১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

কোরবানির তাৎপর্য

কোরবানির তাৎপর্য - ছবি : সংগৃহীত

বছরে একবার কোরবানির ঈদ আসে। এ সময় সামর্থ্যবান মুসলমানরা উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে গরু ছাগল ইত্যাদি ক্রয় করে থাকেন এবং ঈদ ও পরবর্তী দিনগুলোতে পশু কোরবানি দিয়ে থাকেন। কিন্তু এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য না জানার কারণে কিছু মানুষ একে নিরীহ প্রাণী হত্যা বা অমানবিক উৎসব অথবা অনেকে একে গোশত খাওয়ার সাধারণ একটি উৎসব মনে করে থাকেন।

হান আল্লাহ বলেন : ‘আর (কোরবানির) উটগুলোকে আমরা তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শনগুলোর অন্তর্ভুক্ত করেছি। তোমাদের জন্য তাতে বিপুল কল্যাণ নিহিত আছে। ...আর কোরবানির পর যখন তাদের পিঠগুলো জমিনের ওপর স্থিত হয়, তখন তা থেকে নিজেরাও খাও এবং তাদের খাওয়াও যারা অল্পে তুষ্ট হয়ে নিশ্চুপ বসে আছে এবং তাদেরকেও যারা এসে নিজেদের প্রয়োজন পেশ করে।’ (আল-কুরআন ২২:৩৬)

অর্থাৎ অভাবী মিসকিন যারা সারা বছর গোশত খাওয়ার সুযোগ পায় না তাদের জন্য এটি সত্যিই একটি মহোৎসব। পৃথিবীর অন্যতম ধনাঢ্য ব্যক্তি বিল গেটস এ কথাটি সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন : কেএফসি, ম্যকডোনালস, বার্গার কিং প্রমুখ প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ প্রাণী হত্যা করে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের খাওয়ানোর মাধ্যমে অনেক অর্থ উপার্জনের জন্য আর ঈদুল আজহায় তা করা হয় বিনা পয়সায় গরিবদের খাওয়ানোর জন্য। (The Siasat daily, Bill Gates, Tweet Aug 14, 2019)
পশু কোরবানি করার সময় যে দোয়া করা হয় তা প্রণিধানযোগ্য : ‘নিশ্চয়ই আমার সালাত, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু আল্লাহর জন্য যিনি সব সৃষ্টির রব।’ (আল-কুরআন ৬:১৬২)

এ দোয়াটি আল্লাহর দ্বীনের জন্য আমাদের মহান পিতা ইব্রাহিম আ:-এর চরম ত্যাগের কথাই মনে করিয়ে দেয়। তৎকালীন সমাজে বহুল প্রচলিত শিরকের বিরুদ্ধে যখন তিনি নির্ভেজাল তৌহিদের প্রকাশ্য ঘোষণা দেন, তাঁকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়, যা তিনি সন্তুষ্ট চিত্তে বরণ করে নেন। আল্লাহর দ্বীনের জন্য তাঁকে দেশান্তরিত হতে হয়। একই উদ্দেশ্যে তার বৃদ্ধ বয়সে জন্ম নেয়া দুগ্ধপোষ্য শিশু ও সহধর্মিণীকে জনমানবহীন মরু প্রান্তরে রেখে আসতে হয়। অবশেষে পরীক্ষার অংশ হিসেবে সেই সন্তানকে যখন মহান আল্লাহ কোরবানি করার নির্দেশ দেন, ইব্রাহিম আ: তা সন্তুষ্ট চিত্তে পালনে অগ্রসর হন। ইব্রাহিম আ:-এর তখনকার মানসিক অবস্থা মহান আল্লাহ অত্যন্ত সুন্দর ভাষায় প্রকাশ করেছেন:
‘অবশেষে আমরা একটি বড় কোরবানির বিনিময়ে সে পুত্রটিকে ছাড়িয়ে নিলাম।’ (আল-কুরআন ৩৭:১০৭)

অর্থাৎ ইব্রাহিম আ: মহান আল্লাহর আদেশ পালনের ব্যাপারে এত উদগ্রীব ছিলেন যে, তাঁর রব হস্তক্ষেপ না করলে ইব্রাহিম আ: তাঁর সন্তানকে সত্যিই কোরবানি করে ফেলতেন। মহান নবীর এ আত্মত্যাগকে স্মরণে রাখার জন্য প্রতি বছর আমাদের মাঝে ফিরে আসে কোরবানির দিন, একইভাবে আমাদেরকে আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ করার জন্য।

‘তাদের গোশতও আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না, আর রক্তও নয়। কিন্তু তোমাদের তাকওয়া তাঁর কাছে অবশ্যই পৌঁছে।’ (আল-কুরআন ২২:৩৭)

দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য রাসূল সা: ও তাঁর সাহাবিরা আত্মত্যাগের চরম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁকে নানা রকম মিথ্যা অপবাদ দেয়া হয়েছে। তিন বছর অবরুদ্ধ অবস্থায় তাদেরকে গাছের পাতা, শুকনো চামড়া ইত্যাদি খেতে হয়েছে। ইব্রাহিম আ:-এর মতো তাদেরকে দেশান্তরিত হতে হয়েছে।

তায়েফে পাথর মেরে রাসূল সা:-এর সমস্ত শরীর রক্তাক্ত করা হয়েছে। তাঁকে অনেকবার হত্যা করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। ওহুদের প্রান্তরে শিরস্ত্রাণ মাথায় ঢুকে তাঁর মোবারক চেহারা রক্তাক্ত হয়েছে। কী ছিল তাঁর অপরাধ? তা ছিল এ যে, তিনি চেয়েছিলেন সমাজের সব অন্যায় অবিচার দূর করে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি ইনসাফপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে। এটাই ছিল তৎকালীন সমাজপতিদের তাঁর প্রতি আক্রোশের কারণ। একই মিশন ছিল সব নবীর।

‘তিনি তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন এমন দ্বীন যার নির্দেশ তিনি দিয়েছিলেন নূহকে আর যা আমি ওহি করেছি তোমাকে এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইব্রাহিম, মূসা ও ঈসাকে যে, তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং তাতে মতভেদ কর না।’ (আল-কুরআন ৪২:১৩)
দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম একটি কঠিন কাজ, যার উদাহরণ হচ্ছে ইব্রাহিম আ:-এর কোরবানি। যারাই এ সংগ্রামে অবতীর্ণ হবেন, তাদের ধনসম্পদ, জীবন, সন্তান, সন্তুতি সবকিছু কোরবানি দিতে হতে পারে! যেমন দিয়েছিলেন হজরত ইয়াহইয়াহ আ:, হজরত সুমাইয়া, ইয়াসার হামজা, খুবাইব রা:-সহ অগণিত শহীদ। বর্তমান সময়েও একইভাবে দ্বীনের প্রতিষ্ঠাকারীদের ওপর গুম, খুন, মিথ্যা মামলা, শারীরিক নির্যাতন, আমৃত্যু জেল, ফাঁসি, চাকরিচ্যুত, ব্যবসায়ের ক্ষতি অর্থাৎ জানমালের ক্ষতি আসবেই। কারণ সমাজের প্রচলিত শক্তি তাদেরকে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচনা করে এবং তাদেরকে বিপদ মনে করে, যেমন মনে করেছিল নমরুদ ইব্রাহিম আ:-কে, ফেরাউন মূসা আ:-কে, তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী ইয়াহইয়াহ ও ঈসা আ:-কে।

দ্বীন প্রতিষ্ঠার দরকার কেন? মহান আল্লাহ এ ব্যাপারে বলেন :
‘আর তোমাদের কী হলো যে, তোমরা আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করছ না, অথচ দুর্বল পুরুষ-নারী ও শিশুরা বলছে, হে আমাদের রব, আমাদেরকে বের করান এ জনপদ থেকে, যার অধিবাসীরা জালিম এবং আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে একজন অভিভাবক নির্ধারণ করুন। আর নির্ধারণ করুন আপনার পক্ষ থেকে একজন সাহায্যকারী।’ (আল-কুরআন ৪:৭৫)

রাসূল সা: ও অন্যান্য নবীর এ কর্মপদ্ধতি পরিহার করে অনেক মুসলমান ‘সহজ ইসলাম’কে বেছে নিয়েছেন অর্থাৎ ইসলামকে তারা নামাজ-রোজা, হজ-ওমরাহ, জিকির-আসকার, বিভিন্ন ওয়াজ নসিহত মাদরাসা-মসজিদ বানানো ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে নিয়েছেন। ইব্রাহিম আ: ও আমাদের রাসূল সা: ও তাঁর সাহাবিদের মতো দ্বীনের জন্য জীবন বাজি রাখতে তারা প্রস্তুত নন। ‘সহজ ইসলামে’র মধ্যে জানমালের ক্ষতির কোনো ভয় নেই, ঈমানের পরীক্ষা নেই বা ইব্রাহিম আ:-এর মতো আত্মত্যাগের কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ সমাজের প্রচলিত শক্তি ‘সহজ ইসলাম’কে নিয়ে ভীত নয়।

মহান আল্লাহ ঈমানের পরীক্ষার ব্যাপারে বলেন :
“মানুষ কি মনে করেছে যে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’ এ কথা বললেই তাদেরকে অব্যাহতি দেয়া হবে এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না? আমি তো তাদের পূর্ববর্তীদেরকেও পরীক্ষা করেছিলাম; আল্লাহ অবশ্যই প্রকাশ করে দেবেন কারা সত্যবাদী ও কারা মিথ্যাবাদী তা (আল-কুরআন ২৯:২-৩)
মহান আল্লাহ ‘সহজ ইসলাম’কে দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সাথে তুলনা করে বলেন :
‘তোমরা কি হাজীদের পানি পান করানো এবং মসজিদে হারামের সেবা ও তত্ত্বাবধান করাকে ওই ব্যক্তির কাজের সমান মনে করে নিয়েছ, যে ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি, পরকালের প্রতি এবং প্রাণপাত করল আল্লাহর পথে? আল্লাহর কাছে তারা সমান নয়। আল্লাহ জালিম সম্প্রদায়কে সঠিক পথ প্রদর্শন করেন না । (আল-কুরআন ৯:১৯)

প্রতি বছর কোরবানির ঈদ মনে করিয়ে দেয় যে, ইব্রাহিম আ:-এর কোরবানি বা আত্মত্যাগের কথা, যেন আমাদেরকে একইভাবে আত্মত্যাগে অনুপ্রাণিত করে।
‘তোমাদের জন্য ইব্রাহিম আ: ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের মধ্যে একটি উত্তম আদর্শ রয়েছে।’ (আল-কুরআন ৬০:৪)

ইতঃপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, ইব্রাহিম আ:-এর আদর্শ হচ্ছে, আল্লাহর দ্বীনের জন্য সবকিছু কোরবানি করা।

মহান আল্লাহ আরো বলেন :
‘ইব্রাহিমের সাথে সম্পর্ক রাখার সবচেয়ে বেশি অধিকার রয়েছে তাদের, যারা তাঁর অনুসরণ করছে। আর এখন এ সম্পর্ক রাখার বেশি অধিকারী হচ্ছে এ নবী এবং তাঁর অনুসারী ঈমানদাররা! বস্তুত আল্লাহ কেবল তাদেরই সহায়ক ও সাহায্যকারী, যারা ঈমানদার।’ (আল-কুরআন ৩:৬৮)

লেখক : মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ


আরো সংবাদ



premium cement