১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

চালাও গুলি

চালাও গুলি - নয়া দিগন্ত

এটি এক বীর নারীর প্রতিবাদের কাহিনী। এ প্রতিবাদ দখলদার বাহিনীর এক দাম্ভিক ও ধূর্ত জেনারেলকে ক্ষোভে উন্মাদ করে দেয়। জেনারেল ওই নারীকে তার পক্ষে গুপ্তচর বানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ওই নারী গুপ্তচর হতে অস্বীকৃতি জানান। এ অস্বীকৃতি শুনে ক্ষমতার নেশায় ডুবে থাকা জেনারেল ওই নারীকে বিশ্বাসঘাতক অভিহিত করেন এবং তাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। তাৎক্ষণিকভাবে শেকল দিয়ে শক্ত করে বাঁধা ওই নারীকে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়। জেনারেলের ধারণা ছিল, নিজের বুকের দিকে বন্দুকের তাক দেখে ওই নারী ঘাবড়ে যাবেন এবং দয়া ভিক্ষা করবেন। কিন্তু ওই নারী বন্দুকধারীদের লক্ষ করে উচ্চ আওয়াজে চিৎকার করে বলেন, ‘চালাও গুলি’।

এ কথা শুনে জেনারেল ফায়ারের নির্দেশ দেন এবং কয়েকটি গুলি ওই নারীর বুকে বিদ্ধ হয়। ওই নারীর নাম আজিজুন নেসা। যিনি ১৮৫৭ সালের আজাদীর লড়াইয়ের অংশ হিসেবে দখলদার ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহে এক যোদ্ধা হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। ব্রিটিশ বাহিনীর অফিসার মেজর জেনারেল হেনরি হ্যাভলক কানপুর বিজয় করলে পুরুষ সিপাহীর পোশাক পরিহিতাবস্থায় গ্রেফতার হওয়া আজিজুন নেসাকে তার সামনে আনা হয়। তাকে বলা হলো, এ হচ্ছে কানপুরের বিখ্যাত বাইজি (তয়ফা) আজিজুন নেসা, যিনি রাতে ঘুঙ্গুর পরে আমাদের অফিসারদের সামনে নাচেন এবং তাদের গোপন তথ্য চুরি করে বিদ্রোহীদের কাছে পৌঁছে দেন। এরপর দিনের বেলায় তরবারি হাতে নিয়ে ব্রিটিশ বাহিনীর ওপর হামলা করেন। হ্যাভলক বেশ অবাক হন যে, কানপুরে আজিজুন বাই নামে পরিচিত এই ২৫ বছর বয়সী বাইজি শুধু তরবারি ও বন্দুক চালাতেই জানতেন না, তিনি ঘোড়দৌড়েও পারদর্শী ছিলেন। তার ধারণা ছিল, এই নর্তকীকে দণ্ড মওকুফের বিনিময়ে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে।

কিন্তু আজিজুন বাইয়ের ভেতর বিদ্যমান থাকা আজিজুন নেসা তার বিবেক বিক্রি করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন। নির্মম পরিহাস হচ্ছে, ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের এ নারী যোদ্ধাকে অনেক মানুষই জানেন না। তবে তাকে গুলি করার নির্দেশদাতা ব্রিটিশ অফিসার মেজর জেনারেল হেনরি হ্যাভলকের ভাস্কর্য আজো লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে দাঁড়িয়ে আছে এবং লক্ষেèৗর আলমবাগে তার কবরও বিদ্যমান। ব্রিটিশ সরকার তাকে মনে রেখেছে। কেননা, হ্যাভলক ১৮৩৯ সালে প্রথম ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি কাবুল ও গজনিতে বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করেছিলেন। ১৮৫৭ সালে তিনি কানপুর ও লাক্ষেèৗতে বিজয়ী হয়ে প্রবেশ করেন। তবে এ ব্রিটিশ জেনারেল আজিজুন নেসাকে জয় করতে পারেননি। আজিজুন নেসার কাহিনী আপনাদের এ জন্য শোনাচ্ছি যে, কয়েক বছর আগে পাকিস্তানি ফিল্ম মেকার কামাল খান এ বীর নারীকে নিয়ে ফিল্ম নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কামাল খান ‘লাল কবুতর’ নামে ফিল্ম বানিয়ে খ্যাতি অর্জন করেছেন। এখন তিনি আজিজুন নেসাসহ লাক্ষেèৗ ও কানপুরের সেই বাইজিদের ওপর ফিল্ম বানাতে চাচ্ছেন, যারা ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। কামাল খান আজিজুন নেসার ওপর তার গবেষণাকর্ম সম্পন্ন করেন এবং স্ক্রিপ্টের ওপর কাজ শুরু করে দেন। তবে লাহোরের এক স্ক্রিপ্ট রাইটার নারী হঠাৎ গায়েব হয়ে যান। আর এভাবেই এ ফিল্মের পরিকল্পনা স্থগিত হয়ে যায়।

সম্প্রতি ভারতীয় ফিল্ম মেকার সঞ্জয় লীলা বানসালির আট পর্বের ড্রামা ‘হিরামন্ডি’ রিলিজ হয়। ওই ড্রামায় কানপুরের আজিজুন নেসার চরিত্র তো আছে, তবে সেখানে তার নাম, ঠিকানা ও সময় বদলে দেয়া হয়েছে। কারণ তো কিছু একটা আছে, তবে কোনো ঐতিহাসিক চরিত্রের সাথে এ ধরনের অন্যায্য আচরণকে চিন্তাগত অসততা অভিহিত করা হয়। এ অধম ‘নয়া হিরামন্ডি’ নামে (দৈনিক নয়া দিগন্তে ২৫ মে, ২০২৪ প্রকাশিত) কলামে আজিজুন নেসার ভাসাভাসা আলোচনা করেছে। বহু সুহৃদ তার সম্পর্কে আরো বেশি জানতে চেয়েছেন।

আজিজুন নেসা বিদ্রোহী বাহিনীর অন্যতম যোদ্ধা সুবেদার শামসুদ্দিনের খুব কাছের মানুষ ছিলেন। তিনিই আজিজুন নেসাকে তরবারি ও বন্দুক চালানো শিখিয়েছেন। আজিজুন নেসার মা হাসান বানু গওহার লক্ষেèৗর এক ছাউনিবাসী বাইজি ছিলেন। তিনি তার মেয়েকে উচ্চ শিক্ষা দান করেন। মা তাকে আজিজুন বাই বানান। কিন্তু শিক্ষা তার ভেতরের আজিজুন নেসাকে জীবিত রাখে। তিনি কোনো নবাবের বেতনভুক্ত রক্ষিতা হওয়ার পরিবর্তে লক্ষ্ণৌ ছেড়ে চলে যান এবং কানপুরে শুধু গানের আসরের বৈঠক সাজান। ইতিহাস ও সাহিত্য অধ্যয়ন আজিজুন নেসার মধ্যে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। তিনি শামসুদ্দিনের সাথে পলাশীর যুদ্ধ ও টিপু সুলতানের শাহাদত নিয়ে কথা বলতেন। শামসুদ্দিনের কারণে তার বৈঠক রাতের নাচগানের পর বিদ্রোহীদের ঠিকানায় পরিণত হতো। বহু ব্রিটিশ ঐতিহাসিক তাদের গ্রন্থে আজিজুন নেসার নাম উল্লেখ করেছেন, কিন্তু উপমহাদেশের অধিকাংশ ঐতিহাসিক এ বীর নারীকে উপেক্ষা করেছেন। হিন্দুস্তানের শেষ মোগল বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফরের বিরুদ্ধে ১৮৫৭ সালের ২৭ জানুয়ারি থেকে নিয়ে ৯ মার্চ পর্যন্ত লেফট্যানেন্ট কর্নেল ডেভিসের সামরিক আদালতে চলা মামলার বিস্তারিত তথ্য তো বিদ্যমান আছে, কিন্তু ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদের ফতোয়া প্রদানকারী আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদীসহ অপর আলেমদের কথা আমাদের পাঠ্যপুস্তকে পাওয়া যায় না। আর আজিজুন নেসার কথা তো আমাদের ইতিহাসের গ্রন্থগুলোতেও পাওয়া যায় না। ভারতের বিখ্যাত নাট্যরচয়িতা ত্রিপুরারি শর্মা ‘সন সাতাওন কা কিসসা... আজিজুন’ নামে একটি নাটক লিখেছিলেন। এটি গ্রন্থাকারেও প্রকাশ হয়েছিল। কিন্তু কোনো ভারতীয় ফিল্মমেকার এই আজিজুন নেসার ঐতিহাসিক চরিত্র সামনে আনার চেষ্টা করেননি, যিনি মেজর জেনারেল হেনরি হ্যাভলকের ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে ‘চালাও গুলি’ বলে চিৎকার করেছিলেন। নির্মম পরিহাস দেখুন, আজিজুন নেসার কারণে ১৮৫৭ সালের পর ব্রিটিশ সরকার লক্ষ্ণৌ থেকে নিয়ে লাহোর পর্যন্ত সব বাইজির ওপর বহু ধরনের আইনি ধারা আরোপ করে। তাদের ওপর লাইসেন্স ও ট্যাক্স আদায় আবশ্যক করে দেয়া হয়। ২৫ আগস্ট, ১৯২২ সালে লাহোর মিউনিসিপ্যাল কমিটি এক নির্দেশনামার আওতায় লাহোর হিরামন্ডির বাইজিদের কিছু এলাকা থেকে বের করে দেয়।

অপর দিকে বহু দেশবিক্রেতা নবাব ও জায়গিরদারদের ওপর দয়ার বৃষ্টি বর্ষিয়ে দেয়। আপনারা আকিল আব্বাস জাফরির ‘পাকিস্তান কে সিয়াসি ওডিরে’ (পাকিস্তানের রাজনৈতিক জায়গিরদার) বা ওয়াকিল আনজুমের ‘সিয়াসত কে ফেরআইন’ (রাজনীতির ফেরাউন) গ্রন্থ পড়ে নিন। আপনারা জানতে পারবেন, আজো পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর চরিত্রগুলোর অধিকাংশই তারা আছেন, যারা ১৮৫৭ সালে শুধু ব্রিটিশ সরকারকে শুধু সমর্থন জানিয়েছেন তা নয় বরং তাদের বাহিনীতে অংশগ্রহণ করে বিদ্রোহীদের দমন করেছেন। ১৮৫৭ সালে ইংরেজদের বিশ^স্ত অনুগত জায়গিরদারদের সন্তানরা আজো কয়েক কোটি রুপি ও মন্ত্রিত্বের জন্য নিজেদের বিবেক বিক্রি করে দিতে বিন্দুমাত্র দেরি করেন না। বিবেক বিক্রেতা তো বিবেক বিক্রেতাই, এরা কোনো দখলদার বাহিনীর জেনারেলের সামনে ‘চালাও গুলি’ বলার সাহস রাখেন না। তারা জালিমের সহযোগী হয়ে কোনো বড় পদ অর্জন করাকে নিজেদের বড় সফলতা মনে করেন। জনগণের দৃষ্টিতে তিনি সফল নন, যিনি জালিমের সহযোগী হন। জনগণের অন্তরে তিনিই জায়গা করে নেন, যিনি জালিম জেনারেলকে বলেন, ‘চালাও গুলি’।

পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ১৩ মে, ২০১৪ থেকে
উর্দু থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
[email protected]
হামিদ মীর : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement