২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩০, ২০ মহররম ১৪৪৬
`

নৈতিক ভিত্তি হারানো একটি সফর

-

ভারত রাষ্ট্রের মোরাল যেন ভেঙে গেছে। যেকোনো প্রতিষ্ঠানের নৈতিক ভিত্তি থাকতেই হয়, নইলে সে প্রতিষ্ঠান টেকে না। রাষ্ট্র বা যেকোনো প্রতিষ্ঠান ন্যূনতম একটা ন্যায়ভিত্তির ওপর না দাঁড়িয়ে থাকতে পারলে সবার আগে প্রতিষ্ঠান মোরাল হারায়, নৈতিক সঙ্কটে পড়ে যায়। ভারত-রাষ্ট্র সেই সঙ্কটে আটকে গেছে। কারণ, মোদির ভারত নিজের নাগরিকদের সুরক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। শুধু তাই নয়, এবার দিল্লি ম্যাসাকারে মোদি, তার সরকার ও দলই এর প্রযোজক বলে অভিযুক্ত। গত ২০০২ সালের গুজরাট কোনো রাষ্ট্র ছিল না, একালের ভারতও নিছক কোনো রাজ্য নয়। কাজেই কোনো কিছুই ২০০২ সালের মতো ঘটবে না। নরেন্দ্র মোদি এখন পর্যন্ত দিল্লির ম্যাসাকার নিয়ে মুখ খোলেননি। যে নৈতিক সঙ্কটে ভারত পড়েছে সেটা আরো জটিল হবে এতে। দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকার ভারতের বাসিন্দাদের এই নৈতিক সঙ্কটে ফেলে দিয়ে গেছেন যা ক্রমে নাগরিকদের দায়বোধের অস্বস্তিতে বেঁধে ফেলবে। তাই হর্ষবর্ধন শ্রিংলা সরকারি আমলা হিসেবে বাংলাদেশ সফরে এসে বাস্তব কথা বলার শক্ত নার্ভ দেখিয়ে গেলেন! ওদিকে, ঘটনা ঠিক কী ঘটেছে এবং তা কিভাবে, এর ফ্যাক্টসের কিছু এর মধ্যে প্রকাশ পাওয়া শুরুও হয়েছে।

ভারতের পররাষ্ট্র সচিব শ্রিংলা এবার তার দু’দিনের সফরে ঢাকা ঘুরে গেলেন। কূটনৈতিক প্রথা অনুসারে নির্বাহী প্রধানের কোনো দেশ সফরের আগে সাধারণত পররাষ্ট্রমন্ত্রী সে দেশ সফরে আসেন। আর তা মূলত নির্বাহী প্রধানের সফরকে নিশ্চিত করার একটা প্রক্রিয়া। এ ছাড়াও, সফরে কেন ও কী কী ইস্যু উঠবে আর তাতে উভয়ের অবস্থান কী হবে এসব চূড়ান্ত করাও এর লক্ষ্য। এর পরেও অনেক কিছুই থেকে যায় বা রেখে দেয়া হয় যা সফরকালে দুই শীর্ষ প্রধানের আলাপে ফাইনাল করা হবে। দেখা যাচ্ছে, মোদির আসন্ন বাংলাদেশ সফর উপলক্ষে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে না পাঠিয়ে সচিবকে পাঠিয়েছেন। সেটা কোনো দোষ বা বড় ব্যতিক্রমের বিষয় না হলেও, অনুমান করা যায় সেটা ঘটেছে এই বিবেচনায় যে, ঢাকায় শ্রিংলার ‘তাজা বন্ধু’ অনেক বা অন্য ভারতীয়ের চেয়ে তিনি এগিয়ে। কারণ, এই তো সে দিন বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার হিসেবে তিন বছর কাটিয়ে গত বছরের জানুয়ারিতে তিনি এ দেশ ছেড়ে গেছেন। তার সেসব তৎপরতা ও স্মৃতি এখনো অন্য সবার চেয়ে ‘তাজা’ বলে আর তখন যেসব বিশেষ খাতিরের সম্পর্ক তিনি জমিয়েছিলেন, তা এখন কাজে লাগানোর বিচারে তিনি অবশ্যই ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চেয়ে তিনি এগিয়ে।

ভারত-বাংলাদেশ নাকি গভীর বন্ধুরাষ্ট্র অথবা কখনো ‘স্বামী-স্ত্রী’ অথবা আরো কত কী যেগুলো সত্যিই ইউনিক ও তুলনা নেই। দুনিয়ার কোনো কূটনৈতিকপাড়ায় এমন অকূটনৈতিক অর্থহীন ও বোকা বোকা শব্দের ব্যবহার নেই। তা আসলে বাংলাদেশকেই গায়ে পড়ে নিচে দেখানো ছাড়া আর কিছু নয়।

এই পটভূমিতে, শ্রিংলাকেই বেছে পাঠানোর এ ঘটনা- মোদির ভারত যে বিপদে আছে এর আরেকটা প্রকাশ। শ্রিংলাকে এমন একটা সফরে আসতে হয়েছে যখন দুনিয়াজুড়ে মোদির ভারত এক হিউম্যান রাইট রক্ষার কাজ অকার্যকর হয়ে পড়ার সঙ্কটে পড়েছে বলে দেখা হচ্ছে। জাতিসঙ্ঘ হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল এই ব্যর্থতা নিয়ে আদালতের শুনানিতে অবজারভার হতে চেয়েছে। মোদি আপাতত এটা তার দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের প্রমাণ বলে বিবৃতি দিয়ে বাঁচতে চেয়েছেন।

ওদিকে এখন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বা আমেরিকার সংসদে (প্রতিনিধি পরিষদে) দিল্লির ম্যাসাকার নিয়ে আলোচনা ও নিন্দা প্রস্তাব একটা হট ইস্যু। ভারত থেকে মুসলমান উদ্বাস্তুর ঢল নামবে কি না আর সে ক্ষেত্রে আগাম তা ঠেকানোর উপায় কী, আগানোর কৌশল কী, এটাও তাদের মাথাব্যথার বিষয়। ভারত ১৩৫ কোটি মানুষের ভোক্তা-বাজার- কিন্তু এর প্রতি লোভের চেয়েও উদ্বাস্তুর ঢল অনেক বেশি বিপর্যয় আনবে, এটাই এখানে মুখ্য।

মোদি সরকারের সহযোগিতায় দিল্লিতে ৫৮ জনেরও বেশি মানুষ, মুসলমান বলে তাদের হত্যা করা হয়েছে। অথচ আজ পর্যন্ত এই বিষয় নিয়ে তিনি কোনো কথা, বিবৃতি বা প্রতিক্রিয়া কোনো কিছুই দেননি। ভারতের পার্লামেন্টেও কোনো আলোচনা হতে দেয়া হয়নি। এই প্রতিক্রিয়াহীনতা অপ্রধানমন্ত্রীসুলভ, তাই অগ্রহণযোগ্য; এমনকি মারাত্মক অস্বাভাবিক। আর এটাই তার ও সরকারের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগকে তীব্র করছে। এটা সরকারকে মূল্যবোধ, নৈতিকতার এক বিরাট সঙ্কটে ফেলেছে আর এতে এ সরকার ন্যূনতম ন্যায়নীতি পালনেরও অযোগ্য- এমন এক পরিচয় তুলে ধরেছে। অথচ শ্রিংলার বিপদ হলো, এই নৈতিকতার সঙ্কটে থাকা সরকারকেই প্রতিনিধিত্ব করতে তাকে বাংলাদেশে আসতে হয়েছে। তাও আবার যেখানে প্রায় ৯০ শতাংশ লোক মুসলমান।

এসব বিচারে ভারতের হর্ষবর্ধন শ্রিংলাকে আমরা দেখছি তিনি ব্যাকফুটে ও নিষ্প্রভ। তা না হয়ে তার উপায় কী? এমনকি শ্রিংলার ঢাকায় থাকা অবস্থায় ৩ মার্চ আনন্দবাজারের এক রিপোর্টও তার সঙ্কটকে বাড়িয়ে দিয়েছে। এ পত্রিকা লিখেছে, ‘সিএএ-এনআরসি বিতর্কের প্রভাব পড়েছে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে। দিল্লির হিংসা, সেই ক্ষোভে ইন্ধন জুগিয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। সে দেশের মন্ত্রী-পর্যায়ের একাধিক জনের ভারত সফর বাতিল করেছিল হাসিনা সরকার। আজ সেই তালিকায় নতুন সংযোজন, বাংলাদেশের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর নয়াদিল্লি সফর।’ এই খবর মোদি ও শ্রিংলার জন্য বিরাট অস্বস্তির সন্দেহ নেই।

বাংলাদেশের স্পিকারের ভারত সফর ছিল ২-৫ মার্চ। তিনি সফর বাতিলের ঘোষণা দেন মাত্র একদিন আগে, ১ মার্চ; যেন শ্রিংলার বাংলাদেশ সফরে আসা নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলেন তিনি। শ্রিংলা ঢাকা আসেন পরের দিন ২ মার্চ। অর্থাৎ তিনি বাংলাদেশের স্পিকারের সফর বাতিলের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি বা তা পারেননি। অর্থাৎ এটা মেনে নিয়ে হলেও ব্যাকফুটেই স্বস্তিবোধ করছেন।

শ্রিংলা ২ মার্চ সকালে বাংলাদেশে নেমেই ভারতীয় হাইকমিশনের সহ-আয়োজক হয়ে এক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পাঠক ছিলেন। কিন্তু এবারের সফরে তার দুর্ভাগ্য যে, তাকে সরাসরি অসত্য বলেই পার পেতে হবে, অন্য রাস্তা নেই। তাই তিনি আসলে এখানে ভান করলেন যে, এনআরসি ইস্যুটা যেন এখনো কেবল আসামেই সীমাবদ্ধ। তাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ যেন সংসদে দাঁড়িয়ে বলেননি যে, তিনি এবার ‘ভারতজুড়ে এনআরসি করবেন’। অমিত এটা কোনো জনসভায় বলেননি, সংসদে এবং মন্ত্রী হিসেবেই বলেছেন। কাজেই এটা কোনো দলের নয়, ভারতের সরকারি অবস্থান। এ ছাড়া মোদি এমনকি দিল্লিতে নির্বাচনে হারের পরেও বলেছেন, আপাতত এনআরসি বন্ধ রাখা হচ্ছে। আর ভারতজুড়ে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বা সিএএর বাস্তবায়নে মেতে উঠবেন তিনি। তাহলে শ্রিংলা কেন এখনো এনআরসিকে ‘আসামের ঘটনা’ বলছেন? ভারতের কোনো রাজনীতিবিদ বা মিডিয়াও তো তার কথা মেনে নেয়ার কথা না। এযুগে ভারতের সরকারে কে কী প্রতিদিন বলেন তা বাংলাদেশে বসে জানা কি খুবই কঠিন! এনআরসি এখন ভারতজুড়ে বাস্তবায়নের ইস্যু আর এটা এখন এনআরসি-সিএএ ইস্যু। অথচ শ্রিংলা সেমিনারে বলে গেলেন এনআরসি ‘প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণভাবে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনায়’ চলছে। তাই তিনি দাবি করলেন, ‘ ... সুতরাং বাংলাদেশের জনগণের ওপর এর কোনো প্রভাব থাকবে না। আমরা এ ব্যাপারে আপনাদের আশ্বস্ত করছি।’ জানতেন কেউ তার এ কথা এ দেশে বিশ্বাস করেনি। কিন্তু তবু এই চাতুরী ছাড়া কিইবা তিনি করতে পারতেন? সম্ভবত এত অসহায় অবস্থায় হয়তো তিনি এর আগে নিজেকে দেখেননি! তিনি আরো বানিয়ে বলেছেন, সিএএ বা ‘নাগরিকত্ব বিল কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে নয়’। বলেছেন দ্বিতীয়ত, ‘নির্যাতনের শিকার হয়ে এসে যারা ভারতে আছেন, তাদেরকে দ্রুততার সাথে নাগরিকত্ব দেয়াই এর উদ্দেশ্য এবং তৃতীয়ত, এটি (বাংলাদেশের) বর্তমান সরকারের সময়ের জন্য কার্যকর হবে না। কার্যকর হবে ১৯৭৫-পরবর্তী সামরিক শাসক ও অন্য সরকারগুলোর সময়ে, যারা এখানে সংখ্যালঘুদের সাংবিধানিক অধিকার দেয়নি।’ এ কথাগুলো সত্য নয়। কারণ সিএএ আইন প্রযোজ্য হবে বা কাট অফ ডেট হলো ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৪। মানে এর আগে যারা ভারতে প্রবেশ করেছে। কাজেই কেবল ‘১৯৭৫-পরবর্তী’ সময়টি এক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে এই কথাটাই ভুয়া, ভিত্তিহীন। বুঝাই যায় ঢাকা সরকারের মন পাওয়া, তাদের খুশি করার জন্য এ কথাগুলো বলা হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, সিএএ আইনের মধ্যে বাংলাদেশের নাম সরাসরি উল্লেখ করা আছে এবং তা অমুসলিমদের ‘নির্যাতনকারী হিসেবে’। কাজেই ভারত এখন বাংলাদেশকে অমুসলিমদের ‘নির্যাতনকারী দেশ হিসেবে’ আনুষ্ঠানিক প্রমাণ পেশের আগে এ নিয়ে শ্রিংলা বা ভারত কোনো কথা বলতে পারেন না। অথচ বাংলাদেশের নাম বিজেপি সরাসরি আইনের মধ্যে উল্লেখ করে দিয়েছে- পশ্চিমবঙ্গে মেরুকরণ করতে বা হিন্দু ভোট সব নিজের রাজনৈতিক ঝুলিতে পেতে।

বাংলাদেশে এই সফরে শ্রিংলা আরেক বিরাট মুলা ঝুলিয়েছেন- তিস্তার পানি তো বটেই, ভারত বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত মোট ৫৪ নদীর মধ্যে আরো নাকি ছয়টি পানি দেয়ার চুক্তি করতে যাচ্ছে। এটা অবিশ্বাস্য আর তাদের বিশ্বাস করার মতো আস্থা তারা অনেক আগেই হারিয়েছেন। ওই সেমিনারে শ্রিংলা এমন সব কথা বলেছেন, যা দেখেই বুঝা যায় বানানো কথা বলছেন। আসলে মন জয়ের চেষ্টা করছেন। তিনি বলেছেন, ‘এটা প্রমাণিত যে, ৫৪টি অভিন্ন নদ-নদীর পানি পরিবেশবান্ধব, টেকসই ও ন্যায্য বণ্টন করার মধ্যেই আমাদের বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থ নিহিত।’ অথচ এটা ভারতের অবস্থানই নয়, এ পর্যন্ত ভারতের অনুসৃত নীতি নয়। কার্যত তাদের অবস্থানটাই উল্টা। আমরা দেখছি ‘পরিবেশের’ কথা তিনি বলেছেন। যৌথনদীর ক্ষেত্রে পরিবেশ বিবেচনায় টেকনিক্যাল নিয়ম হলো, নদীর ‘অবাধ’ প্রবাহ বজায় রাখতে হবে। অথচ এ বিষয়ে ভারতের পরিবেশবোধ শূন্য এবং তাদের ভূমিকা পরিবেশবিরোধী। ভারত বহু আগে থেকেই হয় নদীতে সরাসরি বাঁধ দিয়েছে, না হলে আন্তঃনদী যুক্ত করার মতো চরম পরিবেশবিরোধী প্রকল্প নিয়েছে। আর তাও না হলে নদীর মূল প্রবাহ থেকে বড় খাল কেটে পানি বহু দূরে টেনে নিয়ে গেছে। এই হলো ভারতের কথিত পরিবেশবোধ।

আর টেকসই? নদীর ওপর যেসব বাড়াবাড়ি ভারতে হচ্ছে তাতে এগুলো একটাও টিকবে না, মূল নদীই শুকিয়ে যাবে ক্রমেই। ফারাক্কা ইতোমধ্যেই এ অবস্থায়। এ ছাড়া ফারাক্কা বাঁধ ভারতের বিহারে প্রতি বছর বন্যার কারণ বলে অভিযোগ উঠছে এখন।

আর ন্যায়সঙ্গত বণ্টন? মানে যৌথ নদীর ক্ষেত্রে আইন? এসব নদীর ক্ষেত্রে ভাটির দেশের প্রাপ্য, সমান হিস্যা ভারত দিতে আইনত বাধ্য। আমাদের সম্মতি ছাড়া বাঁধসহ নদীর প্রবাহকে কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত করা বেআইনি। অথচ ভারতের সাথে নদীর পানি বণ্টনের যেকোনো আলোচনায় তাদের দাবি অনুযায়ী বণ্টনের ভিত্তি হলো ‘ভারতের প্রয়োজন মিটানোর পরে পানি থাকলে তা বাংলাদেশ পাবে’। এই নীতিতেই ভারত চলে। এ ছাড়া প্রায় সব সময়ের যুক্তি হলো ‘এবার বৃষ্টি কম হয়েছে। তাই আরো কম পানি পাবে বাংলাদেশ’। অর্থাৎ ভাটির দেশ হিসেবে পানি আমাদের প্রাপ্য এই আন্তর্জাতিক আইনি ভিত্তি তারা মানে না। কথা হলো, ভারতের পানির প্রয়োজনের কোনো শেষ কি থাকবে?

সোজা কথা ‘পরিবেশবান্ধব, টেকসই ও ন্যায্য বণ্টন’ এই শব্দগুলো শ্রিংলা তুলেছেন- কথার কথা হিসেবে এবং মন ভুলাতে। অথচ না পরিবেশ রক্ষা, না আন্তর্জাতিক নদী আইন- ভারতের চলার ভিত্তি বা সরকারের নীতি নয়। আসলে শ্রিংলা দেখালেন, পুরো বানোয়াট কথা বলার মতো নার্ভ তার আছে। আর সম্ভবত তিনি ভেবেছেন, বাংলাদেশ তবুও তাকে বিশ্বাস করবে বা আস্থা রাখবে।

দিল্লি জ্বালিয়েছে কারা?
বাংলাদেশে এসে হর্ষবর্ধন শ্রিংলা দিল্লি ম্যাসাকার নিয়ে একটা কথাও বলেননি। অজুহাত সম্ভবত, এটা অভ্যন্তরীণ ইস্যু। কিন্তু বাস্তবতা হলো- লাগাতার তিন দিন ধরে এ হত্যাযজ্ঞ বা ম্যাসাকার চলেছে; দিল্লি জ্বলেছে, কমপক্ষে ৫৮ জন মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে। মুসলমানদের বাড়িঘর যতটুকু সম্পদ সব কিছু পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এই প্রথম কারা সুনির্দিষ্টভাবে দিল্লি ম্যাসাকার করেছে তার কিছু তথ্য সামনে আসা শুরু হয়েছে।

দিল্লি ভারতের বিশেষ মর্যাদার টেরিটরি, তা সত্ত্বেও দিল্লি একটা রাজ্য। তাই রাজ্যের ‘বিধানসভা’ নামের সংসদ (প্রাদেশিক পার্লামেন্ট) আছে। সেখানে রাজ্য প্রয়োজনীয় আইনও প্রণয়ন করতে পারে, যা কেবল নিজ রাজ্যের ওপর প্রযোজ্য। দিল্লির বিধানসভায় ১৯৯৯ সালে এমনই একটা আইন পাস করা হয়েছিল, যার নাম ‘দিল্লি মাইনরিটি কমিশন অ্যাক্ট ১৯৯৯’। এ দিকে বাংলাদেশের মানবাধিকার কমিশন ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ অর্থে নির্বাহী বিভাগ থেকে স্বাধীন নয়। আইনের মারপ্যাঁচ ও দুর্বলতায় এটা নির্বাহী ক্ষমতার মুখাপেক্ষী হয়েই চলে। সে তুলনায় ভারতের অধিকারবিষয়ক কমিশনগুলো এত ঠুঁটো নয়। বরং খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং ভারতের আদালতের পর্যায়ে স্বাধীন। যেমন ভারতের ‘জাতীয় নারী কমিশন’ যথেষ্ট প্রভাবশালী ও কর্তৃত্ব রাখে। তেমনি ‘দিল্লি মাইনরিটি কমিশন অ্যাক্ট’-এর অধীনে রাজ্য সরকার এক ‘দিল্লি মাইনরিটি কমিশন’ (ডিএমসি) গঠন করে দিয়েছে। এর মূল কাজ হলো, ‘সংখ্যালঘু বা মাইনরিটিদের অধিকার ও স্বার্থ সুরক্ষা’। এরা পুরোটা আদালতের পর্যায়ের না হলেও তারা অনেক ক্ষমতা রাখেন। যেমন ২৫ ফেব্র“য়ারি রাত থেকে নর্থ দিল্লিতে কার্ফু জারি করতে তারাই পুলিশকে চিঠি দিয়েছিলেন।

সেই ডিএমসি সরেজমিন দিল্লির ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা সফর শেষে প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। অচিরেই একটা ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি গড়ে তারা মাঠে কাজ শুরু করতে যাচ্ছেন, যে কমিটিতে আইনজ্ঞ, সাংবাদিক ও সিভিল সোসাইটির সদস্যরা যুক্ত থাকবেন। এই কমিশন বা ডিএমসির চেয়ারম্যান হলেন জাফরুল ইসলাম খান ও অন্য সদস্য হলেন কারতার সিং কোচার। এরা প্রথম সরেজমিন রিপোর্ট মিডিয়ায় প্রকাশ করেছেন। তাদের প্রথম কথা হলো, এই হামলা ‘একপক্ষীয়’ এবং ‘পূর্বপরিকল্পিত’। অর্থাৎ এটা কোনো দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে মারামারি বা রায়ট নয়। অথবা এটা হঠাৎ উত্তেজনায় ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নয়। বরং আগেই পরিকল্পনা করে ঘটানো সন্ত্রাস। বিভিন্ন মিডিয়ার সাথে তাদের কথা বলার সময় জাফরুল ইসলাম খান সাহেবের করা কিছু মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য।

তার ফাইন্ডিংয়ের সবচেয়ে বড় মন্তব্য হলো, প্রায় দুই হাজার বহিরাগতকে পরিকল্পিতভাবে নর্থ-ইস্ট দিল্লিতে এনে, কয়েকটা স্কুলে রেখে তাদের দিয়ে এই ম্যাসাকার, হত্যা ও আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এর প্রমাণ হিসেবে এক প্রত্যক্ষ সাক্ষীর বয়ান তারা সংগ্রহ করেছেন। তার নাম রাজকুমার। তিনি রাজধানী স্কুলের গাড়ির ড্রাইভার। তিনি বলেছেন, এরকম ৫০০ বহিরাগত যাদের মুখে মুখোশ ছিল। এরা প্রায় ২৪ ঘণ্টা ওই স্কুলে অবস্থান করেছিল। তারা সাথে পিস্তল নিয়ে সশস্ত্র ছিল আর এক ধরনের ‘বড় গুলতি’ ব্যবহার করেছিল উঁচু দালান থেকে পেট্রলবোমা ছুড়ে মারার জন্য। কমিশনও বলেছে, তারা এমন কিছু ব্যক্তির ফুটেজ সংগ্রহ করেছেন।

এ ছাড়া জাফরুল ইসলামের দাবি, তারা জেনেছেন প্রত্যেক গলি থেকেই স্থানীয় অন্তত দু-একজন সহযোগী ছিল যারা মুসলমানদের বাড়ি , দোকান, গুদাম বা সম্পদ কোনগুলো, তা দেখিয়ে দিয়েছে। যাতে কেবল সেগুলোতেই আগুন লাগিয়ে দেয়া যায়। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, এভাবেই ‘যমুনা বিহার’ এলাকা ছাড়া সব জায়গাতেই কেবল বেছে বেছে মুসলমানদের বাড়িঘর ও সম্পদ পোড়ানো হয়েছে।

এই প্রাথমিক রিপোর্ট প্রকাশ করা নিয়ে লুকোচুরি শুরু হয়েছে। বেশির ভাগ ‘মেনস্ট্রিম মিডিয়া’ এটা ছাপেইনি। সবচেয়ে বিস্তারিত ছেপেছে দক্ষিণের ব্রিটিশ আমলের প্রাচীন দৈনিক পত্রিকা ‘দ্য হিন্দু’। এ ছাড়া ওয়েব পত্রিকা ওয়াইর (wire) আর নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এটা ছেপেছে। আরো কিছু পত্রিকা ছেপেছে,তারা কেবল সরকারি সংবাদ সংস্থা পিটিআইয়ের শর্ট ভার্সনটা ছেপেছে। তবে একটা ইউটিউব ভার্সন পাওয়া যায় এক সংশ্লিষ্ট মিডিয়া ‘এইচডব্লিউ নিউজ নেটওয়ার্ক (HW News Network) থেকে। সেখানে এ নিয়ে নিউজ ছাড়াও চেয়ারম্যান জাফরুল ইসলাম খানের সাক্ষাৎকারও প্রচারিত করেছে।

দেখা যাচ্ছে, ফ্যাক্টস বাইরে আসা শুরু হয়েছে। এসবের বিরুদ্ধেও মোদি-অমিত কোনো কৌশল গ্রহণ করবেন সন্দেহ নেই।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com


আরো সংবাদ



premium cement