১৯ মে ২০২৪, ০৫ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলকদ ১৪৪৫
`


মুনশী জমিরুদ্দীনের ঋণ

মুনশী জমিরুদ্দীনের ঋণ - ফাইল ছবি

জমিরুদ্দীনের আত্মজীবনীমূলক রচনা ‘আমার জীবনী ও ইসলাম গ্রহণ বৃত্তান্ত’ রচিত হয় ১৮৯৫ সালে। ২৪ পৃষ্ঠার এ বই যশোরের অন্নপূর্ণা প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় ১৩০৪ হিজরি, ১৮৯৭ সালে। বইটিতে জমির নিজেকে পুরো উন্মোচন করেননি। একটি দ্রুতরেখ বয়ান দিয়ে গেছেন। এখানে জমিরের যে জীবন বিবৃত, তা ঝড়ে ও সঙ্কটে কম্পমান। যখন তিনি খ্রিষ্টধর্ম ত্যাগ করে আপন আলয়ে ফিরে এলেন, স্থানীয় মুসলিম সমাজ তাকে প্রত্যাখ্যান করল। একঘরে করে রাখল। যেন তিনি জীবন্ত এক পাপ। তারা যেমন জানত না ইসলামের শিক্ষাকে, তেমনি জানত না জমিরের প্রতিভা সম্পর্কে। তার জীবনযাপন তারা কঠিন করে তুলল এবং ঋণের ওপর নির্ভর করে চলছিল জমিরের জীবন।

অপর দিকে মিশনারিদের তরফে জমিরের কাছে আসছিল অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা এবং উন্নত জীবন যাপনের নিশ্চয়তা। জমির সেই পরিস্থিতিতে লড়ে গেছেন সত্যনিষ্ঠার জোরে। অচিরেই তার সহায়তায় এগিয়ে আসেন রেয়াজউদ্দীন আহমদ ও মুনশী মেহেরুল্লাহ। ঋণমুক্ত হন এবং স্বাভাবিক জীবন পান। জমিরুদ্দীন দ্রুতই কলম হাতে নেন। ইসলাম প্রচারক পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে তার একের পর এক রচনা। খুবই ধারালো যুক্তি ও তথ্য তত্তে¡র মিশ্রণে কথা বলত তার রচনা। কী বিষয়ে, কী আবেদনে সেগুলো ছিল অনিবার্য।

আমরা লক্ষ করতে পারি কিছু রচনার শিরোনাম। ‘বাইবেল, আপনি আপনার বিরুদ্ধে’ ( জুলাই, ১৮৯৯) যা বাইবেলের বিভিন্ন স্ববিরোধ ও তথ্যগত ভ্রান্তি উন্মোচন করে। ‘প্রভু যিশুখ্রিষ্ট কে?’ (জুলাই-আগস্ট-১৮৯৯) যিশুখ্রিষ্ট প্রভু নন, মানব সন্তান, খিষ্টীয় উৎস থেকে সেটা তিনি তুলে ধরেন এ রচনায়। বাইবেলে বহুবিবাহ (জুলাই-সেপ্টেম্বর, ১৮৯৯) ইসলামের বহুবিবাহ আইনের বিরুদ্ধে খ্রিষ্টীয় রণধ্বনির জবাবে তিনি আলোকপাত করেন, দেখান, বাইবেলেই রয়েছে বহুবিবাহের বিধান। ‘বাইবেলে যুদ্ধ ও জীব হত্যা’ (নভেম্বর-ডিসেম্বর, ১৮৯৯)। দেখা যাচ্ছে, রচনা প্রকাশিত হয়েছে নিয়মিতই আর বিষয়গুলো এতটাই প্রাসঙ্গিক ও অগ্রসর, যা আজকের বাস্তবতায়ও গুরুত্বপূর্ণ। জমির লেখনীর এই ধারাকে পরে আরো গতিদান করেছেন।

বুদ্ধিবৃত্তিক নানা বিতর্কে তিনি যেমন লড়েছেন, তেমনি ইসলামকে বিব্রত করে বা করবে, এমন বিষয়াবলিতেও ছিল তার সমান নজর। প্রাচ্যবাদী বয়ান ইসলামকে কিভাবে আহত করে, সে নিয়ে জমিরুদ্দীনের উদ্বেগ ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ‘খ্রিষ্টানি সংবাদ’ শিরোনামে জমিরের একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় শরিয়ত পত্রিকায় ১৩৩২ সালে, দ্বিতীয় বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যায়। পত্রিকাটির ৬২ পৃষ্ঠায় নাতিদীর্ঘ এ প্রতিবেদন ছিল তখনকার প্রেক্ষাপটে গুরুতর। জমির লিখেন, ‘খ্রিষ্টান মিশনারিরা ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে সাত কোটি পুস্তক প্রকাশ করেছে এবং কোটি কোটি টাকা ইসলাম ধর্মের ক্ষতি সাধন হেতু খরচ করে চলেছে। বর্তমানে ৭৭ হাজারেরও অধিক খ্রিষ্টান মিশনারি প্রচার কাজে নিয়োজিত আছে। তারা প্রতি বছর ৫০ কোটি টাকা প্রচারার্থে ব্যয় করে থাকে। ২৫০টি প্রচার সমিতি সারা বিশ্বের ২০ হাজার কেন্দ্রে তৎপরতা চালিয়ে ইসলাম ধ্বংসের চেষ্টা চালাচ্ছে। ইসলামের বিরুদ্ধে নিত্যনতুন পুস্তক লিখে প্রকাশ করছে।’

দৃষ্টান্ত হিসেবে কলকাতার ২৩ নং চৌরঙ্গী রোডের খ্রিষ্টান ট্রাস্ট বোর্ড সোসাইটির ’২৪ সালের ক্যাটালগ হাজির করেন। সেখানকার বিক্রীত পুস্তক তালিকা থেকে তিনি দেখান, ‘খ্রিষ্টান মিশনারিরা গত বছরে বাংলা ভাষায় ৫২টি পুস্তক লিখে প্রকাশ করেছে।’ পাঞ্জাবের অন্তর্গত লাহোরের আনারকলি ‘খ্রিষ্টানি পুস্তকালয়ের ক্যাটালগ থেকে তিনি দেখান, ‘মিশনারিরা ১২৮টি পুস্তক উর্দু ও হিন্দি ভাষায় প্রচার করেছে।’ জমির এভাবেই তথ্য দিতেন এবং সতর্ক করতেন, বিশ্লেষণ করতেন বাস্তবতা। এর প্রভাব পড়ে মুসলিম নেতাদের একটি অংশের চিন্তায়। তারা প্রত্যহ শুনতে পেতেন জমিরের উদাত্ত, ব্যাকুল কণ্ঠস্বর!

মুনশী মেহেরুল্লাহর বরাত দিয়ে তার জীবনী লেখক শেখ হবিবুর রহমান সাহিত্য লিখেন, খ্রিষ্টানদের মুখোমুখি বিতর্কে জমির লিখেন মোট ১০৮টি পুস্তক। কিন্তু সেগুলোর তালিকা তো আমরা পাই না। হতে পারে, এটি অতিরঞ্জন। তবে সত্য হলো, জমিরের পাণ্ডুলিপির বেশির ভাগই থেকে যায় অপ্রকাশিত। তার মৃত্যুর পর একে একে হারিয়ে যায় সেগুলো। বর্তমানে তার বেশির ভাগ গ্রন্থই দুষ্প্রাপ্য। যেসব প্রবন্ধ বিভিন্ন সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়, সেগুলোর বেশির ভাগই নিখোঁজ। সেসবের অনুসন্ধানে উল্লেখযোগ্য কোনো প্রয়াস সম্পন্ন হয়েছে বলে জানা নেই। তবে জমিরের যে লেখাগুলো বিদ্যমান আছে; ‘ইসলামের সত্যতা সম্বন্ধে পরধর্মাবলম্বীদের মন্তব্য’, ‘হজরত বার্ণাবার ইঞ্জিলের পেশখবরি’, ‘ইঞ্জিলে হজরত মুহাম্মদ সা: ও পাদ্রি রাউস সাহেবের সাক্ষ্য’, ‘শ্রেষ্ঠ নবী হজরত মোহাম্মদ সা: ও পাদ্রির ধোঁকাভঞ্জন’, ‘মাসুম মোস্তফা সা: অর্থাৎ হজরতের নিষ্পাপ ও নিষ্কলঙ্কতা’, ‘ইঞ্জিলে হজরত মোহাম্মদ সা: ও পাদ্রি ওয়েঙ্গার সাহেবের সাক্ষ্য’, ‘রদ্দে সত্যধর্ম নিরূপণ ও হেদায়েতুল খ্রিষ্টান’, ‘পাদ্রি মনরো সাহেবের ধোঁকাভঞ্জন’, ‘আসল হুলিয়ানামা’, ‘হজরত ইসা কে?’ ইত্যাদি একজন বহুদর্শী, বিদগ্ধ ধর্মতাত্তি¡কের জানান দেয়।

তার সাহিত্য-বিষয়ক গ্রন্থ গভীর ভাববাহী এবং মননজাত। ‘কোথা চলি গেলে’, ‘আসল বাঙ্গালা গজল’, ‘শোকানল’ ইত্যাদি কাব্যে একটি দরদি ও সংবেদী অন্তরের রক্ত ও জ্যোৎস্না তরঙ্গিত। তার অনুবাদমূলক রচনা ‘ইসলামী বক্তৃতা’সহ বহু গ্রন্থ ও প্রবন্ধ একজন সক্ষম ও সরস অনুবাদকের সাক্ষর বহন করে। তার ‘মুসলিম সমাজে স্ত্রী জাতির প্রতি ভীষণ অত্যাচার’, ‘তামাকের অপকারিতা’ ইত্যাদি রচনায় আমরা সমাজসচেতন ও অগ্রসর একজন কল্যাণমুখী চিন্তাবিদের মুখোমুখি হই। ইসলামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য প্রশ্নে সরব থেকেছে তার কলম। লিখেছেন ‘ইসলামী সভ্যতা’, ‘জঙ্গে কারবালা’, ‘জওয়াবোন্নাসারা’, ‘গৌড়ের ইতিহাস’ ইত্যাদি রচনা। জীবনী লিখেছেন, ভ্রমণকাহিনী লিখেছেন। ‘বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ সা:-এর জীবনী’, ‘মেহেরচরিত’, ‘মৌলভী নৈমুদ্দীন সাহেবের জীবনী’, ‘হজরত মোহাম্মদ বোখারি সম্বন্ধে যৎকিঞ্চিৎ’, ‘হজরত বেলাল সম্বন্ধে যৎকিঞ্চিৎ’, ‘পারস্য কবিদ্বয়ের বিবরণ’, এষড়ৎু ড়ভ রংষধস, ‘শ্রীযুক্ত বাবু গিরিশচন্দ্র সেন মহাশয়ের সংক্ষিপ্ত জীবনী’ কিংবা ‘দার্জিলিং ভ্রমণ’, ‘পশ্চিম ভ্রমণ’, ‘চট্টগ্রাম ভ্রমণ’, ‘মুর্শিদাবাদ ভ্রমণ বৃত্তান্ত’ তার কব্জির জোরের জানান দেয়। ইসলামী জীবনচিন্তা ও সংস্কৃতির বিকাশে উনিশ শতকের অগ্রগণ্য এক জ্ঞান ও সাহিত্যসাধক জমিরুদ্দীন। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে মুসলিম বাংলার সর্বকালের সেরা পণ্ডিত ও লেখক হিসেবে মুনশী মেহেরুল্লাহর ঠিক পরেই তার অবস্থান।

কুসংস্কারকবলিত অনগ্রসর মুসলিম জীবনে তার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মতাত্তি¡ক ভ‚মিকা ছিল সবল এক ঝাঁকুনি। যা মুসলিম জীবনকে ভেতর থেকে নানাভাবে আন্দোলিত করে।

১৯০৭ সালে মেহেরুল্লাহর মৃত্যুর পর থেকে ১৯৩৭ সাল তার মৃত্যুকাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৩০ বছর এককভাবে ইসলাম প্রচারকের দায়িত্ব পালন করেন। মিশনারি প্রচারকদের প্রবল স্রোতের মুখে তিনি ছিলেন মুসলিম বাংলার প্রধান কণ্ঠস্বর। ঠিক এ জায়গায় তিনি শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের কাজ করেননি, বরং নিজেই হয়ে ওঠেন একটি কাফেলা। জনপদে জনপদে চারণের মতো তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন। বক্তৃতা করেছেন, বিতর্কে অংশ নিয়েছেন। তৃণমূলে থেকেছেন নিবিড়ভাবে যুক্ত। অপর দিকে জ্ঞান ও অধ্যয়নে থেকেছেন বিশ্বচারী।

পাঠ ও দক্ষতা নিয়ে কলমী ও বাগ্মিতার ময়দানে তার লড়াই শুধু মুসলিমদের খ্রিষ্টান হওয়া থেকে থামায়নি, বরং বহু শিক্ষিত খ্রিষ্টান ও হিন্দুকে আকৃষ্ট করেছে ইসলামের সত্যে। তার কাছে ইসলামে ফিরে এসেছেন, এমন খ্রিষ্টানের সংখ্যা ১৩ হাজার ৪২ জন। যাদের প্রধান অংশই মুসলিম থেকে খ্রিষ্টবাদে দীক্ষিত হন একদা। তার বাগ্মিতা, যুক্তি, উপস্থাপন কৌশল, তার্কিক প্রজ্ঞা, পাণ্ডিত্য, সরস বাকভঙ্গি এ সময়ে ছিল এক দৃষ্টান্ত। মুসলিম বাংলায় ইসলাম প্রচারে এই একুশ শতকেও বাস্তবতাবোধের যে ঘাটতি, ভাষা ও উপস্থাপনে পরিমিতির যে অভাব, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সমন্বয়ের যে দৈন্য, সমালোচনা ও পর্যালোচনায় যে প্রান্তিকতা, সেসবের পরিপ্রেক্ষিতে জমিরুদ্দীন এ দেশে, একালের বিচারেও অগ্রসর।

তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের জ্ঞান ও জীবন-জগতকে দেখার গভীর দৃষ্টি তাকে প্রশিক্ষিত মিশনারিদের মোকাবেলায় অপরাজেয় করে তুলেছিল। ফলে তখনকার অগ্রসর মুসলিম আলেম ও চিন্তাবিদরা তার কণ্ঠে শুনতে পেতেন নিজেদের ভাষ্য। ফুরফুরার পীর হজরত মুহাম্মদ আবুবকর সিদ্দিকী (১৮৪৫-১৯৩৯) তার পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে আসেন, যা ছিল এ বাস্তবতারই বিঘোষক। তিনি মুসলমান সমাজের প্রতি আহ্বান জানান জমিরুদ্দীনের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। এ আহ্বান ছিল আলেম-পীর ও মুসলিম বুদ্ধিজীবীর পারস্পরিক যৌথতার এক নজির। যার ধারাবাহিকতা পরবর্তী মুসলিম জীবনে পরিলক্ষিত হয়েছে কম। যেকোনো সভ্যতা ও জাতিগোষ্ঠীর জন্য এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ যে, তাদের চিন্তক শ্রেণী ও সামাজিক-ধর্মীয় জীবনে নেতৃত্বে থাকা শ্রেণীর মধ্যে থাকবে নিবিড় যোগাযোগ ও বোঝাপড়া। এর অনুপস্থিতি প্রায়ই বুদ্ধিবৃত্তিকে করে সমাজবাস্তবতার প্রতি উদাসীন, সামাজিক ও ধর্মীয় নেতৃত্বকে করে প্রান্তিক ও জীবনের চলমানতা থেকে পশ্চাৎপদ। পীর ও বুদ্ধিজীবীর সংযোগ জনজীবনকে নাড়া দিয়েছিল। জমিরের কাজের প্রতি সমাজের একটি অংশে তৈরি হয়েছিল সাড়া। ফলে আমরা দেখি, সুদূর দক্ষিণ আমেরিকার কলম্বিয়া থেকেও শেখ জুওহুর আলী মিয়া (গ্রাম-হাবাট, ডাকঘর-বন্দিপুর, জেলা-হুগলি) নামে একজন প্রবাসী বাঙালি জমিরের রদ্দে খ্রিষ্টান সিরিজের বই প্রকাশের জন্য ছয় পাউন্ডের সাহায্য পাঠান। সে সময় বই প্রকাশ সহজ ব্যাপার ছিল না। ঢাকায় তখনো প্রকাশনা শিল্প দাঁড়ায়নি। কলকাতাই ছিল আসল কেন্দ্র। জমিরুদ্দীনের প্রায় সমস্ত বই সেখান থেকে প্রকাশিত হতো।

প্রেসের মালিকরা ছিলেন সাধারণত হিন্দু বা খ্রিষ্টান। তারা প্রায়ই বই প্রকাশে সমস্যা করতেন। বিক্রিতে রাজি হতেন না। সে জন্য নিজের ছেলের নামকরণে আজিজিয়া বুক ডিপো নামে কলকাতায় একটি বইয়ের দোকান গড়ে তোলেন জমির। এখানে তার লেখা বইসহ বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তক বিক্রি হতো।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, বিচিত্র চ্যালেঞ্জ জমিরের সামনে এসেছে, কিন্তু দমাতে পারেনি তাকে। তার চার দিকে কেবল ছিল শূন্যস্থান। ১৯৩৭ সালের ২ জুন (আষাঢ়, ১৩৪৪), বুধবার বেলা দেড়টায় গাঁড়াডোবের নিজ বাড়িতে ইন্তেকালের আগ অবধি তিনি জাতীয় জীবনের বহু বিস্তৃত এই শূন্যতা পূরণে কাজ করে গেছেন ক্লান্তিহীন!

মুসলিম বাংলায় তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের ময়দানে ইতোপূর্বে কেবল জোয়াদ সাবাত আল হুসাইনি (শাহাদাত ১৮১৬ সালের পর) এবং মুনশী মেহেরুল্লাহ (১৮৬১-১৯৬০) কাজ করে যান। সে ছিল উন্মেষ যুগ। জমিরুদ্দীনের সহকর্মীদের মধ্যে সক্রিয় ছিলেন মৌলভী মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহমদ (১৮৬২-১৯৩৩) মুনশী শেখ আবদুর রহিম (১৮৫৯-১৯৩১)। তাদের ভ‚মিকা ছিল অনেকটা গৌণ। জমির এ ধারাকে দেন বিকাশ ও সমৃদ্ধির স্বতন্ত্র বিভূতি। তার হাত ধরে এ ধারা নতুন যুগে প্রবেশ করে। বৈশ্বিক মাত্রা ও আবেদন পায় এবং বহুভাষিকতা, বহুমাত্রিকতা কর্তৃত্বের ভাষা লাভ করে তার কলম ও জবানে। এরপর দেখা যাবে মওলানা আকরম খাঁ (১৮৬৮-১৯৬৮), মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী (১৮৭৫-১৯৫০), ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯), মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ (১৮৯৮-১৯৭৬), শেখ হবিবুর রহমান সাহিত্যরত্ম (১৮৯১-১৯৬২), খান বাহাদুর আহসানুল্লাহ (১৮৭৩-১৯৬৫), ড. সিরাজুল হক (১৯০৫-২০০৫), ড. মুহম্মদ এনামুল হক (১৯০২-১৯৮২), সাইয়েদ আবদুল হাই (১৯১৯-১৯৯৪) প্রমুখের ক্রিয়াশীলতা এই পাটাতনকে শেকড়ে রেখে অগ্রসর হয়েছে।

সাহিত্যের ক্ষেত্রে মুনশীর রচনাঐতিহ্য মুসলিম বাংলার প্রাণপ্রবাহকে অধিকতর বাঙময় করে। যা তার কালে ও পরবর্তীতে একটি স্বাস্থ্যকর সুসমাচারে পরিণত হয়। মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১১), কাজী ইমদাদুল হক (১৮৮২-১৯২৬), মোহাম্মদ নজিবর রহমান (১৮৬০-১৯২৩), মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক (১৮৬০-১৯৩৩), দাদ আলী (১৮৫২-১৯৩৬), শেখ ফজলুল করিম (১৮৮২-১৯৩৬), সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী (১৮৮০-১৯৩১), বেগম রোকেয়া (১৮৮০-১৯৩২), কায়কোবাদ (১৮৫৭-১৯৫১), আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ (১৮৭১-১৯৫৩), মুনশী আবদুল লতিফ (১৮৭০-১৯৩৬), এয়াকুব আলী চৌধুরী (১৮৮৮-১৯৪০), কাজী আকরম হোসেন (১৮৯৬-১৯৬৩) প্রমুখের মিলিত আওয়াজে মুনশীর কণ্ঠস্বর যুক্ত হয়ে ভিন্ন এক মাত্রা যোজনা করে। এ যাত্রা অধিকতর শক্তিমান ও সুদৃঢ় সাহিত্যিক উচ্চতার দিকে এগিয়ে যায়। যেখানে অচিরেই মঞ্চে এসে দাঁড়াবেন মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী (১৮৯৬- ১৯৫৪), এস ওয়াজেদ আলী (১৮৯০-১৯৫১), শাহাদত হোসেন (১৮৯৩-১৯৫৩), গোলাম মোস্তফা (১৮৯৭-১৯৬৪)। অতপর সবাইকে এবং সব কিছুকে ছাপিয়ে মাথা তুলবেন বাঙালি মুসলমানের সাহিত্যিক এভারেস্ট- কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)।

ইতিহাসের কালোরাতের উজানে বাঙালি মুসলমান নতুন আশা ও ঊষার দিকে পা বাড়াবে অতঃপর। এ পথে আপন সময় ও বাস্তবতার সীমাবদ্ধতার মধ্যে মুনশী জমিরুদ্দীন আমাদের জাতিসত্তার ভাড়ারে সে শস্য সঞ্চিত রেখে যান, তার যথাযথ মূল্যায়ন করতে আমরা কেবল ভুল করিনি, বরং একে ঢেকে রাখছি বিস্মৃতির বালুকাবেলায়! আমাদের এ গাফিলতি আমাদেরকে কেবলই দায়ী করে চলে। ফলে ঋণী আমরা আরো বেশি ঋণী হই, কিন্তু দায় শোধে সচেতন হই কম! এ শুধু মুনশী জমিরের ক্ষেত্রে নয়, আমাদের উঠে আসার পথে রক্তজল ঢেলে দেয়া অনেকের সাথে এ আচরণ আমরা করে চলছি!

লেখক : কবি, গবেষক


আরো সংবাদ



premium cement