১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

নয়া হীরামন্ডি

নয়া হীরামন্ডি - ফাইল ছবি

কয়েক বছর পর মার্কিন বন্ধু যোগাযোগ করে এমন এক আবদার করলেন, যা আমার জন্য একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল। তিনি বর্তমানে কানাডার একটি প্রোডাকশন হাউজের সাথে স্ক্রিপ্টরাইটার হিসেবে কাজ করছেন। তার এক ধনী শিখ বন্ধু সম্প্রতি নেটফ্লিক্সে ভারতের বিখ্যাত সিনেমা নির্মাতা সঞ্জয় লীলা বানসালি নির্মিত ড্রামা সিরিজ হীরামন্ডি দেখেছেন। এটি দেখার পর তিনি হীরামন্ডির ওপর একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানানোর পরিকল্পনা নিয়েছেন। হীরামন্ডি লাহোরে অবস্থিত। আর লাহোরকে ‘পাকিস্তানের হৃৎপিণ্ড’ বলা হয়ে থাকে। সুতরাং মার্কিন বন্ধুর আমার কথা মনে পড়ে যায়। তার পরিচালক এ প্রজেক্টে কাজ করার আগে এটি জেনে নিতে চাচ্ছেন যে, নেটফ্লিক্সে যে হীরামন্ডি দেখানো হয়েছে, তার কোনো নিদর্শন বা চিহ্ন লাহোরে বিদ্যমান আছে কি না। আমি সঞ্জয় লীলা বানসালির হীরামন্ডি তখনো দেখিনি। সুতরাং বন্ধুকে বললাম, আমি এখনই কোনো মন্তব্য করতে পারব না। তিনি বললেন, তুমি এটি দেখো, তারপর মন্তব্য করো। নেটফ্লিক্সে হীরামন্ডির আটটি পর্ব দেখা বেশ কষ্টের। তারপরও এ অধম যেকোনোভাবেই হোক, আটটি পর্ব দেখেছে।

এরপর বন্ধুকে বার্তা পাঠাল, নেটফ্লিক্সের হীরামন্ডি শুধুই একটি ড্রামা। আর এ ড্রামাতে দেখানো বাইজি (তয়ফা) থেকে নিয়ে বাইজিখানা পর্যন্ত কোনো কিছুই আজকের লাহোরে বিদ্যমান নেই। সুতরাং হীরামন্ডির ওপর ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানানোর চেষ্টা সময় নষ্ট বলে গণ্য হবে। বন্ধু বললেন, লাহোরে কি এমন কোনো ইতিহাসবিদ বা গবেষক আছেন, যিনি তাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনে লাহোরের বাইজিদের ভূমিকার ওপর কিছু উপকরণ জোগাড় করে দিতে পারবেন? আমার তাৎক্ষণিকভাবে মুসতানসির হুসাইন তারাড় সাহেবের নাম মনে পড়ল, যিনি তার ‘লাহোর আওয়ারাগি’ গ্রন্থে হীরামন্ডির বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। আমি বন্ধুকে বললাম, শিখ বন্ধুর মাধ্যমে তারাড় সাহেবের সাথে যোগাযোগ করো। তবে এর সাথে লিয়াকত আলী সিন্ধুর ‘লাহোর কী খোঁজ’ গ্রন্থও চেয়ে নিয়ো। ওই গ্রন্থে বলা হয়েছে, লাহোরের অধিকাংশ বাইজি স্বাধীনতা আন্দোলনের যোদ্ধাদের পরিবর্তে ইংরেজদের পক্ষ নিয়েছিল। সমস্যা মূলত হচ্ছে, নেটফ্লিক্সে প্রদর্শিত হীরামন্ডিতে বেবুজান বাইজি স্বাধীনতা আন্দোলনের যোদ্ধাদের জন্য ইংরেজদের কাছ থেকে খবর সংগ্রহের কাজ করছেন এবং একজন ইংরেজ পুলিশ কর্মকর্তা তাকে গুলিও করছেন। এ ধরনের কোনো চরিত্র আমি মুসতানসির হুসাইন তারাড়ের গ্রন্থে খুঁজে পাইনি। তবে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে কানপুরের বাইজি আজিজুন নেসা প্রকাশ্যে বিদ্রোহীদের পক্ষ নিয়েছিলেন। এ বাইজি আজিজুন বাই নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তার দেখাদেখি লক্ষেèৗর বাইজিরাও বিদ্রোহ করেন। এরপর বেনারসে হাসিনা বাই একটি বাইজিসভারও আয়োজন করেন। সঞ্জয় লীলা বানসালির জন্য লক্ষেèৗ বা বেনারসের বাইজিদের নিয়ে ড্রামা বানানো বেশি সহজ ছিল। কিন্তু তিনি আজিজুন বাই ও হাসিনা বাইয়ের চরিত্রকে লাহোরের হীরামন্ডিতে চিত্ররূপ দান করে এক নতুন বিতর্ক ছড়িয়ে দিয়েছেন।

বর্তমানে পাকিস্তানে এ বিতর্ক চলছে যে, নেটফ্লিক্সে প্রদর্শিত হীরামন্ডি ও লাহোরের আসল হীরামন্ডির মধ্যে পার্থক্যটা কী? আমি যখন লাহোরের লোয়্যার মলের সেন্ট্রাল মডেল স্কুলে পড়তাম, তখন ইন্টার স্কুল ক্রিকেট টুর্নামেন্টের অধিকাংশ ম্যাচ মিনার পাকিস্তানের অধীনে ইকবাল পার্কে হতো। আমরা সকাল সকাল স্কুল থেকে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে বসে ইকবাল পার্কে পৌঁছে যেতাম এবং সন্ধ্যায় ম্যাচ শেষ হওয়ার পর হীরামন্ডির রাস্তা হয়ে হেঁটে ভাটি গেট আসতাম। হীরামন্ডির সাথে এটিই ছিল আমার প্রথম পরিচয়। গভর্নমেন্ট কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ক্রিকেট টিমের দু’জন খেলোয়াড় ছিলেন হীরামন্ডি এলাকার। কখনো কখনো আমরা ইসলামিয়া কলেজ সিভিল লাইন্সের সাথে ম্যাচ জিতে ফাজ্জা পায়া (একধরনের বিশেষ পায়া) খেতে হীরামন্ডি চলে যেতাম। ওই সময়ই আমরা শুরেশ কাশ্মিরির ‘ইস বাজার মেঁ’ গ্রন্থ পড়ে ফেলি এবং এই বাইজিদের প্রতি আমাদের সহমর্মিতা তৈরি হয়। সাংবাদিকতায় আসতেই হীরামন্ডি এলাকার অধিবাসী ফিল্মি নায়িকা নাদিরা খুন হন। ওই খুনের এক তদন্ত প্রতিবেদন লেখার জন্য ন্যাশনাল কলেজ অব আর্টসের শিক্ষক ইকবাল হুসাইনের কাছে হীরামন্ডিতে বারবার যেতে হয়েছে। তিনি আমাদের বলতেন, হীরামন্ডির বাইজিরা আল্লামা ইকবাল টাউন ও ডিফেন্সের দিকে চলে যাচ্ছেন। সঞ্জয় লীলা বানসালি নেটফ্লিক্সে যে হীরামন্ডি দেখিয়েছেন, তাতে বড় বড় আলিশান ভবন রয়েছে, যা বর্তমানের আসল হীরামন্ডিতে কোথাও নজরে পড়বে না। এ ড্রামাতে যে নবাব দেখানো হয়েছে, তা ইংরেজদের আমলে লক্ষেèৗতে তো বিদ্যমান ছিল, তবে লাহোরে ছিল না। সঞ্জয় লীলা বানসালির জন্য এ ড্রামার স্ক্রিপ্ট লিখেছেন মুঈন বেগ। ড্রামা তো ড্রামাই হয়, যেখানে বাস্তবতা ও কল্পনার সংমিশ্রণ ঘটানো এক পুরনো রীতি। সাধারণত মনে করা হয়, লাহোরের হীরামন্ডি মোগল আমলে গঠন করা হয়। কিন্তু ‘তারিখে লাহোর’ গ্রন্থের লেখক কানহাইয়া লাল হিন্দি বলেন, মহারাজা রঞ্জিত সিংয়ের শাসনামলে লাহোরের বাইজিদের উত্থান ঘটে। কেননা, তিনি মোরাঁ ও গুল বেগম দুই বাইজিকে বিয়ে করেন।

মোরাঁ একটি মসজিদও নির্মাণ করেন, যা মায়ি মোরাঁ মসজিদ নামে খ্যাতি লাভ করে। আর গুল বেগমের নামে বর্তমানে লাহোরে বাগে গুল বেগম এলাকা রয়েছে। রঞ্জিত সিংয়ের শাসনামলে পাঞ্জাবের ডোগরা প্রধানমন্ত্রী হীরা সিং হাসান বাজারকে ব্যবসাবাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু বানানোর জন্য এখানে কৃষিজাতীয় পণ্যের মন্ডি বা বাজারও বানিয়ে দেন। এ এলাকাকে ‘হীরাসিং দ্য মন্ডি’ বলা হতে থাকে। এ হামিদ ‘লাহোর লাহোরায়’ গ্রন্থে লিখেছেন, একটা সময় স্যার সৈয়দ আহমদ খান আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে শাহী মহল্লাতেও (হীরামন্ডি) গিয়েছিলেন। ওখান থেকে ফিরে এসে বলেছিলেন, বাইজিদের চাঁদায় বিশ্ববিদ্যালয়ে গোসলখানা বানাবেন। মুসতানসির হুসাইন তারাড়ের ‘লাহোর আওয়ারাগি’ গ্রন্থের একটি অধ্যায়ের নাম ‘হার্ট অব হীরামন্ডি’। ওই অধ্যায়ে তারাড় সাহেবকে নুরজাহান, ফরিদা খানম, মাহদি হাসান, বড়ে গোলাম আলী খান ও আরো কয়েকজন বড় শিল্পীকে অনুসন্ধান করতে দেখা গেছে। কিন্তু নেটফ্লিক্সের হীরামন্ডি তার গ্রন্থে নেই। সত্য কথা হচ্ছে, আসল হীরামন্ডি লাহোরের শাহী কেল্লার কোলে নয়; বরং সেটি ভারত-পাকিস্তানের বড় বড় শহরে মডার্ন এলাকায় স্থানান্তরিত হয়ে গেছে। পুরনো হীরামন্ডিতে বাইজিরা রূপচেহারা বিক্রি করতেন। কিন্তু নয়া হীরামন্ডিগুলোতে রাজনীতিবিদ ও মিডিয়ার মানুষরা নিজেদের চরিত্র বিক্রি করেন। ঈমান বিক্রি ও ইনসাফ বিক্রি এগিয়ে গেছে। আর দেহ ব্যবসায় অনেক পিছে থেকে গেছে। আজ আমাদের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা লাহোরের পুরনো হীরামন্ডি নয়; বরং গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হচ্ছে নয়া হীরামন্ডি, যেখানে শহরের সম্ভ্রান্ত মানুষরা তাদের বিবেক বিক্রি করে নিজেদের আস্থাভাজন প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন।

পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ৯ মে, ২০১৪-এর উর্দু থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
[email protected]
লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement
ডিএসইতে ১ ঘণ্টায় সূচক কমল ১০.৭১ পয়েন্ট রঙ তুলির আচড়ে প্রস্তুত হচ্ছে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ নরসিংদী বেলাব অতিক্রম করছে আগরতলামুখী লংমার্চ আবু সাঈদের বাবাকে হেলিকপ্টারে ঢাকা সিএমএইচে স্থানান্তর স্ত্রীর জন্য ওষুধ কিনে বাড়ি আর ফেরা হলো না শহীদ রাকিবের গেইলের রেকর্ড ভাঙলেন মাহমুদুল্লাহ নিম্ন আদালতের বিচারকদের মতামত চেয়েছে সংস্কার কমিশন কুয়াকাটায় ইয়াবাসহ মাদককারারি গ্রেফতার দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রীর আত্মহত্যার চেষ্টা ভারতের উচিত চুক্তি অনুযায়ী শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানো : টবি ক্যাডম্যান দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ে পুলিশের অভিযান

সকল