১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ছোট দেশ কাতার অর্থনীতি ও কূটনীতিতে যেভাবে এত এগোল

কাতারের রাজধানী দোহা - সংগৃহীত

একটি ছোট অপরিচিত উপসাগরীয় রাজতন্ত্র থেকে কাতার এখন বিশ্বে একটি পরিচিত নাম। কাতারের বর্তমান রাজতন্ত্রের পরিবার গত ১৩০ বছর যাবত দেশটি শাসন করছে।

শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি কাতারের আমিরের দায়িত্ব নিয়েছেন ২০১৩ সালে। তিনি যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৩৩ বছর।

তার বাবা শেখ হামাদ বিন খলিফা আল থানি কাতারে জনগণের উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণের মাধ্যমে উত্তরাধিকারীর কাছে এই ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।

মধ্যপ্রাচ্য-ভিত্তিক লেখক মেশি কোয়েন মেশি কোয়েনের মতে, ছোট এই আমিরাতকে তিনি ইন্টারন্যাশনাল পাওয়ার হাউজ বানিয়েছেন। কাতারের রাজধানী দোহাকে অনেকে মধ্যপ্রাচ্যের জেনেভা হিসেবেও বর্ণনা করেন।

বর্তমান আমিরের ইতিহাস
শেখ তামিমের বড় ভাই জাসসিম বিন হামাদ বিন খলিফা আল থানি আমির হওয়ার ইচ্ছে ত্যাগ করেন। তিনি জানিয়ে দেন, তার আমির হওয়ার কোনো আগ্রহ নেই। এরপর শেখ থানিকে উত্তরাধিকার ঘোষণা করেন তার বাবা।

মিসরে তথাকথিত আরব বসন্ত শুরুর চার দিন আগে ক্ষমতা গ্রহণ করেন কাতারের বর্তমান আমির।

বর্তমান আমির শেখ তামিম ব্রিটেনের রয়্যাল মিলিটারি কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করে কাতারের সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন। ক্ষমতার উত্তরাধিকারী হিসেবে তাকে মনোনীত করা হয় ২০০৩ সালে।

তিনি সামরিক বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার অব চিফ ছিলেন এবং আরো কিছু সরকারি সংস্থায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে দেশটির সুপ্রিম অ্যাডুকেশন কাউন্সিল, সুপ্রিম কাউন্সিল অব হেলথ, সুপ্রিম কাউন্সিল অব এনভায়রনমেন্ট, ন্যাচারাল রিজার্ভস।

কাতারের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিকল্পনা ঠিক করার জন্য ২০০৮ সালে গঠন করা হয়েছিল কাতার ‘ন্যাশনাল ভিশন ২০৩০’। এই পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য যে সুপ্রিম কমিটি গঠন করা হয়েছিল সেটির নেতৃত্বে ছিলেন শেখ তামিম।

তার বাবার রেখে যাওয়া পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন বর্তমান আমির। যেহেতু তার বাবা আমির থাকার সময় সেসব ভিশন ঠিক করেছিলেন সেগুলোর সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন শেখ তামিম।

আমির হিসেব অধিষ্ঠিত হওয়ার এক বছর পরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন ইউনিভার্সিটিতে এক বক্তৃতায় তিনি নিজের পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেছিলেন। সেখানে তিনি বলেন, কাতার গ্যাস ও তেল বিক্রির নির্ভরশীলতা থেকে বের হয়ে আসতে চায়।

শেখ তামিম বলেন, ‘আমরা ধনী দেশে সেটা ঠিক। কিন্তু আমরা কিভাবে এ পর্যায়ে এসেছি সেদিকেও ফিরে তাকানো দরকার। ১৯৯০ দশকে আমার বাবা যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন তখন তেলের দাম ছিল ব্যারেল প্রতি মাত্র আট ডলার। রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের বেতন দেয়া কঠিন হতো তখন। একটা সময় আসবে যখন আমরা তেল ও গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল থাকতে পারব না। সেটা আমরা জানি। এটা হয়তো এতো দ্রুত হবে না। কবে হবে সেটা জানি না। এ জন্য আমরা নানা খাতে বিনিয়োগ করছি। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ হচ্ছে শিক্ষা খাতে।’

ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের তথ্য মতে, ২০২১ সালে কাতার শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করেছে প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলার। কাতারে যেসব খাত বেশ দ্রুত বিস্তার লাভ করছে তার মধ্যে শিক্ষা খাত অন্যতম।

কূটনীতিক সাফল্য
যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির বার্কলে সেন্টারের গবেষক ডেভিড বি রবার্টস লেখেন, বর্তমান আমিরের বাবা হামাদ বিন খলিফা আল থানি যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন তিনি চেয়েছিলেন কাতারকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব থেকে বাইরে নিয়ে আসতে। তিনি চাননি কাতার যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে পরিচালিত হোক।

কাতার শুধু ইসলামপন্থী গ্রুপগুলোকে আশ্রয় দেয়নি, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ঘাটি আছে কাতারে।

মধ্যপ্রাচ্যে একটি সক্রিয় এবং প্রভাবশালী দেশ হিসেবে কাতারের আবির্ভাব হয় ১৯৯৫ সাল থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে। বর্তমান আমিরের বাবা শেখ হামাদ বিন খলিফা আল-থানি তখন ক্ষমতায় ছিলেন।

লেবানন সঙ্কট
পর্যবেক্ষকদের মতে, কূটনীতির ক্ষেত্রে কাতার প্রথমে সাফল্য দেখিয়েছে লেবাননের সঙ্কট নিরসনের ক্ষেত্রে। কাতারের মধ্যস্থতায় লেবাননের বিবদমান পক্ষগুলো আলোচনার টেবিলে বসে বিরোধ মীমাংসা করতে রাজি হয়।

টার্কিশ জার্নাল অব মিডল ইস্টার্ন স্টাডিজে তুরস্কের বিশ্লেষক এসরা কেভুসোগ্লু লেখেন, কূটনীতিক ক্ষেত্রে কাতারের বড় সাফল্য আসে ২০০৮ সালে, যখন কাতারের মধ্যস্থতায় লেবাননে হিজবুল্লাহ এবং অন্যান্য গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে একটি সমঝোতা হয়।

এর ফলে লেবাননে স্থিতিশীলতা ফিরে আসে। এর আগে, আরব লিগ, জাতিসঙ্ঘ এবং ফ্রান্স মধ্যস্থতা করে ব্যর্থ হয়েছিল।

আফগানিস্তান সঙ্কট
আফগানিস্তানের তালেবান ২০১৩ সালে দোহায় তাদের কূটনীতিক অফিস খোলে। সেই অফিস চালুর ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের সম্মতি ছিল। এর ফলে বেশ দ্রুত তালেবান শীর্ষ নেতাদের দোহায় যাতায়াত বাড়ে।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিকরাও কাতারে আসতে থাকে। এর ফলে তালেবানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের মধ্যস্থতা করার সুযোগ পায়। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য সরিয়ে নেয়ার সময় আবারো কাতারের ভূমিকা সামনে আসে।

আফগানিস্তান থেকে যেসব মার্কিন এবং আফগান নাগরিক সরিয়ে নেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক আশ্রয় পেয়েছিল কাতারে। তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কাতারের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। বর্তমানে তালেবানের সাথে পাশ্চাত্যের যোগসূত্র হিসেবে কাজ করছে কাতার।

হামাসের সাথে বন্ধুত্ব
ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সংগঠন হামাসের শীর্ষ নেতারা প্রকাশ্যেই কাতারে অবস্থান করছেন। কাতারের সাথে হামাস নেতাদের সুসম্পর্কের কথা সবারই জানা। বিভিন্ন সময় ইসরাইলের সাথে হামাসকে আলোচনার টেবিলে আনার ক্ষেত্রে কাতার গুরুত্বপূর্ণ রেখেছে।

সর্বশেষ গাজায় ইসরাইলের ক্রমাগত হামলায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার প্রেক্ষাপটে ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করেছিল কাতার।

ইরান এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে পরোক্ষ যোগাযোগ হয় সেখানেও কাতারের ভূমিকা রয়েছে।

কাতারের ব্র্যান্ডিং তৈরি
বিশ্বে প্রভাব ও পরিচিতি বাড়ানোর জন্য কাতার দেশ হিসেবে তাদের ব্র্যান্ডিং তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিল নানা ক্ষেত্রে। কাতার তাদের ব্র্যান্ড তৈরির যে উদ্যোগ নিয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল আল-জাজিরা টিভি নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করা। এর মাধ্যমে কাতার আঞ্চলিক প্রভাব তৈরির পাশাপাশি বিশ্বে তাদের পরিচিতি বাড়িয়েছে।

তাছাড়া কাতার এয়ারওয়েজ এবং বিভিন্ন খেলাধুলার আয়োজন করাও ছিল কাতারের ব্র্যান্ডিং তৈরির পদক্ষেপ।

কাতার ব্র্যান্ডিংয়ের সবচেয়ে বড় আযোজন ছিল বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজন।

২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন ইউনিভার্সিটিতে এক বক্তব্যে কাতারের আমির শেখ তামিম বলেন, এই বিশ্বকাপের আয়োজন ছিল সব আরবদের জন্য, শুধু কাতারের জন্য নয়।
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement