সিরিয়ায় ১০ বছরের গৃহযুদ্ধের সময় নির্বিচারে আটক লাখ লাখ মানুষের খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি। এছাড়া আরো হাজার হাজার মানুষকে হেফাজতে রেখে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের তদন্তকারীদের নতুন এক রিপোর্টে এ কথা বলা হয়েছে।
জাতিসঙ্ঘের তদন্তকারীরা বলেছেন, সিরিয়া যুদ্ধের সব পক্ষই যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে যুক্ত থেকেছে। প্রত্যক্ষদর্শী ও নির্যাতিতরা তদন্তকারীদের যে সাক্ষ্য দিয়েছেন তাতে ‘অকল্পনীয় দুর্ভোগের’ বর্ণনা দিয়েছেন। এদের মধ্যে ১১ বছরের শিশুধর্ষণের ঘটনাও রয়েছে।
২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় সরকারবিরোধী বিক্ষোভ দমন করতে প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদের বাহিনী মারাত্মক শক্তিপ্রয়োগ শুরু করলে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। পুরো দেশ বিধ্বস্ত করে দেয়া এই গৃহযুদ্ধে অন্তত তিন লাখ ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় এবং দেশটির জনসংখ্যার অর্ধেকই বাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। আর প্রায় ৬০ লাখ বিদেশী শরণার্থী হিসেবে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেয়। সিরিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে তদন্ত করতে ‘স্বাধীন আন্তর্জাতিক কমিশন’ গঠন করে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কাউন্সিল। বিভিন্ন পক্ষের শতাধিক কারাগার খতিয়ে দেখার পাশাপাশি দুই হাজার ৬৫০ জনেরও বেশি মানুষের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে কমিশনটি। এতে বলা হয়েছে, যুদ্ধে জড়িত প্রায় সবগুলো পক্ষই মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে।
কমিশনের চেয়ারম্যান পাউলো পিনহেইরো বলেন, ‘সরকারি বাহিনীগুলো নির্বিচারে রাজনৈতিক বিরোধী, সাংবাদিক, মানবাধিকার অ্যাক্টিভিস্ট এবং বিক্ষোভকারীদের আটক করে। এ থেকেই সঙ্ঘাত শুরু হয় এবং এটাই সঙ্ঘাত শুরু হওয়ার মূল কারণ।’ তিনি আরো বলেন, ‘সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো এবং হায়াত তাহরির আল শাম ও ইসলামিক স্টেটের মতো জাতিসঙ্ঘ ঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো মানুষের স্বাধীনতা হরণ করতে শুরু করে, চরমভাবে তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করতে শুরু করে। এর সাথে তাদের সাম্প্রদায়িক মনোভাবও জড়িয়ে ছিল।’ বিভিন্ন আটক থাকা পুরনো বন্দীরা মাসের পর মাস ধরে দিনের আলো না দেখা, নোংরা পানি পান ও বাসী খাবার খেতে বাধ্য হওয়ার কথা জানিয়েছেন। বলেছেন শত শত বন্দীকে একসাথে রাখা হলেও সেখানে ছিল না কোনো টয়লেট, দেয়া হয়নি কোনো চিকিৎসাও।
সরকারি কারাগারগুলোতে যারা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তারা তদন্তকারীদের জানিয়েছেন, মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য অন্তত ২০টি উপায়ে সেখানে নির্যাতন করা হতো। এর মধ্যে ছিলো ইলেকট্রিক শক দেয়া, শরীরের বিভিন্ন অংশ পুড়িয়ে দেয়া, নখ ও দাঁত উপড়ে ফেলা এবং দীর্ঘ সময় ধরে ঝুলিয়ে রাখা। হোমস শহরে আটক হওয়া এক ব্যক্তি তাকে জিজ্ঞাসাবাদের সময়কার স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘প্রথমে আমাকে নির্যাতন করল। তারপর বলল, আমরা তোমাকে এখনো এখনি মেরে ফেলতে পারি, কেউ জানতেই পারবে না।
নির্যাতনের শিকার হয়েও ফিরে আসা ব্যক্তিরা বর্ণনা দিয়েছেন কিভাবে তাদের শরীরজুড়ে ব্যথার সাথে এখনো লড়াই করছেন তারা যা পরে মানসিক ট্রমায় রূপ নিয়েছে। হোমস ও দামেস্কে সামরিক হেফাজতে নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন এমন এক নারী বলেন, ‘আমার অবস্থা এখন এমন যে, আমি ডায়াপার ছাড়া থাকতে পারি না। পুরো শরীরে মারাত্মক ব্যথা। আমার আসলে আর কোনো আশাই নেই। জীবনটা পুরোপুরি শেষ হয়ে গেছে।’ তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, হায়াত তাহরির আল শাম পরিচালিত কেন্দ্রগুলোতে যাদের আটক রাখা হয়েছিল তাদেরকেও অত্যাচার করা হতো। তারা এখন বিরোধী দল নিয়ন্ত্রিত সর্বশেষ ঘাঁটিটি নিয়ন্ত্রণ করছে। বহু পুরুষ জানিয়েছেন যে, তাদের নগ্ন করে ইলেকট্রিক শক দেয়া, এমনকি ধর্ষণও করা হয়েছিল।
নারী বন্দীরা জানিয়েছেন, তাদের প্রায়ই ধর্ষণের হুমকি দেয়া হতো এবং হামা চেকপয়েন্টে একজন নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। তদন্তকারীদের জানানো হয়েছে যে, বিচার ছাড়াই সামরিক আদালত বা বিকল্প আদালতে বিরোধী সশস্ত্র গ্রুপগুলোর প্রশ্নবিদ্ধ বিচারের নামে অনেক আটক ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, আটক অবস্থায় কত মানুষ মারা গেছে তার কোনো হিসাব নেই। তবে ধারণা করা হচ্ছে কয়েক লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে সরকারি হেফাজতেই। বেশ কিছু সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, নিহতদের বিভিন্ন গণকবরে দাফন করা হয়েছে যার অন্তত দু’টি দামেস্কের শহরতলিতেই। তবে সরকার ও হায়াত তাহরির আল শাম বন্দীদের নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করেছে। পাউলো পিনহেইরো বলেন, ‘পরিবারের লাখ লাখ সদস্যের জানার অধিকার আছে যে, তাদের প্রিয়জনের ভাগ্যে কী ঘটেছে। এটি একটি ন্যাশনাল ট্রমা যার দিকে সব পক্ষ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জরুরিভাবে দৃষ্টি দেয়া উচিত।’
জাতিসঙ্ঘের এই কমিশন সব দেশকে অপরাধের জন্য জবাবদিহিতার আহ্বান জানিয়েছে এবং গত সপ্তাহে জার্মানির একটি আদালতের রায়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে যেখানে সিরিয়ার একজন সাবেক কর্মকর্তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা