১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ষড়যন্ত্র

-

রেস্তোরাঁর দু’পাশে দুটো চায়ের দোকান। রেস্তোরাঁয় খেয়েদেয়ে কারো চা পানের ইচ্ছে হলে পাশের চায়ের দোকানের যেকোনোটি থেকে চা এনে দেয় রেস্তোরাঁর বেয়ারা। কিংবা রেস্তোরাঁর কাস্টমার নিজেই চায়ের দোকানে বসে চা পান করেন।
মফস্বল শহরের রেস্তোরাঁ কিংবা দোকান বলে খুব বেশি চাকচিক্যপূর্ণ নয়। তবে রেস্তোরাঁটা পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা চোখে পড়লেও মফস্বলের মানসিকতার ছাপ পষ্ট। হয় আঁশটে, নয়তো তেল চিটচিটে গন্ধ! জনশ্রুতি আছে- এই রেস্তোরাঁর বাবুর্চি ওসমান মৃধার মাথায় ছিট আছে। বেঁটেখাটো আর কালো লোকটিকে দেখতে এবং তার কথবার্তার ধরনে প্রতিবন্ধী গোছের ছাপ রয়েছে! মালিককে খুশি রাখতে অগোছালো সুরে কাস্টমার ডাকতে গিয়ে কোনো কোনো দিন হয় গরম তাওয়ায় শোয়া পরাটা অথবা তেলে ডোবা সিঙ্গারা-সমুচা লাল করে পুড়ে ফেলার কায়দা হয়! নয়তো কাস্টমারের কাছে নিজেদের রেস্তোরাঁর গুণকীর্তন করতে গিয়ে পচা মাছ কড়া করে তেলে ভেজে রান্না করার গোপন তথ্য ফাঁস করে দেয়ার ঘটনা ঘটায় প্রায়ই।
অকারণ পাকনামোর কারণে ওসমান মৃধার সাথে রেস্তোরাঁর দু’পাশের চায়ের দোকানির সম্পর্ক ভালো নয়।
রেস্তোরাঁর ডান পাশের চায়ের দোকানি সবুর মিয়া একদিন চায়ের কাপে চামচ নাড়তে নাড়তে ওসমান মৃধাকে বলল- ‘দুইডা সিঙ্গারা দ্যাও তো মৃধা। খিদাডারে একটু চাপা দেই।’
চট করে ওসমান মৃধা বলে উঠলো- ‘চাপাচাপি মোগো হোডেলে আইয়া হরো। তোমার লইগা কাম থুইয়া সিঙ্গারা লইয়া দৌড়াইব কেডা?’
ওসমান মৃধা রেস্তোরাঁয় ঢোকার পথে ডান পাশে দাঁড়িয়ে পরাটা, সিঙ্গারা-সমুচা ভাজে। সবুর মিয়া তার দোকানের বাম পাশে বসে চা বানায়। চাইলেই সিঙ্গারা সমেত প্রিচটা সবুর মিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিতে পারে। তা না করে স্বভাব দোষে ঠেলামারা একটা বাক্য ছুড়ে দিলো। আর সবুর মিয়ার সিঙ্গারার চাহিদা উবে গেল।
আরেক দিন পাশের আরেক চায়ের দোকানিকে ওসমান মৃধা বলল- ‘তোমার চা ভালো অয় না। লাশে ব্যবহার করা চা-পাতা দিয়া চা বানাও নিহি?’ বলে খ্যাক খ্যাক করে হাসলো।
চায়ের দোকানি করিম হাওলাদারের মেজাজ তার কড়া লিকারের ফুটন্ত চায়ের পানির মতো ফুটতে শুরু করলো।
সবুর মিয়া আর করিম হাওলাদার এর আগেও রেস্তোরাঁর মালিক হাসানকে ওসমান মৃধার এমন বাজে আচরণের কথা বহুবার জানিয়েছে।
ওসমান মৃধাকে হাসানেরও অপছন্দ। বছরখানেক হতে চললো রেস্তোরাঁটা হাসানের মালিকানায় যাত্রা করেছে। আশপাশের দোকানিদের সঙ্গে এভাবে সম্পর্ক নষ্ট হতে থাকলে তার ব্যবসা লাটে উঠবে!
ওসমান মৃধাকে রেস্তোরাঁর আগের মালিকের নিয়োগ দেওয়া। মফস্বল এলাকায় বাবুর্চি পাওয়া কঠিন বলে ওসমান মৃধাকে অপসারণ করাও যাচ্ছে না। কিন্তু সুযোগ পেলে হাসান বসেও থাকবে না। বিদায় করবে ওসমান মৃধাকে।

দুই.
ওসমান মৃধা, সবুর মিয়া আর করিম হাওলাদারের খুনসুটি লেগেই আছে।
সবুর মিয়া আর করিম হাওলাদারের চায়ের দোকানে কাস্টমার এলে তারা ইনিয়ে-বিনিয়ে হাসানের রেস্তোরাঁর প্রসঙ্গ তোলে- ‘আরে হাসাইন্নার ভাতের হোডেলে ভালো কিছু আছে নিহি? বাসি-পচা খাওনে ভরপুর!’
সবুর মিয়া আরেকটু ভয়াবহ সুরে বলে-‘আমি তো একদিন পাতলা ডাইলের মধ্যে মরা টিকটিকি পাইছি!’
তাদের কথা লোকেরা বিশ্বাস করুক না-করুক, তারা তাদের গ্রাম্য মানসিকতায় অভ্যাসমতো বলে যায়।
হাসানের রেস্তোরাঁয় কিছু নিয়মিত কাস্টমার আছে। তাদের কেউ কেউ বাকিতে খায়। এই কাস্টমারদের কেউ না কেউ সবুর মিয়া আর করিম হাওলাদারের চায়ের দোকানেরও কাস্টমার; তারাই রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে তাদের কথা হাসানের কানে লাগিয়ে রেস্তোরাঁর প্রতি নিজেদের আন্তরিকতা আর ইমেজ জাহির করে। যেহেতু তারা বাকিতে খায়, হাসানকে খুশি করতে পারলে একটু তো সমীহ পাওয়া যাবে।
তবে হাসানের এসবে গা নেই। সে তার মতো কাজ করে যায়। লোকের কথায় কী যায় আসে! তার রেস্তোরাঁর খাবার ভালো হওয়া নিয়ে কথা। খাবার সুস্বাদু আর ভালো মানের হলে কাস্টমার আসবেই।
সবুর মিয়া, করিম হাওলাদার সম্পর্কে ওসমান মৃধাও হাসানের কান ভারী করার চেষ্টা করে। তাতে লাভ হয় না খুব একটা। ওসমান মৃধা কথা লাগাতে গেলে হাসান মনে মনে ভাবে- সুযোগ পেলেই ওসমান মৃধাকে কিক মারবে।
তবে কাস্টমাররাও কম যায় না। কেউ কেউ সবুর মিয়া, করিম হাওলাদাকে খুঁচিয়ে মজা লোটে!
গ্যারেজের কর্মচারী বেলায়েত আজ সবুর মিয়ার দোকানে চায়ে একটু বাড়তি দুধ-চিনি চেয়ে বলল- ‘বুঝলা সবুর ভাই, ওসমান মৃধা আসলে লোক ভালো না। একটু আগে তাগো হোডেলে খাইতে গেলাম, ভাতের প্লেটটা সামনে দিয়াই শুরু করলো তোমার চায়ের দোকানের কথা। হালায় কইলো কি জানো?’
সবুর মিয়া চায়ে একটু বাড়তি দুধ-চিনি মেশাতে মেশাতে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জানতে চাইলো- ‘কী কইলো?’
‘কইলো, একে তো লাশে ব্যবহার করা চা-পাতা কম দামে আইনা পাবলিকরে চা খাওয়াইতেছ। তার ওপর তুমি নাকি দোকানে গাঁজাও বেচো!’ বলে চায়ে চুমুক দিয়ে বেলায়েত বলল, ‘এহ্হ্,ে এইডা কী করলা মিয়া? চায়ের বদলে শরবত বানাইলা!’
চা যেমনই হোক, ফোৎ ফোৎ শব্দে চা খেয়ে জলদি বেরিয়ে গেল বেলায়েত।

তিন.
আজ সকালবেলা রেস্তোরাঁর কাছাকাছি আসতেই রেস্তোরাঁর সামনে বেশ ভিড় নজরে পড়লো হাসানের। বেশ কিছু লোকজন এবং কয়েকজন পরিচিত মাওলানা সাহেবকে দেখতে পেলো।
কাছে যেতেই শুনতে পেলো মাওলানা সাহেবদের একজন বলছেন- ‘ভুনা’ শব্দটি নির্দিষ্ট করেই যখন লিখেছে, নিশ্চয়ই এরকম কিছু ঘটেছে!’
‘ছি ছি, মেইন সড়কের সাথে এরকম হারাম কাজ চলছে! অথচ দেখার কেউ নেই!’ আরেকজন মাওলানা সাহেব বললেন।
হাসানকে আসতে দেখে একজন বলল, ‘ওই যে, হাসান আইসা গেছে।’
‘কী ইইছে!’ অবাক হয়ে জানতে চাইলো হাসান।
‘ন্যাকা সাজো? কিছুই জানো না?’
‘কুত্তার মাংস বেচো, আর এখন কিচ্ছু বোঝ না?’ উপস্থিত জনতার একজন বলল।
হাসান কিছুই বুঝতে পারছে না। রেস্তোরাঁর টিনের বেড়ায় সাঁটানো পোস্টারের মতো কাগজটা দেখালো একজন। হাসান দেখলো কম্পিউটার টাইপে বড় বড় করে লেখা- ‘এখানে কুকুরের ভুনা মাংস পাওয়া যায়’।
হাসানের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো!
লোকজনের বিভিন্ন কানাঘুষা। আলোচনা-সমালোনা।
একজন মাওলানা সাহেব বললেন, ‘হাসান, সেই ফজর থেকে আমরা এখানে দাঁড়িয়ে। তোমার রেস্তোরাঁয় হারাম খাবার রান্না হয়। মুসলমানের জন্য কুকুরের মাংস হারাম। আর তুমি একজন মুসলিম হয়ে...। ছি ছি ছি...’
একজন অতিউৎসাহী লোক বলে উঠলো- ‘হুজুর, আপনে হোডেল বন্ধ করতে কইয়া দেন। অ্যাসিল্যান্ড আর ওসি সাবরে খবর দেন, তারা আইসা বন্ধ কইরা দিক।’
মাওলানা সাহেবদের একজন অতিউৎসাহী লোকটিকে বললেন, ‘আপনার এত উৎসাহ কেন? আর ফয়সালা তো আপনিই দিয়ে দিলন, আমাদের আর লাগবে কেন?’
‘হুজুর, পাবািলকের কথা বাদ দেন। আপনেরা একটা ফয়সালা দিয়া দেন।’ ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ একজন বলল।
হাসান বলল, ‘আমার একটু কথা আছে হুজুর। কসম আল্লাহর, আমার হোডেলে কোনোদিন কুত্তার মাংস রান্না হয় নাই! এগুলা সবই ষড়যন্ত্র।’
একজন মাওলানা সাহেব তার আগের কথা পুনর্ব্যক্ত করলেন- ‘ভুনা’ শব্দটি নির্দিষ্ট করেই যখন লেখা আছে, নিশ্চয়ই এরকম কিছু ঘটেছে হয়তো!’
‘সন্দেহের বশে কি বিচার করা ঠিক হইবে হুজুর? বললাম তো এটা ষড়যন্ত্র।’ হাসান বলল।
‘না, তা ঠিক হবে না বলেই তো ফজরের পরে বাসায় না গিয়ে, নাশতা-পানি না খেয়ে তোমার অপেক্ষায় এখানে দাঁড়িয়ে আছি। মোবাইল ফোনে ফোন করে তোমার ঘুমও নষ্ট করিনি। তবে বিদআত বা হারাম কিছু হতে দেওয়া যাবে না।’ মাওলানা সাহেবদের একজন বললেন।
‘ঘটনা সামনে যখন আইছে, কিছু একটা ফয়সালা তো দিতেই হবে।’
‘হুট করে কোনো ফয়সালা হয় না। দেওয়াও যায় না।’ একটু থেমে মাওলানা সাহেব বললেন, ‘ইসলাম শান্তি ও সুশৃঙ্খল জীবনের নির্দেশনা দিয়েছে। তাই তোমারে শোধরানোর সুযোগ দিলাম হাসান। তবে আমরা তোমার রেস্তোরাঁ অবশ্যই পর্যবেক্ষণে রাখব। সত্যিই যদি হারাম কোনো খাবার তোমার রেস্তোরাঁয় রাখো বা পরিবেশন করো, আজ হোক কাল হোক ধরা পড়বেই।’
মাওলানা সাহেবরা চলে গেলেন। রেস্তোরাঁর সামনে জনতার ভিড় কমতে থাকলো।

চার.
এমন ঘটনা তার রেস্তোরাঁয় কেন ঘটলো, আন্দাজ করতে পারে হাসান। ওসমান মৃধার সঙ্গে সবুর মিয়া আর করিম হাওলাদারের রেষারেষি থেকে এমন ঘটনা ঘটেছে। হয়তো সবুর মিয়া, নয়তো করিম হাওলাদার নিজে অথবা কাউকে দিয়ে এই কাজ করিয়েছে!
হাসান ঠিক করলো- ওসমান মৃধাকে বিদায় করে দেবে।
কিন্তু ওসমান মৃধাকে বিদায় করলেও হাসানের রেস্তোরাঁর যে বদনাম রটে গেছে, তা কখনো মুছে যাবে? লোকজন সন্দেহের চোখে দেখবে। হয়তো ভাববে- যা রটে তার কিছু তো ঘটে!
সে দিনের ঘটনার পরে হাসানের রেস্তোরাঁয় কাস্টমার কমে গেছে। কেবল কয়েকজন বাকিবাট্টার কাস্টমার আসে। এলেও তাদের বেশির ভাগই মাংস খেতে আগ্রহ দেখায় না।

পাঁচ.
মাসতিনেক পরের ঘটনা।
উপজেলা ভূমি অফিস থেকে নোটিশ করা হলো- সড়কের পাশে সরকারি জমিতে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা স্থাপনা পরবর্তী দশ কর্মদিবসের মধ্যে সরিয়ে ফেলতে হবে।
হাসানের রেস্তোরাঁ তো বটেই, সবুর মিয়া আর করিম হাওলাদারের চায়ের দোকানও সরাতে হবে!
কিন্তু মাওলানা সাহেবদের সচেতন ভূমিকার কারণে, নাকি অন্য কোনো কুচক্রী মহলের ইন্ধনে এই উচ্ছেদের ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে, তা বোঝা কঠিন। কেননা, এই অবৈধ স্থাপনাগুলো সড়কের পাশে এক যুগের বেশি সময় ধরে বহাল তবিয়তে আছে।


আরো সংবাদ



premium cement