শুদ্ধাচারীদের যত গল্পস্বল্প
- সালাহউদ্দিন বাবর
- ৩০ জুন ২০২৪, ০০:০৫
বাংলা ভাষার অভিধানে কুসন্তান বলে একটি শব্দ সংযোজিত আছে। তবে কুপিতা বলে কোনো শব্দ এখনো নেই। অধুনা সব দেখেশুনে ও পরিবেশ পরিস্থিতির বিচারে হয়তো কুপিতা শব্দটি অভিধানে সংযুক্ত করা প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। সেটা শুধু রক্তের সম্পর্কের পিতাই কেবল নয়। প্রতীকী অর্থে রাষ্ট্রযন্ত্রের বহু পিতা। যেমন- নগরপিতা আরো এমন অনেক পিতাই তো থাকতে পারেন। রক্তসম্পর্কের পিতা। এমন পিতা নিয়েই এ নিবন্ধে কথা বলার চেষ্টা করা। অন্যান্য প্রতীকী পিতার নানা ব্যত্যয় অবশ্যই আছে। সেসব নিয়ে প্রয়োজন মতো আলোচনা করার সুযোগ হয়তো ভবিষ্যতে ঘটতেও পারে। রক্তের সম্পর্কে পিতা, কখনো যদি সন্তানের প্রতি অবহেলা, তাচ্ছিল্য করে তার জীবন অর্থহীন করে তোলে। আবার কখনো এমন কোনো পরিস্থিতির কারণে নিজ ঔরস্যের সন্তানকে সরাসরি অস্বীকার করেন। তবে তখন তাকে কুপিতা হিসেবে আখ্যায়িত করা ভিন্ন আর কোনো বিশেষণে ভূষিত করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকতে পারে না। সম্প্রতি ছাগল কাহিনীর সাথে জড়িত যুবক ইফাতের পিতা, যিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে শুধু পদস্থই নন মহাশক্তিধর কর্মকর্তা মতিউর রহমান। যাকে ধনকুবের বললেও কিছুমাত্র ভুল করা হবে না। ছাগল কাহিনী সৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে মতি সাহেব তার নিজের সন্তান হিসেবে অস্বীকার করে বসেন। ব্যক্তি জীবনে মতি সাহেব সবদিক থেকে ‘জ্যোতির্মান’ও ‘উজ্জ্বল’ এক ব্যক্তি। স্ত্রীদের ও সন্তানদের প্রতি মায়া-মমতা তার কোনো শেষ ছিল না। অঢেল বা ‘বেগায়ের’ হিসাব অর্থবিত্তের মালিক ছিলেন মতি সাহেব। দুই প্রেয়সী স্ত্রী ও প্রাণতুল্য পাঁচ সন্তান এবং দূর-নিকট কুটুমদের প্রতি তিনি ছিলেন দরাজ দিল। দু’হাতে সবাই সবাইকে দানদক্ষিণা করেছেন। কিছু প্রাপ্তির আশা না করে। আর দেবেন না-ইবা কেন। সেসব অর্থ তো তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন গৌরী সেনের অর্থ ভাণ্ডার থেকে। বহুল প্রচরিত একটি বাক্য হচ্ছে। ‘সরকার কা মাল দরিয়ামে ডাল।’ এমন মনোবিন্যাস নিয়েই দীর্ঘকাল থেকে মতি সাহেব পথ চলছেন। এভাবে চলতে গিয়ে কখনো এ জীবনে তাকে থামতে হয়নি। সম্প্রতি তার বিধি বাম। পুত্রের এক ছাগলকাণ্ডে। এই ছাগলকাণ্ডে তার সব কিছু ওলট-পালট হয়ে যাওয়ায় মতি সাহেবের মতিভ্রম ঘটেছে। দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়েছেন, তিনি নিজের ঔরসের পুত্রের ওপর খড়গহস্ত হয়েছেন। মতি সাহেবের পুত্রও বাপকা বেটা, কম লায়েক নয়। লায়েক না হওয়ার তো কোনো কারণ নেই। বাবা যেমন রাষ্ট্রের পকেট কেটেছে। পুত্র অবশ্য বাবার পকেট কাটেনি। বাবাই বরং সব কিছু উজাড় করে পুত্রকে দিয়েছিলেন। সে জন্য পুত্র ছিল মুক্তহস্ত। অথচ পুত্রের এই মুক্তহস্ত হওয়ার জের হিসেবে মতি সাহেবের বিধি এখন বাম।
যাই হোক মতি সাহেব বরাবর পুত্র ইফাতকে সোনার চামুচ দিয়ে রূপার থালা থেকে ক্ষির মাখন তুলে পরম মমতায় পুত্রকে খাইয়েছেন। বরাবর ইফাতের জীবনকে সুখানন্দে ভরে তুলতে হেন কিছু নেই, যা করেননি। দামি গাড়ি-বাড়ি সব কিছুই ছিল ইফাতের হাতের মুঠোয়। অতি সম্প্রতি ঈদুল আজহা উদযাপন করতে ইফাতের জন্য সাত গরু ও একাধিক ছাগল কোরবানির ব্যবস্থা করে দিয়ে ইহজনমের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিধানসহ পরকালে ইফাতের ‘মুক্তি’র জন্য ওই কোরবানির আনজাম করে দিয়েছিলেন। সর্বশেষ পুত্রের ইচ্ছা পূরণের ১৫ লাখ টাকা দিয়েছিলেন একটি ছাগল কেনার জন্য। এখানেই ইফাত বাবা মতি সাহেব ধরা খান। বিধি হয়ে উঠল বাম। সেসব কাহিনী সবারই জানা। এই ছাগলকাণ্ডই ইফাতকে কেয়ামতের ময়দানে নিয়ে হাজির করেছে। রোজ কেয়ামতে কেউ কাউকে স্মরণ করবে না, ছাড় দেবে না। ঠিক তেমনি মতি সাহেবের সম্মুখে হাজির হয় এক কেয়ামত। তিনি সেই কেয়ামত দিবসে পুত্রকে অস্বীকার করে বসেন। পুত্রকে অস্বীকার করে কুপিতা হয়ে উঠছেন। আপনি সন্তানকে কুসন্তান করেছেন বটে। নিজে তো হয়ে উঠেছেন জাতির কুসন্তান। মতি সাহেব যেমন পুত্রের দায়িত্ব নিতে এখন অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। মতি সাহেব কেন পুত্রকে অস্বীকার করে অকরুণ হচ্ছেন, কেন।
মতি সাহেবের হাঁড়ির জানাজানি হওয়ায় তিনি হয়তো এখন বড় শরমিন্দায় পড়েছেন। লজ্জা কিসের, মতি সাহেব। আপনি তো দেশের আরো দশজনের মতোই। লজ্জার কি আছে অন্য সবারই মতো দুটো ডাল-ভাত খাবার জন্য কিছু সম্পদ না হয় করেছেন। অভয় নিন, বহু খচ্চর চেচ্ছোর দুর্জন দুর্বৃত্ত দুষ্কর্ম পটীয়সী এই সব শব্দাবলি যোগ করে। দেশে নীলজলের যে সরোবর তৈরি হয়েছে। সেখানে কত শত বজ্জাত আর পাজির বাজরারা পরমানন্দে জলকেলি করছে। মতি সাহেব দয়া করে সেই সরোবরের ঠাণ্ডা পানিতে অবগাহন করুন, দেহমন শীতল করুন। শুচি করুন। সেখানে আপনি আর যত সঙ্গী সাথী পাবেন। সবাই আপনার মতোই শুদ্ধাচারের ভূষণে ভূষিত। সেখানে শুনতে পারেন শুদ্ধাচারীদের যত গল্পস্বল্প। আরো শুনুন, যারা জলক্রীড়ায় মত্ত তাদের তো কোনো ভয় লজ্জা থাকার কথা নয়। আপনাদের সব দিক থেকে সূচি করে তুলতে ‘বেকাপ’ দিতে বহু লোক কোমরে গামছা বেঁধে লেগে পড়েছে। আর লাগবেই না কেন আপনারাও তাদের বিপদের দিনের সময়টাকে আনন্দঘন করে তুলতে কমতো কিছু করোনি। হিমালয়ের মতো দৃঢ় অনড় হয়ে তাদের পেছনে দাঁড়িয়েছিলেন। দুর্মুখদের ভাষ্যে কান দেবেন না। জোর গলায় বলুন, ‘আমি কি ডরাই রাঘবেরে।’ প্রয়োজনে সব সহায় সম্পদসহ দারা পরিবারসহ কোনো একদিন আপনাদের সাত সমুদ্র তেরো নদীর তীরে সবার অলক্ষ্যে অজান্তে এমন এক অভয় আশ্রমে চালান করে দেয়া হবে। কেউ আর আপনাদের টিকিটিও স্পর্শ করতে পারবে না। সেখানে ‘উদ্বাস্তু’ হয়ে কত না সুখ আনন্দেই দিন গুজরান করতে পারবেন।
মতি সাহেবরা একটা কথা মনে রাখবেন। এত সুখ, সুখ নয়, এ দিন দিন নয়, আরো দিন আছে। এ দিন নিয়ে যাবে সে দিনের কাছে। গত কয়েক দিনে সেটা হয়তো হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। আর এ কথাও ভুলবেন না জীবন আপনাদের হয়তোবা একটাই। যার দৈর্ঘ বড়জোর ৮০ থেকে ৮৫। তার পর কী হবে। কোথায় যাবেন! আপনাদের কর্মধারাকে পাপপুণ্য যাই বলেন। বাকি জীবনটা যদি উদ্বাস্তুর মতো বৃত্তচ্যুত মাকাল ফলের মতো মাটিতে পড়ে থাকতে হয়। তখন সে গ্লানি কিভাবে ঘুচাবেন। এটা কোনো প্রশ্ন বা পরামর্শও নয়। নিছক বোধ-বিবেচনা বিষয়।
স্মরণ করুন ম্যাসিডোনিয়ার মহাবীর মহান আলেকজান্ডার। দিগি¦জয়ী ছিলেন। মাত্র ৩২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। কথিত আছে, তার মৃত্যুর পূর্বাহ্নে সহচরদের এমন নির্দেশ দিয়েছিলেন। তার শব যাত্রায় তার হাত দুটো যেন কফিনের বাইরে রাখা হয়। যাতে পৃথিবীবাসী দেখতে পারে। মহাবীর আলেকজান্ডার খালি হাতে পৃথিবী ত্যাগ করে যাচ্ছেন। আরো একটা অনুরোধ করা যেতে পারে। আপনারা বিজ্ঞ ও বিধূষীজন। রুশ লেখক লিও টলস্টয়ের সেই বিখ্যাত গল্পটা নিশ্চয়ই পাঠ করেছেন। সে গল্পের নাম ‘একটা মানুষের কতটা জমি দরকার’। সে গল্পের নায়ক পাহোময়ের শেষ পরিণতিটা কেমন ছিল। যদি গল্পটার মর্মকথা ভুলে গিয়ে থাকেন। তবে সবিনয় নিবেদন মতি সাহেব এবং আপনাদের পূর্ব ও উত্তরসূরিরা গল্পটা না হয় আরো একবার পাঠ করে দেখুন। কথায় আছে, উড়াইয়া দেখিও ছাই পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন।
উপরে বলে আসা হয়েছে মতি সাহেবদের সুরক্ষা দেয়ার জন্য কোমরে গামছা বেঁধে অনেকেই এখন তাফালিং করছেন। এমন তাফালিংকারীদের ভূমিকা দেখে মনে পড়ছে রোম নৃপতি নিরোর কথা। রোমান সাম্রাজ্যের পঞ্চম সম্রাট ছিলেন নিরো। ১৯ জুলাই ৬৪ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দে রোমে এক অগ্নিকাণ্ডে রোম নগরীর অধিকাংশ পুড়ে ছাই হয়ে যায়। পণ্ডিত টোসিটাসের মতে এ অগ্নিকাণ্ডের জন্য অনেক রোম অধিবাসীই মনে করেন যে, নিরো স্বয়ং সে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। আর তখন প্রাচীন গ্রিসের উদ্ভাবিত সুরযন্ত্র ‘লির’ বাজাচ্ছিলেন নিরো। আর আজ যারা মতি সাহেবদের ম্যালভেজের মতোই পথে পথে ঘাঁটি গড়েছেন। তারা বোধ হয় নিরোর মতোই এ দেশে আগুন ধরিয়ে দিয়ে সব কিছু ছারখার করে দেয়ার চেষ্টা করছেন। এ কথা ঠিক রোম নৃপতি নিরোর যে আগুনে শুধু রোম পুড়েছিল বটে, তবে নিরোর কিছু হয়নি। তবে সব উদাহরণ সব সময় সব জায়গায় সমানভাবে ক্রিয়া করে না। যেমন বিজ্ঞানের সূত্র হচ্ছে প্রতিটি ক্রিয়ার সমভাবে সমপরিমাণ প্রতিক্রিয়া হওয়াটাই অনিবার্য। আজকে যে ক্রিয়া কৌতুক হচ্ছে, তার সমপ্রতিক্রিয়া আসন্ন বলে অনুমান করছেন অনেকেই। এটা তো ইতোমধ্যে আপনাদের বোধ-বিবেচনা এসেছে বলে অনুমান করা যায়। এমন কোথাও শোনা যায় জনবিচ্ছিন্নতা আপনাদের জন্য নাকি বিপদ ডেকে আনবে। আর সে জনবিচ্ছিন্নতার এখন কতটা কি। যেটা গত জানুয়ারিতে এবং পরবর্তী নানা নির্বাচনী নাটক প্রহসনে সবাই দেখেছেন।
শুধু নির্বাচনী ক্রীড়া কৌতুকই কর্তৃপক্ষের জনবিচ্ছিন্নতার একমাত্র কারণ। সেটা বলা যাবে না; বরং জনবিচ্ছিন্নতার অসংখ্য কারণ চতুর্দিকে অহরহ ঘটছে। কোনটা রেখে কোন ঘটনার বয়ান দেয়া হবে। সেটা ভেবেও কোনো কূলকিনারা কারো পাওয়ার কথা নয়। ঘটনার বহুলতায় সবাই হতবিহ্বল। তবে সার কথা হচ্ছে- জনমনে তীব্র জ্বালা-যন্ত্রণা ক্ষোভ-আক্ষেপ এখন বিস্ফোরণের মুহূর্তে এসে পৌঁছেছে। ১৮ কোটি মানুষ এখন এক দেহ এক প্রাণ। এই প্রাণের জাগরণের স্ফুরণ অবশ্যই সব কিছু ধুয়ে মুছে দেবে। কোনো সন্দেহ নেই।
দেশের মানুষ এখন একজন টেলেমেকাসের আগমন নিয়ে গভীর উৎসুক আর অপেক্ষায়। যার অপেক্ষায় এক সময় কবি শামসুর রাহমান ছিলেন। তিনি তার এক বিখ্যাত কবিতায় লিখেছিলেন (টেলেমেকাস) ‘তুমি কি এখনো আসবে না? স্বদেশের পূর্ণিমায়/কখনো তোমার মুখ হবে না নাকি উদ্ভাসিত। গ্রিক বীর টেলেমেকাস তার মাতৃতুল্য জন্মভূমিকে রাহুমুক্ত করতে দেশে ফিরুক- সেটাই ছিল গ্রিসের মানুষের গভীর আকুতি। আজ এ দেশের মানুষও এখন এক টেলেমেকাসের আগমনের অপেক্ষায় অধীর আছেন। কবে তিনি ফিরবেন।
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা