১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

প্রলম্বিত ক্ষমতার উপসর্গ

-


বিচিত্র ঘটনাবহুল দিন পার করছি আমরা। জাতীয় জীবনে ঘটছে একের পর এক চাঞ্চল্যকর এবং রোমহর্ষক ঘটনা, যা আমাদের জাতি-রাষ্ট্রের জন্য কলঙ্কজনক। গত ৫০ বছরে দেশে অনেক ধরনের বেদনাদায়ক ও বীভৎস ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কোনো বাহিনীপ্রধানের বেসামাল দুর্নীতির বা কোনো এমপির বিরুদ্ধে চোরাচালান সিন্ডিকেটের গডফাদার হওয়ার অভিযোগ ওঠেনি। কোনো সংসদ সদস্য বিদেশের মাটিতে এভাবে খুনও হননি। আমাদের তাই ভাবা দরকার- কেন, কিভাবে আমরা এমন একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়ে উপনীত হলাম।

বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল হয়ে পড়েছে। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থা সংবিধান থেকে উঠিয়ে দেয়ার পরই শুরু হয়েছে রাজনৈতিক পরিস্থিতির ক্রমাবনতি! যে নির্বাচনী ব্যবস্থার মাধ্যমে বর্তমানের ক্ষমতাসীনরা ২০০৮ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন সেই ব্যবস্থা নির্মূল করে তারা নিজেদের সুবিধাজনক নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতাসীন হয়েছেন। গত তিনটি নির্বাচনেই তারা ভিন্ন ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে ক্ষমতা ধরে রেখেছেন। সবগুলো নির্বাচনই দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রশ্নবিদ্ধ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এভাবে পুরো নির্বাচনব্যবস্থা ধসে পড়েছে। অবস্থা এমন যে, নির্বাচনী ব্যবস্থা এখন স্থানীয় শক্তিমানদের বলয়ে ঢুকে পড়েছে। এমনকি সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতার শীর্ষে থাকা প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশও মাঠপর্যায়ের নির্বাচনী রাজনীতিতে কার্যকর করা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। সদ্যসমাপ্ত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে এর দৃষ্টান্ত দেখা গেছে। অর্থাৎ নির্বাচনপ্রক্রিয়া এমন একটি দুষ্টচক্রের ভেতর ঢুকে পড়েছে যেখান থেকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বের হয়ে আসা অত্যন্ত দুরূহ হবে। ভোটাররা ভোটদানে আগ্রহ হারিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের ভোটের পরিসংখ্যানও আস্থাহীনতায় ভুগছে। ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, ‘নির্বাচন শুধু নির্বাসনেই যায়নি, আমি বলব নির্বাচনই নাই।’ (নয়া দিগন্ত, ৫ জুন ২০২৪)

নির্বাচনে বিরোধীরা না থাকায় ক্ষমতাসীনরা নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। নিজ দলের নেতাকর্মীদের মধ্যেই মনোনয়ন দিয়ে পক্ষ ও প্রতিপক্ষ তৈরি করে নির্বাচন করতে হচ্ছে। এতে দলের ভেতরে নিজেদের মধ্যেই হানাহানি চরম রূপ নিয়েছে। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের মতে, দলীয় বিভেদ এড়াতে দলীয় প্রতীক না দিলেও সঙ্ঘাত প্রাণহানি কমেনি; বরং বেড়েছে। দল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় নেতাকর্মীদের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছে যে, জনপ্রতিনিধি হলেই এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে রাতারাতি সম্পদের মালিক হওয়া সহজ হবে। এ জন্য যেকোনো মূল্যে জেতার জন্য মারিয়া হয়ে ওঠেন। (প্রথম আলো, ১১ জুন ২০২৪) আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে, ২০১৮ সাল থেকে গত মার্চ পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাতে আওয়ামী লীগের ১৯১ জন মারা গেছেন (ঐ)।

অন্যদিকে বিরোধী দল নির্বাচন বর্জনের পাশাপাশি রাজনীতির ময়দান থেকেও উধাও। গায়েবি মামলা, মিথ্যা মামলায় জর্জরিত হয়ে তারা রাজপথ ছেড়ে আদালত প্রাঙ্গণে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আবার তাদের অনেকেই একের পর এক পুরোনো মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে যাচ্ছেন। এমনকি বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য রাতেও আদালতের কার্যক্রম চলতে দেখা গেছে। তবে একই মামলায় জামিন পেয়ে সরকারি দল থেকে এমপিও নির্বাচিত হয়েছেন। এভাবে রাজনীতির মাঠ বিরোধীমুক্ত হওয়ায় একটি ভারসাম্যহীন একদলীয় গণতন্ত্র সৃষ্টি হয়েছে বলে সমালোচকরা মনে করেন।
সাধারণ মানুষ যেভাবে জীবন নির্বাহ করছে তাতেই দেশের বর্তমান অর্থনীতির চিত্র উন্মোচিত। দ্রব্যমূল্যই বলে দেয় আমরা কেমন আছি। সেই সাথে ব্যাংক ব্যবস্থাপনা, শেয়ারবাজার, বাজারে কালো টাকার প্রবেশ, ঋণখেলাপি ইত্যাদি বলে দিচ্ছে আমাদের অর্থনৈতিক দুরবস্থার কথা। অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘ব্যাংকিং খাতের বিশৃঙ্খলা এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে, খাতটি এখন প্রায় নিয়ন্ত্রণহীন অরক্ষিত অবস্থায় বলা চলে। আমরা ক্রমে একটি নৈতিকতাহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছি।’ (প্রথম আলো, ১২ জুন ২০২৪) বাজেটে স্বাভাবিক আয়করের উচ্চতম হার বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। অথচ ১৫ শতাংশ হারে কর দিয়ে বিনা প্রশ্নে কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ দেয়া হয়েছে।

খেলাপি ঋণের চিত্র আরো ভয়াবহ। ২০০৯ সালে যেখানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা, সেখানে ২০২৪ সালে এসে তা দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকায়। (প্রথম আলো, ৭ জুন ২০২৪) ২০১৯ সালে আইএমএফ এক প্রতিবেদনে বলেছিল, ‘বাংলাদেশে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর মানুষের মধ্যে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেয়ার প্রবণতার শিকড় অত্যন্ত গভীরে। প্রভাবশালী, ওপর মহলে ভালো যোগাযোগ আছে এবং ধনী, এমন কিছু ব্যবসায়ী ঋণ ফেরত দেয়ার কোনো তাগিদই অনুভব করেন না। এমনকি বাংলাদেশে আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও নিচ্ছেন প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান এসব ঋণগ্রাহক’ (ঐ)। জনশক্তি রফতানিতেও আমাদের অবস্থা তথৈবচ। নানা অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগে সম্প্রতি মালয়েশিয়া, মালদ্বীপসহ কিছু দেশ বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। (প্রথম আলো, ১০ জুন ২০২৪) এ বিষয়ে পত্রিকায় একটি সংবাদের শিরোনাম হয়েছিল, ‘চক্রে ঢুকে চার সংসদ সদস্যের ব্যবসায় রমরমা।’ এই সংবাদে চক্র বলতে কিছু রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেটের কথা বলা হয়েছে। (প্রথম আলো, ৩০ জুন ২০২৪)

দুর্নীতি আজ সর্বগ্রাসী। এর প্রকৃষ্ট নমুনা সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব:) আজিজ আহমেদ এবং সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীরের দুর্নীতি। এই দু’জনের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে তা ভয়াবহ। বিভিন্ন পত্রিকায় তাদের সুনির্দিষ্ট অঢেল সম্পদের হিসাব তুলে ধরা হয়েছে। এরই মধ্যে একজন ‘এনবিআর’ কর্মকর্তার পুত্রের ১৫ লাখ টাকা মূল্যের ছাগল কোরবানির খবরে জাতি হকচকিত হয়ে ওঠে। গণমাধ্যমে ওই কর্মকর্তার দেশে-বিদেশে দুই স্ত্রীর অসম্ভব বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ির সংবাদও পাওয়া যায়। জানা যায়, তার এক স্ত্রী স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও উপজেলা চেয়ারম্যান। শীর্ষ আমলাদের সম্পদের এসব তথ্য সত্য হলে তা যে অবৈধ তা বুঝতে অর্থনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন নেই। একজন আমলার পক্ষে বৈধ উপায়ে এত সম্পদের মালিক হওয়া অসম্ভব। অনেকের মতে, এই শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সমুদ্রে ভাসমান বিশাল বরফখণ্ডের ডগামাত্র। ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, ‘দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে।’ আর ড. সালেহ উদ্দিন বলেছেন, ‘ঋণখেলাপি এখন নতুন বিজনেস মডেল’। (নয়া দিগন্ত, ১১ জুন ২০২৪) ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ‘দুর্নীতি অনিয়মের সবচেয়ে বড় উৎস হলো ক্ষমতার রাজনীতির ধরন- যার মূল ভিত্তি বিভিন্ন অনুগত স্বার্থগোষ্ঠীর মধ্যে অন্যায় সুযোগ-সুবিধা বিতরণ।’ (প্রথম আলো, ১২ জুন ২০২৪)
দুর্নীতির আরেকটি কলঙ্কজনক সংবাদ হলো- এক এমপির বিরুদ্ধে স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেট পরিচালনার অভিযোগ। তিনি নৃশংসভাবে অন্য দেশে তারই বন্ধু বা রাজনৈতিক সহকর্মীদের পরিকল্পনায় খুন হয়েছেন বলে শোনা যাচ্ছে। চোরাচালান ও খুনের দায়ে ২০০৮ সালে তার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড অ্যালার্ট জারি হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড অ্যালার্ট মুছে যায় এবং প্রায় ২১টি মামলা থেকে তিনি অব্যাহতি পান। গত নির্বাচনে তিনি তৃতীয়বারের মতো এমপি নির্বাচিত হন। এর আগে অন্য একজন এমপি দুর্নীতির দায়ে কুয়েতে কারাবাস করছেন বলে সংবাদ হয়েছে।

দুর্নীতির আরো একটি অভিযোগ উঠেছে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে। সেটি হলো, ভর্তির যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদকে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ ‘ডক্টরেট’ ডিগ্রি প্রদান করে। (প্রথম আলো, ১৪ জুন ২০২৪) দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠসমূহের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। তহবিল তছরুপ, নিয়োগবাণিজ্য, আত্মীয়-স্বজনকে নিয়োগ দিতে যোগ্যতায় ছাড় দেয়া, বাসা-গাড়ির অপব্যবহার ইত্যাদি সব অভিযোগেই অভিযুক্ত হয়েছিলেন কয়েকটি পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসি।
এই রাজনৈতিক ভারসাম্যহীনতা, অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও সর্বগ্রাসী দুর্নীতি এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। গণতন্ত্রের প্রাকৃতিক বহমানতা অব্যাহত থাকলে কোনো দেশেই দুর্নীতি এভাবে শিকড় গেড়ে বসতে পারে না। আশ্রয়-প্রশ্রয় ছাড়া দুর্নীতিপ্রক্রিয়া হৃষ্টপুষ্ট হতে পারে না। ক্ষমতার পালাবদলে দুর্নীতিবাজরা জবাবদিহির ভয়ে ভীত থাকে। সুতরাং তারা দুর্নীতি চালিয়ে যাওয়ার জন্য চলমান সরকারকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে তার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে চায়। সে জন্য সব ধরনের কৌশল অবলম্বন করে। সরকারও ক্ষমতায় থাকার জন্য দুর্নীতির সিন্ডিকেটকে সহযোগিতা করে। এভাবে একটি নেক্সাস তৈরি হয়। এক সময় ক্ষমতা আর দুর্নীতি সিন্ডিকেট পরস্পরের পরিপূরক হয়ে পড়ে। আমাদের দেশে সেই ধরনের কোনো নেক্সাস তৈরি হয়েছে কি-না তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার আরো একটি উপসর্গ হলো- প্রশাসন সরকারের উপর চেপে বসেছে সিন্দাবাদের বুড়োর মতো করে। প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমেদও এ ধরনের একটি অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন সংসদে। মাঝে মধ্যেই দেখা যায়, সরকারি কর্মকর্তারা রাজনৈতিক কার্যকলাপে সরাসরি জড়িত হচ্ছেন, বক্তব্য রাখছেন, কাজকর্ম করছেন। ক্ষমতাসীনদের নজর কাড়তে চাকরিবিধি লঙ্ঘন করতেও দেখা যাচ্ছে কিছু সরকারি কর্মকর্তাকে।
এসব অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা সত্যিকার অর্থে একটি দলের দীর্ঘদিন একনাগাড়ে ক্ষমতায় থাকারই বাইপ্রোডাক্ট। এই অনাকাক্সিক্ষত বিষয়সমূহ ক্ষমতার দীর্ঘসূত্রতার সাথে সাথে বাড়তেই থাকবে। অর্থাৎ আমরা এক ভয়ঙ্কর গন্তব্যের দিকে এগোচ্ছি।
জাতি হিসেবে টিকে থাকতে হলে আমাদেরকে এই পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন জাতীয় ঐকমত্য। দেশকে ভালোবাসলে সঙ্কীর্ণ দলীয় এবং ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশ ও জাতির কল্যাণে সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে। আর এর মূল দায়িত্ব ক্ষমতাসীনদের ওপরই। তারাই পারেন আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে খাদের কিনারে পৌঁছানো থেকে রক্ষা করতে।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
[email protected]

 

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement