শিক্ষায় শকুনের নজর
- সাদেক রহমান
- ০২ জুলাই ২০২৪, ০০:০৫
একটা সময় ছিল স্কুলের ছাত্ররা বড়দের দেখলে ভয়ে লুকিয়ে থাকত, লজ্জা পেত, দূর থেকে সালাম দিয়ে কেটে পড়ত। এখন ছাত্ররা সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে। এখন ছাত্রদের দেখেই সবাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়। কখন বেয়াদবি করে বসে ধারণাই করা যায় না। মান-সম্মানের ভয়ে ছাত্রদের পাশে ঘেঁষতে চায় না কেউ। পাড়ায়-মহল্লায় ছাত্ররা পড়াশোনা বাদ দিয়ে কিশোর গ্যাং প্রতিষ্ঠা করছে। গ্রামে-গঞ্জে ভুক্তভোগীরা কিশোর গ্যাংকে কিয়ামতের আলামত হিসেবে দেখছে। এ দায় কি সরকার এড়াতে পারে? ছাত্রদের ধরে ধরে জেলে ঢুকালেই সমস্যার সমাধান হবে? এমনকি ক্রসফায়ারে দেয়াটাও সমস্যার সমাধান নয়। সমস্যার গভীরে গিয়ে অনুসন্ধান করে কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে হবে।
সরকারের শিক্ষানীতির কল্যাণে আমরা জেনে আসছি ফলাফলনির্ভর পড়াশোনা নয়; বরং সত্যিকারের জ্ঞানার্জনই শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় না ছাত্ররা জ্ঞানার্জনে মনোনিবেশ করেছে। শিক্ষানীতির আলোকে শিক্ষাক্রমের উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশপ্রেম, সম্প্রীতিসহ ছয় ধরনের মূল্যবোধ জাগ্রতকরণ এবং আত্মবিশ্বাসসহ তিন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি। সব মিলিয়ে শিক্ষার্থীরা ১০টি গুণ অর্জন করবে। কিন্তু কথা হচ্ছে এসব গুণধর ছাত্র কোথায় পাওয়া যাবে?
নৈতিক মূল্যবোধ বা ধর্মীয় মূল্যবোধ না শিখিয়ে আমরা যতই জ্ঞান, যুক্তি, প্রযুক্তি, ভাষা, শিল্প ও সংস্কৃতি শিখিয়ে যোগ্যতা এবং সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করি না কেন, তার ফলাফল হবে শূন্য। হেনরি ওয়ার্ড বলেছিলেন, যে ব্যক্তি নৈতিক বোধ হারিয়ে ফেলেছে সে যুদ্ধের একজনের মতো যার দুটো পা-ই কেটে ফেলা হয়েছে। তার দাঁড়ানোর মতো কিছুই নেই।
বর্তমান সরকার ২০১০ সালে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে তার আলোকে তৈরিকৃত বই ২০১৩ সাল থেকে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়। বইগুলোতে ধর্মীয় মূল্যবোধকে নির্বাসনে পাঠানো হলে আলেম-ওলামা ও ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিবাদের মুখে বইগুলোতে ধীরে ধীরে সংশোধনী নিয়ে আসা হয়।
২০১৬ সালে অধিকাংশ বইয়ে ইতিবাচক সংশোধনী নিয়ে আসা হলেও সরকার শিক্ষানীতি ২০১০ বাস্তবায়নে ২০২৩ সাল থেকে নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রমে বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রম শুরু হয়েছে। ২০২৪ সালে দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণীতে চালু হয়েছে। ২০২৫ সালে চতুর্থ, পঞ্চম ও দশম শ্রেণীতে এবং ২০২৬ সালে একাদশ শ্রেণীতে ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণীতে চালু হবে এই নতুন শিক্ষাক্রম।
নতুন শিক্ষাক্রমে ছাত্রদের সালামের বদলে সম্ভাষণ হিসেবে গুডমর্নিং শেখানো হচ্ছে। কে না জানে গুড মর্নিং খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের সম্ভাষণ! তাহলে কি শিক্ষাব্যবস্থায় খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচারের পথ উন্মুক্ত হচ্ছে? গুডমর্নিং-ওয়ালারা শুধু গুডমর্নিং বলেই ক্ষান্ত হয়নি। গুডমর্নিংয়ের সাথে এসেছে শরীফ-শরীফার গল্প। শিক্ষাব্যবস্থায় কি শকুনের নজর পড়েছে?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটন সে দেশে প্রথম সমকামিতা আইনসিদ্ধ করেন। বাংলাদেশেরও কিছু লোক আমেরিকা থেকে সমকামিতা আমদানি করেছে। স্কুলের ছেলে-মেয়েদেরকে তারা টার্গেটে পরিণত করেছে। তারা সুযোগ পেলে শরীফ-শরীফার কাহিনীর মাধ্যমে স্কুলের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে সমকামিতা উসকে দেবে। বুদ্ধিজীবীদের অনেকে মনে করেন, ইহুদিরা যে এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা চালু করতে চায় তারই অংশ হিসেবে বিশ্বব্যাপী সমকামীদের পৃষ্ঠপোষকতা করার নীলনকশা তারা তৈরি করেছে।
আমাদের ঋণ দেয়ার নাম করে গুডমর্নিং দিচ্ছে, শরীফকে শরীফা বানানোর পাঁয়তারা করছে। আশার কথা হলো, দেরিতে হলেও তাদের মতলব বুঝতে সক্ষম হয়েছে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি। যেন অবশেষে কমিটির সদস্যদের হুঁশ ফিরে এসেছে। বিশেষজ্ঞ কমিটি সপ্তম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তক থেকে শরীফার গল্প বাদ দেয়ার সুপারিশ করেছে।
পাঠ্যপুস্তকে আদি মানুষের পরিচয় বর্ণনা করা হয়েছে উলঙ্গ মানুষের ছবি দিয়ে। এ কেমন নির্লজ্জতা। এটি কি স্কুলছাত্রদের লজ্জা ভাঙানোর চেষ্টা? নির্লজ্জের দলেরা এ দেশে তাদের এজেন্টদের মাধ্যমে একটি নির্লজ্জ প্রজন্ম বানানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।
ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের বিভিন্ন অধ্যায়ে যেসব বিষয় সংযুক্ত করা হয়েছে তা দুঃখজনক। বয়ঃসন্ধিকালের দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তনের বিষয়গুলো উন্মুক্তভাবে আলোচনা হলে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পারস্পরিক লজ্জা ভেঙে যাবে। এমনকি ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যেও পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও লজ্জা ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আজকালকার ছেলে-মেয়েরা এমনিতেই এসব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটির চেয়ে কম বোঝে না, তার ওপর যদি খোলামেলা আলোচনার সুযোগ থাকে তাহলে যে কী হতে পারে তা ভাবলেই গা শিউরে ওঠে। এসবের চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে ব্যাপকহারে অবৈধ গর্ভপাত যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে। একটা সময় তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্যদের জ্ঞাতার্থে জানাতে ইচ্ছে করে, আবহমানকাল থেকে বয়ঃসন্ধিকালের শিক্ষা পাঠ্যপুস্তক থেকে নয়; বরং পরিবার থেকেই পেয়ে আসছে। বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্যদের যদি প্রশ্ন করা হয় বয়ঃসন্ধিকালের দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তনের শিক্ষা আপনারা কোন স্কুল থেকে গ্রহণ করেছেন? মনে হয় না তারা স্কুলের নাম বলতে পারবেন! কিন্তু তাদের দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তন হয়েছে এবং ভালোভাবেই হয়েছে। সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে শিক্ষাঙ্গনে যদি ছাত্রছাত্রীদের আদব-কায়দা শেখানো না যায় তাহলে এই শিক্ষাঙ্গন থেকে জাতি আর কী আশা করবে? ছেলেমেয়েদের অনৈতিক ও অসামাজিক প্রাণী হিসেবে তৈরি করাই কি শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য?
আদর্শ অনুকরণীয় গল্প ও কবিতা বা শিক্ষণীয় গল্প ও কবিতা শিক্ষাক্রম থেকে বাদ দেয়া হচ্ছে। এটি বেদনাদায়ক। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জসিমউদ্দীন, শরৎচন্দ্র, মধুসূদন দত্ত, আল মাহমুদ, আহসান হাবীব, দৌলত কাজী, ফররুখ আহমেদ, বন্দে আলী মিয়া প্রমুখ কবি ও সাহিত্যিকদের শ্রেণী উপযোগী যথাযথভাবে পড়াতে হবে। কবি-সাহিত্যিকদের পাশাপাশি আমাদের দেশের শ্রদ্ধেয় মহান জাতীয় নেতা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীসহ বড় নেতাদের মহান কীর্তি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তুলে ধরতে হবে। সর্বোপরি নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন ছাত্রছাত্রী তৈরির জন্য শিক্ষকদের নিজেদেরও নৈতিক মূল্যবোধের চর্চা বাড়াতে হবে।
মার্ক টোয়েন বলতেন, সর্বদা যা নৈতিক তা করুন। এটি মানব জাতির অর্ধেককে সন্তুষ্ট করবে এবং বাকিদের চমকে দেবে।
লেখক : সাংবাদিক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা