জার্মানির ডক্টর পল জোসেফ গোয়েবলস ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ। হিটলারের সময় নাৎসিদের প্রোপাগান্ডা মন্ত্রী ও প্রচারণা-বিশেষজ্ঞ ছিলেন এই গোয়েবলস। যুক্তরাষ্ট্রের লুইস লসনারের উদ্ধার করা ডায়েরি থেকে তার প্রোপাগান্ডার ১৯টি মূলনীতির কথা জানা যায়। যা অতি সংক্ষেপে বলতে গেলে, ‘বুদ্ধির সাথে সরকারের বিভিন্ন অর্গান ব্যবহার করে, দৃঢ়ভাবে বারবার একই কথা বলতে হবে- যা মানুষের কাছে সত্য বলে বিবেচিত হবে।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বাপর ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গিয়ে সেই গোয়েবলসীয় প্রোপাগান্ডা নীতির কথাই মনে পড়ছে। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর থেকে পূর্বপাকিস্তানের রাজনীতি, এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধও ইসলামকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়ে আসছিল। ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক দল- সব জায়গায় ইসলামের প্রাধান্য ছিল।
কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের শুভলগ্ন থেকেই অতি সুকৌশলে বাংলাদেশের রাজনীতি, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ থেকে ইসলাম এবং ইসলামী চেতনাকে পুরোপুরিভাবে মূলোৎপাটন করে দেয়া হয়েছে। অদ্যাবধি এই প্রচেষ্টা চলমান। ইসলামী চেতনা যেন বাংলাদেশে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে পুরোপুরি বিস্মৃত হয়ে যায়, সে ব্যাপারে ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পূর্বমুহূর্ত থেকেই সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করা হয়েছে।
গোয়েবলসীয় প্রোপাগান্ডা নীতি অনুসরণ করেই যেন সুদীর্ঘ অর্ধশতাব্দীকাল ধরে বাংলাদেশে ইসলামকে টার্গেট করে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনীতি থেকে ইসলামী চেতনা, সাম্য ও সামাজিক সুবিচার, ন্যায়-ইনসাফকে বিসর্জন দিয়ে বহাল করা হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা মতবাদ। সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করে নেয়া হয় মূলনীতি হিসেবে।
অথচ, মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালেও এ দেশের রাজনীতি, সমাজনীতি আবর্তিত হচ্ছিল ইসলামী চেতনাকে কেন্দ্র করেই। এ বিষয়ে কিছু নজির তুলে ধরছি। যেগুলো প্রমাণ করে ধর্মনিরপেক্ষতা নয়, ইসলামী চেতনাই ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রধান বিষয়বস্তু।
১. ১৯৬৯ সালে প্রস্তাবিত খসড়া সংবিধান সংশোধনী বিলে সংবিধানে ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান’ শিরোনামসহ এর ইসলামী আদর্শ বহাল রাখার বিষয়ে আওয়ামী লীগ সম্মতি জানিয়েছিল। (সূত্র : মওদুদ আহমদ, অনুবাদ : জগলুল আলম, বাংলাদেশ শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ২০১৬, পৃষ্ঠা : ১২০, ১৬৫)
২. ১৯৭০ সালের নভেম্বরে সাধারণ নির্বাচনের আগে বেতার ও টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধু ভাষণে বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে, আমরা ইসলামে বিশ্বাসী নই। এ কথার জবাবে আমাদের স্পষ্ট বক্তব্য- লেভেলসর্বস্ব ইসলামে আমরা বিশ্বাসী নই। আমরা বিশ্বাসী ইনসাফের ইসলামে। ...
যে দেশের ৯৫ শতাংশ মুসলমান, সে দেশে ইসলামবিরোধী আইন পাসের ভাবনা ভাবতে পারেন তারাই, ইসলামকে যারা ব্যবহার করেন দুনিয়াটা শায়েস্তা করার জন্য।’ (সূত্র : বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, নোবেল পাবলিকেশন্স, ঢাকা, ১৯৮৮, পৃষ্ঠা-২১)
৩. ১৯৭০-এর নির্বাচনে নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ স্পষ্টভাবে ইসলাম প্রশ্নে ঘোষণা করেছিল, ‘ছয় দফা বা আমাদের অর্থনৈতিক কর্মসূচি ইসলামকে বিপন্ন করে তুলেছে বলে যে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হচ্ছে, সেই মিথ্যা প্রচারণা থেকে বিরত থাকার জন্য আমি শেষবারের মতো আহ্বান জানাচ্ছি। অঞ্চলে অঞ্চলে ও মানুষে মানুষে সুবিচারের নিশ্চয়তা প্রত্যাশী কোনো কিছু ইসলামের পরিপন্থী হতে পারে না। আমরা এই শাসনতান্ত্রিক নীতির প্রতি অবিচল ওয়াদাবদ্ধ যে, কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশিত ইসলামী নীতির পরিপন্থী কোনো আইন এ দেশে পাস হতে বা চাপিয়ে দেয়া যেতে পারে না।’ (সূত্র : নুহ-উল-আলম লেনিন সম্পাদিত, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও নির্বাচিত দলিল, সময় প্রকাশন, ২০১৫, পৃষ্ঠা-২৬৫)
৪. ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা ছিল মূলত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দাবি। এতে কোনো ধর্মনিরপেক্ষতার কথা ছিল না; বরং প্রথম দফা ছিল লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দাবি।
৫. ১৯৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী ছাত্র গণআন্দোলনে ছাত্রসমাজ যে ১১ দফা দাবি উত্থাপন করেছিল, তাতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাসংক্রান্ত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকলেও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা ছিল না।
৬. ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টকে এবং ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগকে জনগণ ভোট দিয়েছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির আশায়। আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য। পুরো পাকিস্তান আমলে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা অথবা আওয়ামী লীগের ছয় দফা, ছাত্রসমাজের ১১ দফা, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের কোথাও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা খুঁজে পাওয়া যায়নি।
৭. ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল প্রবাসী সরকার ও স্বাধীনতার ঘোষণা তৈরি করা হয়। পরবর্তীতে ১৭ এপ্রিল ঘোষণার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া হয়। কিন্তু সেই ঘোষণার কোথাও ধর্মনিরপেক্ষতা বা এর কোনো ইঙ্গিত খুঁজে পাওয়া যায় না। স্বাধীনতার লক্ষ্য বা মূলনীতি ঠিক করা হয় সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। এটিই ছিল মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতার ঘোষণা মূলনীতি বা মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা।
১৯৭২ সালে সংবিধান রচনা করে মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতার প্রকৃত চেতনাকে সর্বপ্রথম বিতাড়িত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূলনীতি সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার তথা ইনসাফ অস্বীকার করা হয়। এর পরিবর্তে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ নামে চার মূলনীতি আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়।
ধর্মনিরপেক্ষতার সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ন্যূনতম যোগসূত্র না থাকলেও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতি পেতে গিয়ে ভারতের চাপিয়ে দেয়া এই নীতি তৎকালীন সরকার গ্রহণ করে নিয়েছিল।
১. স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয়ার জন্য ২৪ এপ্রিল ১৯৭১ সালে প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে ভারত সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি চেয়ে চিঠি দেয়া হয়। (সূত্র : বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, তথ্য মন্ত্রণালয়, হাক্কানি পাবলিশার্স, ঢাকা, ২০১০, পৃষ্ঠা-৭৪১)
২. ওই চিঠিতে স্বাধীনতার ঘোষণা, সরকার গঠন ইত্যাদি বিষয়ে উল্লেখ থাকলেও রাষ্ট্রীয় মূলনীতি যা আমরা পরবর্তীকালে সংবিধানে পাই- এ বিষয়ে কোনো কথা বা ইঙ্গিত ছিল না। যার ফলে ভারত সরকার বিভিন্নভাবে গড়িমসি করে ছয় মাস বিলম্ব করে।
৩. পুনরায় ১৫ অক্টোবর ১৯৭১ সালে প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে স্বীকৃতির আবেদন জানিয়ে চিঠি দেয়া হয়। সে চিঠিতেও পাকিস্তানিদের নির্যাতন, বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর জুলুম নির্যাতনের উল্লেখ করলেও ভারত সন্তুষ্ট হয়নি।
৪. পরবর্তীতে ২৩ নভেম্বর ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে ভারত সরকারের স্বীকৃতি লাভের জন্য আবেদন করা হয়।
৫. স্বাধীনতার ঘোষণার মূল তিন নীতিকে অস্বীকার করে ধর্মনিরপেক্ষতাসহ চার মূলনীতি নির্ধারিত হওয়ার পর ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এই স্বীকৃতি আদায় করতে গিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার চেয়ে দীর্ঘ স্বাধীনতার আন্দোলন বা চেতনা বিসর্জন দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতাসহ চার মূলনীতি গ্রহণ করে মুসলিম জাতীয়তাবাদী চেতনা তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া হয়।
ভারত নিজ দেশের সংবিধানেও তখন পর্যন্ত ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি গ্রহণ করেনি।
ধর্মীয় সম্প্রীতির দীর্ঘদিনের ইতিহাসসমৃদ্ধ এই বাংলাদেশে ১৯৪৬ সালে যেভাবে ধর্মীয় দাঙ্গা তৈরি করে হাজার হাজার মুসলিম নিধন করা হয়, তা টিকিয়ে রাখার জন্যই মুসলিম জনগোষ্ঠীকে শায়েস্তা করতে এই ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি নতুন স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের সংবিধানে ঢোকানো হয়।
স্বল্প পরিসরে এর চেয়ে বেশি প্রমাণ হাজির করা সম্ভব নয়। কিন্তু সংক্ষিপ্ত অথচ অর্থবহ এই আলোচনার মাধ্যমে এটিই প্রমাণিত হলো- প্রতিবেশী দেশের প্রভাব, তাদের চাওয়া-পাওয়ার মূল্য দিতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতিকেই নতুন বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে বিসর্জন দিতে হয়েছে। সে সাথে ইসলামী চেতনার পরিবর্তে আমদানি করা হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা মতবাদ। যা এ দেশের ৯৫ শতাংশ মুসলিম জনগোষ্ঠীর আশা-আকাক্সক্ষাকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে।
ধর্মীয় সম্প্রীতির এ ভূমি ধর্মনিরপেক্ষতার নাম দিয়ে এ দেশের মুসলিমদের সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান এবং ধর্ম পালনে নিগৃহীত করা হচ্ছে। ধর্মনিরপেক্ষতা নয় আমাদের এই দেশ, ধর্মীয় সম্প্রীতির দেশ। আমরা ধর্মীয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সব ধর্ম, মত, বর্ণ, জাতি-উপজাতি একসাথে স্বাধীন বাংলাদেশে বাস করতে চাই।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি)
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা