বংশমর্যাদাসম্পন্ন গরু! গরুর বাবার ইতিহাস!
- গোলাম মাওলা রনি
- ১৪ জুন ২০২৪, ০০:০৫
গরু নিয়ে হালফ্যাশনের তুলকালাম অতীতকালে পৃথিবীর অন্য দেশে ঘটেছে কি না তা বুঝতে হলে ২০২৪ সালের পবিত্র ঈদুল আজহা কেন্দ্র করে কিছু গরু ব্যবসায়ীর কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করা জরুরি। হাজার হাজার বছরের পুরনো ইতিহাসে গরু নিয়ে যত লঙ্কাকাণ্ড হয়েছে তা অন্য কোনো পশু নিয়ে হয়নি। পবিত্র আল কুরআনে গরু নামের যে সূরাটি রয়েছে তা মুসলমানদের ঐশী গ্রন্থের সবচেয়ে বড় নির্দেশনা। এই সূরা ছাড়াও আল কুরআনের অন্যান্য স্থানে গরু নিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যেসব কাহিনী তার বান্দাদেরকে শুনিয়েছেন তা যদি ডিসকো গরু ব্যবসায়ী-ফেসবুকার ক্রেতা অথবা টিকটকার কসাইরা জানত এবং বুঝত তবে ঈদুল আজহার মতো পবিত্র একটি উৎসব কোনোমতেই কলঙ্কিত হতো না।
আমি আল কুরআনে বর্ণিত গরু নিয়ে সৃষ্ট সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ফেৎনা নিয়ে কিছু বলব- তবে তার আগে হিন্দুধর্মে গরুর আদি রূপ এবং মোদি জমানায় গোমূত্রের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা জরুরি। হিন্দুদের মহাদেবতা শিব, যার অন্য নাম বিষ্ণু ও মহাদেব, তার বাহন হিসেবে গরুকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা সম্মান করে। কিন্তু পাকভারতে বর্তমান জমানায় যেভাবে গরু-গোমূত্র এবং গোবর নিয়ে আদিখ্যেতা দেখানো হচ্ছে তা দেবতা রাম কিংবা শ্রীকৃষ্ণের জমানার যে কাব্যগ্রন্থ অর্থাৎ রামায়ণ ও মহাভারতে বর্ণিত রয়েছে সেই সময়েও ছিল না। আধুনিক ভারতীয় ইতিহাসবিদ এবং হিন্দু পুরাণ বিশেষজ্ঞ নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী দাবি করেছেন যে, স্বয়ং রামচন্দ্র গোমাংস ভক্ষণ করতেন।
রামায়ণ মহাভারত বাদ দিয়ে উন্নয়নের মহাযজ্ঞে পিষ্ট বাংলাদেশে হালআমলে গরু নিয়ে যা হচ্ছে তার নজির ইতঃপূর্বে দেখিনি। দেড় কোটি টাকা মূল্যের গরু কিনে কোরবানি দেয়া- গরুর বংশমর্যাদা খোঁজা, গরুর পিতার কী কী যোগ্যতা ছিল এবং সেইসব যোগ্যতার ফলে গরুর বংশমর্যাদা কিভাবে বেড়েছে তা নিয়ে গরু ব্যবসায়ী গরুর দালাল কিংবা ফড়িয়ারা যেভাবে আরব্য উপন্যাসের মতো করে একের পর এক গল্প তৈরি করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার করছে তা মানবসভ্যতার জন্য চপেটাঘাত এবং যেকোনো ধর্মীয় বিধি-বিধানের জন্য অবমাননাকর। মানুষের বিকৃত রুচি-অবৈধ আয় রোজগার, নির্বুদ্ধিতা ইত্যাদি একত্রে মিলে কী ধরনের রসায়ন তৈরি করলে মানুষ গরু পূজার জন্য রীতিমতো যুদ্ধ করতে পারে সেই কাহিনী হজরত মূসা আ:-এর জমানায় ঘটেছিল এবং পরিণতিতে আল্লাহর পক্ষ থেকে যে শাস্তি এসেছিল তা বর্ণনার আগে ইসলামে কোরবানির বিধান নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক।
ঈদুল আজহার উৎসব এবং পশু কোরবানি একটি ওয়াজিব ইবাদত। ঈদের নামাজে অংশগ্রহণ সব মুসলমানের জন্য ওয়াজিব। অন্য দিকে যাদের জাকাত দেয়ার সামর্থ্য রয়েছে অর্থাৎ জাকাত দেয়া যাদের জন্য ফরজ তাদের জন্য ঈদুল আজহা উপলক্ষে পশু কোরবানি ওয়াজিব। এই বিধানটি দুনিয়ার সব প্রান্তের মুসলমানের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। পশু কেমন হবে, পশুর ও প্রকৃতি ইত্যাদি বিষয় গত চৌদ্দ শ’ বছরে মোটামুটি নির্ধারিত হয়ে গেছে। পশু কোরবানির প্রথম অন্তর্নিহিত তাৎপর্য মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি। নিজের কুপ্রবৃত্তি-কুচিন্তা-লোভ-লালসা-ইত্যাদি বিসর্জন দেয়ার নিয়তে হালাল উপার্জনের অর্থ ব্যয়ে ক্রয় করা পশু বা নিজ যতেœ লালিতপালিত পশু কোরবানির জন্য উৎসর্গ করতে হবে। পশু কোরবানির কোনো পর্যায়ে যদি অন্তরে রিয়া সৃষ্টি হয় তবে উল্টো গুনাহ হবে। লোক দেখানো কোরবানি, অহমিকা প্রদর্শনের কোরবানি, শক্তিমত্তা বা কুওত প্রদর্শনের কোরবানি কিংবা কেবল রক্ত-মাংসের হোলিখেলার কোরবানির বিধান ইসলাম অনুমোদন করে না।
কোরবানি উল্লিখিত সর্বজনীন বিধান ছাড়াও পবিত্র হজের যেসব ওয়াজিব রয়েছে সেগুলোর মধ্যে পশু কোরবানি ৩ নম্বর ওয়াজিব যা কেবল হাজী সাহেব-সাহেবানদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ইয়াওমে আরাফাতের পর মিনায় ফিরে যেভাবে পশু কোরবানি করা হয় তার সাথে বাংলাদেশের সর্বজনীন কোরবানি হালফ্যাশনের ফেৎনা-ফাসাদের সামান্য যোগাযোগ নেই। তাহলে প্রশ্ন, কেনো পশু কোরবানি কেন্দ্র করে গরু চোরাচালানের সবচেয়ে বড় মেলা বসে, কেন কোরবানির পশুর বিক্রি-দালালি-পরিবহন নিয়ে অবৈধ চাঁদাবাজি, ঘুষ-দুর্নীতি এবং বিকৃত রুচির মেলা বসে? এসব বিষয় যদি বুঝতে হয় তবে আল কুরআনে বর্ণিত বাছুর পূজা বা গোবৎস পূজার ইতিহাস জানা আবশ্যক।
কিংবদন্তির ইসলামী চিন্তাবিদ-দার্শনিক এবং তাফসিরকারক ইবনে কাসির রচিত ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থ ছাড়াও প্রায় সব তাফসিরকারকের গ্রন্থে বাছুর পূজার যে কাহিনী বর্ণিত হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত রূপ এখানে পেশ করছি-
হজরত মূসা আ: তাঁর ১০ লাখ অনুসারী নিয়ে যখন সাগরের মধ্যে আল্লাহর কুদরতে তৈরি হওয়া রাস্তা দিয়ে পার হচ্ছিলেন, তখন এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে ফেরেশতা জিবরাইল আ: যখন বনি ইসরাইলিদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন জিবরাইলের ঘোড়ার খুর যেখানে পড়ছিল- সেখানকার মাটি হঠাৎ স্বর্ণরেণুতে পরিণত হচ্ছিল। ফেরশতা জিবরাইল এবং তার ঘোড়া যেহেতু অদৃশ্য ছিল এবং বনি ইসরাইলিরা যেহেতু সবাই সমুদ্র পাড়ি দেয়ার জীবন-মরণ সমস্যায় ছিল এবং পেছনে ফেরাউনের সৈন্যবাহিনী ধাওয়া করছিল, তাই ঘোড়ার খুরের স্পর্শে মাটি স্বর্ণরেণুতে পরিণত হওয়ার কুদরতি দৃশ্যটি খুব অল্প লোকের নজরে এসেছিল কিন্তু তা নিয়ে চিন্তা করার বা দাঁড়িয়ে একটু স্বর্ণের কাদা সংগ্রহ করার সময়-সুযোগ কারো না হলেও হারুন আস সামেরি নামক এক ব্যক্তি কৌতূহলবশত কিছু স্বর্ণের কাদা ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলেন।
হারুন আস সামেরি নিজে পৌত্তলিক ছিলেন এবং মিসরে তিনি মূর্তি বানানোর কাজ করতেন। সমুদ্র পার হয়ে বনি ইসরাইলিরা যখন নিরাপদ স্থানে বসতি গড়ল তখন কোনো এক অবসরে হারুন আস সামেরি তার সংগৃহীত স্বর্ণের কাদা দিয়ে একটি সুন্দর বাছুর বা গোবৎস নির্মাণ করেন। হারুন হজরত মূসা আ:-এর সান্নিধ্য লাভ করে এবং নবীর সেবাযতœ করে তাঁর অপত্যস্নেহভাজন হয়ে পড়েন। একদিন হজরত মূসা হারুন আস সামেরির কর্মে খুশি হয়ে তার জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করতে চান। হারুন আস সামেরি নবীর কাছে আবেদন করেন যে, আল্লাহ যেন তার একটি মনস্কামনা পূর্ণ করেন এবং হজরত মূসা সেভাবেই আল্লাহর দরবারে দোয়া করেন।
উল্লিখিত ঘটনার অনেক পরে হজরত মূসা আ: ৪০ দিনের জন্য তাঁর কওমের দায়িত্ব তার বড় ভাই হজরত হারুন আ:-এর ওপর ন্যস্ত করে তুর পাহাড়ে চলে যান আল্লাহর কাছ থেকে তাওরাত কিতাব আনার জন্য। হজরত মূসা আ:-এর অনুপস্থিতি, হারুন আ:-এর দুর্বল নেতৃত্ব এবং বনি ইসরাইলিদের অলস সময়ের কারণে লোকজনের মধ্যে নানান বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়ে যায়। তারা অহেতুক আনন্দ উল্লাস, উদ্ভট বিতর্ক এবং সীমাহীন অবাধ্যতায় একের পর এক অনাসৃষ্টি করতে শুরু করে। ঠিক এই সময়ে হারুন আস সামেরির মনে হজরত মূসা আ:-এর দোয়ার কথা মনে পড়ে এবং তিনি আল্লাহর দরবারে তার তৈরি গোবৎসটিতে যেন প্রাণসঞ্চার হয় তার জন্য প্রার্থনা করেন। আল্লাহর কুদরতে স্বর্ণনির্মিত গোবৎসটি লাফালাফি এবং ডাকাডাকি শুরু করে দেয়।
ঘটনার আকস্মিকতায় হারুন আস সামেরি হতবিহ্বল হয়ে পড়েন এবং সেই সুযোগে শয়তান এসে তাকে যে কুমন্ত্রণা দেয় তার ফলে হারুন আস সামেরি উচ্ছৃঙ্খল ও বিবদমান বিশৃঙ্খল বনি ইসরাইলিদের কাছে গিয়ে বলেন, মূসা আ: আল্লাহকে খোঁজার জন্য তুর পাহাড়ে গেছেন অথচ আল্লাহ এখানে- এ কথা বলে তিনি তার স্বর্ণ নির্মিত বাছুরটি বনি ইসরাইলিদের প্রদর্শন করেন। বাছুরটির লাফালাফি এবং হাম্বা হাম্বা রব এবং তার স্বর্ণ নির্মিত দেহসৌষ্ঠব দেখে বনি ইসরাইলিরা যারপরনাই হতবাক হয়ে পড়ে। তাদের দীর্ঘদিনের মূর্তিপূজার অভ্যাস নেশার মতো তাদের মস্তিষ্ক-শরীর-মনে নতুন মূর্তিপূজার উন্মাদনা সৃষ্টি করে। ফলে ১০ লাখ বনি ইসরাইলির মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া বাকিরা গোবৎস পূজা শুরু করে দেয়।
হজরত মূসা আ:-এর জমানার উল্লিখিত ফেৎনার ভয়ঙ্কর শাস্তি এবং পূর্বাপর ঘটনা বর্ণনা করতে গেলে এই নিবন্ধ অনেক বড় হয়ে যাবে। সুতরাং সে দিকে না গিয়ে আজকের শিরোনাম সম্পর্কে আলোচনা করে নিবন্ধের ইতি টানব।
আলোচনার শুরুতেই দেড় কোটি টাকার আমেরিকান ব্রাহামা প্রজাতির গরু এবং সেই গরুর বংশগতি বা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং যা কি না পশুর জিনোম হিসেবে পরিচিত তা বর্ণনা করতে গিয়ে জনৈক গরু ব্যবসায়ী যে ভাষা ব্যবহার করেছেন এবং যা বোঝাতে চেয়েছেন তা ঈদুল আজহার কোরবানির ভাবগাম্ভীর্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যে ষাঁড় গরুর বীর্যে দেড় কোটি টাকা মূল্যের গরুটির প্রজনন ঘটেছে তার সাথে গরুর বংশমর্যাদা এবং গরুটির পিতৃত্বের যে পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে তা মানবের বংশমর্যাদা- মানবসমাজের পিতা-পুত্র বা পুত্র-কন্যা ও মায়ের সম্পর্কের যে মানবিক বন্ধন তা স্পষ্টত লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়েছে। আমাদের সমাজের শিক্ষা-ভাষা জ্ঞান-রুচি-অভিরুচি, বোধ বুদ্ধি, উন্মাদনা, চিন্তা-চেতনা যে কোন স্তরে গিয়ে অধঃপতিত হয়েছে তা কিছু গরু ব্যবসায়ীর কথা শুনলেই আন্দাজ করা যায়।
দেড় কোটি টাকা দিয়ে গরু কিনে কোরবানি দেয়া লোকটিকে আমি চিনি না। তার কত টাকা তাও আমি জানি না। শিক্ষা-দীক্ষা-ধর্ম বোধ এবং রুচি-অভিরুচির স্তর কোন পর্যায়ে গেলে মানুষ এসব কর্ম করে তাও আমি জানি না। তবে গত ৩০ বছরের ব্যবসায়িক জীবন এবং ৪০ বছরের পেশাগত জীবনে বহু ধনী ব্যবসায়ীকে দেখেছি। আমি নিজেও বহু দিন ধরে ধনিক সম্প্রদায়ের মধ্যে বসবাস করছি। কিন্তু দেড় কোটি টাকা দিয়ে বংশমার্যাদাসম্পন্ন গরু কেনার লোকের সন্ধান আজো পাইনি। কিন্তু গরুর বংশকে মর্যাদার আসনে বসিয়ে যারা গরুর পিতার বীরত্ব এবং গরুর পিতার বীর্যের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে ব্যবসার পসরা সাজিয়েছে তাদের নিয়ে দু’কলম লেখার যে সুযোগ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাকে দিয়েছেন সে জন্য আমার মালিকের শুকরিয়া আদায় করছি এবং গরুসংক্রান্ত ফেৎনা-ফাসাদ থেকে তামাম দুনিয়ার মুসলিম উম্মাহকে রক্ষার জন্য প্রার্থনা করছি। আমীন। ছুম্মা আমীন।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা