০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


মানবতা ও দায়িত্ববোধ

-

মানুষ যখন বিপদে পড়ে তখন অন্য মানুষের কর্তব্য বিপদগ্রস্ত মানুষটির পাশে দাঁড়ানো। সাধ্যমতো তাকে সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে বিপদ থেকে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা; কিন্তু সেই মানুষটি যদি হয় অভাবগ্রস্ত কিংবা সমাজের পিছিয়ে পড়া কোনো মানুষ, তখন আমাদের কর্তব্য আরো বেড়ে যায়। তখন তার প্রতি আমাদের মানবিক হয়ে ওঠা কেবল সামাজিক দায়িত্বই নয়, বরং এটি ঈমানি দায়িত্বও বটে। মানবতার ধর্ম ইসলামের ঘোষণা, যখন কোনো মুসলমান বিপদে পড়বে তখন অন্য মুসলমানদের এগিয়ে আসতে হবে তার সাহায্যের জন্য। প্রয়োজনে তাকে অর্থ, চিকিৎসা ও সেবা-শুশ্রƒষা দিয়ে কষ্ট লাঘব করে দিতে হবে। কখনো কখনো এসব মানুষকে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের সুযোগ করে দিতে হয়।
এক হাদিসে নবী করিম সা: বলেছেন, ‘একটি খেজুরের অর্ধাংশ দিয়ে হলেও দোজখ থেকে বাঁচবে। আর তা যদি না থাকে, তাহলে অসহায়, অভাবী ও হতদরিদ্রদের সাথে মিষ্টি কথা বলবে, ভালো ব্যবহার করবে, যাতে পরকালে তোমার নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।’ যদি প্রতিবেশী কোনো অমুসলমান হয় তাহলেও তার সহযোগিতায় এগিয়ে আসা আমাদের ঈমানি দায়িত্ব। কারণ, সে অমুসলমান হলেও প্রতিবেশী। আমার ওপর তার অধিকার বা হক রয়েছে। তাই কখনোই সঙ্কীর্ণমনা বা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করা যাবে না। ইসলাম মানুষের প্রতি এরকম নিষ্ঠুর ও বৈষম্যমূলক আচরণ করতে কখনোই অনুমোদন দেয় না। একজন মুসলমানের প্রতি আরেকজন মুসলমানের দায়িত্ব-কর্তব্য আর অন্য একজন সাধারণ মানুষের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্যের কিছুটা হলেও তারতম্য রয়েছে।
সমাজে এমন অনেক মানুষ রয়েছেন যাদের দানের মানসিকতা রয়েছে; কিন্তু তাদের সম্পদের পরিমাণ কম থাকায় তারা ইচ্ছা অনুযায়ী দান করতে পারেন না বলে পিছিয়ে থাকেন। আসলে কাউকে কিছু সওয়াবের আশায় দান করতে হলে তার পরিমাণ যে অনেক বড় ও মোটা অঙ্কের হতে হবে এমন কোনো শর্ত ইসলামে নেই। দানের ব্যাপারে ইসলামের বিধান হলো আমারা মানুষকে টাকাকড়ি ধনসম্পদ যা-ই দান করি না কেন তা অবশ্যই হালাল উপায়ে অর্জিত হতে হবে। অসৎ উপায়ে সম্পদ অর্জিত দানশীল ব্যক্তি চাইলে দান করতে পারবেন, তবে এমন দানে কোনো সওয়াবের আশা করা যায় না। হয়তো মানুষ তাকে বড় বলতে পারে। লোকের কাছে দানবীরও হওয়া যাবে; কিন্তু আল্লাহর কাছে তার কোনো পুরস্কার থাকার কথা নয়।
অনেকের মানুষকে দান করার মতো টাকা নেই। তাহলে তিনি কি সওয়ার অর্জন করতে পারবেন না? দানশীল ব্যক্তিকে দান করতে উৎসাহ প্রদান, সুপরামর্শ, সহমর্মিতা ও আন্তরিকতা দিয়েও মানুষের সহযোগিতা করা যায়। ইসলাম কখনোই কারো দানকে ছোট করে দেখে না; পরিমাণে যা-ই হোক না কেন। সামান্য পরিমাণ দানকেও ইসলামে উৎসাহিত করা হয়েছে। তাই নবী করিম সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি দান-সাদকা করে, একটি খেজুর পরিমাণও যদি হয়, আল্লাহ তা নিজ হাতে গ্রহণ করেন। তবে তা অবশ্যই বৈধ পথে উপার্জিত হতে হবে। কেননা, আল্লাহ এই বস্তুকেই পছন্দ করেন এবং তা বৃদ্ধি করে নেন। আর তা এতটাই যে, একটি খেজুর এক পাহাড় পরিমাণ হয়ে যায়।’ (বুখারি ও মুসলিম)
মানুষ যখন বিপদে পড়ে তখন তার দুশ্চিন্তার অন্ত থাকে না। ফলে সে বাধ্য হয়েই মানুষের দ্বারে ছুটে যায়। তাই ইসলাম এমন একটি সুন্দর বিধান দিয়ে রেখেছে, যাতে অভাবী লোকদের অভাবও মোচন করা যায় আর দানকারীরা অর্জন করতে পারেন অপরিমেয় সওয়াব। যাদের ধনসম্পদ রয়েছে কুরআনে তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে হতদরিদ্র ও বিপদগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য করতে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! আমি তোমাদের যে জীবনের উপকরণ দিয়েছি, তা থেকে তোমরা ব্যয় করো সেদিন আসার আগেই যেদিন কোনো বেচাকেনা, বন্ধুত্ব এবং সুপারিশ থাকবে না।’ (সূরা আল-বাকারা, ১: ২৫৪)
যারা নেক নিয়তে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য হালাল সম্পদ দিয়ে মানুষের সেবায় বা আল্লাহর রাস্তায় দান করেন, তাদের দান কখনোই বৃথা যায় না। নবী করিম সা: ঘোষণা করেছেন, ‘সামান্য একটি রুটিও যদি কেউ দান করে তার বিনিময়ে তিন ব্যক্তিকে জান্নাতে পাঠানো হবে। যে এটি দানের আদেশ করল, যে এটিকে তৈরি করল, যে এটি গরিবের মাঝে বিতরণ করল।’ (হাকিম, তাবারানি)
১৭ কোটি মানুষের বসবাস আমাদের এই দেশে। এদের মধ্যে কম করে হলেও কয়েক লাখ মানুষ রয়েছেন যাদের অর্থ-প্রাচুর্য কোনো কিছুরই অভাব নেই। আবার কিছু মানুষ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। যারা খেয়ে-পরে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। তাদেরও মানুষকে সহযোগিতা করার সক্ষমতা রয়েছে। তারা যদি সম্মিলিতভাবে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত বা অভাবী মানুষদের পাশে এসে দাঁড়ান, তাহলে তাদের সামান্য দানের একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টাও বিশাল একটি দানে পরিণত হতে পারে। যদি আমরা এ মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসি, তাহলে জাতিগতভাবে আমরা উপকারপরায়ণ জাতিতে পরিণত হবো, তেমনি সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে আমাদের এই দান দেশের সামগ্রিক উন্নতিতে অনেক বড় অবদান রাখতে পারবে।
লোক দেখানোর জন্য দান না-করলেও আল্লাহ তায়ালার রহমতস্বরূপ মানুষ একটা সামাজিক স্বীকৃতি পেয়ে যায়। সে স্বীকৃতি মানুষের অন্তরকে শীতল করে দেয়। আর ভালো কাজের গতিকে আরো বাড়িয়ে দেয়। তাতে আমরা ইহকাল ও পরকালে অবশ্যই লাভবান হতে পারব। হাদিস শরিফে আছে, ‘রোজ কিয়ামতের দিন মানুষ বর্ণনাতীত ক্ষুধা-পিপাসা নিয়ে উলঙ্গ অবস্থায় উত্থিত হবে। যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দুনিয়াতে মানুষকে খাদ্য দান করেছে, সেদিন তাকে খাদ্য দান করা হবে। যে আল্লাহকে খুশি করার জন্য মানুষকে পানি পান করিয়েছে, তাকে সেদিন পানি পান করিয়ে তার পিপাসা দূর করা হবে। যে মানুষকে বস্ত্র দান করেছে, তাকে সেদিন বস্ত্র পরিধান করিয়ে তার লজ্জা নিবারণ করা হবে।’ অন্য এক হাদিসে উল্লেখ আছে, ‘হাশরের ময়দানে বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত দানশীল লোকেরা তাদের দানের ছায়ার নিচে অবস্থান করবে।’
কেউ দুঃখকষ্টে নিপতিত হলে, অসুস্থ হয়ে পড়লে বা প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগের শিকার হলে একজন মুসলমান হিসেবে আরেকজনকে সাহায্য-সহযোগিতা করা কেবল নৈতিক
দায়িত্বই নয়, বরং ঈমানী দায়িত্বও বটে। মনে রাখতে হবে, মানুষের সেবা করাও ইবাদত। আপনি যদি খেয়ে-পরে সুস্থ থাকেন আর প্রতিবেশী বা আত্মীয়-স্বজন অনাহারী থাকে, তাহলে আপনি মুমিন হতে পারবেন না। এমতাবস্থায় নিজেকে মুসলমান বলে দাবি করতে পারেন না। তাই যদি নিজেকে মুমিন মুসলমান বলে দাবি করতে চান, আপনাকে অবশ্যই মানুষের বিপদে-আপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। চরম দুর্যোগের সময় মানুষকে সাহায্য করলে মানুষ যেমন সন্তুষ্ট হয় তেমনি এই অভাবীর দোয়া আল্লাহর আরশে পৌঁছে যায়। আল্লাহ তায়ালাও সন্তুষ্ট হন বান্দার ওপর। আল্লাহ চান মানুষ যেন মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসে। পবিত্র কুরআন পাকে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যা কিছু সম্পদ আল্লাহ তায়ালা তোমাকে দিয়েছেন, তা দিয়ে তুমি পরকালের কল্যাণ সন্ধান করো। দুনিয়া থেকে সম্পদের যে (আসল) অংশ তোমার (পরকালে নিয়ে যাওয়ার জন্য রয়েছে) তা ভুলে যেয়ো না। আল্লাহ তায়ালা যেভাবে (ধনসম্পদ দিয়ে) তোমার ওপর মেহেরবানি করেছেন, তুমিও তেমনি (তাঁর পথে ব্যয় করে তাঁর বান্দাদের ওপর) দয়া করো।’ (সূরা আল কাছাছ, ২৮ : ৭৭)
মুসলমানের অনুসরণীয় আদর্শ মূলনীতি আল-কুরআন। আর শেষ ও শ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর দেখানো পথ ও মত আমরা অনুসরণ করি। রাসূলে আকরাম সা: মানুষের বিপদ-আপদ ও বালা-মুসিবতে নিজেই এগিয়ে এসেছেন। নিজে সাদকা করেছেন। অন্যরাও যাতে দান-সাদকা করে, এজন্য উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন, ‘তোমরা দান-সাদকা করো। এতে আল্লাহ খুব খুশি হন এবং দানকারীর সম্পদ বাড়িয়ে দেন।’
দান-সাদকা করা অত্যন্ত মহৎ কাজ। দানশীলতার ফজিলতও অনেক। দাতার মর্যাদা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেন,‘যারা নিজেদের ধনসম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে, তাদের উদাহরণ হলোÑ একটি শস্যবীজ যা সাতটি শীষ উৎপাদন করে, প্রত্যেক শীষে রয়েছে একশ’ শস্যকণা। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়।’ (সূরা বাকারা, ২ :২৬১)
মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় দাতা হলেন আল্লাহ তায়ালা। মানবকুলের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সা:-এর দানের তুলনা নজিরবিহীন। তাঁর দানের সাথে কারো দানের তুলনা হয় না। তিনি এমনই এক ব্যক্তি যাঁর সারাটা জীবনের মধ্যে কেউ তাঁর কাছে কিছু চেয়েছে, অথচ তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন এমনটি কখনো হয়নি। তাই তো হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা: ছিলেন মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠদাতা।’ ( বুখারি শরিফ)
এই দান-সাদকার মধ্যমেই মানুষ জাহান্নাম থেকে রক্ষা পেতে পারে। করে নিতে পারে জান্নাতে স্থান। সেই দানটি যেন হয় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন, ‘দানশীলতা জান্নাতের একটি বৃক্ষ (এর ডালপালা দুনিয়াতে ছড়িয়ে আছে)। যে এর কোনো একটি ধারণ করবে তা তাকে জান্নাত পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। আর কৃপণতা জাহান্নামের একটি বৃক্ষ। কেউ এর কোনো ডাল ধারণ করলে তা তাকে জাহান্নাম পর্যন্ত নিয়ে যাবে।’ (বায়হাকি, সূত্র : মিশকাত, পৃ. ১৬৭)
আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য মানুষ তার সবকিছু আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিতে পারে। এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন হজরত আবু বকর সিদ্দীক রা:। একদা হজরত আবু বকর সিদ্দীক রা: ঘরে যা ছিল সবকিছুই মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর দরবারে হাজির করলেন। প্রিয় নবী তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আবু বকর, নিজের জন্য কী রেখে এসেছ। তিনি জবাবে বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে রেখে এসেছি।’ সুতরাং দানশীলতার মূর্তপ্রতীক হজরত আবু বকর সিদ্দীক রা:-এর জীবনী থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। দান-সাদকার ক্ষেত্রে যে কেবল সম্পদশালীরাই এগিয়ে আসতে পারেন তা নয়, দানের জন্য মানসিকতা দরকার। কম সম্পদের মধ্য দিয়েও মানুষের উপকার করা যায়।
সমাজে যখন অভাবী ও অনাহারী মানুষেরা ক্ষুধার তাড়নায় আর্তনাদ করেন আর সম্পদশালী মানুষেরা সেই ক্ষুধার্ত মানুষের কষ্ট বোঝার চেষ্টা করেন না, তারা কি কখনো ভেবে দেখেন না, এই সম্পদের প্রকৃত মালিক কে? তিনি কি চাইলে মুহূর্তের মধ্যে তার সম্পদ ছিনিয়ে নিতে পারেন না? অবশ্যই তাঁর এ ক্ষমতা রয়েছে। এর হাজারো প্রমাণ আমাদের চার পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে; কিন্তু আমরা বুঝেও বুঝতে চাই না। এই দুর্যোগকালে আর্থিক ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যারা আর্তমানবতার সেবা করে না তারা কি আল্লাহ ও তার রাসূলের ভালোবাসা পেতে চান না? সম্পদ ব্যয়ের মাধ্যমে সওয়াব অর্জনের এমন সুবর্ণ সুযোগ জীবনে আর না-ও আসতে পারে। হয়তো এর আগেই তাকে হাজির হতে হবে আল্লাহ তায়ালা দরবারে। তখন এই সম্পদ কি তার কোনো কাজে আসবে? এই সম্পদ সম্পর্কে তাকে কি কোনো প্রশ্ন করা হবে না? কারণ, এই সম্পদে অভাবী, দুস্থ ও নিকট আত্মীয় স্বজনের হক ছিল। তা কি তিনি আদায় করেছেন?
সুতরাং আসুন, সবাই মিলে আমরা অন্যের অধিকার ও নিজের দায়িত্বসচেতন হই। হই মানবিক। প্রথাগত ইবাদত পালনের পাশাপাশি এই আপৎকালীন সময়ে সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াই।হ

 


আরো সংবাদ



premium cement