মানবপাচার চক্রের কবলে শিবগঞ্জের যুবকের লোমহর্ষক ঘটনা
- বগুড়া অফিস ও শিবগঞ্জ সংবাদদাতা
- ২৭ জুন ২০২৪, ১৭:৫২
বগুড়ার শিবগঞ্জের ধাওয়াগীর মিল্কিপুর গ্রামের নুরুল ইসলাম (২৭)। তিনি নিজ এলাকায় দিনমজুরের কাজ করতেন। ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে অভাব অনটনে চলছিল তার সংসার। এরইমধ্যে পরিচয় হয় মানবপাচার সিন্ডিকেটের এক সদস্যের সাথে।
চক্রের সদস্যরা বৈধ উপায়ে ভালো বেতনে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রলোভন দেখায় তাকে। তাই সুদে টাকা লোন নিয়ে ওই চক্রের সদস্যের হাতে তুলে দেন।
এরপর তার ভাগ্যে নেমে আসে অন্ধকার। পথে পথে নির্যাতন সহ্যকরে মালেশিয়া পৌঁছলেও সেখানে বেঁধে রেখে করা হয় শারীরিক নির্যাতন। ভিডিও কলে পরিবারকে নির্যাতনের এসব দৃশ্য দেখিয়ে টাকা দাবি করে তারা। অবশেষে তিনমাস জেল খেটে নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে হাইকমিশনের মাধ্যমে গত ১৩ জুন দেশে ফেরেন নুরুল ইসলাম।
বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) উপজেলার মিল্কিপুর গ্রামে গেলে এভাবেই নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ণনা দেন মালয়েশিয়া ফেরৎ নুরুল ইসলাম।
তিনি জানান, ‘আমার প্রতিবেশী ফারুক হোসেন (৬০) তার বিহান (ছেলের শাশুড়ি) তানজিলা বেগমের (৪৫) মাধ্যমে ভালো চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে বৈধভাবে আমাকে মালয়েশিয়ায় পাঠানোর প্রস্তাবে আমি রাজি হই। এরপর আমি বিভিন্ন মানুষ ও এনজিও থেকে সুদে টাকা ঋণ নেই। গত ১ জানুয়ারি ফারুকের হাতে পাঁচ লাখ টাকা দেই। এরপর সে বলে ১২ জানুয়ারি তোমার ফ্লাইট। এ সময় তাদের থেকে পাসপোর্ট ও ভিসা চাইলে তারা জানান, বিমানবন্দরে গিয়ে দেয়া হবে। বিমান বন্দরে গেলে তারা আমাকে ভারতের ভিসা দিয়ে জোর করে কলকাতা পাঠায়। সেখানে আমার মতো আরো পাঁচজন ভুক্তভোগী ছিল। তাদের সাথে সেখান থেকে আমাকে ভিয়েতনামে পাঠায়। সেখানে দেখি আমার মতো আরো অনেককে নিয়ে আসা হয়েছে। সেখানে ১৪ দিন আমাদের সবাইকে আটকে রাখা হয়। এরপর ভিয়েতনাম থেকে সিমান্ত এলাকা দিয়ে চোরাই পথে থাইল্যান্ডে নেয়া হয়। এ সময় দিনের পর দিন আমাদের না খেয়ে রাখে। কাছে থাকা টাকা পয়সা ও মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়। থাইল্যান্ড থেকে নৌকাযোগে তারা আমাদের মালেশিয়া পাঠায়। এরপর আমাদের একটি ঘরে আটকে রেখে শারীরিক নির্যাতন চালাতে থাকে। এ সময় তারা ফারুকের সাথে ভিডিও কলে কথা বললে ফারুক ও তানজিলা আমাকে মারার আদেশ দেন এবং টাকা আদায় করতে বলেন। আমার বাবা সুদে ধার নিয়ে ফের এক লাখ টাকা ওই চক্রকে দেন। মাসখানেক ওই ঘরে আটকে রেখে নির্যাতন করার পর মালেশিয়া পুলিশ আমাকে উদ্ধার করে জেল হাজতে পাঠায়। তিন মাস জেল খেটে বাংলাদেশ হাইকমিশনের মাধ্যমে গত ১৩ জুন দেশে ফিরি।’
নুরুল ইসলামের বাবা দিনমজুর রেজাউল মন্ডল (৫২) জানান, ‘আমার ছেলেকে বিদেশে নির্যাতন করা অবস্থায় আমি থানায় অভিযোগ দিয়েছিলাম, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। পরে ২১ এপ্রিল বগুড়া আদালতে মানব পাচার আইনে ফারুক ও তানজিলাসহ চারজনের নামে মামলা করি।’
গ্রামবাসীরা জানান, ‘বর্তমানে ঋণে জর্জরিত নুরুল ইসলামের পরিবার। এনজিওর কিস্তি ও সুদের টাকা পরিশোধের চাপ, অপর দিকে বেঁচে থাকার লড়াই। গ্রামের মানুষরা কেউ বাড়ি বাড়ি চাল আদায় করে তাদের দিচ্ছেন। কেউ ভাত এনে খেতে দিচ্ছেন। এভাবেই চলছে তাদের সংসার।’
অভিযুক্ত ফারুক মিয়া জানান, ‘নুরুল ইসলাম বিদেশ যেতে চাইলে আমি বলি আমার বিহান (ছেলের শাশুড়ি) তানজিলা বিদেশে লোক পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারে। আমি তাকে শুধু এই লাইন দেখে দিছি। এছাড়া আর কিছুনা।’
অভিযুক্ত তানজিলা বেগম বলেন, ‘নুরুল ইসলামের ভাত খাওয়ার থালি নাই ও কি করে ছয় লাখ টাকা আমাকে দিবে? তার সাথে সাড়ে তিন লাখ টাকার কন্টাক্ট হয়েছিল। টাকা দিতে পারেনি দেখে তাকে এজেন্টের লোকজন নির্যাতন করেছে। এ ব্যাপারে আমরা তার সাথে গ্রামে ও থানাতে মীমাংসায় বসতে চাই, কিন্তু সে রাজি হচ্ছে না।’
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) বগুড়ার সাব ইন্সপেক্টর সবুজ মোহাম্মদ জানান, ‘মামলাটি তদন্ত চলছে। আমি এ বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়েছি। প্রাথমিকভাবে বাদির অভিযোগ সত্য বলে মনে হয়েছে।’