১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বাংলাদেশের রাজনীতি ও বেগম জিয়া

খালেদা
বেগম খালেদা জিয়া - ছবি : নয়া দিগন্ত

বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনব্যবস্থাকে সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় রূপায়ণ, গণতন্ত্র ও মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ, রাজনীতিতে নারীর ক্ষমতায়ন বা নারী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তিনি এক সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতির স্ত্রীও ছিলেন। স্বামীর অবর্তমানে রাজনীতিতে আগমন তার। শুরু থেকেই নিজ যোগ্যতা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা আর প্রজ্ঞায় বিএনপির নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন তিনি। জীবনের পড়ন্ত বেলায়ও দল, দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য তার ভূমিকা সর্বমহলে প্রশংসিত হচ্ছে।

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অবর্তমানে দলটি তিনবার রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে বেগম জিয়ার হাত ধরে। যদিও দেশী-বিদেশী বিভিন্ন রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রতিকূলতায় বিএনপি আজ কঠিন সময় অতিক্রম করছে। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে গিয়ে ২০১৪ সালের পর ক্ষমতাসীনদের রোষানলে পড়েন। এরপর ২০১৮ সালে এসে তাকে কথিত দুর্নীতির মামলায় জেলে যেতে হয়।

বয়সের ভারে এমনিতেই তিনি দীর্ঘ দিন থেকে অসুস্থ। তারপর কারাগারে থাকার কারণে আরো অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ৭৪ বছর বয়সী বেগম জিয়াকে কারাগারে রাখায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে মানবাধিকার সংগঠনগুলো সরকারের এমন অমানবিক আচরণের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। তাছাড়া বিএনপি নেতাকর্মীসহ গণতন্ত্রপ্রিয় দেশের অসংখ্য মানুষ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা এর প্রতিবাদ জানিয়ে বেগম জিয়াকে দ্রুত মুক্তির দাবি করে আসছিলেন শুরু থেকেই। কিন্তু সরকার শুরুতে এতে কর্ণপাত করেনি। পরে বেগম খালেদা জিয়ার জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। তখন পরিবারের এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে কিছু শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দেয়া হয়। মুক্তির পর থেকে সরকারের দেয়া শর্ত মেনে গুলশানের বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন আপোসহীন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া।

দেশে করোনা দুর্যোগের বছর পেরোনোর পর দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে ইতোমধ্যে। এতে বিএনপি চেয়ারপাসন বেগম খালেদা জিয়াও আক্রান্ত হয়েছেন। অবশ্য তার শারীরিক অবস্থা ভালো আছে। করোনার উপসর্গ তার তেমনটা নেই। কিন্তু দেশবাসীর উদ্বেগের কমতি নেই। তার অসুস্থতায় দেশবাসী উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত। বেগম জিয়ার রোগমুক্তির জন্য দেশব্যাপী কুরআন খতম, দোয়া ও মিলাদ মাহফিল হচ্ছে। দ্রুতই করোনামুক্ত হবেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম জিয়া- এমনটাই কামনা করছেন দেশের কোটি কোটি মানুষ।

দেশের ঐতিহাসিক সব ইস্যুতেই বেগম জিয়ার অনন্য ভূমিকা রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত ঐতিহাসিক সব ইস্যুতে তার উপস্থিতি ও ইতিবাচক ভূমিকা জাতির কাছে গ্রহণ যোগ্যতা পেয়েছে।

একজন গৃহবধূর দেশজয়ের গল্প
১৯৬০ সালের আগস্ট মাসে দিনাজপুরে সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা- ডিজিএফআইয়ের অফিসার ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সাথে বিয়ে হয় খালেদা জিয়ার। শুরু হয় গৃহবধূর জীবন। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ কালোরাতে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর গণহত্যা শুরুর পর মেজর জিয়াউর রহমান ‘উই রিভল্ট’ বলে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপর মেজর জিয়া স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবার রেখে সম্মুখ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পরিবারের মায়া ভুলে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর কমান্ডের ভূমিকা পালন করেন তিনি। এ সময় গৃহবধূ বেগম খালেদা জিয়া ছোট ছোট দু’ছেলেকে নিয়ে কিছু দিন চট্টগ্রামের গ্রামে আত্মগোপনে থাকেন। পরে ২৭ জুন নৌপথে ঢাকায় এসে বড় বোন খুরশিদ জাহান হকের (চকলেট আপা) বাসায় উঠেন। ২ জুলাই পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী সিদ্ধেশ্বরী এস আব্দুল্লাহর বাসা থেকে দু’ছেলেসহ বেগম জিয়াকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় ঢাকা সেনানিবাসে। স্বামী মেজর জিয়া মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত সেনানিবাসে দু’ছেলেকে নিয়ে বেগম জিয়া বন্দী ছিলেন।

১৯৭৫ সালে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর উপ-সেনা প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান কারাবন্দী হন। দু’ছেলেকে নিয়ে বেগম জিয়া ফের অনিশ্চয়তায় পড়েন। তবে এ অনিশ্চয়তা কেটে যায় দ্রুতই। ৭ নভেম্বর সিপাহি জনতার বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে খালেদ মোশাররফের বন্দীশালা থেকে মুক্ত হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বগ্রহণ করেন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান।

দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতির মৌলিক ও গুণগত পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা, আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার, দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক শীর্ষ সংগঠন- সার্কের প্রতিষ্ঠাতা, বিশ্বদরবারে জাতি রাষ্ট্র হিসেবে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ মতদর্শের প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। তার নেতৃত্বে দেশ যখন গণতন্ত্র, গণমাধ্যম ও বাক স্বাধীনতার পূর্ণ রূপ পায়, বাংলাদেশ উন্নয়ন-সমৃদ্ধির পথে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই (১৯৮১ সালের ৩০ মে) চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে শহীদ হন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। ক্ষণজন্মা মানুষটি শহীদ হওয়ার পর দেশ স্তব্ধ হয়ে যায়। জাতি থমকে দাঁড়ায়। আবারো দু’ছেলেকে নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েন বেগম জিয়া।

ভাইস-প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন।

এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপিতে এরশাদের ষড়যন্ত্রে তৈরি হয় দলীয় কোন্দল। অন্য দিকে তার মন্ত্রিসভায় বিএনপির নেতাদের যোগদানে দল অনেকটা বিপর্যয়ে পড়ে। এবার দলকে পুনর্গঠন ও দেশের গণতন্ত্র মুক্তি আন্দোলনে যোগ দেন বেগম জিয়া। এর আগ পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়া নিতান্তই গৃহবধূ ছিলেন। কিন্তু দল ও দেশের প্রয়োজনে রাজপথে নেমে আসেন তিনি। দলকে সুসংগঠিত রাখতে সিনিয়র নেতাদের পরামর্শে ১৯৮৩ সালে ৩ জানুয়ারি দলের সাথে যুক্ত হন বেগম জিয়া। এবার বেগম খালেদা জিয়া হয়ে উঠেন বিএনপির অবিচ্ছেদ্য অংশ, দেশের গণতন্ত্রের অগ্রনায়ক।

১৯৮৩ সালের মার্চে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্বগ্রহণ করেন। ওই বছর ১ এপ্রিল দলের বর্ধিত সভায় বক্তব্য রাখেন বেগম খালেদা জিয়া। আর ১৯৮৪ সালে ১০ মে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন তিনি।

স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের জন্য ‘আপোসহীন’ নেত্রী হিসেবে স্বীকৃতি পান বেগম খালেদা জিয়া। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে তার বলিষ্ঠ ভূমিকা সব মহলে প্রশংসিত হয় তখন। ১০ বছরের মধ্যে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার হাতে গড়া দল- বিএনপিকে ফের রাষ্ট্র ক্ষমতায় নিয়ে আনেন তিনি। ১৯৯১ সালের নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনে সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেয়ে বিএনপি সরকার গঠন করে। দেশের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ করেন বেগম খালেদা জিয়া। এরপর ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ও ২০০১ সালে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে তৃতীয়বারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রী হন বেগম জিয়া।

২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচন দেশী-বিদেশী চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের কারণে ভণ্ডুল হয়ে যায়। ১/১১-পরবর্তী সরকারের ওপর ভর করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতায় আসে। এরপর থেকে শুরু হয় জিয়া পরিবারকে নির্মূলের কর্মসূচি। ১/১১ সরকারের নির্যাতনের শিকার হয়ে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকো আগে থেকেই বিদেশে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে মামলার পর মামলা দিয়ে দেশে আসার পথ রুদ্ধ করা হয়। বেগম জিয়াকেও কারারুদ্ধ করতে চক্রান্ত অব্যাহত থাকে। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তা কার্যকর করা হয় দুর্নীতির কথিত মামলায় আদালতের রায়ের মাধ্যমে।

অথচ দেশের ইতিহাসে পাঁচটি সংসদীয় আসনে প্রথমবার নির্বাচন করেই সবগুলো আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছেন বেগম জিয়া। এরপর যতবার যে কয়টি আসন থেকে তিনি নির্বাচন করেছেন সব কয়টিতেই বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। এতেই তার জনপ্রিয়তা প্রমাণিত হয়।

কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে হয়রানিমূলক মামলার রায়ে তাকে সাজা দেয়া হয়েছে। কোভিড-১ মহামারীর মধ্যে তিনি গৃহবন্দী। উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেয়ার সুযোগ হয়নি। এখন তিনি কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত। দেশী-বিদেশী অগণিত মানুষের প্রাণখোলা দোয়ায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দ্রুত সুস্থ হবেন- এটিই প্রত্যাশা।

লেখক : সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা- জাসাস


আরো সংবাদ



premium cement

সকল