এমপি আজীমের লাশ লোপাটের আগে আলাদা করা হয় খুলি আর ধড়
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৬ মে ২০২৪, ২৩:১৬
সতর্কতা : এই সংবাদ অনেকের ওপর মানসিক চাপ তৈরি করতে পারে।
বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম হত্যার ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত জিহাদ হাওলাদার জেরার মুখে জানিয়েছে আজীমকে হত্যা করার পরে তার শরীর থেকে মাথা কেটে ফেলা হয়েছিল, তারপরে সেটিকে টুকরো করে ফেলেছিলেন তিনি।
রোববার সন্ধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের তদন্তকারী শাখা সিআইডির সূত্রে এ তথ্য জানা গিয়েছে।
এর আগে সিআইডি জানিয়েছিল আজীমকে খুন করার পরে জিহাদ-ই তার শরীর থেকে চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে মাংস ও হাড় পৃথক করে ফেলে।
লাগাতার জেরায় জিহাদ এখন তদন্তকারীদের বলেছে, হাড় এবং খুলির টুকরো সেই আলাদা করেছিল, কিন্ত তা কোথাও ফেলে দেয়ার দায়িত্ব ছিল আরেক অভিযুক্ত ফয়সালের ওপরে।
আজীমের শরীরের মাংসের টুকরোগুলি কোথায় ফেলেছিল জিহাদ, সেটা তিনি সিআইডি’র তদন্তকারীদের দেখিয়েছে। কিন্তু ফয়সাল কোথায় খুলি আর হাড়ের টুকরোগুলি ফেলেছে, তা তিনি জানেন না বলেই এখনো পর্যন্ত জেরায় দাবি করেছে জিহাদ।
তবে নিউ টাউন সংলগ্ন ভাঙ্গর এলাকার কৃষ্ণমাটি সেতুর কাছে যে জায়গায় বাগজোলা খালে সংসদ সদস্যের শরীরের মাংসের টুকরোগুলি ফেলেছিল বলে জিহাদ দেখিয়ে দিয়েছিল, সেখানে রোববার চতুর্থ দিনের মতো ডুবুরি নামিয়ে তল্লাশি চালানো হলেও কিছুই উদ্ধার করা যায়নি।
এদিকে রোববারই কলকাতায় গিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশের ডিবির প্রধান হারুন উর রশীদের নেতৃত্বে একটি দল।
তারা সিআইডির তদন্তকারীদের সাথে নিউ টাউন থানা থেকে সঞ্জীভা গার্ডেন্সের সেই ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন, যেখানে হত্যা করা হয়েছিল আনোয়ারুল আজীমকে।
বেশ কিছুক্ষণ সেখানে থেকে ডিবির টিমটি পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সদর দফতর‘ভবানী ভবনে’ গিয়ে সিআইডির শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করেন।
গ্রেফতার হওয়া জিহাদকে জেরা
এই ভবনেই হেফাজতে রাখা হয়েছে এই হত্যার অন্যতম অভিযুক্ত জিহাদ হাওলাদারকে।
হারুন উর রশীদ জানিয়েছেন, বাংলাদেশে যে তিনজন গ্রেফতার হয়েছে, তাদের যেহেতু আমরা মুখোমুখি বলে কথা বলেছি, আমরা চাইব যে তাদের থেকে যেসব তথ্য আমরা পেয়েছি, সেগুলো পশ্চিমবঙ্গে অভিযুক্ত জিহাদের সাথে কথা বলে সেগুলো যাচাই করে নিতে।’
রোববার রাত প্রায় সাড়ে ৮টা পর্যন্ত ডিবির দলটি ভবানী ভবনে জিহাদকে জেরা করে।
জিহাদকে জেরা করা ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের সিআইডি যেসব সিসিটিভি ফুটেজ জোগাড় করেছে, সেসবও তারা দেখবেন, ঢাকায় গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে যা তথ্য পেয়েছেন জেরায়, সে সবও পশ্চিমবঙ্গের গোয়েন্দাদের সাথে মিলিয়ে নেবেন বলে জানান হারুন উর রশীদ।
কিন্তু গ্রেফতারকৃতদের বিচার কী ভারতে হবে, না বাংলাদেশে?
এই হত্যাকাণ্ড পরিকল্পনা এক দেশে করা হয়, হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয় আরেক দেশে, অভিযুক্তরা এক দেশ থেকে এসে অপরাধ করেছে, আবার মূল পরিকল্পনাকারী তৃতীয় একটি দেশের নাগরিক।
এক্ষেত্রে এই মামলার বিচার কোনো দেশে হবে, ভারতে না বাংলাদেশে, তা নিয়ে একটা আলোচনা ইতোমধ্যেই উঠেছে।
কলকাতা হাইকোর্টের সিনিয়ার ক্রিমিনাল লইয়ার জয়ন্ত নারায়ণ চ্যাটার্জী বলেন,‘অপরাধ যেহেতু ভারতে হয়েছে, তাই এদেশের আইন অনুযায়ীই বিচার হওয়ার কথা।’
‘তবে এক্ষেত্রে অপরাধের মূল পরিকল্পনা হয়েছিল বাংলাদেশে, অভিযুক্তরাও বেশির ভাগই সেদেশের নাগরিক। আবার পশ্চিমবঙ্গে প্রথম নিখোঁজ ডায়েরি করা হয়, অন্য দিকে ঢাকাতেও এফআইআর হয়েছে বলে জানি।’
চ্যাটার্জী বলেন,‘সে ক্ষেত্রে বিচারটা কোনো দেশে হবে, তা দুদেশের মধ্যে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
অন্যদিকে ডিবির প্রধান হারুন উর রশীদ বলেন,‘আমাদের দেশে কেউ কোনো অপরাধ করলে যেমন দেশেই তদন্তের পরে তাকে বিচারের সম্মুখীন করা হয়, তেমনই একস্ট্রা-টেরিটোরিয়াল অফেন্সের ক্ষেত্রেও সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে আমরা কোনো ব্যক্তিকে দেশেই বিচারের সম্মুখীন করতে পারব।’
এর আগের খবর
সিআইডির এক শীর্ষ কর্মকর্তা বৃহস্পতিবার গভীর রাতে জানিয়েছেন, জিহাদ হাওলাদার নামে ব্যক্তি বাংলাদেশী নাগরিক এবং তিনি অবৈধভাবে ভারতের মুম্বাইতে বাস করতেন। তার পুরাতন বাসস্থান বাংলাদেশের খুলনা জেলার দিঘলিয়া থানার অন্তর্গত বারাকপুরে।
এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আখতারুজ্জামান দুমাস আগে জিহাদকে কলকাতায় নিয়ে এসেছিল।
বৃহস্পতিবার জিহাদকে আটক করে একটানা জেরা করা হয়। তারা নিহত আনোয়ারুল আজীমের দেহ কলকাতা সংলগ্ন কোন এলাকায় ফেলে দিয়ে থাকতে পারে, সেটা জানার চেষ্টা করা হয়।
নিহত এমপির দেহাংশের খোঁজে সিআইডি বৃহস্পতিবার রাতে কলকাতা পুলিশ এলাকার অন্তর্গত পোলেরহাট থানার কৃষ্ণবাটি সেতুর কাছে বাগজোলা খালে তল্লাশি চালায়। নিউ টাউন এলাকার যে ফ্ল্যাটে আজীমকে খুন করা হয়, সেই আবাসিক কমপ্লেক্সের সামনে দিয়েই এই খালটি বয়ে গেছে।
তবে সেখানে কিছু পাওয়া যায়নি বলেই সিআইডি জানিয়েছে।
শুক্রবার সকালে কাপড় দিয়ে জিহাদ হাওলাদারের মুখ ঢেকে তাকে বারাসাতের আদালতে নিয়ে যায় সিআইডি।
দুপুরে তার ১২ দিনের সিআইডি রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত।
দেহাংশ লোপাটের বীভৎস বর্ণনা
সিআইডির ওই শীর্ষ কর্মকর্তা বৃহস্পতিবার গভীর রাতে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমকে খুনের পরে কীভাবে দেহাংশ লোপাট করা হয়েছিল, তার ভয়ঙ্কর বর্ণনা দিয়েছেন।
গ্রেফতার হওয়া জিহাদ সিআইডির জেরায় স্বীকার করেছেন, আখতারুজ্জামানের নির্দেশে ওই ফ্ল্যাটে তিনি এবং আরো চারজন বাংলাদেশী নাগরিক এমপি আনারকে শ্বাসরোধ করে খুন করে।
সিআইডির ওই কর্মকর্তা বলেন,‘হত্যা করার পরে লাশ থেকে চামড়া ছাড়িয়ে শরীরে মাংস আলাদা করে নেয় তারা। শরীরের মাংস এমনভাবে টুকরো করা হয় যাতে তাকে চেনা না যায়। মাংস-খণ্ডগুলি পলি প্যাকেটে ভরা হয়। হাড়ও ছোট টুকরো করা হয়।’
‘এরপরে ফ্ল্যাট থেকে প্যাকেটগুলি বার করে বিভিন্নভাবে কলকাতার নানা জায়গায় ফেলে দেয়া হয়,’ বলেছেন সিআইডির ওই শীর্ষ কর্মকর্তা।
গ্রেফতার হওয়া জিহাদ হাওলাদারকে শুক্রবার বারাসাত আদালতে তোলা হবে।
পুরো পরিকল্পনার বর্ণনা ঢাকার ডিবি প্রধানের মুখে
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বৃহস্পতিবার দুপুরে মিন্টো রোডে তার কার্যালয়ে এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।
হারুন অর রশীদ সংবাদ সম্মেলনে এ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা কোথায়, কখন, কীভাবে ও কারা সংঘটিত করেছে তার বিস্তারিত বর্ণনা দেন।
তিনি জানান, এ হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড আখতারুজ্জামান বা শাহীন। শাহীন এমপি আজীমের বাল্যবন্ধু।
তার সাথে ব্যবসায়িক বিরোধ কী নিয়ে ছিল, সে বিষয়েও তদন্ত করা হচ্ছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান রশীদ।
তিনি আরো জানান, ২৫ এপ্রিল জিহাদ অথবা জাহিদ এবং সিয়াম কলকাতার সঞ্জীভা গার্ডেনে বাসা ভাড়া করে। এজন্য ৩০ এপ্রিল ঘটনার মাস্টারমাইন্ড কলকাতায় যায়।
হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করবেন উনি ও আরেকজন। সাথে ছিলেন তাদেরই গার্লফ্রেন্ড। তিনজনে মিলে ৩০ এপ্রিল বিমানযোগে কলকাতা চলে যায়। যে বাসা ভাড়া করা হয় সেখানে তারা উঠে। বোঝাতে চায় এখানে পরিবার থাকবে। অপরাধের কোনো কিছু ঘটবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের নথি দিয়ে ফ্ল্যাট ভাড়া
ফ্ল্যাট ভাড়া করার সময়ে স্থানীয় থানায় যে তথ্য জানাতে হয়, সেই নথি বিবিসি বাংলার হাতে এসেছে।
ভারতে বাড়ি বা ফ্ল্যাট ভাড়া দিতে হলে মালিক এবং ভাড়াটিয়া, আর যে দালালের মাধ্যমে ভাড়া নেয়া হচ্ছে, সব পক্ষের ছবিসহ নথি স্থানীয় থানায় জমা দিতে হয়।
মুহম্মদ আখতারুজ্জামান, আমানুল্লা সৈয়দ এবং সেলেস্তি রহমান ওই ফ্ল্যাটে থাকবেন বলে সেটি ভাড়া নেয়া হয়েছিল।
মে মাসের ১ তারিখে নিউ টাউন থানায় এই নথি জমা করা হয়।
তার আগেই গোটা দল কলকাতায় চলে এসেছিল বলে পুলিশ জানতে পেরেছে।
তিনজন থাকবেন বলে থানায় জমা দেয়া নথিতে লেখা থাকলেও ফ্ল্যাটটি সল্ট লেক অঞ্চলের এক দালালের মাধ্যমে ভাড়া নিয়েছিলেন মুহম্মদ আখতারুজ্জামানই।
ভাড়া নেয়ার সময়ে নথি হিসেবে তিনি নিউ ইয়র্কের ড্রাইভিং লাইসেন্সের নম্বরও জমা দিয়েছিলেন। রয়েছে তার ছবিও।
পেশা হিসাবে তিনি সেখানে লিখেছেন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার।
সিআইডির আইজি অখিলেশ চতুর্বেদী জানিয়েছেন,‘ওই ফ্ল্যাটটি সন্দীপ রায় নামের পশ্চিমবঙ্গের শুল্ক বিভাগের এক অফিসারের।’
২ মাস ধরে নজর রাখা হয়
ঘটনার পূর্ব পরিকল্পনা কীভাবে হয়েছে, তা বর্ণনা করতে গিয়ে ঢাকা পুলিশের ডিবি প্রধান রশীদ বলেন,‘তারা দুই মাস যাবত এটাও খেয়াল করছিল ভিকটিম কবে আসা যাওয়া করে। কলকাতা কখন যায়। কারণ তিনি মাঝেমধ্যে কলকাতা যান। এবার ১২ মে সেখানে যান ও বন্ধু গোপালের বাসায় উঠেন। এখান থেকে তারাও সেখানে যায়। আরো দুইজনকে সেখানে ভাড়া করে।’
ডিবি প্রধান হারুন বলেন, কলকাতার এই বাসাতে আসা যাওয়া করবে, এমন দ ‘জনকে ঠিক করে। মাস্টারমাইন্ড সেখানে সব কিছু ঠিক করে, কোন গাড়ি ইউজ হবে, কাকে কত টাকা দিতে হবে। কারা কারা থাকবে সেগুলো সব কিছু ঠিক করে অপরাধ সংঘটিত করতে পাঁচ-ছয়জনকে রেখে ১০ মে দেশে চলে আসে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এমপি আজীম কলকাতায় ১২ মে গিয়ে বন্ধু গোপালের বাসায় ছিলেন। পরদিন হত্যাকাণ্ড যারা ঘটায় তাদের সাথে যোগাযোগ হয় তার।
হারুন বলেন,‘১৩ মে উনার ওই চক্রটার সাথে কথা হয়। প্রথমে ফয়সাল নামের একটা ব্যক্তি সাদা গাড়িতে রিসিভ করে।’
‘সেখান থেকে নিয়ে কিছু দূরে যে মূল হত্যাকাণ্ডটা সংঘটিত করে সে, ফয়সাল ও ইন্ডিয়ান ড্রাইভার ছিল রাজা। সে (রাজা) আসলে কিছুই জানে না, সে ছিল ক্যারিয়ার। সে তাদেরকে নিয়ে ওই বাসায় যায়। ওই বাসায় যাওয়ার পরই মোস্তাফিজ নামে আরেকজন ঢুকে। জিহাদ ও সিয়াম আগেই ওই বাসায় ছিল।’
বিভ্রান্ত করতে এমপির ফোন থেকে মেসেজ
কলকাতায় এসে যে বন্ধুর বাড়িতে উঠেছিলেন আনোয়ারুল আজীম, সেই গোপাল বিশ্বাস আগেই জানিয়েছিলেন যে তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরে এমপির ফোন থেকে একাধিক মেসেজ পেয়েছিলেন তিনি।
সেই মেসেজে কখনো বলা হয়েছিল, তিনি (এমপি) সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরবেন, কখনো জানানো হয় যে তিনি বিশেষ কাজে দিল্লি চলে যাচ্ছেন। আবার দিল্লিতে যে তিনি পৌঁছেছেন আর তার সাথে ‘ভিআইপি’রা আছেন, সেকথাও জানান বন্ধু গোপাল বিশ্বাসকে।
ঢাকার ডিবি প্রধান জানিয়েছেন, ‘টোটাল উদ্দেশ্য ছিল একদিকে লাশ গুম করা, অস্তিত্ব যেন কখনো না পাওয়া যায়। অন্যদিকে তদন্তকারীরা যেন কোনো ডিভাইস খুঁজে না পায়। আবার ইন্ডিয়ান পুলিশের নজর যেন বাংলাদেশে না আসে।’
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা