গরু নয়, ব্রাজিল থেকে উন্নত জাত আনার দাবি খামারিদের
- কাওসার আজম
- ০৯ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০৫
বছরখানেক হলো স্বামীহারা আসমা খাতুনের স্কুল কলেজ পড়ুয়া দুই ছেলেকে নিয়ে সংসার। স্বামীর রেখে যাওয়া স্বল্প জমি চাষাবাদ করে চলছে সংসার। বয়স চল্লিশ না পেরুতেই স্বামীকে হারিয়ে অসহায় তিনি। ভাগ্যিস কলেজ পড়ুয়া ছেলেটার সরকারি একটি প্রকল্পে দিন হাজিরায় কাজের সুযোগ হয়েছে। এ দিয়ে চলছে সংসার, দুই ছেলের লেখাপড়া। স্বামী বেঁচে থাকতেই বাছুর রেখে হঠাৎই মারা যায় গাভী। সেই বাছুর মোটাতাজাকরণ করার পর এখন ষাড়ে পরিণত হয়েছে। তার স্বপ্ন আছে কোরবানির ঈদে বিক্রি করবেন। লাখ টাকার উপরে বেচবেন। একটা পুঁজি হবে সেখানে। এরপর তার গোয়ালে থাকা আরো দু’টি গরু লালন পালন করবেন। পরে মোটাতাজা করে বিক্রি করে দেবেন। কিন্তু বিধাব আসমা খাতুনের চোখেমুখে এক ধরনের আতঙ্ক। স্বজনদের কাছ থেকে শুনেছেন যে, সামনে গরুর দামে ধস নামতে পারে। তাই ষাঁড়টি আগেভাগেই বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
আসমা খাতুন ও তার স্বজনদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ছোট ছেলেকে নিয়ে ষাঁড়টি মোটাতাজা করেছেন। উচ্চমূল্যে খৈল-ভুসিসহ অন্যান্য গোখাদ্য কিনে প্রায় বছর খানেক গরুকে খাইয়েছেন। নিজ পরিশ্রম বাদে তাতে আশা করছেন ২৫-৩০ হাজার টাকা লাভ থাকবে। তবে নিজ পরিশ্রম যোগ করলে খুব বেশি টাকা থাকার কথা নয় বলে জানান আসমা খাতুন। এ অবস্থায় গরুর দাম না পেলে মাঠে মারা যাবে তার কষ্ট। বলছিলাম সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জের আসমা খাতুনের কথা। শুধু আসমা খাতুন নন, তার মতো লাখো ক্ষুদ্র কৃষক যারা ঈদকে সামনে রেখে গরু মোটাতাজা করেন সম্প্রতি বিভিন্ন মাধ্যমে গরু আমদানির খবর শুনে আতঙ্কে আছেন।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, সর্বশেষ গত কোরবানির ঈদেও প্রায় ২৬ লাখের বেশি কোরবানির পশু অবিক্রীত থেকে গেছে। তার আগের দুই বছরও ১৬-২২ লাখ পশু অবিক্রি রয়ে যায়। দেশে যে পরিমাণ গরু মোটাতাজাকরণ হয়, তার বেশির ভাগই আসে ক্ষুদ্র কৃষকের ঘর থেকে। তবে ২০১৫ সালের পর থেকে দেশে বাণিজ্যিকভাবে গোখামারির সংখ্যা বাড়তে থাকে। একসময় ভারতের গরু না এলে দেশের ঈদবাজার (পশুরহাট) অস্থিতিশীল হয়ে পড়ত। সময়ের ব্যবধানে গত কয়েক বছরে কোরবানির পশুতে স্বাবলম্বী হয়েছে বাংলাদেশ। হাজার হাজার শিক্ষিত যুবক-যুবতী গরু, ছাগল, মহিষের খামার করে নিজেরাও স্বাবলম্বী হয়েছেন। প্রতিনিয়ত শিক্ষিত যুবকেরা বিনিয়োগ করছেন এ খাতে। এতে সরকারেরও পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে।
গত বছর হঠাৎ করেই গরুর গোশত ৮০০ টাকা কেজি হাঁকান গোশত ব্যবসায়ীরা। এর পেছনে কসাইসহ মধ্যস্বত্বভোগীরা রয়েছে বলে খামারিরা দাবি করেন। কৃষক বা খামারি থেকে হাতবদল হয়ে কসাই হয়ে ভোক্তা পর্যন্ত আসতে গোশতের দাম বেপরোয়াভাবে বেড়ে যায়। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ও বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশন বলছে, মধ্যস্বত্বভোগী না থাকলে গরুর গোশতের দাম সাড়ে ৬০০ টাকার উপরে যাওয়ার সুযোগ নেই। এই রোজায় খামারি থেকে সরাসরি গরু জবাই করে রাজধানীর ৩০টি জায়গায় ৬০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয় প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের উদ্যোগে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লোকসান দিয়ে তো আর এই দামে বিক্রি হয়নি। সুতরাং মধ্যস্বত্বভোগী না থাকলে কম দামেই গরুর গোশত বিক্রি সম্ভব।
এক সময় অবৈধভাবে ভারত থেকে সীমান্ত হয়ে দেশে গরু আসত। উভয় সরকারের মৌখিক সম্মতিতে বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে গরু আসত দেশে। কিন্তু ভারত সরকার হঠাৎ তা বন্ধ করে দেয়ার পর বর্তমান সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নানা উদ্যোগে গোশতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। কয়েক বছর হলো ঈদকে সামনে রেখে ব্যবসায়ীদের একটি মহল ভারত থেকে গরু আমদানির তোড়জোড়/তদবির শুরু করে। দেশে গরুর গোশতের উচ্চমূল্য হওয়ায় ভারত থেকে তারা গোশত আমদানিরও সুযোগ চায়। যদিও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় তা নাকচ করে দেয়। ব্যবসায়ীদের এই অংশটি এখনো নানাভাবে চেষ্টা করছেন গরু আমদানির। সর্বশেষ আলোচনায় এসেছে ব্রাজিল থেকে কম মূল্যে গরু আমদানির বিষয়টি।
গত রোববার ঢাকায় সফররত ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাউরো ভিয়েরার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু সাংবাদিকদের জানান, ব্রাজিল অত্যন্ত কমমূল্যে গোশত রফতানি করতে চায়। আমরা আগামী কোরবানি সামনে রেখে তাদের ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করেছি, যদি সস্তাই হয়, তাহলে কোরবানির সময় গরু পাঠানোর ব্যবস্থা করা যায় কি না। ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেছেন, এ যৌথ আলোচনা সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। জুলাইয়ে তারা আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। আশা করি, এর মধ্যে আমরা কিছু ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে পারব।
গণমাধ্যমে এ খবর প্রকাশের পর মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায় সামাজিক মাধ্যমে। গরুর গোশতের দাম বেশির পরিপ্রেক্ষিতে কিছুদিন ধরে এমনিতেই পেঁয়াজ, তরমুজের মতো গরুর গোশত কিছুদিন বয়কটের ডাক ওঠে। তাদের অনেকে আবার গরু আমদানির বিষয়টি বিবেচনায় নেয়ার যুক্তি দেন। তবে গোখাদ্যের উচ্চমূল্যসহ ক্ষুদ্র খামারিদের কথা চিন্তা করে গরু আমদানির বিষয়টি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেয়ার পক্ষেও মতামত আসে। তারা বলছেন, খেল,ভূষি, ফিডসহ অন্যান্য গোখাদ্যের দাম গত কয়েক বছরে দুই তিনগুণ বেড়েছে। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। সরকারের উচিত গোখাদ্যের দাম যেকোনোভাবে কমিয়ে আনা।
এসব বিষয়ে কথা হয় বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো: ইমরান হোসেনের সাথে। তিনি বলেন, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী ব্রাজিল থেকে গরু আমদানির যে কথা বলেছেন, তা হয়তো প্রকৃত তথ্য না জানার কারণে। কারণ আপনারা দেখেছেন গত তিন বছর ধরে দেশে কী পরিমাণ কোরবানীর পশু অবিক্রীত থেকে যাচ্ছে। গত বছরও তো প্রায় ২৬ লাখ পশু অবিক্রি থেকে গেছে।
তিনি বলেন, গরু আমদানি নয়। বরং ব্রাজিল থেকে উন্নত জাত আনা গেলে দেশ উপকৃত হবে। তাদের গরুর জাদে অনেক বেশি গোশত ও দুধ হয়। এ জাত ডেভেলপ করতে পারলে এমনিতেই গোশতের দাম কমবে। সরকারকে সে দিকেই নজর দেয়া উচিত।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ফিডের দাম বেড়েছে, অন্যান্য গোখাদ্যের দামও বেড়েছে। কিছুদিন আগে ফিড ব্যবসায়ীরা কেজিতে ৫ টাকা করে বাড়িয়ে দিলেন। যে অজুহাতে বাড়ানো হলো, সেটার সমাধান হলেও তা আর কমানো হয়নি। সরকার যদি গোখাদ্যের উচ্চমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারে খামারিরা কম দামেই গরু দিতে পারবে। আর এমনিতেই তো খামারিদের কোনো সিন্ডিকেট নেই। আমাদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে কারা দাম বাড়াচ্ছে এটা সবারই জানা। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, এইতো এবারো রমজানে আমরা ৬০০ টাকা কেজিতে গরুর গোশত বিক্রি করলাম। লসে তো বিক্রি করিনি আমরা। কয়েকজন কসাইও কম দামে গোশত বিক্রি করেছেন। সুতরাং কথিত সিন্ডিকেট গরুর গোশতের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। এটা বন্ধ করতে হবে।
এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা: রেয়াজুল হককে ফোন দিলেও রিসিভ করেননি। তবে, একাধিক কর্মকর্তা জানান, দেশে গরু বা অন্য কোনো গবাদি পশুর সঙ্কট নেই। তবে গোশতের দাম বেশি, এটা ঠিক। ভারত গরু পাঠানো বন্ধ করে দেয়ার পর হাজার হাজার উদ্যোক্তা গড়ে উঠেছে। কয়েক বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশ এখন গোশতে স্বয়সম্পন্ন। যতটা না খামারিরা লাভ করেন, তার চেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। এ ছাড়া, গো খাদ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সফল হলে ভোক্তাকে কম মূল্যে গোশত নিশ্চিত করা যাবে।