কারাগারে বিরোধী দলের হাজারো নেতাকর্মীর ঈদ
- অসীম আল ইমরান
- ০৯ এপ্রিল ২০২৪, ১০:৩৮
ঈদ মানেই আনন্দ, ঈদ মানেই খুশি। কিন্তু এবারের ঈদুল ফিতরে ঈদকে সামনে রেখে বিএনপির হাজারো নেতাকর্মীর এই আনন্দের ছেদ পড়েছে। পরিবারগুলোতে ঈদ আনন্দের বদলে বিরাজ করছে হতাশা, দুঃখ, গ্লানি। জেলখানার চার দেয়ালে কাটবে বিএনপির হাজারো নেতাকর্মীর এবারের ঈদ।
ঈদের আগে জামিন প্রত্যাশা করে আবেদন করলেও অনেকেই জামিন মেলেনি। অনেকেই সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ঈদের আগে জামিনের আশায় আত্মসর্মপণ করেছিলেন। কিন্তু তাদের জামিন হয়নি। কেউ কেউ বিভিন্ন মামলায় আগাম জামিন শেষে হাজিরা দিতে গিয়ে গেছেন কারাগারে। এমনকি দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত হয়ে বছরের পর বছর ধরে কারাগারের। কবে তাদের মুক্তি মিলবে জানে না রাজনৈতিক সহকর্মী, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন বা পরিবার। ঈদ আনন্দ আবার কবে ভাগাভাগি করতে পারবেন তারা তাও বলতে পারেন না কারাবন্দী এই নেতারা। এমনকি অনেকের সন্তান জন্ম নিয়ে বড় হলে একবারের জন্য ঈদ করতে পারেনি বাবার সাথে।
বিএনপি সূত্র জানায়, গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ ভণ্ডুল হয়ে যাওয়ার পর রাজপথে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি শুরু করে দলটি। আর এ কর্মসূচি ঘিরে সারাদেশে চলে গণহারে গ্রেফতার অভিযান।
বিএনপির দাবি, ওই সময় দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ প্রায় ২৬ হাজার নেতাকর্মীকে কারাগারে বন্দী করা হয়।
৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বেশিভাগ সিনিয়র নেতা জামিনে মুক্ত হয়েছেন। তবে নতুন করে বেশ কিছু নেতাকর্মীকে গ্রেফতার এবং আদালতে জামিন চাইতে গেলে জামিন নামঞ্জুর করে অনেককেই কারাগারে প্রেরণ করা হচ্ছে, ফলে নতুন পুরনো মিলিয়ে এখন এক হাজার ২০০ থেকে ৩০০ নেতাকর্মী এখন কারাগারে বন্দী রয়েছেন।
এসব নেতাকর্মী ছাড়াও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে একদিকে যেমন সরকারবিরোধী আন্দোলনে সারাদেশ উত্তাল হয়ে পড়ে, তেমনি শুরু হয় নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে পুরোনো মামলার সাজার রায়। প্রায় ১০০ মামলায় দেড় হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে সাজা দেয় আদালত। এর মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, যুগ্ম মহাসচিব থেকে শুরু করে বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতারাও রয়েছেন।
বিএনপির নেতাকর্মীরা জানান, অন্দোলন ও নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে সাজাপ্রাপ্ত নেতাকর্মীর একটি অংশ আদালতে আত্মসমর্পণ করে কারাগারে গেছেন। আবার আন্দোলনকালীন বিএনপির অনেক নেতাকর্মীর পুরনো মামলায় ওয়ারেন্ট ইস্যু হওয়ায় তারাও যান হাজিরা দিতে। এসব নেতাকর্মীর বেশিভাগকেই পাঠানো হয়েছে কারাগারে।
জানা গেছে, সাজাপ্রাপ্ত নেতাকর্মীর মধ্যে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, তথ্য ও গবেষণা-বিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান, ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান, স্বেচ্ছাসেবক দলের দফতর সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মামুন, ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক দলের সহ-সভাপতি মোস্তফা কামাল হৃদয়, সাংগঠনিক সম্পাদক এস এ খোকন, উত্তরা থানার ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেনসহ অনেকে আত্মসমর্পণ করেন।
এছাড়া বিগত দিনের মামলায় হাজিরা দিতে গিয়ে কারাগারে যেতে হয় বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, যশোর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু, জেলা বিএনপির সদস্য মুনির আহমেদ সিদ্দিকী বাচ্চু, সদর উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক, জেলা যুবদল সভাপতি এম তমাল আহমেদ, জেলা ছাত্রদল সভাপতি রাজিউর রহমান সাগর, সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান বাপ্পিসহ ৫১ জন, দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও দিনাজপুর-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আখতারুজ্জামান মিয়া, চিরিরবন্দর উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক নুরে আলম সিদ্দিকী নয়ন, সাভার উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাভার উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান কফিল উদ্দিনসহ অনেকে।
বছরের পর বছর ধরে কারাগারে আছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অব্দুস সালাম পিন্টু, যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরী, প্রকাশনা সম্পাদক হাবিবুল ইসলাম হাবিব, নির্বাহী সদস্য লুৎফুজ্জামান বাবর, ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপির দলীয় প্রার্থী মিয়া নুরুদ্দিন অপু, কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির উপদেষ্টা ও কুমারখালী পৌর বিএনপির আহ্বায়ক হুমায়ুন কবীর, মরহুম মেয়র সাদেক হোসেন খোকার ব্যক্তিগত সহকারী মনির হোসেন।
এসব নেতাদের বাইরে কারাগারে আছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নীরব, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির নেতা ও সাবেক কমিশনার হারুন অর রশীদ, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা আজিজুর রহমান মুসাব্বির, ছাত্রদলের সাবেক সহ সভাপতি ইখতিয়ার রহমান কবির, ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক কাজী জিয়াউদ্দিন বাসিত, ঢাকা কলেজ ছাত্রদল নেতা জামাল হোসেনসহ আরো অনেকে।
কারাগারে থাকা বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের মেয়ে জান্নাতুল ইলমী সূচনা বলেন, ‘আমার বাবার বিরুদ্ধে ৪৯০টির বেশি মিথ্যা মামলা, তিনি কারাগারে আছেন। রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম হয়েছে বলেই আমরা ধরে নিয়েছি বাবা কখনো কারাগারে থাকবেন, আবার কখনো বাসায় থাকবেন। ১২ মাসের মধ্যে ছয় মাস পলাতক থাকছেন। কোনো বিশেষ দিন নেই আমাদের। ঈদ আসছে কিন্তু আমাদের মনে কোনো ঈদ নেই।’
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘এই সরকারের আমলে কবরে শায়িত ব্যক্তি, কোলের বাচ্চা, বিদেশে অবস্থানকারী মানুষ, কারাবন্দী লোককে নাশকতা, ককটেল বিস্ফোরণ, সরকারি কাজে বাধা দেয়া ইত্যাদি গায়েবি মামলায় জড়িত করার অগণিত উদাহরণ রয়েছে। তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত কেউই এই গায়েবি মামলা ও সরকারি নির্যাতন-নিপীড়ণ থেকে রেহাই পায়নি। দেশ যেন এখন কাঁটাতারের বেড়াঘেরা এক অবরুদ্ধ জনপদ।’
রিজভী বলেন, ‘সরকারের সাজানো মিথ্যা মামলায় জর্জরিত বিএনপির তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত প্রায় সকল নেতাকর্মী। কারো কারো বিরুদ্ধে ৪০০ থেকে ৫০০ মামলাও রয়েছে। একদিকে মামলার চাপ আরেক দিকে ব্যবসা বাণিজ্যসহ সব হারিয়ে অনেকটা নিঃস্ব হয়ে পড়েছে বিএনপির অনেক নেতাকর্মীরা। এছাড়াও এখনো কারবান্দী রয়েছেন এমন নেতাকর্মীর সংখ্যাও কম নয়। কারাগারের চার দেয়ালের মধ্যে এবারো ঈদ করতে হচ্ছে দলটির অজস্র নেতাকর্মীকে। অবৈধ ও ডামি নির্বাচনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে রাজনৈতিক মামলায় বন্দী এসব নেতাকর্মী।’
তিনি আরো বলেন, ‘দলের কারাবন্দী নেতাকর্মীদের পরিবারের পাশে আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে ঈদ উপহার পৌঁছে দেয়া হয়েছে। এছাড়া বিএনপিসহ অঙ্গসংগঠনগুলো নিজ নিজ জায়গা থেকে সাধ্যমত ঈদ উপহার দিয়ে যাচ্ছে।’