পররাষ্ট্রনীতি আমেরিকার বন্ধুদের নজরে
- গৌতম দাস
- ০১ জুন ২০১৯, ১৯:৩৭

বাংলাদেশের ‘পররাষ্ট্রনীতি’ হঠাৎ করে আমেরিকানদের নজরে পড়েছে মনে হচ্ছে। কোন আমেরিকান, কারা এরা, তা নিয়েও কথা আছে অবশ্য। সে কথা পরে বলা যাবে। ‘প্রথম আলো’র ভাষাতেই বলি, গত ১৭ মে লিখেছে, ‘বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কোন পথে- এই জিজ্ঞেস নিয়ে সম্প্রতি এক গোলটেবিল বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন রাজনীতিক, কূটনীতিক, নিরাপত্তা বিশ্লেষক, শিক্ষাবিদ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা। আলোচনায় উঠে আসে আমাদের পররাষ্ট্রনীতির ভেতর-বাহির, জাতীয় নিরাপত্তা, রোহিঙ্গা সমস্যা এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতির নানা দিক।
আয়োজক ছিল বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট (বিইআই) ও ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই )’। আয়োজক প্রতিষ্ঠান দু’টি আমেরিকান থিঙ্কট্যাঙ্ক ধরনের দুই প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্কিত। তারা ওই থিঙ্কট্যাঙ্কেরই বাংলাদেশ শাখা নাকি কেবল ফান্ডদাতা-এনজিও সম্পর্ক, কোনটা- সেটি তাদের মুখ থেকেই আমাদের জানার দরকার। যা হোক, এমন প্রতিষ্ঠানগুলো যা কিছু নিজের কাজের ইস্যু হিসেবে তুলে আনে, অনুমান করা অবাস্তব হবে না যে, তাতে আমেরিকান রাষ্ট্রস্বার্থ আছে।
কথা হলো, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কেমন আছে, এর ঘাটতি কী- সে প্রশ্ন এখন কেন? বিশেষ করে আজকের খোদ বাংলাদেশই যে দশায় আছে, একে এই অবস্থায় আনা ও ফেলার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা আমেরিকার বুশ এবং ওবামা- এই দুই প্রশাসনের তো বটেই অন্তত আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটেরও বিশেষ ভূমিকা এ ক্ষেত্রে আছে, ভারত-আমেরিকার আলোচনাগুলোতে, গোলটেবিল বা ইনফরমাল বৈঠকে ইনপুট দিয়ে।
বর্তমান বাংলাদেশ সরকার ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এক ধরনের পরিণতি, এই অর্থে ‘উত্তরসূরি।’ ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশে যে এক ধরনের সামরিক ক্ষমতা দখল হয়েছিল তাকে আমরা অনেকে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ বলি, যা দুই বছর ক্ষমতায় ছিল। কেন এই ঘটনা ঘটেছিল, এর আনুষ্ঠানিক কারণ জানা যাবে না। কিন্তু আসল কারণ যা দখলকারীদের সাফাই-বক্তব্য থেকে জানা যায় তা হলো, আগের সরকার ‘ওয়ার অন টেররকে’ ঢিলেঢালাভাবে নেয়াতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে ‘জঙ্গি মোকাবেলার উপযোগী’ করে সাজানো ও সংস্কার করা হয়নি। সে কাজগুলো সম্পন্ন করতে ওই ক্ষমতা দখল। এই বক্তব্যটি ক্ষমতা দখলের ছয় মাস পরে বদলে যায়।
কারণ, আমেরিকান প্রায়োরিটি বদলে নতুন আকার নিয়েছিল। আমেরিকান ওয়ার অন টেরর বা জঙ্গি ঠেকানোর চেয়ে এবার আমেরিকান রাষ্ট্রস্বার্থ বেশি প্রায়োরিটিতে আনে ‘চীন ঠেকানো’র বিষয়। কারণ, আমেরিকার ‘চায়না কনটেইনমেন্ট’, মানে ‘চীন ঠেকানো’ নামের কর্মসূচি আছে। গ্লোবাল অর্থনীতিতে নেতা হিসেবে চীনা উত্থান আর আমেরিকার পতন যখন আমেরিকার প্রকাশিত সার্ভে রিপোর্টও স্বীকার করে, তখন এশিয়ার দুই ‘রাইজিং অর্থনীতি’ চীন ও ভারত- এদের একটাকে (ভারতকে) কাছে টেনে অপরটির বিরুদ্ধে লাগানোর নীতিই ‘চায়না কনটেইনমেন্ট’। প্রায়োরিটি বদলের রহস্য এখানেই। আমেরিকার ‘চায়না ঠেকানোর’ নীতিতে ভারত নিজেকে পরিচালিত হতে দিতে রাজি হয়ে যায় এসময়েই। এর বিনিময়ে ভারত পায়- এক দিকে আমেরিকায় পণ্যের রফতানি বাজারে প্রবেশ সুবিধা, ভারতের আমেরিকান হাইটেক অস্ত্র ইত্যাদি; এ ছাড়াও অন্য দিকে আমেরিকা ভারতের হাতে বাংলাদেশকে ‘দেখভালের দায়িত্ব’ তুলে দেয় যাতে বিনা পয়সার করিডোর, আসামের বিদ্রোহ দমনসহ এ দেশকে বাস্তবেও ব্যবহার করে সব সুবিধাই নিতে পারে ভারত। অনেক কিছু তার হাতে চলে যায়।
এরপর আজ আমাদের এই দুর্দশা। আমেরিকা আবার কী চায়? একই লোকদের আমরা আবার তৎপর হতে দেখছি কেন?
গত ২০১৪ সালের নির্বাচন উপলক্ষে দেখেছিল যে, সেবার বাংলাদেশের বিনা ভোটের নির্বাচনকে সমর্থন দিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের সরকার এত ঘনিষ্ঠতায় মিলে গেছে যে, তারা আর যেন আমেরিকাকে চেনেই না। বাংলাদেশে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ডন মোজিনা, স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে ব্রিফিং না পেয়ে বা না নিয়ে ভারতে গেছিলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে- ব্যাপারটা খুবই প্রতীকী নিঃসন্দেহে।
বাস্তবতা হলো, আমেরিকা যেন সব মুরোদই হারিয়েছে। যে চীনকে ঠেকানোর কাজ ভারতকে দিয়ে করানোর বিনিময় হিসেবে আমেরিকা ভারতের হাতে বাংলাদেশকে দেখার দায় তুলে দিয়েছিল, তাতে কি চীনের উত্থান ঠেকানো গেছে? না আমেরিকা তা ঠেকাতে পারেনি, বরং বেগতিক অবস্থায় আমেরিকা এক ‘পাগলা প্রেসিডেন্ট’, পেয়েছে, যিনি নিজেই আমেরিকার গ্লোবাল নেতাগিরি ছেড়ে দিতে চান। তিনি নাকি ন্যাশনালিস্ট আমেরিকান! কী তামাশা! গ্লোবালাইজেশনের নেতা আমেরিকা, যে দুনিয়াটাকে অন্তত ৩০ বছর ধরে একটা গ্লোবালাইজড শ্রমবিভাজিত এক গ্লোবাল অর্থনীতিতে নিয়ে গিয়েছে, সেই আমেরিকার পাগলা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলছেন, উনি এখন নাকি ‘ন্যাশনালিস্ট’ (আমেরিকা ফার্স্ট) হয়ে যাবেন।
ঘটনা হলো, আমরা কেউই মায়ের গর্ভে ফিরে যেতে পারব না। এর চিন্তাই করি না। কিন্তু বিতর্কিত ট্রাম্প মনে করেন এটাও করা সম্ভব। ব্যাপারটা এমনই। আসলে পাগলামি আর দেশ চালানো তো এক জিনিস নয়। তাতে আমাদের অসুবিধা নেই; কিন্তু যারা আবার বাংলাদেশে ‘ফ্রেন্ডস অব আমেরিকা’ তাদেরকে আবার তৎপর আর বড়ই পেরেশান দেখাচ্ছে।
এসব ব্যাপারে প্রথম প্রয়োজন হয় মুরোদের। ‘মুরোদহীন’ হলে আর সে মরদ থাকে না। ঘটনা হলো, ভারতকে বাংলাদেশ দিয়ে দেয়ার পর থেকে ঘটনাচক্রে আমেরিকাও মুরোদহীন হয়ে যায়। ট্রাম্পের উত্থান ঘটে। ইতিহাসে ২০০৭ সালই সম্ভবত সর্বশেষ আমেরিকান হস্তক্ষেপ বলে উল্লেখ থাকবে। অন্তত ২০২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত, মানে ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকা পর্যন্ত আমেরিকা এমন থাকবে- অভিমুখ, তাই বলছে। এই সময়ের মধ্যে স্টেট ডিপার্টমেন্ট, পেন্টাগন ইত্যাদি যেখানেই যা কিছু নড়াচড়া শুরু হোক না কেন, সেসব হোয়াইট হাউজে যাওয়া মাত্রই ‘আমেরিকান স্বার্থের’ সবচেয়ে ‘ভালো ভালো উদ্যোগ ও প্রস্তাব’- সবই ডিপ ফ্রিজে চলে যাবে। কারণ, পুরনো অভ্যাসে এসব তৎপরতায় ট্রাম্প ন্যূনতম আগ্রহী নন। এখান থেকেই ‘মুরোদহীনতা’র শুরু বলতে পারেন।
আসলে ‘ফ্রেন্ডস অব আমেরিকা’ ইন বাংলাদেশ আসলে খেয়ালই করেননি যে ২০০৭ সালেই অসত্য বলা হয়েছে। ‘ওয়ার অন টেরর’-এর ভয়াবহতার কথা তুলে তা সামনে রেখে এর আড়ালে আমেরিকা ‘চীন ঠেকানোর প্রায়রিটি’তে মেতেছে। অথচ বন্ধুদেরও তা বলেনি। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে এসে আমেরিকার পক্ষে ‘ওয়ার অন টেরর’ যে আর আমেরিকার প্রায়রিটি নয়, সে তা আর লুকিয়ে রাখতে পারেনি। প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস মাতিস পরিষ্কার করে তা বলে দিয়েছেন, ‘টেররিজম নয়, বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতা আমেরিকার জন্য প্রধান হুমকি।’ অথচ ২০০৭ সালের সিদ্ধান্তের সময় এ কথা লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।
বিশেষ করে খোদ ‘ফ্রেন্ডস’ শব্দটিরই সংজ্ঞা বদল হয়ে গেছে ট্রাম্পের হাতে। ট্রাম্প আসলে বলে দিয়েছেন আদৌ আমেরিকার কোনো ফ্রেন্ড দরকার আছে কি না। আর যদি থাকেও, তারা ভিন্ন কেউ; অথবা বাংলাদেশে তার এমন ফ্রেন্ড আর লাগবে না। ট্রাম্প সরাসরি এ কথা বলেননি, তবে তার অনুসৃত নীতি এই মেসেজটিই স্পষ্ট করে দিয়েছে।
অনেকে বলছেন, ভালো ভালো ‘গণতান্ত্রিক দেশে’ নাকি তাদের পররাষ্ট্রনীতি ‘জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে’ সমৃদ্ধ থাকে বলে, পররাষ্ট্রনীতির চ্যালেঞ্জ তারা সহজেই মোকাবেলা করতে পারেন। কিন্তু আমরা সেই সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারিনি। আবার একটি প্রভাবশালী পত্রিকা রিপোর্ট করছে এভাবে- “আলোচনায় প্রায় সব বক্তা অভিমত প্রকাশ করেন, যেকোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য হলো সর্বোচ্চ জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা। কিন্তু অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ঐক্য সুদৃঢ় না হলে সেটি অর্জন করা সম্ভব নয়। আমাদের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বিরোধী দলে থাকতে একে অপরের বিরুদ্ধে ‘সার্বভৌমত্ব’ বিকিয়ে দেয়ার অভিযোগ করে থাকে, যা জাতীয় স্বার্থ রক্ষার পরিপন্থী। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে ক্ষমতার পালাবদল হলেও পররাষ্ট্রনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে ক্ষমতার পরিবর্তনের সাথে সাথে পররাষ্ট্রনীতিও অনেকটা বদলে যায় বলে জনমনে ধারণা আছে। এ ছাড়া পররাষ্ট্রনীতির বিষয়টি অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও সুশাসনের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত বলে মন্তব্য করেছেন একাধিক আলোচক।”
বিইআই ও আইআরআই-এর আলোচনা সভায় আমাদের রাজনৈতিক দলের ওপর সব দায় চাপিয়ে এমন মন্তব্য খুবই অনুচিত ও অবিচার। কারণ, ২০০৭ সাল থেকে আমেরিকার হস্তক্ষেপ ও অবস্থানের ব্যাপার কমবেশি সবই আপনারা জানেন। আমাদের রাজনৈতিক দলের বিবাদের অনেক কারণ থাকলেও সবচেয়ে বড় কারণ, আমেরিকার হস্তক্ষেপ।
চীনা বেল্ট ও রোড প্রকল্প প্রসঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে তা নিয়ে এই প্রথম প্রধান দলগুলো একটা সফল অভিন্ন অবস্থান প্রকাশ করেছে। সেটি হলো, “গত ১৯ মে প্রধান দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ‘বাংলাদেশ চীন সিল্ক রোড ফোরাম’ গঠন করেছেন।” বেশির ভাগ পত্রিকার হেডিং এটাই। এর কৃতিত্ব যারই হোক, এ ঘটনা অতীব তাৎপর্যপূর্ণ।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
Goutam.das@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা