১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ফিলিস্তিন প্রশ্নে মার্কিননীতির পুনঃভারসাম্য প্রয়োজন

-

১৯৯০-এর দশক থেকে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পৃক্ততার মূল ভিত্তি হচ্ছে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের প্রতি আনুষ্ঠানিক সমর্থন প্রদান করা। তথাকথিত শান্তিপ্রক্রিয়ার শুরু থেকেই আমেরিকা এই নীতি অনুসরণ করে আসছে। তা সত্ত্বেও ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে এই পর্যন্ত ইসরাইলের ওপর আমেরিকার রাজনৈতিক প্রভাব সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে।
গাজায় ইসরাইলি সরকারের সামরিক হামলার প্রতি মার্কিন সমর্থন দানের ব্যাপারে স্পষ্টভাবে একটি অসঙ্গতি তথা পরস্পর বিরোধিতা বোঝা যাচ্ছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি নীতি হলো দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানকে সমর্থন দেয়া। অন্যভাবে বলতে গেলে, যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলি সরকারকে রাজনৈতিক সমর্থন দিয়ে দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের বিরোধিতা করছে- এটিকে কিভাবে যৌক্তিক ন্যায়সঙ্গত বলবেন?
অন্যান্য রাষ্ট্র যেমন- যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও মিসরের নীতির ক্ষেত্রেও এই পরস্পর বিরোধিতা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সদাসর্বদা দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের বিরোধী হয়ে এখনো অনেকগুলো দেশ থেকে সমর্থন পাচ্ছেন যে দেশগুলো ফিলিস্তিন প্রশ্নে সরকারিভাবে দ্বিরাষ্ট্রিক সমাধানকে সমর্থন করে।
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী তার নিজের রাজনৈতিক এজেন্ডা পশ্চিমা মিত্রদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার জন্য যে শক্তি প্রদর্শন করছেন- সেটিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় নীতির সীমিত উদ্দেশ্য লক্ষ্য হিসেবেই সবচেয়ে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। নেতানিয়াহুর কৌশলের প্রথম মাত্রা হলো, ইসরাইল-আরব সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে ওয়াশিংটনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য থেকে ফায়দা হাসিল করা।
ফিলিস্তিনিদের দুঃখ-দুর্দশার অবসান ঘটানোর জন্য একটি ন্যায়সঙ্গত শান্তির পথ খুঁজে বের করার মাধ্যমে আরব-ইসরাইল সম্পর্ক স্বাভাবিক করার যে এজেন্ডা ওয়াশিংটন প্রণয়ন করতে চায় সেটিকে অবজ্ঞা করেই নেতানিয়াহু তার পথে এগিয়ে যেতে চান। দ্বিতীয় মাত্রাটি হলো মধ্যপ্রাচ্যের কোনো সঙ্ঘাতে জড়িয়ে না পড়া এবং এশিয়ার দিকে আবর্তিত হওয়া। এই মার্কিননীতির দৃষ্টিভঙ্গি ২০০৯ সালের ওবামা প্রশাসনের অবস্থানের দিকেই ফিরিয়ে নিচ্ছে। গত মাসে একজন প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেন তার স্টেট অব ইউনিয়ন ভাষণে ব্যাখ্যা করেছিলেন, গাজায় ইসরাইলি যুদ্ধে সমর্থন দেয়ার জন্য ‘কোনো মার্কিন বুট মাটিতে থাকবে না’ অর্থাৎ কোনো মার্কিন সৈন্য মাটিতে তথা স্থলভাগে থাকবে না।

যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইল আলোচনায় গাজা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ফিলিস্তিনি ইস্যুতে একটি রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্য সামরিক সঙ্ঘাতের বিস্তৃতি বা সঙ্ঘাত তীব্রতর হওয়াকে সামাল দেয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। বাইডেন তার স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন ভাষণে জোর দিয়ে বলেছেন, ইসরাইলকে অবশ্যই গাজায় আরো অধিক সাহায্য পৌঁছে দেয়ার অনুমতি দিতে হবে এবং মানবাধিকারকর্মীরা যাতে গোলাগুলির মধ্যে না পড়ে তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায়, বর্তমানে ফিলিস্তিনি সমস্যার একটি ব্যাপকভিত্তিক রাজনৈতিক সমাধানের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকারে মোটেই নেই বরং ইসরাইলি হস্তক্ষেপের ব্যাপারে মানবিক বিবেচনায় তারা একটি স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থাপনা কার্যকর করতে চায়। গাজায় আমেরিকার লক্ষ্যকে হামাসের ৭ অক্টোবরের আটককৃত পণবন্দীদের মুক্তির বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে বলে সংজ্ঞায়িত করা যায়।
ফিলিস্তিন-ইসরাইল সঙ্ঘাতের মূল কারণ নিয়ে আলোচনা করলেই কেবল মানবিক বিপর্যয়ের বিষয়টি উদঘাটন করা যাবে। গাজার বেসামরিক লোকদের মানবিক সহায়তার বিষয়টি এখন পণবন্দীদের মুক্তির একটি দরকষাকষিতে পরিণত হয়েছে। গাজায় দুর্ভিক্ষের অবসান ঘটানোকে অগ্রাধিকার দিতে মার্কিন অক্ষমতা, রোগ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি এবং গাজায় মৃত্যু ও ধ্বংসের অবসান ঘটাতে ব্যর্থতা হলো ফিলিস্তিন ইস্যুতে নিরুদ্বেগ মার্কিন কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রথম এবং প্রধান ফলাফল। ইসরাইলকে সুরক্ষিত ও নিরাপদ করার মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গি এখনো বাইডেনের নীতির প্রধান চালিকাশক্তি।
এই প্রেক্ষাপটে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্তনি ব্লিনকেনের ঘোষণা হলো গাজা যুদ্ধের পর মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর একটি পর্যালোচনা করবে এবং একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ব্যাপারে সম্ভাব্য মার্কিন ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিষয়ে নীতিগত বিকল্প উপস্থাপন করবে- যেটি সীমিত প্রভাব ফেলবে।
প্রকৃতপক্ষে ফিলিস্তিন সঙ্কট সমাধানে মার্কিন রাজনীতির কোনো পথ নেই। ১৯৮০-এর দশকের পর থেকে এই পর্যন্ত দ্বিপক্ষীয় এবং জাতিসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমাগতভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির বিরোধিতা করে আসছে। অপর দিকে যুক্তরাষ্ট্র সবসময় জোর দিয়ে আসছে যে, ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র শুধু ইসরাইল ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের মধ্যে সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হতে পারে।
২০০০ সালের শুরুর দিকে শান্তিপ্রক্রিয়ার অবসানের মধ্য দিয়ে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের মধ্যকার সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়ার কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতার অনেক ব্যাখ্যা রয়েছে। যেমন : ইসরাইল কর্তৃক একটি ফিলিস্তিনি অংশীদারের অস্তিত্ব মেনে নিতে অস্বীকার করা এবং দু’পক্ষের মধ্যে ভারসাম্যহীন নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা ক্রমেই দুর্বল হয়ে যাওয়া। সত্যিকার অর্থে, ওয়াশিংটন এবং তেল আবিবের মধ্যকার রাজনৈতিক নৈকট্য ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের কাছে সবসময় একটি নীতিগত প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব দু’দেশের আলাপ-আলোচনা প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রকে একটি সৎ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে দেখতে চায়। সবসময় তারা এটাই চেয়েছে। বর্তমানে বাইডেন প্রশাসন দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের ব্যর্থতার উত্তরাধিকারের মুখোমুখি হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতার দুর্বলতার বিষয়টি কাটিয়ে ওঠার জন্য বাইডেন প্রশাসন ইসরাইল ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্ভাব্য স্বাভাবিক প্রক্রিয়া তৈরি করার জন্য সংযোগ স্থাপনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র তার যুদ্ধ-পরবর্তী নীতির অংশ হিসেবে একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি পথ তৈরি করার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই কূটিনৈতিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও দুই রাষ্ট্রভিত্তিক একটি সমাধান এখন আগের চেয়েও অনেক দূরে। এমনকি অনেকে এটাকে ‘মৃত’ বলে ঘোষণা করেছে। একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিতে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সহজ না হলেও জাতিসঙ্ঘের ১৩৯টি দেশ স্বীকৃতি দিয়েছে। এমনকি, পশ্চিমতীর ও গাজায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এবং হামাসের নিজস্ব নিরাপত্তা অথবা সীমান্ত না থাকলেও এই দেশগুলো ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট তাৎক্ষণিক আইনগত কার্যকারিতা দিয়ে একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে পারেন। এই পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য তাকে মার্কিন কংগ্রেস অথবা ইসরাইলের অনুমতি নেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এমনকি ইসরাইলি সৈন্যরা ফিলিস্তিনের অধিকাংশ ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণে রাখলেও তিনি এই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন। একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে আহ্বান জানিয়েছে- নেতানিয়াহু তার বিরোধী।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা প্রশ্নে সমঝোতায় আসতে ইসরাইলি অস্বীকৃতির আনুষ্ঠানিক যৌক্তিকতা হলো দশকের পর দশক ধরে এই প্রশ্নে নিঃশঙ্ক ও উদ্বেগমুক্ত থাকার ফলাফল।
নেতানিয়াহু গত জানুয়ারিতে বলেছেন, ‘জর্দান নদীর পশ্চিমের সব ভূখণ্ডের ওপর ইসরাইলের পূর্ণ নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কোনো সমঝোতা করবেন না। ইসরাইলের এই নিরাপত্তা নীতিই সম্ভবত গাজায় সামরিক অভিযান বন্ধ করতে একটি বিশ্বাসযোগ্য কূটনৈতিক কাঠামো উপস্থাপনে যুক্তরাষ্ট্রকে বিরত রেখেছে। আরব এবং ইসরাইলি স্বার্থের মধ্যে পুনঃবিন্যাসের তথা আবার ভারসাম্য তৈরির মার্কিন নীতিই কেবল গাজাযুদ্ধ অবসান এবং ফিলিস্তিনি জনগণের দুর্দশা লাঘবের পথ খুলে দিতে পারে।
আরব নিউজ থেকে ভাষান্তর মুহাম্মদ খায়রুল বাশার


আরো সংবাদ



premium cement
আমাদের সংবিধান ও পার্বত্য শান্তিচুক্তি চব্বিশের নতুন বাংলাদেশে বিজয় দিবস বাংলাদেশের ধর্মীয় শিক্ষার গুরুত্ব চীনের রাষ্ট্রদূতের সাথে মঈন খানের বৈঠক বীর মুক্তিযোদ্ধারা চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে : অ্যাডভোকেট জুবায়ের ভারতীয় চলচ্চিত্রে বাংলাদেশকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন! স্বাধীনতা যুদ্ধের সঠিক, প্রকৃত ইতিহাস লেখা হয়নি: বদরুদ্দীন উমর রাজশাহীতে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের ২ কর্মী গ্রেফতার জামায়াত নেতা ড. তাহের সম্পর্কে সাংবাদিক ইলিয়াসের মন্তব্যের প্রতিবাদ গাজীপুরে নতুন ট্রেন ও অসমাপ্ত বিআরটি লেনে বিআরটি বাস সার্ভিসের উদ্বোধন বেনজীর ও মতিউরের বিরুদ্ধে দুদকের ৬ মামলা

সকল