১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

চামড়াজাত পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে

চামড়াজাত পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে - ফাইল ছবি

চামড়া দেশের গুরুত্বপূর্ণ রফতানি পণ্য। পোশাক শিল্পের পরই চামড়ার স্থান। আশির দশক থেকেই এই শিল্পের নানা সমস্যার কথা বলা হলেও একে একটি সুষ্ঠু কাঠামোর মধ্যে আনা যায়নি। পোশাক খাতের প্রতি নজর বেশি থাকায় তা অনেক দূর এগিয়েছে। চামড়া শিল্পে রফতানির সম্ভাবনা ধরে রাখতে হলে আমদানিযোগ্য কাঁচামাল, শুল্ক ব্যবস্থাপনা, পণ্য ছাড় করা ও ব্যবসা সহজীকরণ নিশ্চিত করা উচিত। দেশে শিল্প বিকাশে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বড় ভূমিকা রাখতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রা আহরণে ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে চামড়া শিল্পের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে বাস্তব পরিকল্পনার অভাব এবং আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত না করার কারণে এ শিল্পের বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে আছে। তবে আশার আলো হলো, শিল্প মন্ত্রণালয় দেশের চামড়া শিল্প ব্যবস্থাপনায় ‘বাংলাদেশ চামড়া শিল্প ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ আইন ২০২৪’ শীর্ষক যে খসড়া আইন প্রণয়ন করা হয়েছে তার বাস্তবায়নে এ শিল্পের বিকাশে ভূমিকা পালন করতে আশা করি সহায়ক হবে।

চামড়ার ওপর নির্ভর করে দেশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রায় ৯ লাখ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। এই শিল্পকে কেন্দ্র করে দেশে গড়ে উঠেছে ২৩০টিরও বেশি ট্যানারি। গত কয়েক বছর ধরে স্থানীয় বাজারে কাঁচা চামড়ার দাম কম। কোরবানির সময় পানির চেয়েও কম দামে চামড়া বিক্রি হয়। আবার সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করার কারণে ও উপযুক্ত দাম না পাওয়ায় অতীতে চামড়া নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছে, মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে। এ ধরনের খবর খুবই উদ্বেগজনক।

চামড়ার মতো এত গুরুত্বপূর্ণ খাত দেখার কি কেউ নেই! প্রতিবেশী ভারতে বাংলাদেশী চামড়ার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। দামও বেশি। কারণ বাংলাদেশী চামড়ার মান ভালো। সুযোগ নিয়ে কিছু পাচারকারী প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রতি বছর চামড়া পাচার করে যাচ্ছে। দেশীয় বাজারে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের কারখানা প্রতিষ্ঠা, চাহিদা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করলে চামড়া পাচার রোধ করা সম্ভব। এই সঙ্কট উত্তরণের জন্য সরকারকেই পদক্ষেপ নিতে হবে।

ঢাকার হাজারীবাগ থেকে চামড়া শিল্পনগরী স্থানান্তরের জন্য ২০০৩ সালে একটি প্রকল্প নেয় সরকার। সে অনুযায়ী ২০০ একর জমি নিয়ে সাভারের হেমায়েতপুরের হরিণধরায় গড়ে ওঠে চামড়া শিল্পনগরী। বুড়িগঙ্গা নদী বাঁচাতে ঢাকার হাজারীবাগ থেকে ২০১৭ সালে চামড়া শিল্প সাভারে স্থানান্তর করা হয়। বর্তমানে সাভারে ১৪১টি ট্যানারি রয়েছে। যেখানে ৫৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) তৈরি করা হয়। কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার পুরোপুরি প্রস্তুত না হওয়ায় এলডব্লিউজি সনদ অর্জনও সম্ভব হচ্ছে না। মূলত এলডব্লিউজি সনদ না থাকায় দেশের চামড়া শিল্পের অগ্রগতি হচ্ছে না। এ খাতের উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এলডব্লিউজি সনদ অর্জনে যেসব মানদণ্ড রয়েছে তা পূরণে জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে সরকারকে।

চামড়া খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, হেমায়েতপুরের চামড়া শিল্প নগরের দূষণ বন্ধ না হওয়ায় ইউরোপ-আমেরিকার বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি বাংলাদেশী চামড়া কিনছে না। ফলে বাংলাদেশী চামড়ার বড় ক্রেতা বর্তমানে চীন। তারা কম দাম দেয়। সেটির প্রভাব কাঁচা চামড়ার দামেও পড়ছে। বাংলাদেশ থেকে চীনে যে শতকরা ৮০ ভাগ লেদার যাচ্ছে, তা মূলত ক্রাস্ট লেদার। সেগুলোকে বিভিন্নভাবে প্রক্রিয়াজাত করে ফিনিশড লেদারে পরিণত করে বিভিন্ন দেশে রফতানি করছে চীন। অথচ বাংলাদেশ নিজেই যদি আধুনিক ট্যানারি শিল্প গড়ে তোলার মাধ্যমে ফিনিশড লেদার রফতানি করতে পারত, তাহলে আরো বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারত।

এ শিল্পনগরীর উন্নয়নে অবকাঠামো আধুনিকীকরণ করতে হবে। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনকে (বিসিক) চামড়া শিল্প নগরীর সমস্যা সমাধানে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া উচিত। বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ অর্জনের মানে পৌঁছতে হবে। এই সনদ না পাওয়ায় ইউরোপ আমেরিকার নামকরা আমদানিকারকদের ভালো ক্রেতাদের কাছে সরাসরি চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বিক্রি করা যাচ্ছে না। ফলে এ খাতের রফতানি এখনো কাক্সিক্ষত মানে পৌঁছেনি।

হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সাভারে সরিয়ে নেয়া হলেও অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। কমপ্লায়েন্সের অভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে দেশীয় চামড়ার দাম কমেছে। আবার ট্যানারির শ্রমিকরাও ন্যূনতম মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। শ্রমিকদের আবাসন ও চিকিৎসাসহ জীবনযাপনের মৌলিক চাহিদা পূরণের যথাযথ ব্যবস্থা নেই। ট্যানারিগুলোয় স্থায়ী ও অস্থায়ী দুই ধরনের শ্রমিক কাজ করেন। তাদের জীবন অনেকটা দুর্বিষহ। মজুরি বোর্ডের নির্ধারিত গ্রেড নয়, অভিজ্ঞতার আলোকে তাদের বেতন নির্ধারিত হলেও ওভারটাইম ও ছুটি সুবিধা সীমিত। সন্তানদের শিক্ষা, চিকিৎসার ব্যবস্থাও ঠিকমতো করতে পারেন না তারা। তাই শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

বাংলাদেশে জুতার বাজারেও চামড়া শিল্পের বিরাট অবদান রয়েছে। চামড়া ও চামড়াবিহীন প্রধানত দুই ধরনের জুতা তৈরি হয় দেশে। এতে আমাদের স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে কিছু পণ্য বিদেশেও রফতানি হয়। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে জানা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রফতানি হয়েছিল ৭৮ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াবিহীন জুতা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রফতানি হয় প্রায় ৮১ কোটি ডলারের, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রায় ৮৮ কোটি ডলারের এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৭৫ কোটি ডলারের বেশি জুতা রফতানি হয়।

লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এলএফএমইএবি) সূত্রে জানা যায়, বিশ্বে জুতার মোট বাজারের ৫৫ শতাংশ চীনের দখলে। এতে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮ তে। তবে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের এ খাতে অবদান মাত্র ১ দশমিক ৭ শতাংশ। বর্তমানে প্রায় ৯০টি দেশে বাংলাদেশের জুতা রফতানি হচ্ছে। সাভারের শিল্পনগরীকে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী তৈরি করে পরিবেশবান্ধব করা ও সিইটিপির আধুনিকীকরণ করা জরুরি। একই সাথে বিশ্ববাজারের সাথে মিলিয়ে মূল্য প্রতিযোগিতামূলক করা দরকার।

বাংলাদেশের পশুর চামড়ার মান ভালো, সরবরাহও বেশি হওয়ার পরও আন্তর্জাতিক মানের ব্যবস্থাপনা না থাকায় বিপুল সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ২৪০ বিলিয়ন ডলারের চামড়ার বাজার আছে। ইউরোপ আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জুতা, ট্রাভেল ব্যাগ, লেডিস ব্যাগ, বেল্ট, ওয়ালেট, পার্টস, ওয়ার্কিং হ্যান্ড গ্লাভস প্রভৃতি। বর্তমানে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানি এক বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, করোনা বা তার কাছাকাছি সময়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে সামগ্রিক রফতানি আয় ৩৪.৩৮ শতাংশ বেড়েছিল। এতে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে ১২৫ কোটি ডলার আয় হয়েছে। এ খাতে রফতানি বেশ কয়েক বছর পর শত কোটির ঘরে পৌঁছেছে।

পরিবেশ দূষণজনিত কারণে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের পর থেকে এই খাতের রফতানি কমতে থাকে। টানা দুই বছর শত কোটি ডলারের নিচে রফতানি থাকার পর অর্থবছর (২০২১-২২) এই খাতটি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল। ২০২১-২২ অর্থবছরটি শেষ হয়েছে ৫২ বিলিয়ন বা পাঁচ হাজার ২০০ কোটি ডলারের রফতানি আয় দিয়ে। আগের অর্থবছরের তুলনায় অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া রফতানি খাতের এই ধারা ধরে রাখা যাবে কি না সেটি এখন প্রশ্ন। এ জন্য আমাদের রফতানিযোগ্য পণ্যের গুণগত মান বাড়াতে হবে। লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের সনদ নিতে হবে। দেশের পরিবেশ অধিদফতরের নির্ধারিত মানদণ্ড অর্জন করতে হবে।

চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনে শতভাগ কাঁচামাল আমাদের দেশে আছে। তার পরও এই শিল্পের বিকাশ কাক্সিক্ষত মানে হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এবং সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। না হলে এই শিল্পের সম্ভাবনা বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। কিছু উন্নত দেশ চামড়ার অভাবে তাদের ট্যানারি বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু সেসব দেশে চামড়াজাত পণ্য তৈরির কারখানা যথারীতি চালু আছে। ফলে সেসব দেশে শিল্পের কাঁচামাল বা ফিনিশড লেদারের চাহিদা রয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগালে আমাদের রফতানি আয় বাড়বে।
চামড়াবিহীন জুতা রফতানিতে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে আমাদের দেশে। আমাদের দেশের মোট রফতানি আয়ের বড় অংশ আসে এ খাত থেকে। তবে চামড়াবিহীন জুতা থেকেও ব্যাপক পরিমাণ রফতানি সম্ভব। ইউরোপ-আমেরিকার বাইরে আফ্রিকায় চামড়াবিহীন জুতার ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে জুতার বাজার ভারত ও চীনের দখলে। ফলে আমাদের সামনে অবারিত সুযোগ।

চামড়াবিহীন জুতার বাজার ধরতে হলে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতে হবে। শ্রমিকদের দক্ষতা প্রতিনিয়ত বাড়াতে হবে।

বিশ্ববাজারের ক্রেতারা এখন বহুমুখী উৎস থেকে চামড়া সংগ্রহ করছেন। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারে। এ জন্য চামড়া শিল্পকে আরো প্রতিযোগিতার সামর্থ্য অর্জন করতে হবে। বিশেষ করে সাভারের শিল্পনগরীর কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারকে আরো বেশি কার্যকর করতে হবে। পরিবেশবান্ধব শিল্পনগরী হিসেবে এর উত্তরণ ঘটাতে হবে। এ শিল্পের রফতানি বাড়াতে হলে পরিবেশসম্মত ট্যানারি স্থাপনের বিকল্প নেই। রফতানিকে আরো গতিশীল করার জন্য পরিবেশবান্ধব বর্জ্য শোধনাগার ও তার বর্জ্য ধারণক্ষমতা বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের রফতানি আয়ের ৮৫ শতাংশই আসে তৈরী পোশাক খাত থেকে। এর বাইরে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় দেশে আসে এমন শিল্পের মধ্যে চামড়া শিল্প অন্যতম। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য থেকে জানা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১১ মাসে (জুলাই-মে ) চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি থেকে ৯৬ কোটি ১৫ লাখ ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ।

এটি আগের অর্থ বছরের চেয়ে ১৪ দমমিক ১৭ শতাংশ কম। ২০২২ -২৩ অর্থবছরে জুলাই-মে সময়ে এখান থেকে রফতানি হয়েছে ১১২ কোটি ডলার, যা ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় ১.৭৪ শতাংশ কম। অর্থাৎ এ খাত থেকে ক্রমান্বয়ে রফতানি আয় কমে যাচ্ছে। এটি এই গুরুত্বপূর্ণ খাতকে অবহেলা বা অবজ্ঞারই প্রতিফলন। এ শিল্প নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা আলোচনা পর্যালোচনা ও পরিকল্পনা হলেও তাতে বাস্তবধর্মী কোনো পদক্ষেপ ও বাস্তবায়ন না হওয়ায় কাক্সিক্ষত ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু পোশাক শিল্পের ওপর ভর করে দেশের রফতানি আয় বাড়ানোর চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সম্ভাবনাময় এই খাত এগিয়ে নিতে বাস্তবধর্মী কার্যকরী পদক্ষেপ এখনই নেয়া দরকার।

ই-মেল : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement