অগ্নিদুর্ঘটনা ও এর প্রতিকার
- ড. মো: রফিকুল ইসলাম
- ২৮ মার্চ ২০২৪, ০৫:০৮
গার্মেন্টস কারখানা থেকে শুরু করে হাসপাতাল, বস্তি থেকে অভিজাত এলাকা গুলশান ও বনানী এবং কল-কারখানা থেকে পার্ক যেন কোনো কিছুই অগ্নিকাণ্ড থেকে বাদ যাচ্ছে না। এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স তদন্ত প্রতিবেদনে অগ্নিদুর্ঘটনায় হতাহতের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার নানাবিধ চিত্র উঠে এসেছে। এর অন্যতম কারণ হলো অগ্নিদুর্ঘটনার প্রতিরোধের বিষয়ে যথেষ্ট শিক্ষার ও আধুনিক প্রশিক্ষণের অভাব। সে সাথে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার ফলে আগুন সহজে ছড়িয়ে পড়ছে। এ ছাড়াও ভবন নির্মাণে আইন অমান্য করাসহ ভবনের নিরাপত্তাব্যবস্থা দুর্বল থাকার কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে।
হুড়াহুড়ি ও আতঙ্কের কারণে মানুষ দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। আগুন যদি অক্সিজেনের সংম্পর্শে এসে মারাত্মক আকার ধারণ করে। তখন বদ্ধ স্থানে অর্থাৎ দুর্ঘটনা স্থানে বাতাসে কার্বন-মনোক্সাইডসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর গ্যাস বাড়তে থাকে। ফলে আবদ্ধ জায়গায় সহজে বায়ু চলাচল করতে পারে না এবং কার্বন-মনোক্সাইড বিষক্রিয়া করে। অল্প সময়ের মধ্যে বায়ু মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস অনুপযোগী হয়ে পড়ে। ফলে এ বিষাক্ত ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে অধিকাংশ মানুষের মৃত্যু ঘটে। বিশেষজ্ঞরা অগ্নিদুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে মানুষের অজ্ঞতা ও অসচেতনতাই দায়ী করছে। বিশেষত বাসাবাড়িতে বেশির ভাগ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হওয়ার মূল কারণগুলো হলো ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট ও এসি কম্প্রেসার বা জ্বলন্ত সিগারেটের উচ্ছিষ্টাংশ থেকে। ঢাকা তথা দেশের বিভিন্ন শহর ও গ্রামগঞ্জে গ্যাস সিলিন্ডার লিকেজের কারণেই প্রতিনিয়ত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে।
যতদূর জানা যায়, দেশে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে ৮০ শতাংশ অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটছে। অর্থাৎ নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহারের ফলে সহজেই শর্টসার্কিটের ফলে আগুনের মতো ঘটনা ঘটছে। বিদ্যুতের তার উৎপাদন ও বাজারজাতের ক্ষেত্রে বিএসটিআইয়ের অনুমোদন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন নামী-দামি প্রতিষ্ঠানের লোগো ও সিল ব্যবহার করে নিম্নমানের বিদ্যুতের তার উৎপাদন করে বাজারজাত করছে। স্বাভাবিকভাবে বৈদ্যুতিক তারগুলো আসল কিংবা নকল তা বুঝার কোনো উপায় নেই। অধিকাংশ রেস্তোরাঁ ও শপিং কমপ্লেক্সে দুর্ঘটনাকালীন জরুরি বহির্গমন পথের কোনো ব্যবস্থা নেই। এতে কোথাও কোনো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে উদ্ধারকাজে বিঘ্ন ঘটছে। এর মূল কারণ ঢাকার অপরিকল্পিত অবকাঠামোগত নির্মাণ, পর্যাপ্ত জায়গা ও প্রশস্ত রাস্তার অভাব, রাজউক কর্তৃক প্রণীত ভবন নির্মাণ নীতিমালা না মানা।
একটি শহরে সর্বোচ্চ ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কংক্রিট ব্যবহারের নিয়ম রয়েছে। আর সেখানে ঢাকা শহরে প্রায় ৮০ শতাংশের বেশি কংক্রিট ব্যবহার করা হয়েছে। এর ফলে সবুজ বনায়ন কমে যাওয়ায় দিন দিন তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়াও নগরে প্রায় ৯২ শতাংশ ভবন নিয়মের কোনো তোয়াক্কা না করে নির্মাণ করছে। এসব ভবনে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা নেই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ ও পানিদূষণ বেড়েছে অতিমাত্রায়। একটি আইনও কোথাও মানা হচ্ছে না। ঢাকা শহরে ৫২টি সংস্থার মাধ্যমে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এসব সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের বড় অভাব রয়েছে। এ সমন্বয়ের অভাবে দেশের কোটি কোটি টাকা অবচয় হচ্ছে।
বাংলাদেশ তথা ঢাকা শহরে একসময় অনেক নদী-নালা ছিল। এতে অনেক ছোট-বড় নৌযান চলাচল করত। বর্তমানে ঢাকা শহরের বেশির ভাগ নদী-নালার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। এখন যা রয়েছে তা একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীরা ভরাট করে বড় বড় অট্টালিকা নির্মাণ করেছে। এছাড়া দৃশ্যমান কোনো নালা থাকলেও এর মধ্যে বাসাবাড়িসহ শহরের ময়লা-আর্বজনার ভাগাড়ে পরিণত করছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন আগুন নেভানোর জন্য পানির প্রাপ্যতা সহজ করতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ফায়ার হাইড্রেন্ট বসানোর চেষ্টা করছে। অর্থাৎ ফায়ার হাইড্রেন্ট হলো পানি সংরক্ষণাগারের সঙ্গে সংযুক্ত বিশেষ পানিকল। যা সাধারণত রাস্তার পাশে ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করে ওয়াসার লাইনের সাথে যুক্ত করা হয়। এক্ষেত্রে কোথাও কোনো অগ্নিকাণ্ড ঘটলে ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ওয়াসার লাইনের সাথে ফায়ার হাইড্রেন্ট যুক্ত করে ওয়াসার পানি সরবরাহের মাধ্যমে আগুন নেভানোর কাজ করতে পারবে।
অপরিকল্পিতভাবে নগরায়নের ফলে শহরজুড়ে স্ট্রিট হাইড্রেন্ট বসানো সমস্যা হচ্ছে।
নতুন আইনের অধীনে যেসব ভবন বিদ্যমান রয়েছে। সেসব ভবনে ফায়ার সেফটি কী রকম হবে। সেই সাথে নতুন নির্মাণাধীন ভবনগুলোর জন্য ফায়ার সেফটির অংশ হিসেবে পিলার হাইড্রেন্ট তৈরির ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে। এক্ষেত্রে অনেক ভবন মালিক পিলার হাইড্রেন্ট বসানোর বিষয়ে উদাসীন। এ বিষয়ে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক সংস্থার সমন্বয়ে তদারকি বিশেষ জরুরি। বিশেষ করে ভবন মালিকরা অর্থ বাঁচানোর জন্য অনেক সময় গড়িমসি করে পুরনো বৈদ্যুতিক তার ও নি¤œমানের সামগ্রী ব্যবহার করে। ভবনগুলোতে উন্নতমানের বৈদ্যুতিক তার ব্যবহার ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং দক্ষ ইলেকট্রিশিয়ান দ্বারা ওয়ারিং করতে হবে। এতে শর্টসার্কিটজনিত দুর্ঘটনার হার নিঃসন্দেহে হ্রাস পাবে। এর পাশাপাশি ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোডের বিষয়ে কোনো ধরনের আপস না করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
আবাসিক এলাকায় কোনো ধরনের রাসায়নিক সামগ্রীর দোকান রাখা উচিত নয়। আর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের বিভিন্ন ভবনসমূহে সচল অগ্নিপ্রতিরোধকমূলক সামগ্রী স্থাপন বিষয়ে অধিক কঠোর হতে হবে। স্কুল ও কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে নিয়মিত প্রচারণা চালাতে হবে।
প্রতিটি বাণিজ্যিক ভবনে জরুরি সিঁড়ি বা ইমার্জেন্সি ফায়ার এক্সিট থাকতে হবে। আর প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদেরকে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা সম্পর্কে মৌলিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং যেসব ভবন ঝুঁকিপূর্ণ তা চিহ্নিতকরণ করে ভবন মালিকদের নোটিশ দিতে হবে। এক্ষেত্রে মালিকদেরকে সতর্ক করে দিতে হবে। তবুও যদি কোনো ভবন মালিকগণ কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ না করে। সেক্ষেত্রে জরিমানা অথবা আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। তবে যদি এ আইনের কোনো ধরনের ফাঁকফোকর থাকে। সেক্ষেত্রে আইন সংশোধন করে নতুন আইন করে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
বর্তমানে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগে নতুন প্রযুক্তি লুফ-৬০ সংযোজন করা হয়েছে। এ অত্যাধুনিক যন্ত্রটি রিমোটের সাহায্যে আগুন নিয়ন্ত্রণ করছে। এর সাহায্যে মিনিটে এক হাজার লিটার পানি ছিটানো সম্ভব। তবে অদূরভবিষ্যতে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগে আরো উন্নতমানের নিত্যনতুন প্রযুক্তি যোগ হবে। এতে দেশবাসী উপকৃত হবে।
লেখক : গ্রন্থাগার বিভাগের প্রধান
সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা