দুর্নীতির বিষবৃক্ষ ছড়াচ্ছে ডালপালা
- মো: হারুন-অর-রশিদ
- ০৬ মে ২০২৪, ০০:০৫
আমাদের সমাজে কে সাধু আর কে অসাধু তা নির্ণয় করা বড় কঠিন হয়ে পড়েছে। সমাজের উঁচুস্তর থেকে নিচুস্তর পর্যন্ত যে অবস্থান থেকেই যে কথা বলুক না কেন, মনে হয় সেই বুঝি খোদাতায়ালার কাছ থেকে সত্যের বাণী নিয়ে এসেছে। লেবাস দেখে আর বয়ান শুনে মনে হয় খালেস বান্দায় দেশটা ভরে গেছে। কিন্তু এই খালেস বান্দাদের অন্তরে আছে বিষবৃক্ষ। তাদের কাছে দেশ, দেশের জনগণ এবং জনগণের সম্পদ কোনোটিই নিরাপদ নয়। জনসমাজে তারা এমন বয়ান ছাড়ে, মনে হয় এর থেকে ভালো মানুষ বুঝি এই সমাজে কোনকালে কেউ জন্ম নেয়নি। এমন খালেস বান্দারা কখনও কোনো অপকর্ম, অপরাধ করতে পারে সে কল্পনারও অতীত। কিন্তু যখন তাদের আমলনামা সামনে এসে হাজির হয় তখন বোঝা যায় এহেন অপরাধ নাই যা তাদের দ্বারা সংঘটিত হয়নি।
সমাজের অপরাধীরা পুলিশের লাঠিকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। কারণ পুলিশের কাজ অপরাধ দমন করা। নিরীহ গোবেচারা মানুষের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, যারা অপরাধীদের ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করেন তারা নিশ্চয়ই অপরাধ করতে পারেন না! যারা চোর, ডাকাতদের ধরে নিয়ে বেদম পিটুনি দিয়ে তারপর জেলহাজতে পাঠান তাদের মতো সাধু সন্ন্যাসী সমাজে দ্বিতীয়টি থাকার কথা নয়! কিন্তু এর সবই অমূলক। সবই সিনেমার কল্পকাহিনীর মতো। পুলিশের কনস্টেবল থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ মহল পর্যন্ত একশ্রেণীর সদস্যের মধ্যে কে কতটা দুর্নীতিবাজ তা নিয়ে তাদের মধ্যেই প্রতিযোগিতা হতে পারে।
আমরা একসময় বনের রাজা আব্দুল গণির নাম শুনেছিলাম। যার লেপ, বালিশ, তোশকের নিচে টাকার খনি আবিষ্কার হয়েছিল। তখন ভেবেছিলাম সেই বুঝি সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিবাজ। কিন্তু না! এই রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের চেলা-চামচা, পিয়ন, পাইক-পেয়াদা, চাপরাশি, রুই-কাতলা সবাই যে ঘুষ-দুর্নীতির মহারাজ্য তৈরি করে রেখেছে তা তাদের বেতন-ভাতার সাথে, পুঞ্জীভূত সয়-সম্পত্তির সাথে মেলাতে গেলেই টের পাওয়া সম্ভব। দুর্নীতির মহারাজ্যের এই অধিপতিদের কারো বেহিসেবি সম্পদের তথ্য যখন লোকচক্ষুর সামনে ভেসে ওঠে, তখন কেউ জিজ্ঞাসা করলে তাদের শ^শুরবাড়ির ধন-ভাণ্ডার থেকে সামান্য একটু দানের ওসিলাতে তাদের এই মহারাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে অনেকে ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেন।
পুলিশের সাবেক মহান অধিপতি বেনজীরের যে পরিমাণ সম্পত্তির হিসাব পত্রিকান্তে প্রকাশিত হয়েছে, তার শিরোনাম হয়েছিল এই রকম যে, ‘বেনজীরের ঘরে আলাদিনের চেরাগ।’ যে চেরাগবলে ৩৪ বছর সাত মাসের চাকরিজীবনে বেনজীর আহমেদ বেতন-ভাতা বাবদ মোট এক কোটি ৮৪ লাখ ৮৯ হাজার ২০০ টাকা (এর বাইরে পদবি অনুযায়ী পেয়েছেন আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা) আয় করলেও চাকরি শেষে তার হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পত্তির হদিস পাওয়া গেছে। বেতন-ভাতা যার থাকা-খাওয়ায় শেষ হয়ে যাওয়ার কথা তিনি এত টাকার সম্পদ কিভাবে করলেন গোটা সমাজের সুবোধ নাগরিকের মুখে মুখে আজ এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। একজন বেনজীর হয়তো দুর্নীতির মহা বিষবৃক্ষ, তবে এমন কত লাখ বেনজীর বিষবৃক্ষ হয়ে গোটা সমাজের বুকে বিষবাষ্প ছড়িয়ে যাচ্ছে তার হিসাব করাও সাধারণের পক্ষে সম্ভব নয়।
আমরা এমন একটা দেশে বসবাস করছি যেখানে একটি শ্রেণী রাতারাতি কোটিপতি বনে যাচ্ছেন। অন্যদিকে অনেক মানুষ একটু ভালো থাকার আশায় বিদেশ বিভুঁইয়ে যেতে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরছেন অথবা দেশে থাকলে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। জবাবদিহি দূরে থাক, কোনও কিছুতেই কারো কোনো দায় আছে বলে মনে হয় না। একদিকে প্রখর রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে একজন কৃষক ফসল ফলিয়ে নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারছে না, অন্যদিকে একটি বিরাট শ্রেণী ব্যাংক লোপাট থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ দখল করে কোটিপতি হয়ে যাচ্ছেন। এক দেশের নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্যমূলক এই শ্রেণি বিভাজন দিনে দিনে সমাজের মধ্যে এক ভয়ঙ্কর ক্ষত সৃষ্টি করে ফেলছে। কিন্তু কেন এমনটি হচ্ছে? যদি এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয় তাহলে প্রথমেই যে বিষয়টি সামনে আসবে তাহলো, দেশে ন্যূনতম আইনের শাসন নেই। একটি গণতন্ত্রহীন রাষ্ট্রে আইনের শাসনের অভাব থাকবে এটিই স্বাভাবিক। তবে প্রশ্ন হলো, এভাবে আর কত দিন? সরকারের কি কোনো দায়-দায়িত্ব নেই? একটি সরকার যখন অস্বাভাবিকভাবে জনগণকে জিম্মি করে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে চায় তখন তাকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কব্জায় নিতে হয়। এই সুযোগে কব্জাকৃত প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা দুর্নীতির সাগরে নিজেদের ডুবিয়ে রাখেন। আমরা যদি লক্ষ করি দেখতে পাবো, টিআইবির সেবা খাতের দুর্নীতির খানা জরিপ প্রতিবেদনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত বলা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলতে প্রধানত বোঝানো হয় পুলিশ বাহিনীকে। অবশ্য এর সঙ্গে আরো অনেক সহযোগী বাহিনী আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ভূমিকা পালন করে থাকে। যেমন : র্যাব, বিজিবি এবং পুলিশের বিভিন্ন বাহিনী। তথাকথিত নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের শায়েস্তা করার জন্য এই বাহিনী বিরোধী দলের উপর চরম অন্যায় এবং নিষ্ঠুরতম আচরণ করেছে, যা একটি গণতান্ত্রিক দেশে কল্পনারও বাইরে। বিরোধী শক্তির ওপর পুলিশের এই নিষ্ঠুরতার উপহার হিসেবে তারা সরকারের কাছ থেকে দায়মুক্তি নিয়ে দুর্নীতির বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিচ্ছে সর্বমহলে। এ কারণে, আমাদের সমাজে পুলিশ সম্পর্কে মানুষের ধারণা অত্যন্ত নেতিবাচক। অনেকেই মনে করেন, পুলিশ মানেই ঘুষখোর। পুলিশ মানেই নির্যাতনকারী ও অত্যাচারী। এ কারণে কোনো ব্যক্তি একান্ত বাধ্য না হলে সাহায্যের জন্য পুলিশের সহায়তা নিতে চান না। রাষ্ট্রের এই প্রতিষ্ঠানকে এতটা বিতর্কিত করার জন্য সরকারের ক্ষমতালোভী বাসনাই দায়ী। দুর্নীতি দমনের বহু হাঁক-ডাক দিলেও বাস্তবে দুর্নীতিবাজরা বহাল তবিয়তে দুর্নীতি করে যাচ্ছে। বড় বড় দুর্নীতিবাজ এ সরকারের আমলে অনেক ক্ষেত্রেই প্রশ্রয় পাচ্ছে। কারণ, তারা সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়ে রাখার জন্য জনগণকে প্রতিবাদহীন রাখতে হাতুড়ির ভূমিকা পালন করছে। এভাবে সমাজ একটি অসহনীয় পর্যায়ে উপনীত হয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে সমাজ ও রাজনীতি দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের বিকল্প নেই। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দলমত নির্বিশেষে সব দুর্নীতিবাজকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আজকের বাস্তবতায় শুধু পুলিশই নয়; রাষ্ট্রের এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই যেটা দুর্নীতিমুক্ত। টিআইবির একটি জরিপে দেখা গেছে দেশের ৭০.৯ শতাংশ নাগরিক সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। এমপি, মন্ত্রী, আমলা-কামলা সবাই দুর্নীতির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। প্রকৃত অর্থে আমরা যতই অর্থনৈতিক সাফল্যের জিগির তুলে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে বলে গলা ফাটাই না কেন, উন্নয়নের সেই জাদুর প্রদীপের নিচে অন্ধকার বৃত্তটা কিন্তু ক্রমেই বাড়ছে। বেনজীরের মতো আরো লাখো বেনজীরের ঘরে আলাদিনের চেরাগ জ¦লতে জ¦লতে সমাজে যে গভীর ও অদৃশ্য ক্ষত তৈরি হচ্ছে, তা নিরসন করবে কে?
দুর্নীতিপ্রবণ এই জাতির কপালে শনির রেখা এতটাই প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে যে, এখানে ঘাট অঘাট হয়ে যাচ্ছে আর অঘাট ঘাট হয়ে যাচ্ছে। কৌতুকের ছলে বলতে গেলে বলতে হয়, আগে ডাকাতেরা টাকার জন্য ব্যাংক লুট করত, আর এখন ডাকাতেরাই টাকা লোপাটের জন্য ব্যাংক বানায়। একটি অগণতান্ত্রিক সরকারের ছত্রছায়ায় দুর্নীতির বিষবৃক্ষ যে হারে রোপিত হচ্ছে তা এখনই রোধ করতে না পারলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক নিকষকালো অন্ধকার অপেক্ষা করছে। মোদ্দা কথা, এই জাতিকে রক্ষা করতে হলে আইনের শাসনে বিশ^াসী গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। জনগণের সার্বভৌমত্ব ফিরিয়ে দিয়ে জনগণের কাছে জবাবদিহি করার মাধ্যমে দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েমের জন্য জাতির প্রতিটি নাগরিকের প্রার্থনা করা উচিত। এটি কায়েম করতে পারলেই জাতি হয়তো হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে।
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা