২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১, ২০ মহররম ১৪৪৬
`

মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা

মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা - নয়া দিগন্ত

যে শিক্ষা বোধসম্পন্ন মানুষের জ্ঞানের বিকাশ ঘটায় এবং যার মাধ্যমে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং নৈতিক মূল্যবোধের প্রসার ঘটে তা মানসম্মত শিক্ষা। অন্যভাবে বলা যায়, একটি নির্দিষ্ট মানদণ্ডের আলোকে যখন কোনো শিক্ষাকে বিচার করা হয়, সেটি হয় মানসম্মত শিক্ষা।

মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে আমাদের বেশ কিছু কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। এসব কর্মসূচি হলো : পাঠ্যবই ও শিক্ষাসামগ্রীর মান বাড়ানো ও যথাসময়ে বণ্টন, শিক্ষকদের সক্ষমতা বাড়ানো, নতুন স্কুল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা, পুরনো প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঢেলে সাজানো এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা।

মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণী সৃষ্টি করা হয়েছে। ২০১০ সালে পাঁচ-ছয় বছরের শিশুদের জন্য ৩৭ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক বছর মেয়াদি অবৈতনিক প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু হয়েছে। এ পর্যায়ে শিক্ষা পদ্ধতিকে মানসম্পন্ন করতে ২০১১ সালে জাতীয় প্রাক- প্রাথমিক শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হয়। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এ শিক্ষাক্রমের ভিত্তিতে শিক্ষাসামগ্রী প্রস্তুত করে। এরপর জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর মিলে এনজিও এবং অন্যান্য সহযোগীর সাথে আলোচনার মাধ্যমে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষকদের একটি প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল প্রস্তুত করে। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানে প্রত্যেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি করে ৩৭ হাজার ৬৭২টি সরকারি শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করে নিয়োগ দেয়া শুরু হয়। ইতোমধ্যে ৩৫ হাজার শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।

প্রাক-প্রাথমিকে ভর্তির হার ২০১০ সালের তুলনায় বর্তমানে তিন গুণ বেড়েছে। ২০১২ সালে শতকরা ৫০ ভাগ প্রথম শ্রেণীর শিক্ষার্থীর প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার অভিজ্ঞতা ছিল। ২০১৫ সালে দাঁড়ায় শতকরা ৯৬.১ ভাগ। বতর্মানে এ হার প্রায় শতভাগ। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার ভবিষ্যৎ লক্ষ্য হলো প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানকারী সব বিদ্যালয়ে একটি নির্দিষ্ট মান বজায় রাখা এবং মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে আরো একধাপ এগিয়ে যাওয়া।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখন বিভিন্ন সংস্কৃতি-আর্থসামাজিক অবস্থান থেকে উঠে আসা ও নানা শারীরিক প্রতিবন্ধকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সক্ষম শিশুদের চাহিদার প্রতি বিশেষভাবে মনোযোগী। শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশুরা এখন মূলধারার স্কুলে ভর্তি হতে ও শিক্ষা নিতে পারছে। দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকার ও দরিদ্র পরিবারের শিশুসহ সব শিশুর জন্য পরিচালিত হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা উপবৃত্তি কর্মসূচি ও রিচিং-আউট-অব-চিলড্রেন প্রকল্প (রস্ক)। এখন প্রথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা দুই কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পায়। বিভিন্ন স্তরে ৮০ হাজার প্রতিবন্ধী শিশুকে উপবৃত্তি দেয়া হয়। সমাজে সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠী যেমন- বেদে ও নিম্নশ্রেণীর সন্তানরা লেখাপড়া চালিয়ে নিতে মাসিক বৃত্তি পেয়ে থাকে। বর্তমানে তিন কোটির বেশি শিক্ষার্থী স্কুল ফিডিং কর্মসূচির আওতায় খাদ্যসহায়তা পাচ্ছে। এ পদ্ধতি ১৫০টি উপজেলায় চালু আছে। এর মধ্যে ৮৫টি উপজেলার কার্যক্রম চলছে সরকারি অর্থায়নে। আগে ঝরে পড়া প্রায় ৯৮ হাজার ২১১ শিক্ষার্থী ২০১২ সালে রস্ক প্রকল্প চালু থাকাকালীন প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। চতুর্থ উন্নয়ন কর্মসূচির (পিইডিপি-৪) আওতায় বিদ্যালয়ের বাইরে থাকা ১০ লাখ শিশু শিক্ষাকেন্দ্রে প্রাথমিক শিক্ষা পেয়েছে। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতে প্রতিনিয়ত পাঠ্যক্রম, সিলেবাস ও পাঠ্যপুস্তকের বিষয়গুলো উন্নত করা, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং বিদ্যালয়ের পরিবীক্ষণ প্রক্রিয়া উন্নত করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। শিক্ষকের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং শিক্ষাবান্ধব অবকাঠামোয় বিনিয়োগ বাড়ানো ও গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। দক্ষতানির্ভর পাঠ্যক্রমের সাথে সামঞ্জস্য আনতে শিখন-শেখানো পদ্ধতি ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়া ক্রমাগত পর্যালোচনা হচ্ছে। এসব প্রচেষ্টার কারণে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া কমেছে। শিক্ষার মান ও শিক্ষা সমাপনের হারও বেড়েছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপাত্ত অনুযায়ী, ২০১৬ সালে প্রাথমিকে গমন উপযোগী শিশুদের ৯৭.৯৪ শতাংশ ভর্তি হয়েছিল। ২০২৩ সালে এ হার বেড়ে হয়েছে ৯৮%। ২০২৩ সালে ঝরে পড়ার হার ১৪.১৫ শতাংশ। তবে প্রত্যাশিত মানের শিক্ষা অর্জনে সার্বিক যে ইতিবাচক পরিবেশ প্রয়োজন তা থেকে বাংলাদেশ এখনো বেশ কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে। এর বড় কারণ আমাদের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী এবং তাদের জন্য শিক্ষার মান নিশ্চিতের ক্ষেত্রে বিদ্যমান বিভিন্ন অন্তরায়।
মনে রাখা প্রয়োজন, মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে উপযোগভিত্তিক শিক্ষার সাথে জোরালো সামাজিক ও মানসিক মূল্যবোধে বলীয়ান শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। একই স্তরের শিক্ষার্থীদের শেখার ক্ষেত্রে অসমতা, বিভিন্ন ধরনের শিক্ষার মধ্যে ব্যাপক ফারাক, দুর্বল শিখন মূল্যায়ন, শিক্ষকের উন্নয়ন ও জবাবদিহিতা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা, শিক্ষক প্রণোদনার অভাব, ঝরে পড়ার উচ্চহার, অতি দরিদ্র বা দুর্গম এলাকার শিশু ভর্তি না হওয়া, প্রাথমিক পরবর্তী পর্যায়ে শিক্ষার্থী বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থী হ্রাস, নগর অঞ্চলে দরিদ্র জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং মানসম্মত দক্ষতা প্রশিক্ষণমূলক শিক্ষার অভাব প্রভৃতি কারণগুলো মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের প্রধান অন্তরায়।

মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছর থেকে পাঁচ বছরের জন্য চতুর্থ উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি-৪) বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এ কর্মসূচির প্রধান উদ্দেশ্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিখন-শেখানো পদ্ধতির মানোন্নয়ন করা। এ প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষাক্রম ও পরীক্ষা পদ্ধতির উন্নয়ন, একদল সুশিক্ষিত শিক্ষক তৈরি এবং স্কুলের নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম মূল্যায়নে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা হচ্ছে। যেহেতু মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে শিক্ষকের ভূমিকা মুখ্য, তাই সরকার তাদের সক্ষমতা নিশ্চিত করতে চায়। সে লক্ষ্যে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষকের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেশনের পাশাপাশি এর সাথে ইংরেজি, বাংলা, প্রাথমিক গণিত, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়, প্রাথমিক বিজ্ঞান, সঙ্গীত, চারু ও কারুকলা ও শরীরচর্চার মতো বিষয়গুলো শিখন-শেখানো পদ্ধতি প্রশিক্ষণ চলমান রয়েছে। এ বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদনে প্রয়োজন পর্যাপ্ত আর্থিক বরাদ্দ।

ইউনেস্কোর নীতিমালা অনুযায়ী একটি দেশের শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ মোট জিডিপির ৬ শতাংশ হওয়া উচিত, যা মোট বাজেটের ২৫ শতাংশ। সেখানে এ ক্ষেত্রে বরাদ্দ জিডিপির মাত্র ১.৯ শতাংশ। পরবর্তী সময়ে তা বাড়িয়ে ২.৪ শতাংশ করা হয়। কিন্তু ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে এ বরাদ্দ কমিয়ে জিডিপির মাত্র ১.৭৬ শতাংশের কথা বলা হয়েছে।

উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে শিক্ষাক্ষেত্রের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করতে হবে সর্বাগ্রে।
লেখক : প্রধান শিক্ষক


আরো সংবাদ



premium cement
অস্ত্রবিরতির জন্য হ্যারিসের আহ্বান, সমালোচনায় ইসরাইলি কট্টরপন্থিরা আহতদের দেখতে পঙ্গু হাসপাতালে প্রধানমন্ত্রী ‘ছুরি দিয়ে গলাকেটে হত্যা করার পর হাত-পা বেঁধে ফেলেছি’ নাশকতাকারীদের ছাড় দেয়া হবে না : ডিবিপ্রধান হারুন সিলেটে আজ কারফিউ শিথিল ১২ ঘণ্টা কোটা আন্দোলন : পূর্ব রেলের ক্ষতি ২২ কোটি টাকা সাগরে লঘুচাপ, ৬০ কিমি বেড়ে ঝড়ের আভাস পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হলে কারফিউ তুলে নেয়া হবে : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্যারিস অলিম্পিক্স : গণহত্যা চালানো নদীতে লাল গোলাপ দিলো আলজেরিয়া মার্কিন নির্বাচনের আগেই ইসরাইল-সৌদি সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে! পাকিস্তানকে হারিয়ে এশিয়া কাপের ফাইনালে শ্রীলঙ্কা

সকল