১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চাই মাদকমুক্ত সুস্থ জীবন

-

মাদক, বিশ্বব্যাপী মানবজাতির জন্য এক ভয়াবহ সমস্যা। মাদকের আগ্রাসন আজ দেশে দেশে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। মাদকের নীল ছোবলে ধ্বংস হয়েছে লাখো মানুষের সুন্দর স্বাভাবিক জীবন এবং সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ। প্রতিনিয়ত অসংখ্য মানুষ নানাভাবে মাদকে আসক্ত হচ্ছে এবং ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সব শ্রেণীর মানুষই সর্বনাশা মাদকে আক্রান্ত। বস্তি থেকে প্রাসাদ এবং বলিউড থেকে হলিউড সর্বত্রই মাদকের উপস্থিতি বিদ্যমান। নর-নারী, ছোট-বড়, ধনী-গরিব সবাই মাদকের নেশায় ধ্বংস হচ্ছে। যে একবার মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে সে ক্রমেই আরো বেশি করে দ্রæত ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে।

নিয়মিত মাদক গ্রহণকারী ক্রমে তার স্বাভাবিক জীবন হারিয়ে ফেলে এবং আস্তে আস্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। মাদক আক্রান্ত ব্যক্তির পক্ষে চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সংসারকর্ম কোনোটাই করা সম্ভব নয়। এভাবে কার্যত একটি সমাজই ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়। সে জন্যই মাদক নির্মূল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাদক মানবজাতির জন্য একটি ক্যান্সার। ক্যান্সারের মতো মাদকদ্রব্য ও মানবদেহের সব শক্তি এবং সম্ভাবনা ধ্বংস করে দেয়। এই মাদকের সাম্রাজ্য অনেক বিস্তৃত। সিগারেট, মদ, গাঁজা, আফিম, হেরোইন, ইয়াবা, ফেনসিডিল, আইস ইত্যাদি মাদকের বিভিন্ন রূপ। এসবে মাদক বা নেশার মাত্রা ভিন্ন ভিন্ন। মাদকের প্রথম ধাপ কিন্তু ধূমপান। যারা মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছে তারা সবাই প্রাথমিকভাবে ধূমপানে আসক্ত ছিল। পর্যায়ক্রমে তারা শক্তিশালী মাদকে আসক্ত হয় এবং ক্রমান্বয়ে নিঃশেষ হয়ে যায়। সুস্থ শরীর এবং মন একজন মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ।

মাদকদ্রব্য মানুষের শরীর এবং মন সবই ধ্বংস করে দেয়। সুতরাং আসুন আমরা আমাদের মানবসমাজকে মাদকের ছোবল থেকে রক্ষা করি এবং এর মাধ্যমে মানবজাতিকে রক্ষা করি। এজন্য মাদককে নির্মূল করতে হবে। কেবল আইন করে এবং মাদক ব্যবসায়ীদের শাস্তি দিয়ে কখনো মাদক নির্মূল এবং মাদকমুক্ত জীবন সম্ভব নয়। মাদক নির্মূল এবং মাদকমুক্ত জীবনের জন্য প্রয়োজন মাদকমুক্ত মানুষ। কারণ মাদক নির্মূলের জন্য যিনি আইন প্রয়োগ করবেন, তিনি যদি নিজেই মাদকাসক্ত অথবা মাদক ব্যবসার সাথে যুক্ত থাকেন তাহলে মাদক নির্মূলের জন্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ হবে না। আইনের মাধ্যমে মাদক নির্মূল তখনই সম্ভব, যখন আইন প্রয়োগকারী প্রতিটি ব্যক্তি মাদকমুক্ত জীবনের অধিকারী এবং মাদক নির্মূলে অঙ্গীকারবদ্ধ হবে। এজন্য মাদকমুক্ত মানুষ তৈরি করতে হবে এবং এর কোনো বিকল্প নেই। রাজনৈতিক দল ও এর নেতৃত্বকে অবশ্যই মাদকমুক্ত হতে হবে এবং মাদক নির্মূলে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ হতে হবে। রাষ্ট্রের উদ্যোগে আইন করে মাদকের উৎপাদন এবং বিপণন বন্ধ করতে হবে। মাদক ব্যবসায় জড়িতদের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান করতে হবে। রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক উদ্যোগে মাদকবিরোধী প্রচারণা চালাতে হবে এবং মাদকের কুফল সম্পর্কে জনগণকে বোঝাতে হবে। মোট কথা মাদক নির্মূলে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং রাষ্ট্রের ভূমিকা অপরিহার্য।

মাদক নির্মূলে প্রথমত মাদকমুক্ত মানুষ তৈরি করতে হবে এবং এটা সবারই দায়িত্ব। এ কাজটা সমাজের প্রাথমিক স্তর পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে, যার মূল ভিত্তি হচ্ছে বাবা-মা। বাবা-মার দায়িত্ব হলো, সন্তানকে ছেলেবেলা থেকেই মাদক থেকে দূরে রাখা এবং মাদকমুক্ত জীবনযাপনে অভ্যস্ত করে তোলা। সন্তান যেন কোনো অবস্থাতেই মাদকসেবীদের খপ্পরে না পড়ে এবং মাদকাসক্ত না হয়ে পড়ে, সে বিষয়ে অবশ্যই প্রতি মুহূর্তে খেয়াল রাখতে হবে। এজন্য সন্তানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়তে হবে এবং মাদকের কুফল সম্পর্কে বোঝাতে হবে। তবে বাবা যেহেতু বেশির ভাগ সময় বাসার বাইরে থাকে তাই এ ক্ষেত্রে মায়ের দায়িত্ব বেশি।

সব বাবা-মা-ই সন্তানকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার সব রকমের চেষ্টা করেন, চাকরি অথবা ব্যবসার মাধ্যমে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। এর পাশাপাশি সন্তানকে মাদকমুক্ত জীবনযাপনের শিক্ষা দিতে হবে। বখাটে ছেলেদের পাল্লায় পড়ে অনেক সময় সন্তানেরা মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ে। কৈশোরের তারুণ্যের জোয়ারে এই সন্তানেরাই এক দিন ধূমপান শুরু করে এবং তারপর মাদকের দিকে হাত বাড়ায়। এভাবে শিক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মাধ্যমে যে সন্তানের সুন্দর একটি জীবনযাপনের কথা ছিল, সেই সন্তানই মাদকাসক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনই হারিয়ে ফেলছে এবং ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং সন্তানের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলুন, তাদেরকে সময় দিন, তাদের সাথে প্রাণ খুলে কথা বলুন। দেখবেন আপনার সন্তান কখনো মাদকাসক্ত হবে না।

দ্বিতীয়ত ছাত্ররা যাতে মাদকমুক্ত থাকতে পারে সেজন্য বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন আনতে হবে এবং মাদকমুক্ত শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। শিক্ষককে বলা হয় দ্বিতীয় জন্মদাতা। মাদকমুক্ত নাগরিক সৃষ্টির ক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকা অপরিসীম। যদি পাঠ্যপুস্তকে মাদকের কুফল সম্পর্কে বলা হয় এবং শিক্ষকরা যদি কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের মাদকের কুফল সম্পর্কে শিক্ষা দেন এবং মাদকমুক্ত জীবন গড়তে উদ্বুদ্ধ করেন তাহলে সহজেই শিক্ষার্থীরা মাদকমুক্ত জীবন গড়তে পারবে। তারা বড় হয়ে মাদক নির্মূলে কাজ করবে।

তৃতীয়ত রাজনৈতিক দলগুলোতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে, যাতে করে দলের কর্মীরা সততা এবং নৈতিকতার পাশাপাশি মাদকমুক্ত জীবন সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করে। দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের ওপর রাজনৈতিক দলের সরাসরি প্রভাব থাকে এবং রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্র ও দলের কর্মসূচি দ্বারা নেতাকর্মীরা প্রভাবিত হয়। সুতরাং যে দলের নেতারা মাদকাসক্ত, যে দলে মাদকমুক্ত জীবনের চর্চা নেই, যে দলে কর্মীদের মাদকমুক্ত হিসেবে গড়ে তোলার কোনো ব্যবস্থা নেই, সেই দল ও দলের নেতাকর্মীদের দিয়ে মাদকমুক্ত সমাজ গড়া সম্ভব তো নয়ই বরং তাদের দিয়ে সমাজে মাদকের আরো বিস্তার ঘটবে। চতুর্থত দেশের সাংস্কৃতিক মাধ্যমকে মাদকমুক্ত করতে হবে। নাটক সিনেমা হচ্ছে সমাজের দর্পণ, সমাজকে পরিবর্তনের হাতিয়ার। এমন নাটক এবং সিনেমা তৈরি করতে হবে যাতে করে এসব নাটক এবং সিনেমা দেখে মানুষ মাদকের কুফল সম্পর্কে জানতে পারবে। কিন্তু বিশে^র দেশে দেশে বর্তমানে যে চলচ্চিত্র তৈরি হচ্ছে তার প্রধান বিষয় হচ্ছে ভায়োলেন্স, অশালীন নৃত্য এবং কুরুচিপূর্ণ গল্পকাহিনী। পাশাপাশি সিনেমার নায়ক নায়িকা এবং ভিলেনরা ফ্যাশন হিসেবে মাদক গ্রহণ করেন। এসব দেখে কোমলমতি ছেলেমেয়েরা অতি সহজেই চরিত্র হারানোর পাশাপাশি মাদক গ্রহণে অভ্যস্ত হচ্ছে। মাদকমুক্ত সুন্দর সমাজ গড়তে হলে নাটক-সিনেমায়ও পরিবর্তন আনতে হবে। তার জন্য নাটক ও চলচ্চিত্র থেকে ভায়েলেন্স, অশালীনতা এবং মাদকের ব্যবহার দূর করতে হবে এবং তৈরি করতে হবে মূল্যবোধসম্পন্ন সুস্থ ধারার নাটক ও চলচ্চিত্র। এজন্য ব্যক্তি উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা অবশ্যই প্রয়োজন।

অসুখ হওয়ার পর চিকিৎসা করে সুস্থ হওয়ার চেয়ে অসুখ প্রতিরোধ করাই উত্তম এবং এটাই সঠিক পথ। সুতরাং আমাদের স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে চলতে হবে। এর পরও যদি শরীর অসুস্থ হয় তাহলে চিকিৎসা করে সুস্থ হতে হবে। একইভাবে মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে মাদক নির্মূল করতে হবে।

সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও আজ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এ জন্য মাদকবিরোধী সচেতনতা বাড়াতে হবে এবং মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের সুস্থ করে তোলার জন্য মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। মাদকদ্রব্যের উৎপাদন বন্ধের জন্য রাষ্ট্রের উদ্যোগে আইন প্রণয়ন করতে হবে এবং তার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। মাদক নির্মূলের জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর নামে যে প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাকে আরো বেশি সক্রিয় এবং গতিশীল করতে হবে। আর এখানে সত্যিকারের মাদকমুক্ত এবং মাদক নির্মূলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ জনবল নিয়োগ দিতে হবে। প্রবাদ আছে- Save a generation to save a nation. অর্থাৎ একটি জাতিকে রক্ষার জন্য একটি প্রজন্মকে রক্ষা করো। সুতরাং একটি জাতিকে রক্ষার জন্য একটি প্রজন্মকে রক্ষা করতে হবে। একটি জাতিকে গঠনের জন্য একটি প্রজন্মকে গঠন করতে হবে। আমরা যদি একটি মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ে তুলি, তাহলে সেই প্রজন্ম তার পরবর্তী প্রজন্মকে মাদকমুক্ত হিসেবে গড়ে তুলবে।
লেখক : প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক
Email-omar_ctg123@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement
দেশে করোনায় আরো একজনের মৃত্যু উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনের অংশ নিতে মানা সবল-দুর্বল ব্যাংক একীভূত করার কাজ শেষ হতে কত দিন লাগবে? জনগণের শক্তির কাছে আ'লীগকে পরাজয় বরণ করতেই হবে : মির্জা ফখরুল টাইম ম্যাগাজিনের ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় মেরিনা তাবাসসুম বিএনপি নেতারা সন্ত্রাসীদের সুরক্ষা দেয়ার অপচেষ্টা করছে : ওবায়দুল কাদের ট্রাকচাপায় নিহত ১৪ : তদন্ত কমিটি গঠন, চালক-হেলপার গ্রেফতার নেতানিয়াহুর একগুঁয়েমির কারণে মধ্যস্তকারীর ভূমিকা থেকে সরে যাবে কাতার! আফ্রিদির সাথে বিবাদের বিষয়ে কথা বললেন বাবর বাংলাদেশে গ্রিসের দূতাবাস হচ্ছে : পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাকিস্তানের সাথে টেস্ট খেলতে চান রোহিত

সকল