১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

যুদ্ধবিরতির সংশোধিত প্রস্তাবে আলোচনায় রাজি হামাস-ইসরাইল

-

যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবিত চুক্তির একটি সংশোধিত প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে হামাস-ইসরাইল। গতকাল শনিবার হামাসের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, চুক্তির একটি সংশোধিত প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে হামাস-ইসরাইল। সে হিসেবে চুক্তির প্রথম ধাপের পর ১৬ দিনের মধ্যে সৈন্য এবং অবশিষ্ট পুরুষসহ ইসরাইলি বন্দীদের মুক্তির জন্য আলোচনা শুরু হবে। খবর : রয়টার্স, বিবিসি, আলজাজিরা ও আরব নিউজ।
সূত্রটি আরো বলেছে, প্রস্তাবে বলা হয়েছে যে মধ্যস্থতাকারীরা একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি, ত্রাণ বিতরণ ও ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহারের নিশ্চয়তা দেবে। এই নিশ্চয়তা চুক্তির দ্বিতীয় ধাপ বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। সূত্রটি নাম প্রকাশ না করার শর্তে রয়টার্সকে বলেছে, তবে এ ক্ষেত্রে হামাস তাদের একটি দাবি থেকে সরে এসেছে। তাদের দাবি ছিল, ইসরাইল প্রথমে চুক্তিতে স্বাক্ষর করার আগে একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে।
হামাস ও একজন মিসরীয় কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) জানিয়েছে, এই চুক্তির মধ্যে একটি ‘সম্পূর্ণ’ ছয় সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি অন্তর্ভুক্ত থাকবে, যা কয়েক শ’ ফিলিস্তিনি বন্দীর বিনিময়ে নির্দিষ্টসংখ্যক ইসরাইলি বন্দীর মুক্তির বিষয় থাকবে। হামাস বলেছে, প্রথম ধাপে ছয় সপ্তাহের সমঝোতা চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই স্থায়ী যুদ্ধবিরতির আলোচনার সুযোগ দিতে হবে। আলোচনাটি গোপনীয় হওয়ার কারণে ওই সূত্র তার নাম প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়েছেন।

শান্তি প্রচেষ্টার সাথে সম্পৃক্ত এক ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা বলেছিলেন, প্রস্তাবটি ইসরাইল গ্রহণ করলে একটি কাঠামো চুক্তি হতে পারে। এতে গাজায় ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে নয় মাস ধরে চলা যুদ্ধের অবসান ঘটাতে পারে। ইসরাইলি আলোচনাকারী দলের একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছে, এখন চুক্তি অর্জনের সুযোগ রয়েছে। এটি গাজায় নয় মাসব্যাপী যুদ্ধের অতীত দৃষ্টান্তের বিপরীত। এর আগে ইসরাইল বলেছিল যে হামাসের দেয়া শর্তগুলো অগ্রহণযোগ্য।
আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় চলমান শান্তি প্রচেষ্টার সাথে সংশ্লিষ্ট এক ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা বলেছেন, প্রস্তাবটি যদি ইসরাইল মেনে নেয়, তবে এর মধ্য দিয়ে চুক্তির রূপরেখা তৈরি করা যেতে পারে। আর এতে গাজায় ইসরাইল ও হামাসের মধ্যকার ৯ মাসের যুদ্ধের অবসান হতে পারে। ইসরাইলের আলোচক দলের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখন সমঝোতায় পৌঁছানোর মতো সত্যিকারের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ইসরাইলের আগের অবস্থান বদলের ইঙ্গিত মিলেছে।
এর আগে হামাসের দাবিকে অগ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করেছিল তেলআবিব। শনিবার ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর এক মুখপাত্রের মন্তব্য জানার চেষ্টা করেছিল রয়টার্স। তবে তাৎক্ষণিক সাড়া পাওয়া যায়নি। গত শুক্রবার নেতানিয়াহুর কার্যালয় থেকে বলা হয়, আগামী সপ্তাহে আলোচনা চলবে এবং দু’পক্ষের মধ্যে এখনো যে মতবিরোধ রয়েছে, তার ওপর আলোচনা করা হবে।

হামাস সূত্র বলছে, দ্বিতীয় দফার চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে যত দিন পরোক্ষভাবে আলোচনা চলবে, তত দিন মধ্যস্থতাকারীরা একটি সাময়িক যুদ্ধবিরতি, ত্রাণ সরবরাহ অব্যাহত রাখা এবং ইসরাইলি সেনাদের প্রত্যাহারের নিশ্চয়তা দেবেন বলে প্রস্তাবে আশ্বস্ত করা হয়েছে। গত কয়েক দিনে গাজায় যুদ্ধবিরতি ও বন্দী মুক্তির প্রচেষ্টা জোরদার হতে দেখা গেছে। আঞ্চলিক একটি সূত্র বলেছে, নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে একটি চুক্তি নিশ্চিত করার জন্য মার্কিন প্রশাসন জোর চেষ্টা চালাচ্ছে।
মোসাদ প্রধানের কাতার সফর : এ দিকে কাতারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আবদুলরহমান আল-থানির সাথে ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রধান ডেভিড বার্নিয়ার এর আলোচনাকে ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতির সম্ভাব্য চুক্তির ক্ষেত্রে ‘বড় অগ্রগতি’ হিসেবে এটাকে দেখা হচ্ছে। বিবিসি লিখেছে, চুক্তির বিষয়ে ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যে মতপার্থক্য আছে তা নিরসনে জটিল আলোচনার প্রাথমিক পদক্ষেপ মনে করা হচ্ছে। গাজা যুদ্ধবিরতি নিয়ে কয়েক সপ্তাহ আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেন যে তিন দফা প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সেটি নিয়ে হামাস প্রতিক্রিয়া জানানোর পর চুক্তির জন্য সবশেষ আশার আলো হিসেবে দেখা হচ্ছে মোসাদ প্রধানের সফরকে।
হামাস দীর্ঘ দিন ধরে স্থায়ী যুদ্ধবিরতির দাবি জানিয়ে আসছে। তার পাল্টায় ইসরাইল বলছে, ‘প্রয়োজনে’ ফের গাজা যুদ্ধ হতে পারে- এমন স্বাধীনতা থাকতে হবে। ইসরাইলের এমন অবস্থানকেই চুক্তির জন্য প্রধান বাধা হিসেবে দীর্ঘ দিন ধরে মনে করা হচ্ছে। বিবিসি লিখেছে, সব মিলিয়ে বাধা কাটিয়ে স্থিতিশীলতার জন্য এবার আশার আলো দেখা যেতে পারে।

১০ ইসরাইলি সেনা নিহত : ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের সামরিক শাখা কাসেম ব্রিগেড জানিয়েছে, তাদের এক অভিযানে ইসরাইলের বহু সেনা হতাহত হয়েছে। ধারনা করা হচ্ছে এতে কমপক্ষে ১০ ইসরাইলি সেনা নিহত হয়েছে। পূর্ব গাজা শহরের পার্শ্ববর্তী আল-নাজাজ সড়কের কাছে ইসরাইলি সেনারা একটি ভবন দখল করলে সেখানে থার্মোবারিক (টিবিজি) রকেট দিয়ে হামলা চালান কাসেম ব্রিগেডের সদস্যরা।
টেলিগ্রামে দেয়া এক বিবৃতিতে কাসেম ব্রিগেড জানিয়েছে, তাদের যোদ্ধারা শুক্রবার ইসরাইলি সেনাদের দখল করা একটি ভবনে অভিযান চালায়। ওই ভবনে প্রবেশ করার আগেই দূর থেকে ভবনে থাকা সেনাদের হত্যা করা হয়েছে বলে আলজাজিরা খবর দিয়েছে। কাসেম ব্রিগেডের যোদ্ধারা অভিযান শেষে ভবনটি একটি বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ওই বিস্ফারণে হতাহত সেনাদের সরিয়ে নিতে হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়েছে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে। কাসেম ব্রিগেডের ওই অভিযানে অন্তত ১০ ইসরাইলি সেনা নিহত হয়েছে বলে আলজাজিরা জানিয়েছে।
নিষেধাজ্ঞার আহ্বান সৌদির : গাজা যুদ্ধে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ভঙ্গ করায় ইসরাইলি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেতাদের কাছে নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানিয়েছেন সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান। একই সাথে তিনি সতর্ক করে বলেন, গাজার এই হত্যাযজ্ঞ দক্ষিণ লেবাননসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্যের ওপর প্রভাব ফেলেছে। সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, গাজা পরিস্থিতি শুধু ফিলিস্তিনি ইস্যুর ওপর প্রভাব ফেলছে না, পুরো মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব ফেলছে এবং ক্রমেই তা চলমান সঙ্ঘাত বাড়িয়ে তুলছে, যার ফলাফল আমরা দেখছি দক্ষিণ লেবাননে।

সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, গাজায় ইসরাইলি হামলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নিশ্চুপ রয়েছে। ফলে পশ্চিমতীরে ফিলিস্তিনিদের শান্তি প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে। তিনি আরো বলেন, ফিলিস্তিনিদের অবশ্যই আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে এবং স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতির দাবিদার।
৫ সাংবাদিকসহ নিহত ৮৭ : গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গাজায় গত ২৪ ঘণ্টায় ২৯ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরাইল। তাদের মধ্যে অন্তত পাঁচজন সাংবাদিক রয়েছে। গতকাল শনিবার কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। নিহত সাংবাদিকরা হলেন, ফিলিস্তিন মিডিয়া এজেন্সির প্রতিনিধি আমজাদ জাহজাহ ও রিজক আবু আশকিয়ান। গাজার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি রেডিওর প্রতিনিধি ওয়াফা আবু দাবান। তারা তিনজন নুসিরাত শরণার্থী শিবিরে নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া ডিপ শট মিডিয়া প্রোডাকশনের প্রতিনিধি সাদি মাদুখ ও আহমাদ সুক্কার গাজা স্ট্রিপে নিহত হয়েছেন।
সূত্রটি আরো জানিয়েছে, গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে যে গত ৪৮ ঘণ্টায় ইসরাইলি হামলায় অন্তত ৮৭ জন নিহত হয়েছে। তাদের নিয়ে নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা ৩৮ হাজার ৯৮ জনে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া আরো ৮৭ হাজার ৭০৫ জন আহত হয়েছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement