০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`


যে বই দেশপ্রমিকদের পড়া উচিত

-

পেশাগত জীবনে উদ্ভিদ বিজ্ঞানের শিক্ষক ও গবেষক ছিলেন প্রফেসর ড. এবনে গোলাম সামাদ। কিন্তু উদ্ভিদ বিজ্ঞানী হবেন এমন কোনো লক্ষ্য তিনি শৈশব-কৈশোরে লালন করেননি। এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় যা ঘটে থাকে প্রায় সবার বেলায়ই, ছাত্রের পছন্দ-অপছন্দ বা ইচ্ছা-অনিচ্ছা গুরুত্ব পায় না, সে রকম হয়েছিল তার ক্ষেত্রেও। কিভাবে যেন তিনি গাছে উঠে পড়েছিলেন। কিন্তু একবার যখন উঠেছেন তখন উদ্ভিদের এ-ডাল সে-ডাল তো বটেই তার ভেতরেও ঢুকেছেন, যতটা গভীরে এ দেশের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের একজন ছেলের পক্ষে ঢোকা তখন সম্ভবপর ছিল। উদ্ভিদবিজ্ঞান নিয়ে উচ্চতর ডিগ্রি করেছেন প্যারিস ও লন্ডনের নামকরা প্রতিষ্ঠান থেকে।

তার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন অত্যন্ত নিষ্ঠা ও নিবেদনের সাথে। ছাত্র-শিক্ষকদের পড়াশোনায় কাজে লাগবে এ রকম বইও লিখেছেন, যেমন ‘উদ্ভিদ সমীক্ষা’ (১৯৬৬) ও ‘প্রাথমিক জীবাণুতত্ত্ব’ (২০০৭)। কর্মস্থলে পড়াশোনা করা এবং ছাত্রবান্ধব শিক্ষক হিসেবে তার সুনাম অক্ষুণ্ণ ছিল শেষ দিন পর্যন্ত।

তিনি চিত্রশিল্পী হতে চেয়েছিলেন। শৈশব-কৈশোরের এ লালিত আকাঙ্ক্ষা সেভাবে পূরণ না হলেও শিল্পকলা নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেছেন। লিখেছেন এ বিষয়ের ওপর আকর গ্রন্থ - ‘শিল্পকলার ইতিকথা’ (১৯৬০), ‘ইসলামী শিল্পকলা’ (১৯৭৮) ও ‘মানুষ ও তার শিল্পকলা’ (২০০৬)। এভাবে চিত্রশিল্পী না হতে পারলেও, হয়েছেন শিল্পকলার বিশেষজ্ঞ।

প্রফেসর সামাদের জ্ঞানস্পৃহা ছিল বহুমুখী। নিজের একাডেমিক জগতের বাইরে এত বিচিত্র বিষয়ে গভীর জ্ঞানার্জন ও গ্রন্থরচনার উদাহরণ খুব কমই আছে। বাংলাদেশে নৃতত্ত্ব নিয়ে তিনিই প্রথম বই লেখেন। ‘নৃতত্ত্ব’ নামের বইটি বাংলা একাডেমি ১৯৬৭ সালে প্রকাশ করে। এ ছাড়া ইতিহাস, সাহিত্য, ধর্ম, সংস্কৃতি, রাজনীতি, কৃষি, অর্থনীতি, যুদ্ধ, কূটনীতি, নানান বিষয় নিয়ে লিখেছেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে; যখন যা ভালো লেগেছে বিক্ষিপ্তভাবে তার চর্চা করেছেন। কিন্তু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে, আপাতবিক্ষিপ্ত এসব বিষয়ের মধ্যে একটা অন্তর্গূঢ় সম্পর্ক রয়েছে; যা কিছুই তিনি পড়ুন বা লিখুন না কেন, তার অভিমুখ হচ্ছে বাংলাদেশ এবং এ ভূখণ্ডের মানুষ।

নানান ঐতিহাসিক উত্থান-পতন ও টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির অভ্যুদয় ঘটেছে। এখন আমাদের প্রাথমিক দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রটিকে স্বাধীন ও সার্বভৌম হিসেবে টিকিয়ে রাখা। দ্বিতীয়ত, কেবল টিকিয়ে রাখাই নয়, মর্যাদাবান ও সমৃদ্ধ জাতিরাষ্ট্র হিসেবে এর বিকাশ ও ক্রমোন্নতি নিশ্চিত করা। কাজটি কঠিন, কারণ জন্মলগ্ন থেকেই বিচিত্র সব জটিলতা রাষ্ট্রটিকে পেয়ে বসেছে; এর ঘূর্ণাবর্তে পড়ে একেক সময় একেক দিকে ছুটে চলেছে। তার মূল কারণ আত্মপরিচয়ের সঙ্কট। জাতিসত্তার প্রশ্নে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী দ্বিধাহীন বা নিশ্চিত হতে পারেনি। এ দ্বিধা ও অনিশ্চয়তা আরো গভীর ও জটিল করে তোলার বহুমুখী চক্রান্ত চলে আসছে শুরু থেকেই। এ সঙ্কট অপনোদনে প্রয়োজন যে ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, শিল্পকলা, সংস্কৃতি, ধর্ম, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ের জ্ঞান ও চর্চা।

এবনে গোলাম সামাদ তাকেই তার নিজস্ব অধ্যয়ন, গবেষণা ও লেখালেখির বিষয় করেছেন। এটি করতে গিয়ে অন্ধের মতো কোনো ‘তৈরি’ করা তথ্য ও বয়ান গ্রহণ করেননি। কারণ অতীত ও বর্তমানের অভিজ্ঞতা প্রচলিত অনেক তথ্য ও বয়ানকে সমর্থন করে না। তিনি নৃতত্ত্ব, শিল্পকলা, ইতিহাস ও সাহিত্য ঘেঁটে এ ভূখণ্ড এবং জনগোষ্ঠীর মৌলিক মানবিক বৈশিষ্ট্য, আবেগ, বিশ্বাস, প্রবণতা, অভ্যাস, ধর্মাচরণ, ভাষা ও দৈনন্দিনতাকে খুঁজে বের করেছেন এবং তার ভিত্তিতে তার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে শনাক্ত করেছেন; তার পর বলেছেন সমকালে ও ভবিষ্যতে জাতির কী করণীয়। বাঙালি মুসলমান যে, একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তার অধিকারী তা তিনি তথ্য-উপাত্ত সহযোগে ব্যাখ্যা করেছেন। তার যাবতীয় জ্ঞানচর্চা মূলত এই একটি বিষয় ঘিরে আবর্তিত হয়েছে।

খুব সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন সামাদ। মিশতেন সাধারণ মানুষের সাথে। সবজি বিক্রেতা, মুদির দোকানি, রিকশাচালক, দোকানের কর্মচারী, বই বিক্রেতা - এরাই ছিলেন তার দৈনন্দিন আলাপ-গল্পের মানুষ। আর পছন্দ করতেন সাংবাদিকদের সাথে আড্ডা দিতে। সর্বশেষ খবর রাখতেন স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের। তার একটা প্রবণতা ছিল লক্ষ্য করার মতো। সেটি হলো প্রশ্ন করা, বিতর্ক তৈরি করা। আপনি যদি আমেরিকার পক্ষ নেন তো তিনি নেবেন রাশিয়ার পক্ষ। বিতর্কে তিনি প্রতিপক্ষকে উসকে দিতেন, এভাবে জেনে নিতেন তার যুক্তি ও দৃষ্টিভঙ্গি। সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা, বিশ্বাস, ধারণা ও আকাঙ্ক্ষাকে তিনি খুব গুরুত্ব দিতেন। তিনি ছিলেন জ্ঞানের ভাণ্ডার। আর ছিল প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব। যেকোনো বিষয়েই হোক, তার ঠোঁটে উত্তর যেন আগে থেকেই মজুদ থাকত। সহজে রাগ করতেন না, যদিও একবার না বললে হাঁ করানো মুশকিল ছিল। একটি পত্রিকায় লিখতে রাজি করানোর জন্য আমাকে তার পেছনে মাসের পর মাস সময় দিতে হয়েছিল। তার সংসারে আর্থিক অনটন ছিল, চিকিৎসার টাকা জুটত না, তবুও অর্থের প্রত্যাশায় জ্ঞানচর্চা করেননি কখনো। ফরমায়েশি লেখা তাকে দিয়ে লেখানো যেত না।

প্রফেসর সামাদ শেষজীবনে কলামিস্ট হিসেবেই অধিক খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। বাংলাদেশে কলাম বলতেই একদেশদর্শী বয়ানের ফুলঝুরি বোঝায়, যেখানে থাকে কিছু সত্যের সাথে অধিক অর্ধসত্য কিংবা মিথ্যার মিশেলে বানানো আবেগময় কাহিনীর বিস্তার। তিনি এ দুর্নাম থেকে কলামিস্টদের উদ্ধার করেছিলেন। তার কলামগুলো ছিল প্রবন্ধ ও নিবন্ধের মতো, তাতে থাকত প্রয়োজনীয় ও প্রাসঙ্গিক তথ্য এবং তার ভিত্তিতে নির্বাচিত বিষয়ের বিশ্লেষণ। তার সাথে তিনি নিজস্ব মতামত ও দিকনির্দেশনাও জুড়ে দিতেন; কখনো প্রত্যক্ষভাবে, কখনো পরোক্ষভাবে।

বাংলাদেশের শতকরা নব্বই ভাগ (আনুমানিক) বুদ্ধিজীবীই একচক্ষু হরিণের মতো, তারা এক দিকে দেখেন তো আরেক দিক সম্পর্কে থাকেন সম্পূর্ণ অন্ধ। আরো ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে, তাদের এ পক্ষপাতদুষ্টতা ইচ্ছাকৃত। প্রফেসর এবনে গোলাম সামাদ ছিলেন এ রকম বশংবদতার ঘোর বিরোধী। তিনি কোনো রাজনৈতিক আদর্শ, দল বা গোষ্ঠীর আনুগত্য করেননি। অন্ধভাবে কারো সমর্থন বা বিরোধিতা করতেন না; না ব্যক্তিগত পর্যায়ে না জাতীয় পর্যায়ে, না বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে, না ব্যবহারিক জীবনে। কোনো দল বা গোষ্ঠী তার সত্যিকারের আপন ছিল না, তিনিও কোনো দল বা গোষ্ঠীর চিরকালের আপন ছিলেন না। সে জন্য বাস্তব জীবনে তাকে অনেক ভুগতে হয়েছে, আর্থিকভাবে ও সামাজিকভাবেও, যেমন - বিশ্ববিদ্যালয়ে বারবার তার পদোন্নতি আটকে দেয়া হয়েছে। কিন্তু দেশ, জাতি ও মানুষের কল্যাণকর ও করণীয় বিষয়ে কারো রাগ বা বিরাগের পরোয়া করেননি তিনি। স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করেছেন সবসময়।

সত্যিকারের জ্ঞানান্বেষী বুদ্ধিজীবী হিসেবে তার আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিপরীত মতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীল মনোভাব। মতভিন্নতাকে তিনি বুদ্ধিবৃত্তিকভাবেই দেখেছেন এবং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবেই তার বিরোধিতা করেছেন প্রাসঙ্গিক ও প্রামাণ্য তথ্য উপস্থাপন ও যুক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে। অদম্যতা, আনুগত্যহীনতা, বস্তুনিষ্ঠা, স্বাধীন চিন্তা ও পরমতসহিষ্ণুতা তাকে চিন্তক হিসেবে বিশিষ্টতা দিয়েছে এবং সত্যিকারের বুদ্ধিজীবী হিসেবে উচ্চ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।

এবনে গোলাম সামাদ (জন্ম ২৯ ডিসেম্বর, ১৯২৯) গত বছরের (২০২১) ১৫ আগস্ট ইন্তেকাল করেছেন। তিনি আর লিখবেন না। কিন্তু যে পরিমাণ রচনা তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন সেটি কম নয়। তার প্রকাশিত কয়েকটি বই এখন আর বাজারে পাওয়া যায় না। তার অগ্রন্থিত রচনার পরিমাণও বিপুল। সেগুলোর সঙ্কলন, প্রকাশ ও প্রচার দরকার। এ কথা ঠিক যে, তিনি বিচিত্র বিষয়ে বৈচিত্র্যময় লেখা লিখেছেন। সে কারণে তার অনেক চিন্তা ও মত বিক্ষিপ্ত থেকে গিয়েছে, যা তার সমগ্র রচনাবলি না পড়লে বোঝা ও আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। সাধারণ পাঠকের জন্য সেটি কিছুটা কষ্টসাধ্য। সে জন্য এবনে গোলাম সামাদের জ্ঞানচর্চার বিষয়গুলো পদ্ধতিগতভাবে বিন্যস্ত করা প্রয়োজন। এ কাজে গবেষকদের এগিয়ে আসতে হবে।

প্রফেসর ড. এবনে গোলাম সামাদ সম্পর্কে এ সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনার অবতারণা সম্প্রতি প্রকাশিত তার ‘রচনাসংগ্রহ’ পড়তে গিয়ে। পরিলেখ প্রকাশনী এটি বের করেছে। তিন খণ্ডের রচনাসংগ্রহে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৯টি বাছাই করা বই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। প্রথম খণ্ডে রয়েছে ‘বায়ান্ন থেকে একাত্তর’, ‘বাংলাদেশে ইসলাম’ এবং ‘বাংলাদেশ : সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতি প্রতিক্রিয়া’, দ্বিতীয় খণ্ডে ‘আত্মপরিচয়ের সন্ধানে’, ‘আত্মপক্ষ’ ও ‘আমাদের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা ও আরাকান সঙ্কট’ এবং তৃতীয় খণ্ডে রয়েছে ‘ইসলামী শিল্পকলা’, ‘বাংলাদেশের আদিবাসী এবং জাতি ও উপজাতি’ এবং ‘বাংলাদেশ : মানুষ ও ঐতিহ্য’। এ ছাড়া প্রত্যেক খণ্ডে রয়েছে অগ্রন্থিত অনেক রচনা। প্রায় হারিয়ে যাওয়া বেশ কিছু মূল্যবান প্রবন্ধ ও নিবন্ধও এ রচনাসংগ্রহে স্থান পেয়েছে। দেশপ্রেমিক নাগরিক এবং জ্ঞানপিপাসু, চিন্তাশীল ও সচেতন পাঠকের জন্য এবনে গোলাম সামাদের এ রচনাসংগ্রহ অবশ্যপাঠ্য।

প্রফেসর এবনে গোলাম সামাদের ‘রচনাসংগ্রহ’ প্রকাশ খুব গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োচিত কাজ। এর মাধ্যমে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘পরিলেখ’ একটি জাতীয় প্রয়োজন পূরণ করল। সে জন্য ‘পরিলেখ’-এর কর্ণধারদের ধন্যবাদ জানাতেই হয়। আমরা আশা করব, ‘পরিলেখ’ অদূর ভবিষ্যতে তার অন্যান্য বই এবং অগন্থিত রচনাগুলোও প্রকাশ করবে।

বিশেষ দ্রষ্টব্য : এবনে গোলাম সামাদের রচনাসংগ্রহ বাংলা একাডেমির একুশে বইমেলায় পরিলেখ প্রকাশনীর ২৯ নম্বর স্টলে পাওয়া যাচ্ছে।


আরো সংবাদ



premium cement