১৮ মে ২০২৪, ০৪ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৯ জিলকদ ১৪৪৫
`


ছন্দহীন দ্বন্দ্বের নির্বাচন ২০২৪

ছন্দহীন দ্বন্দ্বের নির্বাচন ২০২৪ - নয়া দিগন্ত

ঘোষিত নির্বাচন না হওয়া নিয়ে যারা মনে করছিলেন, তাদের মতামত কখনোই যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি। নির্বাচন হয়ে যাবে এবং যথাসময়েই হবে- এ কথাই বরাবর বলেছি। বলেছি, সরকার নির্বাচন উঠিয়ে নেবেই এবং আওয়ামী লীগ নির্বাচন দেবে জিততে, হারতে নয়। নির্বাচন যথাসময়ে হয়ে যাবে, এটিই শেষ কথা। তবে কেমন হবে এই ছন্দহীন-তর্কিত নির্বাচন, সেটিও একরকম স্পষ্ট। এ দেশে দলীয় সরকার ক্ষমতায় বসে নির্বাচন করলে এমনটিই ঘটবে।

দ্বিতীয় দফায় তালেবানরা আফগানিস্তান দখল করলে সেই রাতে এক আফগান তার ভারতীয় সাংবাদিক বন্ধুকে ফোনে বলেছিলেন, ‘নাজেস, আমি আজ সকাল থেকে কেঁদেছি। কখনো ভাবিনি আমাদের জীবনকালে আমার দেশের মানুষকে একই পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে দু’বার যেতে হবে।’ (সাংবাদিক নাজেস আফরোজের লেখা থেকে)। পরপর তিনটি নির্বাচন দেখে কারো মনে এমন কথা মনে হবে কি না জানি না। জানি না, কেউ কাঁদবে কি না। কেউ তো ভাবতেই পারে, একটি গণতান্ত্রিক দেশের আধুনিক-ডিজিটাল-স্মার্ট বলে দাবিদার সরকারের অধীনে পরপর তিনটি তর্কিত নির্বাচন হয়ে গেল।

বিতর্কিত নির্বাচন কেবল বিরোধীরা বলছে বলেই না, যেকোনো মাপকাঠিতেই সেটি বিবেচিত হবে এবং বহুজনের কাছে। একজন তরুণ বলতেই পারে, ২০০৮ সালে ভোটার হওয়ার পর অবধি একটি নির্বাচনেও ভোট দিতে পারিনি।

২০১৮ সালের নির্বাচনের পর একটু রাত বাড়লে ক’জনকে ফোন করেছিলাম। এদের সব ক’জন আওয়ামী লীগকে ভোট দেন, বঙ্গবন্ধুকে যারপরনাই ভালোবাসেন, রাজনীতি করলেও দল থেকে কোনো চাওয়া নেই। তারা বলেছিলেন, এ কী হলো! দলটির এমন হলো কী করে! একজন তো বলেই বসলেন, মরতে ইচ্ছে করছে। এবার তেমন করে এসব কেউ বলবে না তো? কেউ দূর-অতীতের নির্বাচনের কথাও বলতে পারেন। সেই সময় আর এই সময়, একদমই ভিন্ন। আর অতীতে খারাপ কিছু ঘটেছে, এই যুক্তিতে খারাপকে অনুসরণ করা চলে না। যেমন- জনরায় অবজ্ঞা করে ক্ষমতায় থাকা সংবিধান অনুমতি দেয় না। তাহলে তো কখনো বা সামরিক শাসনের জয়গান গাওয়া হতো, কিন্তু পৃথিবীময় সামরিক শাসন ঘৃণার বস্তুতে পরিণত হয়েছে। একটিই কারণ, ভোটে আসেনি।

নির্বাচন হয়েই যাচ্ছে এবং ফলাফলও নিশ্চিত। ক্ষমতা পরিবর্তনের নির্বাচন নয় এটি। যে দল ছিল, তারাই থাকবে। তবে সংসদের বিরোধী শিবির নিয়ে সংশয় কাটতে ৭ জানুয়ারির সন্ধ্যাতক অপেক্ষা মাত্র। এই নির্বাচন নিয়ে নানা নতুন নতুন শিক্ষার কথা আসবেই, যেমন- এই ধাঁচের নির্বাচন দুনিয়ায় এই প্রথম। ২০১৮ সালের নির্বাচনকেও নিন্দুকরা তেমন বলেছিল। কে একজন বলেছেন, ২০১৪-এর চেয়ে ২০১৮-তে খারাপ হয়েছিল, ২০১৮-এর চেয়ে এবার আরো খারাপ। নতুন নতুন ধারণার কথায় যাওয়া যাবে। কিন্তু তিনটি বিষয়ে বেশি কষ্ট দেবে। কত দিনের এই কষ্ট জানি না। কোনো কোনো বিশ্লেষক বলেন, ২০১৮ সালেই বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের মৃত্যুঘণ্টা বেজেছে, যুক্তি হিসেবে বলা হয়, আওয়ামী লীগের মতো দলের জনভোটে ভয় ও জাতির পিতার নিজের সংসদীয় আসনটিতেও সকাল-বিকাল ঠিকঠাক ভোট হয়নি বলে মনে করা হয়। ক’দিনের মধ্যেই আওয়ামী লীগ দলটি পঁচাত্তরে পা রাখবে। এই দলটির নেতৃত্বে একটি নতুন মানচিত্র পেয়েছি। দলটি কি কেবল ক্ষমতায় থাকার জন্যই রাজনীতি করছে, না গণতন্ত্র, সুষ্ঠু ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা, বিরোধী দলের ভূমিকা, অবাধ জনমত, জনরায় নিয়েও কোনো কাজ আছে? পরপর তিনটি নির্বাচন দেখে এসব মনে করার কারণ নেই। এই তিনটি নির্বাচনই সর্বাপেক্ষা পুরোনো এবং সুসংগঠিত দলটির অধীনে হয়েছে। এখানে ভাবনার বিষয়, এই বিশাল পুরোনো সংগঠিত দলটির পরপর তিন নির্বাচন থেকে ঠিক অর্জনটা কী! কেবল কি ক্ষমতায় থাকাই প্রথম ও শেষ প্রাপ্তি? দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগের মতো একটি দলের নেত্রী তথা দেশের সরকারপ্রধানকে গাড়ি পোড়ানোর মামলায় সদ্য জামিনপ্রাপ্ত আসামির সাথে খোদ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে দেখা করতে হয়! কখন সেটি- জামিনের কিছুক্ষণ পরই (শাজাহান ওমর দল বদলে অন্যত্র যোগদান করতেই পারেন, রাজনীতিতে এসব হয়)। আবার জনবিচ্ছিন্ন ছয়-সাতটি ইসলামী ব্লকের নেতাও সরকারপ্রধানের সাথে চা পান করেন। আওয়ামী লীগকে এতটা নিচে নামতে হয়!

তৃতীয়ত, আমার জন্য সংবিধান সর্বোচ্চ আইন। একটি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের জন্য দলের গঠনতন্ত্র অনুরূপ মর্যাদার। গঠনতন্ত্র বিদ্যমান রেখেই বিদ্রোহী বা ডামি অথবা বিকল্প প্রার্থীর অনুমোদন দেয়া হয়েছে দলের সর্বোচ্চ ফোরাম থেকে। অথচ গঠনতন্ত্রে এই কাজের জন্য বহিষ্কারই একমাত্র ব্যবস্থা। তাহলে এই নির্বাচনের জন্য দলটিকে গঠনতন্ত্রও অমান্য-অবজ্ঞা করতে হয়? এসব কোনোভাবেই একটি ঐতিহ্যবাহী দলের সাথে যায় না। আওয়ামী লীগ বিরতিহীন তিন দফায় ১৫ বছর ক্ষমতায়। সামনে আরো পাঁচ বছর। দলটির নামের সাথে ইতিহাসটা কী হবে?

এই-ই প্রথম নির্বাচন, যেখানে বিরোধীরা নেই সত্ত্বেও মারামারি, হই-হট্টগোল থেমে নেই। জীবনহানিও আছে। রাজনৈতিক লড়াইয়ের চেয়েও দলীয় কোন্দল এই নির্বাচনে প্রকট হয়ে দেখা দিলো। ২৬৩ জনকে দল মনোনয়ন দিলেও ২৬৯ জনই দলের বিরুদ্ধে। নেই দলীয় শৃঙ্খলার সামান্যতম প্রয়োগ। অথচ একই অপরাধে অতীতে অনেকের কপালে শাস্তি আরোপিত হয়েছিল। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মেজাজ আনতে নজিরবিহীন সব কাণ্ড করা হয়েছে। জাতীয় পার্টিকে তোয়াজ-তোষামোদ অথবা আসন রফা, জোটের তিন দলের ছয়জনকে জিতিয়ে আনার জন্য নানা কায়দা-কানুনের আশ্রয়ও এই নির্বাচনে একটি দৃষ্টিগ্রাহ্য প্রপঞ্চ হয়ে থাকবে। তৈমূর-মুবিন-ইবরাহিমদেরও ছাড় দিতে হয়- কেউ বলতেই পারে, আওয়ামী লীগ এতটাই দেউলিয়া অথবা সস্তা হয়ে গেল!

দেখলাম, নির্বাচনে বিরোধীদের অংশগ্রহণ কীভাবে ঠেকিয়ে দেয়া যায়। এ নিয়ে নানান বিতর্ক আছে। তবে প্রধান বিরোধী দল ও সমমনাদের নির্বাচনের বাইরে রাখার কৌশল এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে। বলা হয়, বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখার কৌশলে আওয়ামী লীগ পুরোই সফল। আরো লক্ষণীয়, পরপর দু’টি সংসদে অনুগত বিরোধী দলের তকমায় অভিষিক্ত জাতীয় দলকে নানা ছাড়ের পরও দলহীন তথা স্বতন্ত্রীদের লাঙ্গলের চেয়ে বেশি আসন পাওয়ার সম্ভাবনা, যদিও তারাও আপাতত দলহীন হলেও আদতে নৌকারই লোক। দলের হাইকমান্ড মনোনীত প্রার্থীরা হারবে একই দলের বিদ্রোহী বা ডামি প্রার্থীর কাছে। অতীতে এমন দু’-চারটি ঘটলেও এবার নতুন হিসাব দেখা যাবে। আবার যাদের বিরোধী দল হিসেবে পাওয়ার ইচ্ছা, তাদের কেউ কেউ আওয়ামী লীগ মনোনীত বা প্রধানমন্ত্রীর ছবি ব্যবহার করছেন নির্বাচনী পোস্টারে- আগে অনুগত বিরোধী দল, লয়্যাল অপজিশন, গৃহপালিত বিরোধী দল সূচিত হয়েছে, এবার কী হবে?

এটিই এই দেশের প্রথম নির্বাচন, যখন ভোটার হাজির করাটাই মুখ্য চ্যালেঞ্জ হয়ে যায়। মানুষের তো উৎসব করে ভোট দেয়ার কথা। ভোট প্রদানে স্বতঃস্ফূর্ততা থাকার কথা। এটিই আমাদের নির্বাচনী সংস্কৃতি। কিন্তু এবারের নির্বাচনে সেখানে ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। ফলে ভোটার হাজির করা চাই। আন্দাজ এই যে, জোর করে হলেও কেন্দ্রে ভোটার চাই-ই চাই। প্রয়োজনে হুমকি-ধমকি ও সরকারি যন্ত্রাদিও ব্যবহৃত হতে পারে। এমনকি রাষ্ট্রীয় সুবিধার দোহাইও দেয়া হচ্ছে। ঘটছে সুবিধা কেড়ে নেয়ার ভয় প্রদর্শন। ভোট প্রদান আইনগতভাবে বাধ্যকর নয়। না ভোট নেই। এমনকি এক ভোটেও নির্বাচিত হতে বাধা নেই। পছন্দের প্রার্থী না থাকলে কাউকে জোরপূর্বক ভোটকেন্দ্রে নেয়া আইনানুগ নয়; বরং অপরাধ। সেটি কি ঘটবে আসন্ন নির্বাচনে? এ ছাড়া যত্রতত্র নির্বাচনী বিধি ভঙ্গ আর শাস্তি প্রায় অনুপস্থিত তো থাকছেই। নজরে আছে প্রায় সব অতীত এমপিদের সম্পদ বৃদ্ধির নজিরবিহীন রেকর্ড।
প্রতিযোগিতা কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতার চেয়ে এই নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে, সে আর বলতে নেই। কমবেশি ৫০ শতাংশ ভোটারের পছন্দের মার্কার অনুপস্থিতিজনিত কারণে এখন ভোটারের টার্নআউট নিয়েই মূল চিন্তা। ভোটার উপস্থিত করতে নানা কিছুই করা হবে, তা সহজেই অনুমেয়। কোথাও কোথাও সাফল্য পাওয়া বিচিত্র নয়। নিন্দুকেরা বলে আসছিল, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন মানেই ভোটারদের অবাধে ভোট প্রদান এবং প্রধান প্রধান দলের অংশগ্রহণই এ ক্ষেত্রে মোদ্দাকথা।

সরকার থেকে বরাবরই বলা হচ্ছে, কোন দল এলো কি এলো না, ব্যাপার না। জনগণ ভোট দিতে এলেই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়ে যাবে। সেটিই এই নির্বাচনের প্রধান দেখার বিষয়। নির্দিষ্ট সংখ্যায় ভোটারও এসে গেল, ভোট দিলো- তাতে কি বাইরের দেশ এই নির্বাচনের মান্যতা দেবে; এ কথার জবাব এখনই মিলবে না। আদতে এবারের জাতীয় নির্বাচন একটি ব্যবস্থাপনা। কেবল প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনে না আসায় কত কিছুই করতে হচ্ছে। এ-ও এক নতুন অভিজ্ঞতা। আওয়ামী লীগ এই ভোটের ব্যবস্থাপক; কে জিতবে, কে হারবে, কাকে ছেড়ে দেয়া হবে, কাকে হারিয়ে দেয়া হবে- এসবেরই একটি ব্যবস্থাপনা মাত্র। ছন্দহীন নির্বাচন, নেই যথার্থ প্রতিযোগিতা। কিন্তু দ্বন্দ্ব আছে, বিতর্কও পিছু ছাড়ছে না। ব্যবস্থাপনা শেষমেশ কতটা উত্তাপ ছড়াবে ভোটের শরীরে; দেখার তো আছেই। ফলে নানা কিছুই এই নির্বাচন থেকে গ্রহণ করার আছে বৈকি! এ সবের অনেক কিছুই আবার এই নির্বাচন থেকে একদম নতুন পাওয়া হতে পারে। সামান্যই অপেক্ষা মাত্র।


আরো সংবাদ



premium cement