গাজায় মানবতার মৃত্যু
- জালাল উদ্দিন ওমর
- ২২ মে ২০২৪, ১২:১৮
![](https://www.dailynayadiganta.com/resources/img/article/202405/836906_196.jpg)
জাতিসঙ্ঘ ঘোষিত সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণাপত্রে বিশ্বের সব মানুষের সমান অধিকার স্বীকৃত। ধর্ম-বর্ণ এবং গোত্রীয়ভাবে কাউকে চিহ্নিত করে, তাদেরকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার অধিকার কারো নেই। কিন্তু ফিলিস্তিনে শত বছর ধরে সেটিই চলছে। গাজায় এখন চলছে নির্বিচার গণহত্যা।
ইসরাইলি হামলায় গাজা এখন এক বিধ্বস্ত জনপদ। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে ইসরাইল নির্বিচারে গাজায় হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব হামলায় নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধসহ নিহত হয়েছে ৩৫ হাজারেরও বেশি মানুষ, আর আহত হয়েছে ৭৫ হাজার। ইসরাইলি বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ধুলায় মিশে গেছে হাজারো বাড়িঘর, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-গির্জা ও হাসপাতাল। গাজার বেশির ভাগ মানুষই আজ উদ্বাস্তু। সেখানকার মানুষের আজ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা- কিছুই নেই। চাকরি, ব্যবসাবাণিজ্য এবং আয়ের কোনো পথ খোলা নেই। গাজার মানুষ আজ খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে এবং ত্রাণের খাবার খেয়েই দিন কাটাচ্ছে। অনেকে খাবার না পেয়ে মারা যাচ্ছে। এসব মানুষের কাছে ত্রাণের খাবার এবং চিকিৎসাসামগ্রীও ঠিকমতো পৌঁছানো যাচ্ছে না। গাজায় আজ নেমে এসেছে মানবতার চরম বিপর্যয়। ত্রাণের জন্য অপেক্ষারত ক্ষুধার্তদের ওপরও ইসরাইল হামলা চালিয়ে অনেক মানুষকে হত্যা করেছে। রোজা এবং ঈদের দিনও ইসরাইল হামলা চালিয়ে অসংখ্য ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। ইসরাইল যেভাবে নিরপরাধ ও নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের নির্বিচারে হত্যা করছে, তা কোনো সভ্য সমাজে কল্পনাও করা যায় না। কোনো বিবেকবান মানুষ এ অবস্থায় নীরব থাকতে পারে না। ইসরাইল কোনো ধরনের আইন-কানুন, আন্তর্জাতিক বিধিবিধান ও যুদ্ধের নিয়ম মানছে না। ইসরাইল সেখানে পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করেছে এবং গণহত্যা চালাচ্ছে।
ইসরাইলকে বাধা দেয়ার কেউ নেই। ফলে হয়ে উঠেছে বেপরোয়া। জাতিসঙ্ঘের সিদ্ধান্তও মানছে না। নির্যাতন থেকে ফিলিস্তিনের নিরপরাধ জনগণকে বাঁচাতে পশ্চিমা বিশ্ব এগিয়ে আসেনি। ইসরাইল মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালালেও, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব যেমন ব্রিটেন, ফ্রান্স, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া বরাবরই ইসরাইলকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক সাহায্য দিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ সারা দুনিয়ার সাধারণ মানুষ ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এবং ফিলিস্তিনিদের পক্ষে বিক্ষোভ করলেও এর কোনো আবেদন এসব দেশের নেতাদের কাছে নেই। ইসরাইলের অন্যায় ও অপকর্মের বিরুদ্ধে জাতিসঙ্ঘে উত্থাপিত প্রতিটি প্রস্তাব ভেটো প্রয়োগ করে নাকচ করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ফিলিস্তিন বর্তমানে জাতিসঙ্ঘের পর্যবেক্ষক সদস্য। ফিলিস্তিন ২০১২ সালে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পেয়েছিল। গত ১৮ এপ্রিল জাতিসঙ্ঘের পূর্ণ সদস্য পদ পেতে নিরাপত্তা পরিষদে ভোট হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট সেই প্রস্তাবেও ভেটো দিয়েছে। ফলে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হিসেবে জাতিসঙ্ঘের পূর্ণ সদস্যপদ অর্জন করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের এসব ভূমিকায় ইসরাইল আজ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। দেশটি ভালো করেই জানে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব শেষ পর্যন্ত তার পাশেই থাকবে।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্বের নেতৃত্ব কথায় কথায় মানবতার কথা বললেও তাদের সেই মানবতা আজ গাজায় মারা গেছে। গাজায় আজ মানবতার মৃত্যু হয়েছে। একই সাথে পশ্চিমাদের সুনাম, আস্থা, বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতাও মারা গেছে। জাতিসঙ্ঘ ঘোষিত সর্বজনীন মানবাধিকারের কোনো কিছুই আজ গাজায় বিদ্যমান নেই। সেখানে নেমে এসেছে মানবতার চরম বিপর্যয়।
যুুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের নেতৃত্ব সবসময় বিশ্বব্যাপী মানুষের বাকস্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলে। মানুষের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তারা সবসময় উপদেশ ও নির্দেশ দেয়। তাদের শত্রু ও বিরোধী কোনো দেশে কিছু হলেই গণতন্ত্র গেল, মানবাধিকার গেল বলে চিৎকার শুরু করে এবং গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কথা বলতে থাকে। এমনকি গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলে তারা বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন স্বাধীন দেশে আক্রমণ করেছে, যুদ্ধ করেছে এবং সেখানে সরকারও পরিবর্তন করেছে। কিন্তু ইসরাইলের আগ্রাসন এবং দখলদারিত্ব থেকে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য পশ্চিমা বিশ্ব এবং জাতিসঙ্ঘ আজ পর্যন্ত ফিলিস্তিনে কোনো গণভোটের আয়োজন করেনি; বরং ফিলিস্তিনে আগ্রাসন ও দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য এরা ইসরাইলকে সার্বিক সহযোগিতা করে। পশ্চিমাদের দ্বিমুখী নীতির কারণে জাতিসঙ্ঘও আজ অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমা মিত্র নেতাদের প্রতিশ্রুতির কোনো আবেদন এখন আর মানুষের কাছে নেই। তাদের এসব কথাবার্তা এখন আর লোকজন বিশ্বাস করে না। কারণ তাদের এসব প্রতিশ্রুতি সর্বজনীন এবং বিশ্বজনীন নয়। পশ্চিমাদের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতিশ্রুতি আজ তাদের আগ্রাসন এবং আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলে পশ্চিমারা ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া ও সিরিয়ায় হামলা চালিয়েছে। এরা এসব দেশে লক্ষাধিক মানুষকে হত্যা করেছে, অনেক অবকাঠামো ধ্বংস করেছে। এখানে আগ্রাসনের শিকার হওয়া সব দেশই কিন্তু মুসলিম দেশ। এভাবে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নামে এরা এসব মুসলিম দেশকে ধ্বংস করেছে। একইভাবে তারা জাতিসঙ্ঘকে ব্যবহার করে গণভোটের আয়োজন করে ইন্দোনেশিয়া থেকে পূর্ব তিমুর এবং সুদান থেকে দক্ষিণ সুদানকে স্বাধীন করেছে। তারা মুসলিমপ্রধান ইন্দোনেশিয়া এবং সুদানকে দুর্বল করেছে এবং খ্রিষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। অথচ ইসরাইলের আগ্রাসন ও দখলদারিত্ব থেকে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন এবং মুক্ত করার কোনো কর্মসূচি পশ্চিমা দেশগুলোর নেই। ৭৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ইসরাইল ফিলিস্তিনি ভূমিকে দখল করে রেখেছে আর প্রতিনিয়তই ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের হত্যা করেছে, আটক করছে, বাড়িঘর ধ্বংস করছে। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যোগ ও কর্মসূচি যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র ব্রিটেনসহ পশ্চিমা দেশগুলো কখনো গ্রহণ করেনি; বরং ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকারের কথা বলে পশ্চিমা বিশ্ব সবসময় নিঃশর্তভাবে ইসরাইলকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। কারণ এখানে ফিলিস্তিনিরা মুসলমান এবং ইসরাইল একটি ইহুদি রাষ্ট্র।
ফিলিস্তিন স্বাধীন হলে নতুন একটি মুসলিম দেশের অভ্যুদয় হবে এবং ইসরাইল দুর্বল হবে, যা পশ্চিমা বিশ্ব মানতে একেবারেই নারাজ। তাই ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরাইলের বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা ও হত্যাযজ্ঞেও পশ্চিমা বিশ্ব নীরব থাকে এবং ফিলিস্তিনে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসে না। পশ্চিমাদের এই দ্বৈতনীতি কিন্তু পশ্চিমাদের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে। কারণ প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। ফিলিস্তিনে ইসরাইলের বর্বরতা এবং এই ইস্যুতে পশ্চিমাদের দ্বিমুখী নীতিরও একটি প্রতিক্রিয়া আছে এবং থাকবেই। আর সে প্রতিক্রিয়ায় মুসলমানরা অধিক হারে পাশ্চাত্যবিরোধী ও শক্তিশালী হবে। পশ্চিমাদের দ্বৈতনীতির কারণে বিশ্বজুড়ে পশ্চিমাদের ওপর মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে এবং আস্থাহীনতা সৃষ্টি হচ্ছে। আর এই আস্থাহীনতা পশ্চিমাদেরকে জনবিচ্ছিন্ন করবে এবং তাদের প্রতিপক্ষ রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া, সিরিয়া ও ইরানকে শক্তিশালী করবে।
ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্র অপরাজেয় কোনো শক্তি নয়। তাই ইসরাইলের উচিত তার আগ্রাসন, দখলদারিত্ব ও বর্বরতা চিরতরে বন্ধ করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা এবং পাশাপাশি শান্তিতে বসবাস করা। আর পশ্চিমাদের উচিত তাদের এই পক্ষপাতিত্ব ও দ্বিমুখী নীতি এখনই পরিহার করা এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দেয়া না হলে বিশ্বব্যাপী ইসরাইলের প্রতি যে ঘৃণা এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের প্রতি যে আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে, তা তাদের জন্য একসময় বিপর্যয় ডেকে আনবে। অধিকন্তু ফিলিস্তিনের নির্যাতিত নিপীড়িত হাজারো মানুষের বুকফাটা আর্তনাদ আর কান্নায় প্রকৃতিও কিন্তু অধৈর্য হয়ে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠতে পারে। আর প্রকৃতির প্রতিশোধ প্রতিহত করার শক্তি তো কারো নেই।
লেখক : প্রকৌশলী এবং উন্নয়ন গবেষক
ই-মেল : omar_ctg123@yahoo.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা