১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ইসরাইলের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী

-

দ্বিতীয় কিস্তি
রাফায় অভিযান চলাকালে সম্প্রতি মিসর প্রথমবারের মতো ইসরাইলের বিরুদ্ধে গিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে যোগ দিয়েছে। তুরস্কের এরদোগান গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী তার দেশ সফরের সময় হামাসকে সন্ত্রাসী বলে অভিহিত করলে প্রত্যুত্তরে হামাসকে দাখলদারদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা অভিহিত করে জানিয়েছেন, হাজারের বেশি হামাস যোদ্ধা তুরস্কে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এতে যে বিষয়টি স্পষ্ট, গাজাবাসী তথা ফিলিস্তিনের পাশে ক্ষমতাধর আরব রাষ্ট্রগুলো না থাকলেও ইরানের পাশাপাশি তুরস্ক ও মিসর পরোক্ষভাবে দাঁড়িয়েছে। সিরিয়া দুর্বল হওয়ায় সরাসরি সহায়তা না দিতে পারলেও ইয়েমেনের হুতিরা প্রবল পরাক্রমে পুরো পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। ইরান, মিসর, তুরস্ক, সিরিয়া, ইয়েমেন- হামাস তথা ফিলিস্তিনকে সহায়তা করতে পারে ও ইচ্ছুক এমন প্রতিটি দেশ তীব্র আর্থিক সঙ্কটে। আর্থিক পরিস্থিতির পরিবর্তন হলে ফিলিস্তিন বিষয়ে এসব দেশের সম্পৃক্ততা বাড়বে। এমনকি হামাস ও হিজবুল্লাহ যদি আইডিএফকে তাড়িয়ে দিয়ে কিছু আক্রমণাত্মক অবস্থায় যায়, এসব দেশ ইসরাইলের বিরুদ্ধে গর্জে উঠবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বর্তমান ইউএস ডলারের রাজত্বকালে এ আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন সহজ হবে না, কিন্তু ব্রিকসের মুদ্রা অদূর ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যম হবে। তখন ইউএস মূদ্রা ও ইউএস হেজিমনি ক্ষমতা হারাবে, আমেরিকান স্যাংকশনের অস্ত্র ভোঁতা হয়ে যাবে। এসব দেশ নিশ্চিত আর্থিক শক্তি সঞ্চয় করবে। ওই সময়টি সুনির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও সে অবস্থার অনিবার্য আগমন অনুধাবন করা যায় সহজে।

বস্তুগত সহায়তা দিতে না পারলেও দূরবর্তী দেশ মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তান জাতিসঙ্ঘে ও অন্যান্য ফোরামে ফিলিস্তিন তথা গাজার পক্ষে উচ্চকণ্ঠ। দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে ইসরাইলকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। বলিভিয়া, চিলি, কলম্বিয়া, হন্ডুরাসের মতো ল্যাটিন আমেরিকান দেশ ইসরাইল থেকে নিজেদের রাষ্ট্রদূত ডেকে পাঠিয়েছে। উপসাগরীয় দেশ কুয়েত এখন পর্যন্ত ইউএস-ইসরাইলি নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সাড়া দেয়নি। জর্দান ও বাহরাইন যদিও আব্রাহাম অ্যাকর্ডে ঢুকে পড়েছে, তবু নিজ দেশের জনমতের চাপে ইসরাইলকে মৌখিক ছবক দেয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এসব দেশের কোনো কোনোটি ফিলিস্তিনের পাশে সরাসরি দাঁড়াবে বলে ধরে নেয়া যায়। এমনকি, আব্রাহাম অ্যাকর্ডভুক্ত দেশগুলোর নেতৃত্ব তথা রাজনৈতিক পরিবর্তন হলে সেগুলোও নিশ্চিতভাবে ফিলিস্তিনের পক্ষে দাঁড়াবে।
ইসরাইলের কোনো কৌশলগত গভীরতা নেই, অর্থাৎ পিছিয়ে পড়ার মতো কোনো অঞ্চল নেই, অন্যদিকে মোবিলাইজেশনে রয়েছে একটি আধাসামরিক গণরিজার্ভ বাহিনী। এমন বাস্তবতায় আইডিএফকে সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের ডিজাইন করা হয়েছে। দ্রুত অগ্রসর হয়ে সঙ্ঘাত নিজ ভূখণ্ড থেকে সরিয়ে অবিলম্বে আক্রমণাত্মকভাবে নিষ্পত্তিমূলক যুদ্ধে জয়লাভ করা তেলআবিবের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বর্তমান গাজা আগ্রাসন সাত মাস পার হতে চলল, যুদ্ধ ইসরাইলের বাইরে সরিয়ে দিতে পারলেও কোনো নিষ্পত্তি করতে পারেনি, এ দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে রণক্লান্ত ইসরাইল। বাস্তবতা হলো, রণক্লান্ত ইউনিটগুলোর কিছু অবকাশ দিতে বদলি সৈন্য নিয়োজিত করার মতো পর্যাপ্ত সৈন্য নেই। ইসরাইলে অবৈধ বসতি গড়া লক্ষাধিক ইসরাইলি হিজবুল্লাহর হামলা থেকে বাঁচতে বাস্তুচ্যুত। সরকার তাদের হোটেলে রেখেছে। তাদের জনগণ ও সেনারা যুদ্ধবিরতির জন্য সরকারের ওপর তীব্র চাপ দিচ্ছে। কিন্তু কোনো স্থায়ী যুদ্ধবিরতি তাদের পরাজয়ের সামিল হওয়ায় এবং নেতানিয়াহু সরকারের পতনের নামান্তর হওয়ায় নিরুপায় হয়ে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হতে পারছে না। ইসরাইলের ভেতরে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আন্দোলন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, মিডিয়া এটিকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ভিয়েতনাম মোমেন্ট’ বলে উল্লেখ করছে। সাড়ে তিন লাখের বেশি রিজার্ভ বাহিনীর সৈন্য নিজ নিজ পেশা ছেড়ে এসেছে, এতে নানা খাতে ব্যবসায়-বাণিজ্য ও উৎপাদন বন্ধ হওয়া ছাড়াও এ বাহিনীকে খরচ দিয়ে পুষতে হচ্ছে।

যুদ্ধে ইসরাইলের অর্থনীতি ২০ শতাংশ সঙ্কুচিত হয়েছে। পর্যটনসহ নানা খাতে আয়রুজি খাঁ খাঁ করছে। যুদ্ধের ব্যয় মেটাতে বাজেট ঘাটতি ৪৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, কারেন্সির পতন ঠেকাতে রিজার্ভ বিক্রি করতে হয়েছে। তেল আবিবের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ক্রমে ধস নামছে। নারী ও শিশুদের গণহত্যাকারী হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও প্রভাবে তীব্র নেতিবাচক প্রভাব ফেরেছে, এমনকি আয়ারল্যান্ড, স্পেন, পোল্যান্ড ও গ্রিসের মতো ইউরোপীয় কিছু দেশও বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে, মারাত্মক ভাবমর্যাদা সঙ্কটে পড়েছে ইসরাইল। দেশটির যুদ্ধ করার সামর্থ্য ও ইচ্ছাক্রমে নিম্নগামী। মানবেতিহাসের ভয়াবহতম গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের মুখোমুখি হয়ে হামাসও জানে এটি তাদের শেষ যুদ্ধ, তারা মরণপণ প্রস্তুতি নিয়েছে। তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই, স্বাভাবিক জীবন নেই, কোনো নিরাপত্তা নেই, রয়েছে যুদ্ধের ন্যায়সঙ্গত ও নৈতিক কারণ, তাদের রিক্রুটিং সচল থাকবে, তারা এ যুদ্ধ টেনে নিয়ে যাবে। হামাসের দীর্ঘমেয়াদি গেরিলা যুদ্ধ ইসরাইল সামাল দিতে পারবে বলে মনে হয় না। ইসরাইলের এ সীমাবদ্ধতা তার শত্রুর চোখে অবশ্যই ধরা পড়ছে, তারা ভবিষ্যতে সুযোগ নেবে, এতে সন্দেহ নেই। হিজবুল্লøাহর বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গেলে তা ইসরাইলের ভূখণ্ডে এসে পড়ার ঝুঁঁকি রয়েছে। সেটি হলে ইসরাইলের সার্বভৌমত্বে উচ্চমাত্রার ঝুঁকি দেখা দেবে।
ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিকূল পরিবেশে টিকে আছে ভীতি ছড়িয়ে দেয়ার কৌশল অবলম্বনে। ইসরাইল ফিলিস্তিনে দখলদারিত্ব কায়েম করে বসে নেই- নৃশংস, হিংস্র, অত্যাচারী ও অবদমনমূলক শাসনব্যবস্থা জারি করেছে। ঠাণ্ডা মাথায় ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্ন করতে কাজ করছে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, দীর্ঘমেয়াদে এ কৌশল দুনিয়ার কোথাও কাজ করেনি, ইসরাইলের ডিটারেন্সের এন্টিবায়োটিকও অচিরে কাজ করবে না। ইরানের পাল্টা জবাব এ ডিটারেন্স কাজ না করার লক্ষণ, এরও আগে ৭ অক্টোবরে হামাসের হামলাও ডিটারেন্সকে চ্যালেঞ্জ জানানোর ঘটনা। এ ডিটারেন্স তৈরিতে ইসরাইল অনুসরণ করে এসকেলেশন ডকট্রিন। এর অনুসরণ দেখা যায়, স্মরণকালে গাজায় মানবেতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণ্য ও রক্তপিপাসু উন্মত্ত গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞে। কিন্তু হিজবুল্লাহের ক্ষেত্রে এসকেলেশনের দেখা মিলছে না! এটি বিস্ময়কর।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত মেজর ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক


আরো সংবাদ



premium cement

সকল