ফ্রান্সে উগ্র ডানপন্থীদের হটিয়ে বামপন্থীদের জয়
- নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- ০৯ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
- প্রথম পর্বে উগ্র ডানপন্থীরা জিতেছিল
- ঝুলন্ত পার্লামেন্ট হতে যাচ্ছে
- স্বস্তিতে ফ্রান্সের ইউরোপীয় মিত্ররা
ফ্রান্সের পার্লামেন্ট নির্বাচনের দ্বিতীয় পর্বের ফলাফলে সবাইকে অবাক করে শীর্ষস্থান দখল করেছে বামপন্থী জোট নিউ পপুলার ফ্রন্ট (এনএফপি), তবে কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। এক সপ্তাহ আগে অনুষ্ঠিত প্রথম পর্বের ভোটে উগ্র ডানপন্থী ন্যাশনাল র্যালি (আরএন) ঐতিহাসিক জয় পেলেও এ পর্বে তারা তৃতীয় হওয়ায় কাক্সিক্ষত সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁর মধ্যপন্থী এনসেম্বল জোট দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। এ অবস্থায় ইউরোপের শক্তিশালী এ দেশটিতে হতে যাচ্ছে ঝুলন্ত পার্লামেন্ট।
রোববারের ভোটের রাতটি ফ্রান্সের সবার জন্য অপ্রত্যাশিত বার্তা নিয়ে আসে। পার্লামেন্ট নির্বাচনে যেমন ফলাফল আসবে বলে ধারণা করা হয়েছিল হয়েছে তার উল্টো। আনুষ্ঠানিক ফলাফলে উগ্র ডানপন্থীদের হতাশ করে জয় পায় বামপন্থীরা। কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় ঝুলন্ত পার্লামেন্ট পেতে যাচ্ছে ফ্রান্স। আর এই তিন জোটের একসাথে কাজ করার কোনো ঐতিহ্য নেই বলে জানিয়েছে বিবিসি।
এক মাস আগে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট নির্বাচনে ফ্রান্স থেকে উগ্র ডানপন্থীরা জয় পাওয়ার পর হতাশ মাক্রোঁ দেশে আগাম পার্লামেন্ট নির্বাচনের ডাক দেন। ইইউয়ের নির্বাচনে ডানপন্থীদের এই জোয়ারে মাক্রোঁর মধ্যপন্থী দল খারাপ ফল করায় তিনি জুনে পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে আগাম নির্বাচন ঘোষণা দেন। নির্বাচনের ফলাফল আসার পর তাৎক্ষণিকভাবে মাক্রোঁ কোনো মন্তব্য করেননি।
দুই পর্বে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের প্রথম পর্বে উগ্র ডানপন্থীরা জয়ী হওয়ার পর দ্বিতীয় পর্বে তাদের ঠেকাতে বামপন্থী ও মধ্যপন্থী দলগুলো একজোট হয়ে লড়াই করে। বহু নির্বাচনী আসনে মধ্যপন্থী ও বামপন্থী প্রার্থীরা তাদের মধ্যে এগিয়ে থাকা প্রার্থীর পক্ষে সমর্থন দিয়ে নির্বাচন থেকে সরে যান। ফ্রান্সের ভোটাররা মেরিন লা পেনের জাতীয়তাবাদী, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সম্প্রসারণ বিরোধী আরএনকে একটি বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দিয়েছে, অথচ নির্বাচনপূর্ব জরিপগুলোতে দলটি দ্বিতীয় পর্বে জয় পেতে পারে বলে আভাস দেয়া হয়েছিল।
নির্বাচনের এই ফল মধ্যপন্থী প্রেসিডেন্ট মাক্রোঁর জন্যও একটি ধাক্কা, কারণ তিনি আগাম এ নির্বাচনের ডাক দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পেলেন একটি ঝুলন্ত পার্লামেন্ট। এতে ইইউতে ফ্রান্সের ভূমিকা দুর্বল হয়ে ওঠার আশঙ্কা আছে। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ফ্রান্সের পার্লামেন্ট তিনটি বড় জোট- বামপন্থী, মধ্যপন্থী ও ডানপন্থীর মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এদের প্রত্যেকেরই পুরোপুরি পৃথক ধরনের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী রয়েছে এবং কোনো ক্ষেত্রেই একমত হওয়ার কোনো ঐতিহ্য নেই।
বামপন্থী জোটভুক্ত দলগুলোর মধ্যে কট্টর বাম, গ্রিনস ও সমাজতন্ত্রীরা আছে। তারা ভোটের আগে তাড়াহুড়া করে এ জোট গঠন করেছে। পার্লামেন্টের ৫৭৭ আসনের মধ্যে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ২৮৯ আসনে জয় দরকার, কিন্তু বামপন্থী জোট এর চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। পালার্মেন্ট নির্বাচনের বেশির ভাগ আসনের ফল ঘোষণা হয়ে গেলেও এখনো কিছু বাকি আছে। ফ্রান্সের স্থানীয় সময় সোমবার সকালের মধ্যেই সব ফল ঘোষণা হয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে জরিপ সংস্থাগুলো নির্বাচনের ফলের যে পূর্বাভাস তুলে ধরে তা সাধারণত সঠিক হয়। তাদের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, বামপন্থীরা ১৮৪ থেকে ১৯৮টি আসন, মাক্রোঁর মধ্যপন্থী জোট ১৬০ থেকে ১৬৯টি আসন এবং লা পেনের আরএন ও এর মিত্ররা ১৩৫ থেকে ১৪৩টি আসন পেতে পারে।
স্বস্তিতে ইউরোপীয় মিত্ররা : এ দিকে ফ্রান্সের পার্লামেন্ট নির্বাচনে দ্বিতীয় দফার ভোটে মারিন লো পেনের উগ্র ডানপন্থী দল ন্যাশনাল র্যালি (আরএন) জয় পেতে ব্যর্থ হয়েছে। এতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে ফ্রান্সের অনেক মিত্রদেশ। তারা মনে করছে, এর মধ্য দিয়ে সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতি অন্তত এড়ানো গেছে। ন্যাশনাল র্যালি গতকাল রোববার নির্বাচনে সর্বোচ্চ আসন পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি।
তেমনটা ঘটলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথম কোনো উগ্র ডানপন্থী দল ফ্রান্সে সরকার গঠনের সুযোগ পেত। তারা সরকার গঠন করলে দেশটির অর্থনৈতিক ও বৈদেশিক নীতিতে বড় পরিবর্তন আসত। নির্বাচনে কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ফলে একটি ঝুলন্ত পার্লামেন্ট পাচ্ছে ফ্রান্স। এ নিয়েও ফ্রান্সের মিত্রদের মধ্যে উদ্বেগ আছে। ইতোমধ্যে ফ্রান্সের বেশ কিছু মিত্রদেশ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। ফ্রান্সে উগ্র ডানপন্থীদের সরকার গঠনের আশঙ্কা আপাতত এড়ানো সম্ভব হওয়ায় তারা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে।
ইউক্রেনের মিত্রদের আশঙ্কা ছিল, ফ্রান্সে লো পেনের নেতৃত্বাধীন সরকার এলে তারা মস্কোর প্রতি নমনীয় হতে পারে। ২০২২ সালে ইউক্রেনে রুশ হামলা শুরুর পর থেকে ফ্রান্সসহ অন্যান্য পশ্চিমা মিত্রের সহায়তার ওপর নির্ভর করে আসছে কিয়েভ। লা পেন সরকার গঠন করলে এ সহায়তা কমিয়ে দিতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছিল। যদিও সম্প্রতি তার দল রাশিয়াকে ‘হুমকি’ বলে আখ্যা দেয়।
ইউরোপে উগ্র ডানপন্থীদের জনপ্রিয়তায় সাময়িক ভাটা পড়েছে, আপাতত সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে ন্যাশনাল র্যালির পরাজয়। এখন নতুন সরকার গঠনের কাজটি মোটেই সহজ হবে না। বরং জোট সরকার গঠন দেশটির রাজনৈতিকে অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। ডানপন্থীদের পরাজয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড টাস্ক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) বলেন, প্যারিসে উদ্দীপনা, মস্কোয় হতাশা, কিয়েভে স্বস্তি। ওয়ারশের (পোল্যান্ডের রাজধানী) খুশি হওয়ার জন্য যথেষ্ট।
জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎসের দল সোস্যাল ডেমোক্র্যাটসের বৈদেশিক নীতির মুখপাত্র নিলস স্কিমিড বলেন, ভয়াবহ খারাপ পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব হয়েছে। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে অস্পষ্টতার মধ্যেই কেন্দ্রীয় ভূমিকায় থাকলেও রাজনৈতিকভাবে প্রেসিডেন্টের অবস্থান এখন দুর্বল। এর জন্য সরকার গঠন করা কঠিন হয়ে পড়বে।
স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজের দল ফ্রান্সের বাম জোট নিউ পপুলার ফ্রন্টকে নির্বাচনে জেতায় অভিনন্দন জানিয়েছে। দলটির ভাষ্য, বাম জোট কট্টর ডানপন্থীদের সরকার গঠনের পথ রুখে দিয়েছে। গ্রিসের সোস্যালিস্ট পাসোক পার্টির প্রধান নিকোস এন্ড্রুলাকিস বলেন, ফ্রান্সের জনগণ কট্টর ডান, বর্ণবাদ ও সঙ্কীর্ণতার বিরুদ্ধে একটি দেয়াল তুলে দিয়েছে। ফ্রান্সের দীর্ঘদিনের মূলনীতি : স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের সুরক্ষা করেছে। লা পেনকে রুখে দেয়ায় কলম্বিয়ার বামপন্থী প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেট্রোও ফ্রান্সকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এমন অনেক যুদ্ধ আছে, যেগুলো খুব অল্প দিনের জন্যই স্থায়ী ছিল। কিন্তু এসব যুদ্ধে মানবজাতির ভাগ্য লেখা হয়েছে। ফ্রান্সও এমন একটি যুদ্ধের (ভোটের লড়াই) মধ্য দিয়ে গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) এক কর্মকর্তা একে বড় স্বস্তির বিষয় বলে উল্লেখ করেন। তবে ফ্রান্সের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ইউরোপের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলেও মনে করছেন তিনি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা