবলিকান দলের ভূমিকা এখন এতই নোংরা ও ধ্বংসাত্মক যে, যেকোনো সময় জনমত তাদের এসব তৎপরতার বিরুদ্ধে চলে যেতে পারে। আমেরিকার সাধারণ নাগরিক সারা দিন এত কঠিন বাস্তবতার মধ্যে কষ্টকর জীবনযাপন ও বসবাস করতে হয় যে, কোনো আবেগে প্রভাবিত হওয়ার চেয়ে এরও আগে কঠিন বাস্তব দিকটা তাদের আগে চোখে পড়ে। আবেগ যেন বিলাসিতা, তাই দূরে থাকে আগে থেকেই। ফলে তারা যখন দেখতে পেয়ে যাবে যে, ট্রাম্প প্রমাণ দেয়ার চেয়ে অভিযোগ তোলার দিকেই বেশি আগ্রহী তখন তারা খোদ ট্রাম্পেরই হাত ছেড়ে হতাশ হয়ে সরে যেতে দেরি করবেন না। এভাবে একবার জন-মনোযোগ হারিয়ে ফেললে এটাই ট্রাম্পের হেরে যাওয়ার বাস্তব অবস্থা পরিস্থিতি তৈরি করে ফেলতে পারে। মানুষকে কষ্ট দিতে আর হতাশ করে ফেলতে ট্রাম্প ও তার দল বা সরকারের এসব কাজও আরেক দিকে প্রচণ্ড নষ্ট ভূমিকা পালন করেছে।

একই সাথে গ্লোবাল নেতৃত্ব পালাবদলের কাল চলছে। যেখানে বাস্তবে গ্লোবাল নেতৃত্ব বদলানোর আগে, খুব সম্ভবত, এটাই শেষ আমেরিকান নির্বাচন অথবা যুদ্ধবাজ রিপাবলিকানদের জন্য শেষ সুযোগ। অর্থাৎ এবার ট্রাম্প যদি জেতেন, তবে গ্লোবাল নেতৃত্ব বদল তাতে থামবে না যদিও কিন্তু একটি যুদ্ধের ভেতর দিয়ে ফলাফল হিসাবে আসবে হয়তো। অর্থাৎ একটি যুদ্ধপরিস্থিতির পরেই কেবল গ্লোবাল নেতৃত্বে পালাবদল ঘটবে। ট্রাম্পের এই মনোভাবের প্রতিক্রিয়াতেই যেমন সারা এশিয়া বিশেষত সাউথ-এশিয়ায় ভারতের পড়শি রাষ্ট্রগুলোতে প্রচণ্ড আগ্রাসী ও চাপ সৃষ্টিকারী হয়ে আমেরিকা গত কয়েক মাস থেকে গত সপ্তাহ পর্যন্ত তৎপর ছিল। পম্পেই বা স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্তারা বাংলাদেশসহ নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ইত্যাদি দেশে সফরে গিয়ে এমন মরণ-চাপ তৈরি করে চলেছিলেন।

এটি সত্য যে, এবারের আমেরিকান নির্বাচন এত চাপের মধ্যে হওয়ার মূল কারণ গ্লোবাল অর্থনীতির অর্ডারের নেতৃত্বের পালাবদল একেবারেই আসন্ন, তাই। বাইডেন জিতলে সেটি তুলনামূলকভাবে কম উত্তেজনা ছড়িয়ে শান্তিপূর্ণ ডায়লগের মধ্য দিয়ে ঘটার দিকে যাবে। কিন্তু এসব কিছুকে যা ছাড়িয়ে গেছে তা হলো, বাংলাদেশ ছাড়াও নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, পাকিস্তানেও- এসব দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে নোংরামি আর খোয়াখেয়িতে ভরপুর করে তুলেছে। এরা বাধ্য করছেন এসব দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে আমেরিকা, ভারত না চীন এভাবে কোনো একটার ‘পা-চাটা দালাল’ হয়ে তারা নিজ দেশটাকেই যেন বিভক্ত করে ফেলেন বেপরোয়াভাবে। আর এতে আস্তে আস্তে সব হারানো ভারতের ভূমিকাও আরো মরিয়া আমেরিকান বরকন্দাজ যেন, যার কাজ হলো নিজের সঙ্কীর্ণ স্বার্থে এসব নোংরামিকে আরো তুঙ্গে তোলা।

বড় উদাহরণ নেপাল
গত দু’সপ্তাহ ধরে এমনই হুমকির মুখে পড়া দেশ হলো নেপাল। ইংরেজিতে ‘র’ হলো ভারত রাষ্ট্রের বহিস্থ গোয়েন্দা সংস্থা যার ঘোষিত প্রধান কাজই হলো, প্রতিবেশী দেশে অন্তর্ঘাতমূলক ক্ষতিকর কাজ করে বেড়ানো। এ কারণে ‘র’ নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা ভারত সরকার নিজেই করে না বা প্রায় হয় না বললেই চলে। আর এটাই স্বাভাবিক। ঠিক যেমন ওয়াশরুমে গিয়ে আমরা কী করি তা নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো আলোচনা করি না, এমন ‘নোংরা কিছু’ যেন এই প্রতিষ্ঠান। তবু নেপালে ঘটনার শুরু এই ‘র’ থেকেই। ‘র’-এর প্রধান, সীমান্ত কুমার গোয়েল নেপাল সফরে গিয়েছিলেন গত ২১ অক্টোবর এবং প্রটোকল ভেঙে ‘ওয়ান-টু-ওয়ান’ নেপালের প্রধানমন্ত্রীর সাথে ২ ঘণ্টা ধরে বৈঠক করে ওই দিনই ফিরে এসেছেন। এতদিন ‘র’-এর প্রসঙ্গ উঠলে তা লিখেছি- ‘ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা’। আজ প্রকাশ্যে লিখতে হবে। কারণ ‘র’-এর প্রধান ৯ সদস্যের টিম নিয়ে ভারতীয় বিমানবাহিনীর যানে চড়ে ভিন দেশে গিয়ে প্রকাশ্যে একনাগাড়ে ১৬ ঘণ্টা (যেখানে শিডিউল ছিল ৯ ঘণ্টার) তৎপরতা চালিয়ে মধ্যরাতে নিজ দেশে ফিরেছেন। অথচ ভারতীয়দের দিক থেকেই বিচারে এটা লক্ষণ বা ইঙ্গিত হিসেবে খুবই খারাপ উদাহরণ। একজন প্রধানমন্ত্রীর সাথে কেন ‘র’-এর প্রধান মিটিং করবেন? যেমন, মানুষ নিজ শরীরের মধ্যেই নিজের বর্জ্য নিয়ে ঘোরে। এর মানে এই নয় যে, আমরা তা প্রদর্শন করে বেড়াই। এটা তো প্রটোকলেও পড়ে না। এটা ভারতের কোনো হামবড়া ভাব বা ক্রেডিট নয়। কারণ এর উল্টা মানে হলো, ভারত যেন নিজের বিদেশ বিভাগের কাজ ‘র’-এর হাতে তুলে দিয়েছে। এটা কি ইঙ্গিত যে, ভারতের বিদেশ বিভাগ ফেল করেছে, তারা অযোগ্য? কাজেই নিজ প্রশাসনের এটুকু নিয়ম তো অন্তত ভারতের নিজের জন্যই মানা উচিত ছিল! এখন একটি উদাহরণ থেকে গেল যে, চাইলে ভারত সরকার এমন ‘ন্যুইসেন্স আচরণ’ করতে পারে!

আবার নেপাল মানেই কেবল ওর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী খাড়্গা প্রসাদ অলি (কেপি অলি) নন। ওর অন্যান্য ডেজিগনেটেড নেতা বা জনপ্রতিনিধিরাও আছেন। আছে নিজ রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব। কিন্তু ব্যক্তি অলির কোনো দুর্বলতায় তাকে বেকায়দায় ফেলে এই সফরের অনুমতি ‘র’-এর প্রধান নিয়েছেন বলে মনে করার কারণ আছে। যেমন এই সফরের ফরমাল উদ্দেশ্য কী? তা প্রধানমন্ত্রী অলি না নিজের দলে, না মন্ত্রিসভায়, না মিডিয়ায় কখনো আলোচনা করেছেন বা জানিয়েছেন। এমনকি নেপালের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও কিছু জানাননি। কেবল করোনাকালে ফ্লাইট বন্ধ। তাই সামরিক বিমান নেপালে আসতে গেলে আগাম অনুমতি যেটা দরকার, এর অনুরোধের ফাইলটাই কেবল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইনিশিয়েট করে দিয়েছিল। এ ছাড়া কোথায়ও কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না যদিও পররাষ্ট্রমন্ত্রী দলে অলিরই গ্রুপের লোক। আবার এটা কি ফরমাল না ইনফরমাল সফর, তা নিয়ে মিডিয়ায় আলোচনা হচ্ছে; জবাব কেউ জানে না। বিশেষত যখন এই সফরে আলোচনার অ্যাজেন্ডা বলে কিছুই ছিল না। আবার প্রধান প্রটোকল ভঙ্গের ঘটনাটি হলো, বিদেশী সফর হয়ে থাকে সবসময় কাউন্টারপার্টের (সচিব হলে সচিব, জেনারেল হলে জেনারেল এভাবে) আমন্ত্রণে ও মূলত তার সাথেই এবং আগাম ঠিক হওয়া অ্যাজেন্ডা ধরে। তবে সেটা এবার যেমন, প্রধানমন্ত্রীর সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ পর্যন্তও হতে পারে। কিন্তু কোথাও কোনো আলোচনা-সাক্ষাৎ ওয়ান-টু-ওয়ান হবে না, প্রতিনিধিদল থাকবে সাথে। কিন্তু অলি প্রথম যে প্রটোকল ভেঙে নিজেকে অপমান বা নিচু করেছেন আর (‘র’ তা হতে দিয়েছে) তা হলো, তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়ে আরেক দেশের গোয়েন্দা প্রধানের সাথে এবং ওয়ান-টু-ওয়ান বৈঠক করেছেন এবং তা কোনো অ্যাজেন্ডা ছাড়া বৈঠক; কিভাবে তিনি করেন এটা? ন্যূনতম আত্মসম্মান থাকলেও এটা তার করার কথা নয়।

তবে পরের দিন প্রচণ্ড সমালোচনার মুখে তিনি নিজের প্রেস উপদেষ্টাকে দিয়ে এক ছোট্ট প্রেস নোটে বলালেন যে, “ভারতের ‘গুপ্তচর সংস্থা’ ‘র’-এর প্রধান সামন্ত গোয়েল প্রধানমন্ত্রী অলির বাসভবনে এসে সাক্ষাৎ করেছেন। বৈঠকের সময় নেপাল-ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে বিপর্যস্ত হতে না দেয়া, আলোচনার মধ্যমে সমস্যার সমাধান, পারস্পরিক সহযোগিতা অব্যাহত রাখার ব্যাপারে তিনি নিজ ধারণা ব্যক্ত করেন। সূর্য থাপা, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উপদেষ্টা।”

নেপাল-ভারত সম্পর্ক গত এক বছর ধরে ‘ভীষণ তিতা’ হয়ে আছে। মূলত কালাপানি, লিপুলেখ আর লিম্পিয়াধুরা- এই জায়গাগুলো বর্তমানে ভারতের দখল নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। নেপাল মনে করে এগুলো তার ভূখণ্ড। তাই পাল্টা এগুলো অন্তর্ভুক্ত করে নেপাল নতুন মানচিত্র প্রকাশ করেছে।

প্রধানমন্ত্রী অলি, তার দল কমিউনিস্ট পার্টি। আমাদের সিপিবি ধরনের; তবে অনেক গণভিত্তি এর হয়ে গেছে নির্বাচনী রাজনীতি করতে করতে। এক মাওবাদী ছাড়া ছুটাছাটা নেপালের সব দলই আগের রাজতন্ত্রের আমলে রাজার অনুগত হয়ে চামচামি করে ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট ভোগ করত। মাওবাদীদের কারণে আগের সেই ভারসাম্য উৎখাত হয়ে যায়। রাজতন্ত্র উৎখাত হয়ে গেছে। গত সেপ্টেম্বর ২০১৫ সালে নয়া কনস্টিটিউশন চালুর পরে (যেটা ভারত না মানা থেকেই চরমবিরোধের শুরু আর তা থেকে সাধারণ নেপালবাসীর চরম ভারতবিরোধী হয়ে যাওয়া), এর পর থেকেই এই ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্ট- এই পপুলিজমের নেতা হয়ে বসেন অলি। অথচ এর আগে তিনিই ছিলেন নেপালি কংগ্রেসের পরের গুরুত্বের ভারতপ্রেমী রাজনৈতিক দল। সে সময় নাকি তার খাতির ভারতের রাজনীতিবিদ বা নেতাদের চেয়েও বেশি ছিল ‘র’-এর সাথে। তাই ভারত গত একবছরের তিতা সম্পর্কের সময় থেকে উঠে আসার জন্য আবার ‘র’-কেই ব্যবহারের জন্যই সামনে এগিয়ে দিয়েছে। এমন একটি মুখ আড়ালের ব্যাখ্যা ভারত থেকেই দেয়া হচ্ছে। কিন্তু অবিশ্বাস্য দিকটা হলো, নেপালের সব মিডিয়া গত দু’সপ্তাহ ধরে হন্যে হয়ে খুঁজছে কেন ‘র’-এর প্রধান গোয়েল এসেছিলেন। কেউ হদিস করতে পারেনি কিন্তু সবাই আশঙ্কা করছে, এগুলো সামনে আকস্মিক সরকার বদল বা খারাপ সময়ের ইঙ্গিত।

এদিকে আরেক বড় পরিবর্তন নেপালে ঘটেছিল গত সাধারণ নির্বাচনের আগে। তত দিনে (২০১৫ সালের কনস্টিটিউশন চালুর পর থেকেই কেবল নেপালের রাজনীতিতে চীনের উত্থান ঘটেছিল) চীনের সাথে সারা নেপালের ব্যাপক সম্পর্ক হয়েছিল। বিশেষত অলির কমিউনিস্ট পার্টি আর মাওবাদী পার্টির। তাই চীনের পরামর্শ ও অনুরোধে এই দুই পার্টি এক পার্টি হওয়ার প্রক্রিয়া চালু করে একসাথে নির্বাচনে ক্ষমতায় এসেছিল, দু-তৃতীয়াংশ আসন নিয়ে যেটা এখনও আছে। কিন্তু এক হওয়ার প্রক্রিয়া সুখকর হয়নি। বেশির ভাগ সময় যে মূল অভিযোগ তা হলো, অলি কাউকে বলে বা দলীয় ফোরামে কোনো সিদ্ধান্ত নেন না, নেন একাই। আর তা সবাইকে মানতে বাধ্য করেন। আর দ্বিতীয় বড় অভিযোগ হলো, তাদের নতুন দলের নীতি ও সিদ্ধান্ত হলো একসাথে একের অধিক পদ হোল্ড করা যাবে না। প্রধানমন্ত্রী হলেন, তাহলে দলীয় প্রধানের পদ ছেড়ে দিন। অথচ অলি সেটা আজো মানেননি, প্রয়োগ করেন না।

অবস্থা এমন, এই দ্বন্দ্বের এখন একটাই সমাধান- কমিউনিস্ট পার্টি আবার ভাগ হয়ে যাওয়া। সেটি চীনের পরামর্শে এত দিন এক হয়ে আছে। কিন্তু বাস্তবতা অসহনীয় পর্যায়ে। তবে এটি আবার আগের মতোই আগে যে যার দলে ছিল, সেভাবে ফিরবে না। বড় অংশটা মাওবাদী পুষ্পকুমার দাহালের পক্ষে চলে যাবে। কিন্তু যেকোনো ভাগ হওয়া মানেই ভারত তাদের ব্যাক করবে আর নেপালি কংগ্রেসের সাথে কোয়ালিশনে সরকার করা যায় কি না সে দিকে পরিস্থিতি টার্ন নিবে। মূল কথায়, নেপালে আবার অস্থিতিশীলতা প্রবেশ করবে।

কিন্তু আজব ঘটনাটি হলো নেপালজুড়ে একটি পক্ষ যে গুজব ছড়াচ্ছে তা হলো, পুষ্প দাহালের মাওবাদী ফ্রাকশন ভারতের সহযোগিতায় অলিকে পদচ্যুত করতে চাইছে। অথচ এই গল্পটার সবচেয়ে স্ববিরোধী বা না-মেলা অংশ হলো, ভারত যদি অলিকেই ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত তাহলে সেই অলির সাথে একান্তে গোয়েল এই সাহসী মোলাকাত করছেন কেন? তাই এটা অ্যাবসার্ড প্রপাগান্ডা!

আরেক গুজব হলো, পুষ্প দাহাল অংশ থেকে বেরিয়ে অলি ভারতের প্ররোচনা ও সহযোগিতায় নেপালি কংগ্রেসের সাথে মিলে প্রো-ইন্ডিয়ান সরকার গড়বে। এই গুজব-গল্পটারও বিরাট দুর্বল দিকটা হলো, অলি ভারতবিরোধী বক্তব্যের জন্য ‘চ্যাম্পিয়ন’। এই তো গত বছর লিপুলেখ ভারত দখল করেছে বলে যে ইমেজ তিনি দাঁড় করিয়েছেন, সেই তিনি এখন প্রো-ইন্ডিয়ান সরকার গড়বেন কেমন করে? তাও আবার নেপালি কংগ্রেসের সাথে মিলে যার ইমেজ হলো গত নির্বাচনের পর থেকে যতদূর সম্ভব ভারতের কোলের ভেতরে ঢুকে যাওয়া!

সার কথা, নেপালের দলগুলো কেউ ভারতের, কেউবা চীনের, কেউবা আমেরিকার দালালির অ্যাজেন্সি নিয়ে বসে পড়লেই সব শেষ! এটা এড়িয়ে নেপাল যেন এই তিন দেশের প্রস্তাবে ‘না’ বলার ক্ষমতাটা কখনো নিজের হাতছাড়া করে, এটা বাদে অনেক কিছুই করা সম্ভব!

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com


আরো সংবাদ



premium cement