কৃষি উন্নয়নে ইসলামী ব্যাংকের ভূমিকা
- সিরাজুল ইসলাম
- ১৩ জুন ২০২৪, ০৬:৪২
সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বাংলাদেশ। এই দেশের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- এটি একটি কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষি বাংলাদেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি, যা আবহমান কাল ধরে বাংলার গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। সাধারণ মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নে এখনো কৃষির কোনো বিকল্প নেই। আর দেশের জিডিপিতে কৃষির অবদান ১১.৩৮ শতাংশ। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে যেমন- কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্যদূরীকরণ, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং খাদ্য নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় কৃষি খাতের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
বাংলাদেশের জনগণের একটা বিশাল অংশ জীবনধারণের জন্য কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এ বিষয়টি মাথায় রেখে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ দেশের কৃষি খাতের উন্নয়নে হাতে নিয়েছে নানামুখী কর্মসূচি। বিগত পাঁচ বছরে কৃষিতে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগসহ আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে চাষাবাদের জন্য হাতে-কলমে আড়াই লক্ষাধিক কৃষককে প্রশিক্ষণ দিয়েছে এ ব্যাংক। কৃষিপণ্য উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, কৃষিসহায়ক শিল্প স্থাপন ও গুদামজাতকরণের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিনিয়োগ করছে নিয়মিত। সহায়ক বিনিয়োগ হিসেবে কৃষি যন্ত্রপাতি বিনিয়োগ প্রকল্প, পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে। কৃষিকে বাণিজ্যিক ভিত্তি প্রদানের লক্ষ্যে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ বা করপোরেট উদ্যোক্তাপর্যায়ে বিনিয়োগ সুবিধাসহ অঞ্চলভিত্তিক বহুল পরিচিত ও উচ্চফলনশীল ফসল উৎপাদনে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকের ভূমিকা অত্যন্ত ইতিবাচক।
এ ছাড়া সরকারের অগ্রাধিকার খাত তথা ডাল, তৈলবীজ, মসলা ও ভুট্টা চাষে রেয়াতি মুনাফা হারে বিনিয়োগ করে আসছে ইসলামী ব্যাংক। এ খাতে বিনিয়োগ যেমন বেড়েছে তেমন সফলতাও এসেছে অভূতপূর্ব। কৃষি খাতে ইসলামী ব্যাংকের এই অভূতপূর্ব সাফল্যের পেছনে রয়েছে ইসলামী ব্যাংকের উদ্যোক্তা ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, দক্ষ জনবল ও নিবিড় মনিটরিং।
শুধু তাই নয়, ইসলামী ব্যাংক কৃষি খাতে করোনাকালীন সরকারি প্রণোদনা স্কিমের বিনিয়োগ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করায় বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বীকৃতি অর্জন করেছে।
আরেকটি তথ্য এখানে উল্লেখ করা যায়। একটি সময় ছিল যখন সামান্য কিছু টাকা কৃষিঋণ পেতে কৃষককে অনেক বেগ পেতে হতো; কিন্তু এখন সেই অবস্থার অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। কৃষিঋণ সহজীকরণে ইসলামী ব্যাংকের অবদানও অনস্বীকার্য। কৃষকদের জন্য কৃষিঋণের বিষয়ে নানা তথ্য জানাতে ইসলামী ব্যাংক বিভিন্ন সময়ে সরকার আয়োজিত কৃষিমেলায় অংশগ্রহণ করে আসছে। এসব মেলার মাধ্যমে কৃষিপণ্য ও কৃষি শিল্পের বিনিয়োগ গ্রহণে আগ্রহীদের প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করা হয়।
ইসলামী ব্যাংকের এসব কর্মসূচির মাধ্যমে বিনিয়োগ পাবার বিষয়টি একদম কৃষকের দোরগোড়ায় নিয়ে গেছে ইসলামী ব্যাংক। প্রান্তিক কৃষক থেকে শুরু করে সবধরনের কৃষকদের বিনিয়োগ সুবিধা দিচ্ছে এই ব্যাংক। এ বিষয়ে তাদের নিজস্ব নীতমালাও রয়েছে। একটি তথ্য থেকে জানা যায়, ইসলামী ব্যাংকের পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে ১৮ হাজার গ্রামে সাত লাখ নারীকে বিনিয়োগ সুবিধা দেয়া হচ্ছে। খাদ্য ও কৃষিনির্ভর শিল্পেও বিনিয়োগ সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে।
গ্রামের বেকার যুবকদের আত্মকর্মসংস্থানসহ কয়েকটি লক্ষ্য নিয়ে কৃষি সরঞ্জাম বিনিয়োগ প্রকল্প পরিচালনা করে ইসলামী ব্যাংক। এই প্রকল্পের মাধ্যমে বেকার যুবক ও কৃষকরা বিনিয়োগ সুবিধা লাভের জন্য আবেদন করতে পারেন। জামানতের বিপরীতে সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা বিনিয়োগ করে ব্যাংকটি।
দেশী ফলের নতুন বাগান সৃষ্টিতে এবং বিদ্যমান বাগানের পরিচর্যার জন্য ‘ফল বাগান বিনিয়োগ প্রকল্প (ফলবীথি)’ নামে একটি বিনিয়োগ স্কিম চালু রয়েছে। দেশের মানুষের পুষ্টিচাহিদা পূরণে স্কিমটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এই স্কিমের আওতায় একজন গ্রাহক ৫০ হাজার থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ সুবিধা ভোগ করে থাকেন। ব্যাংক বাই-মুয়াজ্জাল পদ্ধতিতে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর এবং বাই-সালাম পদ্ধতিতে এক বছরের জন্য বিনিয়োগ করে থাকে।
ইসলামী ব্যাংক পল্লী অঞ্চলের অসহায় ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে বিনিয়োগ প্রদান করে তাদের স্বাবলম্বী করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বর্তমানে ব্যাংকের পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প দেশের ২২ হাজার গ্রামে বিস্তৃত যার সদস্য সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১১ লাখ। আন্তরিক সেবার পাশাপাশি গণমুখী প্রকল্প ও কর্মসূচি গ্রহণের কারণে ইসলামী ব্যাংক দেশের শীর্ষ ব্যাংক এবং বিশ্বের সেরা এক হাজার ব্যাংকের তালিকায় স্থান লাভ করেছে।
পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় সংশ্লিষ্ট এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা, শেয়ার ক্রপার, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক, সরাসরি কৃষি বা আয় সৃষ্টিকারী কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত ব্যক্তি যিনি খেলাপি গ্রাহক নন এবং সংশ্লিষ্ট সেক্টর সম্পর্কে অভিজ্ঞতা আছে তাদেরকে বিনিয়োগ দেয়া হয়। এখানে তিনটি মূল খাত হলো শস্য, মৎস্য ও পশুসম্পদ। এসব খাতে বিনিয়োগ দেয়া হয় ছয় মাস থেকে পাঁচ বছরের জন্য। গ্রাহক তার সুবিধামতো বিনিয়োগ নিতে পারেন। এ ধরনের বিনিয়োগে সংশ্লিষ্ট গ্রাহককে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত হারে মুনাফা দিতে হয়। পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় একজন গ্রাহক বিনিয়োগ নিতে পারেন ৫০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত। এক লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগে ব্যক্তিগত গ্যারান্টি যথেষ্ট। তবে বিনিয়োগ এক লাখ টাকার বেশি হলে সহায়ক জামানত প্রয়োজন হয়।
ব্যাংক ফসল উৎপাদনের জন্য একজন কৃষককে সর্বোচ্চ ১৫ বিঘা (৫ একর বা ২ হেক্টর) জমি চাষাবাদের জন্য নিয়মাচারে নির্ধারিত হারে বিনিয়োগ প্রদান করে। কৃষিক্ষেত্রে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে উল্লিখিত পরিমাণের চেয়ে বৃহৎ আকারের জমিতে কৃষি বিনিয়োগের আবেদন নিয়মাচারের নির্ধারিত হারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিনিয়োগ প্রদান করা হয়ে থকে। কৃষির অন্যান্য খাতসমূহে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ সীমার কোনো নির্ধারিত সীমারেখা নেই।
কৃষির উন্নয়নে ইসলামী ব্যাংকের আরেকটি বিনিয়োগ খাত রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমরা দেশের কৃষিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাবে। কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণ করাও দরকার। যাতে আমাদের কৃষকরা আরো অধিক পরিমাণ খাদ্যোৎপাদন করতে পারেন। যান্ত্রিকীকরণের জন্য হারভেস্টার থেকে শুরু করে সব ধরনের যন্ত্র ধীরে ধীরে কৃষকের হাতে পৌঁছে দিতে হবে।’
এই আহ্বান সামনে রেখে ইসলামী ব্যাংক শিক্ষিত/অশিক্ষিত কৃষক এবং শিক্ষিত বা স্বল্প শিক্ষিত যুবক কৃষক এবং কৃষির সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের মাঝে পাওয়ারটিলার, পাওয়ার পাম্প, গভীর নলকূপ, শ্যালো টিউব-ওয়েল, থ্রেশার মেশিন, কম্বাইন্ড হারভেস্টার, ট্রাক্টর, রাইস ট্রান্স-প্লান্টার, ইউএসজি মেকিং মেশিন, ড্রাম সিডার, উইডার, অ্যাগ্রো প্রসেসিং মেশিনারি এবং অনুরূপ অন্য যেকোনো মেশিনারি সরঞ্জামাদি সরবরাহের জন্য অর্থ বিনিয়োগ করছে। বিনিয়োগের সময়কাল বাই-মুয়াজ্জাল পদ্ধতিতে সর্বোচ্চ এক বছর এবং এইচপিএসএম পদ্ধতিতে সর্বোচ্চ তিন বছর। এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা। এই বিনিয়োগ অনেকটা অংশগ্রহণভিত্তিক। মোট বিনিয়োগে ব্যাংকের অংশগ্রহণ থাকবে শতকরা ৮০ ভাগ আর গ্রাহকের ২০ ভাগ।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশে পিএলসি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) কৃষি খাতের উন্নয়নে ৬৮১ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। দেশের কৃষি খাতের উন্নয়নের জন্য বিশেষায়িত কৃষি ব্যাংক সবচেয়ে বেশি এক হাজার ৫২৭ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করেছে। এর পরেই রয়েছে ইসলামী ব্যাংকের অবস্থান।
শস্য উৎপাদন, মৎস্য চাষ ও গবাদিপশু পালন, সেচ উপকরণ, কৃষিযন্ত্রপাতি এবং ফল চাষ- এসব খাতকে গুরুত্ব দিয়ে কৃষি বিনিয়োগ পরিচালনা করছে ব্যাংকটি।
আমাদের দেশের ছিটমহল এলাকাগুলোতে রয়েছে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর বসবাস। তাদের আর্থিক উন্নয়নের লক্ষ্যেও কাজ করছে ইসলামী ব্যাংক। পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার দহলা খাগড়াবাড়ি, লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপেজলার পাথরডুবি ও শিলকুড়ি এবং কুড়িগ্রাম জেলার ভুরুঙ্গামারী উপজেলার বাঁশকাটা ও পানবাড়ি ছিটমহলের গ্রাহকদের মধ্যে বিনিয়োগ বিতরণের কাজ করছে ইসলামী ব্যাংক। ব্যবসায়িক ভিত্তিতে কৃষি খামার স্থাপন, খামার যান্ত্রিকীকরণ ও সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কার্যকর পদক্ষেপে আমাদের কৃষি একটি টেকসই ও সমৃদ্ধ অবস্থানে যেতে পারে। এমন লক্ষ্য অর্জনের জন্য ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি প্রতি অর্থবছরে বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দিয়ে বিশাল অবদান রাখছে। এতে যেমন কৃষি, কৃষক ও শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষিত হবে তেমনি দেশের অর্থনীতির চাকা হবে আরো গতিশীল। পরিণামে এই গাঙ্গেয় ব-দ্বীপে গড়ে উঠবে সমৃদ্ধ সোনার বাংলা।
লেখক : সাংবাদিক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা