বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদ: ইতিহাস যাকে মনে রাখে
- ব্যারিস্টার তমিজ উদ্দিন
- ০৩ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০৫
১২১৫ সালে ইংলান্ডের রাজা ‘কিং জন’ রাজনৈতিক সঙ্কটের বাস্তবসম্মত সমাধানের জন্য বিরোধীদের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। বিশ্ব ইতিহাসে এটি ‘ম্যাগনা কার্টা’, যার অর্থ ‘দ্য গ্রেট চার্টার’ হিসেবে পরিচিত। এতে প্রথমবারের মতো প্রতিষ্ঠিত হয় যে, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়, এমনকি রাজাও। এতে ব্যক্তির মানবিক অধিকার এবং ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়।
বিংশ শতাব্দীর মধ্যেভাগে আমাদের দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশে অবিভক্ত পাকিস্তানের সাবেক প্রধান বিচারপতি মরহুম বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদের ঐতিহাসিক বিচারিক অনেক রায় ‘ম্যাগনা কার্টা’ হিসেবে আইনের জগতে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। মানুষের মৌলিক অধিকার, সুশাসন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদের বিচারিক রায়গুলো তথাকথিত বেসিক ডেমোক্র্যাসির লেবাসে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান সরকারের শরীরের মাংসপিণ্ডে এক একটি কাঁটা হয়ে ওঠে। তার সাহসী বিচারিক রায় বিচারপতি মোর্শেদকে কেবল জাতীয়তাবোধই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রশংসা, খ্যাতি অর্জন ও আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে যায়।
বিগত শতাব্দীর প্রথম দশকের শেষের দিকে তিনি জন্মগ্রহণ করেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত ও সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে। উচ্চ মেধাসম্পন্ন মাহবুব মোর্শেদ ছাত্রজীবন থেকে বেড়ে ওঠেন বাধ্যতামূলক নিয়মতান্ত্রিক পরিবেশে যা তাকে শুধু ঈর্ষণীয় চরিত্রের অধিকারীই করেনি, প্রেরণা জুগিয়েছে এবং সাহায্য করেছে বিশ্বের সর্বোচ্চ সম্মানিত এবং মর্যাদাপূর্ণ শিক্ষাগত যোগ্যতা ব্যারিস্টার এট ল অর্জন করতে, যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ‘দি অনারেবল সোসাইটি অফ লিংকন ইন’ থেকে ১৯৩৮ সালে।
পেশাগত জীবনে তার কঠোর পরিশ্রম, অসামান্য মেধা এবং জ্ঞান অর্জনের অফুরন্ত ক্ষুধা তাকে নিয়ে গেছে খ্যাতির শীর্ষ অবস্থানে। ১৯৫৪ সালের শেষের দিকে তিনি ঢাকা হাইকোর্টে যোগ দেন এবং একই বছর ঢাকা হাইকোর্টের বিচারক পদে নিযুক্ত হন। বিচারপতি মোর্শেদ পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৬২ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত। ১৯৬৪ সালে তিনি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির পদে অধিষ্ঠিত হন। প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি নি¤œ আদালতের ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেন। সামাজিক ন্যায়বিচার, স্বাধীন বিচার বিভাগের জন্য তার গুরুত্বপূর্ণ ধারণা এবং তা কার্যকর করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বিচারপতির দায়িত্ব পালনকালে তার কিছু ঐতিহাসিক রায় এবং সাংবিধানিক ব্যাখ্যা উপমহাদেশের পরিধি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ব্যাপক প্রশংসিত হয়।
আইন পেশায় সুখ্যাতি অর্জনের পাশাপাশি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এক কঠিন সময়ে বিচারপতি মোর্শেদ এগিয়ে এসেছিলেন এবং দায়িত্ব নিয়েছিলেন একজন অকুতোভয় বীর সৈনিকের মতো। তার দূরদর্শী চিন্তা, মেধা, পরিশ্রম এবং সোচ্চার ভূমিকার জন্য এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সবশ্রেণীর মানুষের অংশগ্রহণ এবং বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী মহলের এক বিরাট সমর্থন লাভ করেছিল।
ব্রিটিশ শাসনের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি লাভের পর পশ্চিম পাকিস্তানিদের শাসন এবং শোষণের বিপরীতে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে এবং ২১ দফা কর্মসূচি প্রণয়নে মাহবুব মোর্শেদ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি আবুল মনসুর আহমদের সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট সরকারের ২১ (২১ দফা) পয়েন্টের ঘোষণাপত্রের খসড়া তৈরি করেন এবং পরে মোর্শেদ ২১ দফাকে ছয়টি পয়েন্টে চূড়ান্ত সংক্ষিপ্ত রূপ দেন যা ছিল বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের সে সময়ের চাহিদা। যা পরবর্তী পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তান যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। (সে সময়ের প্রতিশ্রুতিশীল ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব মুজিবুর রহমানকে এই স্বাধিকার আন্দোলনের ৬ দফা দাবির জন্য পাকিস্তানের কারাগারে কারাভোগ করতে হয়েছিল)। এটি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বৈষম্যের জন্যই নয়, অধিকন্তু ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পরে মোর্শেদ দৃঢ়ভাবে উপলব্ধি করতে পারেন যে, পূর্বের পক্ষের (পূর্ব পাকিস্তানের) স্বার্থ সঠিকভাবে রক্ষিত হয়নি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সে সময়ের রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে ১৯৬৬ সালে ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি মাজহারুল হক বাকী পরবর্তী সময়ে বলেছিলেন যে, প্রধান বিচারপতি মোর্শেদ ব্যতীত অন্য কেউ তাদের বার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করতে সাহস করেননি। এই সম্মেলনে মাহবুব মোর্শেদ এবং পরে ব্যাপকভাবে শেখ মুজিব প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের আহ্বান জানান।
বিচারপতি মোর্শেদ তার জীবনকালে শুধু ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে যুক্ত ছিলেন না তিনি নিজেই সৃষ্টি করেছেন ইতিহাস। বিচারপতি মোর্শেদের পেশাগত সুখ্যাতি, আভিজাত্যময় ব্যক্তিত্ব, উচ্চ মর্যাদাশীল হওয়া সত্ত্বেও সাধারণের মাঝে কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ, সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা ও অবস্থানের গুরুত্ব জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত হয়েছিল। সে সময় ঐতিহাসিক ‘নেহরু-লিয়াকত’ চুক্তি প্রণয়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য আইয়ুব খানের ঐতিহাসিক গোলটেবিল বৈঠকে (ফেব্রুয়ারি-মার্চ ১৯৬৯) সমগ্র পাকিস্তানের যে ৩৫ নেতা আমন্ত্রিত হয়েছিলেন, বিচারপতি মোর্শেদ ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। সে বৈঠকে বিচারপতি মোর্শেদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আমাদের বাংলাদেশের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ইতিহাসবিদদের মতে, সেদিন গোলটেবিল বৈঠকে বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদ শুধু বাঙালি জাতি যে একটি আত্মমর্যাদাশীল এবং এর ‘উচ্চ শির যে নোয়াবার নয়’ তাই প্রমাণ করেনি তিনি তার দেয়া প্রস্তাব ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’ এ দাবি সামরিক জান্তাদের রক্তচোখের সামনে থেকে ছিনিয়ে আনেন। এর পূর্বে পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের সমানসংখ্যক আসন নির্ধারিত ছিল। মাহাবুব মোর্শেদের দেয়া প্রস্তাব ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’ নীতি গ্রহণের ফলে নির্ধারিত ৩০০ আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫০ থেকে বেড়ে ১৬৯টিতে। রাজনৈতিকভাবে এ আসন সংখ্যার বিভাজনটি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীকে ব্যাপকভাবে পরাভূত করে, যার বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায় ১৯৭০ এর নির্বাচনে। বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদের এ অবদান বাংলাদেশের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে যখন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা আইয়ুব খান তার সামরিক শাসন পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে ঐতিহাসিক ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ মামলা দায়ের করে সে সময়ে বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদ ইতিহাস সৃষ্টি করে প্রধান বিচারপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে জনতার কাতারে এসে দাঁড়ান। বিচারপতি মোর্শেদ গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং মানুষের অধিকারে বিশ্বাস করতেন এবং সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতেন। তিনি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মারফত গণতন্ত্রের মর্যাদা অক্ষুণœ রাখার চেষ্টা করেছেন এবং সফলতাও অর্জন করেছেন। মাত্র পাঁচ দশক পূর্বে যখন আমাদের এ ভূখণ্ডটি হাজার মাইল দূর থেকে ভিনদেশী শাসকগোষ্ঠী শাসনের নামে শোষণ করতো, সিদ্ধান্ত নিতো কী হবে আমাদের সংস্কৃতি, ভাষা, পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ, আমাদের নিত্যদিনের জীবনযাত্রা যা ছিল একটি জাতির জন্য অপমানকর, সে সময়ের এ অনাচার ও নির্মমতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে মাহবুব মোর্শেদ তার সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদ প্রধান বিচারপতির আসন থেকে পদত্যাগ করেন যা ছিল নজিরবিহীন। সে সময়ে তার এ পদত্যাগটি ছিল 'ঃধষশ ড়ভ ঃযব পড়ঁহঃৎু'. অনেক ঐতিহাসিক এবং সমাজবিশেষজ্ঞ মনে করেন, তার এ পদত্যাগপত্রটি ছিল সে সময়ে সামরিক জান্তা আইয়ুব খানের জন্য একটি চপেটাঘাত। প্রধান বিচারপতি পদ থেকে ইস্তফা দেয়ার পর প্রথমেই তিনি মনোযোগ দেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিদের পক্ষে মামলার প্রস্তুতি গ্রহণের এবং পাশাপাশি এর বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গঠন করেন। এ জনমত গঠন করার মাধ্যমেই মাহবুব মোর্শেদ রাজনীতিতে সরাসরি পদার্পণ করেন। তিনি সামনে থেকে আইনি প্রক্রিয়ার পাশাপাশি সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে ব্যাপক ‘আইয়ুুববিরোধী আন্দোলন’ গড়ে তোলেন। সে সময়ের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব আসামির গ্রেফতারি পরোয়ানার বিরুদ্ধে ও তাদের মুক্তির জন্য সভা, সমাবেশ, সেমিনার এবং আন্তর্জাতিক মহলে আবেদন জানান। তার এ অবদানের কথা ইতিহাসের পাতা থেকে কখনো মুছা যাবে না। তার মতো গুণীর জন্ম বারবার হবে কি না- এ প্রশ্নের উত্তর না জানলেও তিনি আমাদের মাঝে আছেন জীবন্ত ইতিহাস হয়ে তা জানি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা