১৯ মে ২০২৪, ০৫ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলকদ ১৪৪৫
`


মানবসভ্যতা রক্ষায় করণীয়

মানবসভ্যতা রক্ষায় করণীয় - সংগৃহীত

একজন মা তার সন্তানকে যতটা ভালোবাসে, আল্লাহতায়ালা তাঁর সৃষ্টিজগতকে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি ভালোবাসেন। মানুষ অপরাধ করে আর ধ্বংসের পথে চলে। হয়তো সে জানে না মুক্তির পথ কোনটি অথবা জেনেও ভুল পথে চলে। এটা বলা চলে তার স্বভাবগত বিষয়। তার পাপের কারণে অন্যান্য সৃষ্টিকেও ভোগান্তিতে পড়তে হয়। মানুষসহ অন্যসব প্রাণীকে বিপর্যয় থেকে বাঁচাতে আল্লাহতায়ালা নিজেই বিভিন্ন রকম সুরক্ষার ব্যবস্থা করে রেখেছেন। পবিত্র কুরআনে উল্লেখ রয়েছেÑ ‘নিশ্চয় আপনার রব সব কিছুরই সুরক্ষাকারী।’ (সূরা সাবা-২১) আল্লাহতায়ালার সবচেয়ে প্রিয় ও সুন্দর সৃষ্টি মানুষ। তাকে তিনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। তাদের জন্যই আসমান-জমিনের সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। অথচ বাস্তব দুনিয়ায় তারাই ¯্রষ্টার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করে চলেছে। আল্লাহ জানেন, দুনিয়ার সব মানুষ তার হুকুম মেনে চলবে না। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ তাঁর অবাধ্যতার সীমা ছাড়িয়ে যাবে, এটাও তিনি পছন্দ করেন না। এ জন্যই তাদেরকে শোধরাতে কিংবা শায়েস্তা করতে সময় সময়ে আজাব দিয়ে থাকেন। এ বিষয়ে আল কুরআনে সতর্ক করে বলা হয়েছেÑ ‘জলে ও স্থলে যে বিপর্যয় প্রকাশ পায় সবই মানুষের হাতের উপার্জন।’ (সূরা আর রুম-৪১)

দুনিয়ার বিপর্যয় আর আখিরাতের আজাব থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহতায়ালা মানুষকে চারটি কাজ ঠিক করে দিয়েছেন। এ কাজগুলো সে সহজেই করতে পারে এবং এর মাধ্যমে বাঁচাতে পারে গোটা মানবসভ্যতাকে। পবিত্র কুরআনের ১০৩ নম্বর সূরা আল আছরে অত্যন্ত সংক্ষেপে এ চারটি কাজকে গুরুত্বসহকারে বর্ণনা করা হয়েছে। ‘যুগের শপথ, নিশ্চয় সব মানুষ ধ্বংসের পথে রয়েছে, তবে তারা নয়, যারা ঈমান আনে, সৎকর্ম করে, ন্যায়ের বিষয়ে পরস্পরকে নির্দেশনা দেয় এবং সংযত থাকার বিষয়ে পরস্পরকে উপদেশ দেয়।’ এখানে স্পষ্টতই বলা আছে, মানব সমাজে যদি এ চারটি কাজ চালু থাকে, কখনো তাদের বিপর্যয় বা ধ্বংস আসবে না। অন্যদিকে এ কাজগুলোর চর্চা ছেড়ে দিলে যুগের অন্ধকারতম গহ্বরে হারিয়ে যাবে তাদের জাতিসত্তা। মানবসভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এর অসংখ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। একক ধর্মীয় চিন্তার ঊর্র্ধ্বে উঠে, উদার মানসিকতা নিয়ে বলা যায়, ‘জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সারা দুনিয়ার বেশির ভাগ মানুষ যদি নি¤েœ বর্ণিত চারটি কাজ কোনো ধর্মীয় আবরণ ছাড়াও বাস্তবায়ন করে, তবে দিনে তাদের উপর চেপে বসা সব দুর্যোগ নিশ্চিত দূর হয়ে যাবে, আরো বলা যায়, যতদিন মানব জাতি এ কর্মসূচি পালন অব্যাহত রাখবে, ততদিন তাদের ওপর আজাব-গজব ও মহামারী নেমে আসবে না।’

সূরা আছরে বর্ণিত চারটি কাজের উদার দৃষ্টিভঙ্গি-

১. এক আল্লাহ বা সৃষ্টি কর্তায় বিশ্বাস : অর্থাৎ আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, জীবন-মৃত্যু, কল্যাণ-অকল্যাণের মালিক হিসেবে মেনে নেয়া, তার সন্তুষ্টির প্রত্যাশা, অসন্তুষ্টির ভয় করা, সর্বাবস্থায় তাঁর প্রতি বিনয়ী থাকা, এ মৌলিক বিষয়গুলো হৃদয়ে ধারণ করা। এখানে বিশেষ কোনো ধর্মীয় পরিভাষা, দৃষ্টিভঙ্গি জরুরি নয়; বরং আল্লাহ, সৃষ্টিকর্তা, ঈশ্বর যেকোনো নামে তাঁর প্রতি বিশ্বাস হতে পারে। পবিত্র কুরআনে বলা আছেÑ ‘তোমরা আল্লাহ নামে ডাকো অথবা পরম করুণাময় নামে, যে নামেই ডাকো না কেন, তাঁর অনেক সুন্দর সুন্দর নাম রয়েছে।’ (সূরা আল ইসরা-১১০) অন্যত্র বলা হয়েছেÑ ‘আল্লাহর আছে অনেক সুন্দর সুন্দর নাম, সেগুলো অবলম্বনে তোমরা তাঁকে ডাকো।’ (সূরা আল আরাফ-১৮) সুতরাং একজন মানুষ যে নামেই হোক তার ¯্রষ্টাকে বিশ্বাস করলে ও তাঁকে ডাকলে তিনি সাড়া দেবেন। এটা খোদাদ্রোহিতা ও নাস্তিকতার শাস্তি থেকে বাঁচার উত্তম উপায়। এ কথা তাদেরকে বলছি যাদের কাছে নাস্তিকতার লেবাসই বেশি পছন্দ। যারা মরণের ভয় না পেলে ¯্রষ্টাকে ডাকে না।

২. সৎকর্ম করা : সৎকর্ম বলতে শুধু নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ইত্যাদি বোঝায় না। সুস্থ বিবেক যে কাজকে ভালোকাজ বলে বিবেচনা করে, সেগুলোও আমলে সালেহ তথা সৎকর্ম। যদি কোনো কাজের টার্গেট হয় আল্লাহ বা সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি, সেটাই হতে পারে সৎকর্ম। অতি নিকৃষ্ট একটি প্রাণীকেও যদি আল্লাহর সৃষ্টি হিসেবে উপকার করা হয়, সেটাও পুণ্যের কাজ। তাই এ ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। ¯্রষ্টার দাসত্ব, মানব সেবা ও সৃষ্টির কল্যাণ। এখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ইতর, ভদ্র বা ভৌগোলিক সীমারেখা বিবেচ্য নয়। আল কুরআন বলেছেÑ ‘তোমরা কল্যাণ করে যাও, যেভাবে আল্লাহ তোমাদের কল্যাণ করেছেন।’ (সূরা আল কাসাস-৭৭) নবী করিম সা: বলেছেনÑ ‘যে মানুষকে দয়া করে না, আল্লাহ তাকে দয়া করেন না।’ (বোখারি, মুসলিম) তোমরা জমিনে বসবাসকারীদের দয়া করো, যিনি আকাশে আছেন তিনি তোমাদের দয়া করবেন।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি) ‘সৃষ্টিকুল হচ্ছে আল্লাহর পরিবারতুল্য, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি সেই যে তার পরিজনের বেশি উপকার করে।’ (বাযযার, তাবরানি)
কুরআন-হাদিসের এ বাণীগুলোর আহ্বান অত্যন্ত উদার। এখানে সবার কল্যাণ নিয়ে কথা বলা হয়েছে। অনেককে রাস্তার ক্ষুধার্ত কুকুর-বিড়ালকে খাওয়াতে দেখা যায়। এটা অবশ্যই সৎকর্ম, পুণ্যের কাজ। এ কথা তাদেরকে বলছি যারা ভালো কাজ বলতে নিজের কল্যাণই বোঝেন, যারা বলেন ‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম’।

৩. ন্যায়ের পক্ষাবলম্বন : বিচার-ফয়সালা, সাক্ষ্য দান বা মতামত প্রদানের ক্ষেত্রে ন্যায়-অন্যায় বুঝে ন্যায়ের পক্ষে কথা বলা ও জনমত তৈরি করা এবং অন্যায়ের বিরোধিতা করা ও সেটা বর্জন করা কর্তব্য। এ ক্ষেত্রে আপন-পর, জাত-পাত বিচার করার সুযোগ নেই। পবিত্র কুরআনে এমন নির্দেশই দেয়া হয়েছেÑ ‘ওহে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্য প্রদানে সদা প্রস্তুত থাকো, যদিও সেটা নিজের অথবা পিতা-মাতার কিংবা আপনজনের বিপক্ষে হয়’ (সূরা আন নিসা-১৩৫)। ইসলামে সত্য প্রকাশের ক্ষেত্রে সামান্যতম স্বজনপ্রীতির অবকাশ রাখা হয়নি। স্বজনপ্রীতির কারণে যারা সত্যের পক্ষ নিতে পারে না, তারা যেন অন্তত নীরব থেকে হলেও মিথ্যার পক্ষ না নেয়।

৪. ধৈর্য ধারণের পরামর্শ দেয়া : যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ধৈর্য ও সংযমের ওপর অবিচল থাকা, সমস্যা সমাধানের উত্তম উপায়। বিভিন্ন সময় নানামুখী মানবিক বিপর্যয়, সামাজিক প্রতিকূলতা, আর্থিক সঙ্কট আমাদের মনকে ভারাক্রান্ত ও জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। এমন পরিস্থিতিতে একে অপরের পাশে দাঁড়ানো এবং বিশেষত সংযমের পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করা জরুরি। আল কুরআনে বলা হয়েছেÑ ‘তোমাকে যে বিপদ পেয়েছে তাতে ধৈর্য ধারণ করো, নিশ্চয় এটাই হচ্ছে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য অবলম্বন’ (সূরা লুকমান-১৭)।

জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, সম্পদ ও জনসংখ্যায় পৃথিবী অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তার বিপরিতে ধর্মীয় গোড়ামি, স্বার্থপরতা ও সঙ্কীর্ণতায় পিছিয়েছে বহুযোজন। নিজেরাই নিজেদের তৈরি সভ্যতা ধ্বংস করছে অবলীলায়। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পূর্ব নাৎসি বাহিনী কর্তৃক ইহুদি নিধন যেমন কোনো মুসলিম বা অন্য ধর্মাবলম্বী কর্তৃক সমর্থনযোগ্য ছিল না। একবিংশ শতাব্দীর মুসলিম নিধন ও হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি বা খ্রিষ্টান কারো কাছেই সমর্থনযোগ্য হওয়া উচিৎ নয়। মানবিক বিপর্যয়, দুর্যোগ, মহামারীর পেছনে মানুষের এসব অন্যায় বাড়াবাড়িই যে দায়ী, এ কথা আজকের দুনিয়ায় প্রমাণিত হয়ে আসছে বারবার।
লেখক : খতিব, তামীরুল মিল্লাত জামে মসজিদ, টঙ্গী, গাজীপুর


আরো সংবাদ



premium cement
বায়ুদূষণে আজ দ্বিতীয় ঢাকা অপরাজেয় থেকেই বুন্দেসলিগার শিরোপা বুঝে নিল লেভারকুসেন যুদ্ধের সময় নিখোঁজ হাজার হাজার মানুষের ভাগ্য সম্পর্কে শ্রীলঙ্কাকে স্পষ্ট জানাতে হবে : জাতিসঙ্ঘ অনুমোদন ছাড়া কিভাবে ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকস বিক্রি করছিল কোম্পানিগুলো সরকারি কেন্দ্রে কৃষকেরা ধান বেচতে পারে না, লাভ খাচ্ছে দালালরা গরুর নাম উড়াল সড়ক, ওজন ৩৫ মণ ইরান ২ সপ্তাহের মধ্যে পরমাণু অস্ত্র বানাতে পারবে! বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ভিক্ষুক, মোট সম্পত্তি ৭.৫ কোটি ভারতের কোভ্যাক্সিনেও রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইসরাইল সরকারে ভয়াবহ দ্বন্দ্ব : নেতানিয়াহুকে গাঞ্জের পদত্যাগের আলটিমেটাম রাফায় ইসরাইলি হামলা, সরে যেতে বাধ্য হয়েছে ৮ লাখ ফিলিস্তিনি

সকল